প্রতিদিন আমরা আমাদের অভিরুচি অনুযায়ী বিভিন্ন রকমের অভিমত পোষণ করি, আমাদের পরিতৃপ্তির জন্যে অথবা ফলপ্রসূ কোনো নির্দিষ্ট কাজ বাস্তবায়নের জন্যে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। এই অভিজ্ঞতাগুলি আমাদের জীবন সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি এবং আমাদের ব্যক্তিত্বকে সংজ্ঞায়িত করতে সহায়তা করে। ফলাফলস্বরূপ আমাদের পরিতৃপ্তির জন্যে গৃহীত সিদ্ধান্ত নিতে একেকজনের সক্ষমতা একেকরকম হওয়ায় আমাদের মধ্যে বিভিন্ন স্নায়ুবিক মনোরোগ যেমন আসক্তি, বিষণ্ণতা প্রভৃতি দেখা দেয়।
তৃপ্তিদায়ক অভিজ্ঞতায় আমাদের মস্তিষ্কে যা হয়ঃ
পরিতৃপ্তি একটি সুখকর অনুভূতি যা আমরা খাবার-দাবার, যৌনক্রিয়া, মাদকদ্রব্য প্রভৃতির মাধ্যমে অনুভব করি। আমাদের মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশে এই অনুভূতিটি নিয়ন্ত্রিত হয় কয়েক রকমের নিউরোট্রান্সমিটারের (রাসায়নিক বার্তাবাহক) সাহায্যে।
আমাদের মস্তিষ্কের প্রতিক্রিয়ায় ডোপামিন নিঃসরণ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কোনো ফলপ্রসূ বা সুখকর অনুভূতি প্রত্যাশা, তা কতটুকু সুখকর হবে তা নিয়ন্ত্রণ এবং অনুভূতিটি লাভের জন্যে কামনা তৈরি সবকিছুই আমাদের মস্তিষ্কে নিয়ন্ত্রিত হয় ডোপামিন নিঃসরণের মাধ্যমে। আমাদের সেচ্ছাধীন চলাচল ও বোধশক্তির মত আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্যে ডোপামিন নিঃসরণ অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
সিজোফ্রেনিয়ার মত ব্যাধিতে অতিমাত্রায় ডোপামিন নিঃসরণ হয় যা বিভিন্ন মনোরোগের লক্ষণ প্রকাশ করে। পারকিনসন্স রোগের মত নিউরোডিজেনারেটিভ ক্যাটাগরির রোগে অকালে পেশিসঞ্চালন সমন্বয়ের ক্ষমতা কমে যাওয়ার পেছনে ডোপামিন কোষগুলো দায়ী। সকল মাদকদ্রব্যই ক্রিয়ার প্রাথমিক পর্যায়ে দৈহিক সিস্টেমে ডোপামিন নিঃসরণ করে। অন্যান্য তৃপ্তিকর অভিজ্ঞতা যেমন- যৌনক্রিয়া, খাবার-দাবার, জুয়া প্রভৃতির অনুভূতিও ডোপামিন নিঃসরণ বেড়ে যাওয়ার ফল। বিপরীতভাবে, বিষণ্ণতা, আনন্দ বা প্রেরণায় কমতি, প্রত্যাখ্যান প্রভৃতি ডোপামিন নিঃসরণ কমে যাওয়ার ফলে হয়।
আমাদের একেকজনের দৈহিক বা স্নায়ুবিক রসায়ন আলাদা হওয়ায় তৃপ্তিকর অনুভূতি আমরা একেকজন একেকরকমভাবে অনুভব করি। তাছাড়াও পূর্ববর্তী খারাপ অভিজ্ঞতার কারণে (যেমন কোনো খাবার খেয়ে পূর্বে অসুস্থ হয়ে থাকলে) কিংবা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পার্থক্যের কারণেও এই পছন্দের বা অনুভূতির ব্যাপারগুলো ভিন্ন হতে পারে। ঠিক এ কারণেই কারো কারো একটা নতুন হ্যান্ডব্যাগ কেনায় ডোপামিন নিঃসরণ বেড়ে যায় আবার কারো কোনো খেলায় বাজি ধরলে ডোপামিন নিঃসরণ বেড়ে যায়।
সিদ্ধান্ত গ্রহণের মহাঝামেলা:
আমরা যখন কোনো সিদ্ধান্ত নিই তখন কখনো কখনো তা অভ্যাসবশত আবার কখনো কখনো তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আমাদের অনেকেই দুপুরের খাবারে রোজ আইসক্রিম খেতে পছন্দ করবো কারণ এটি খেতে মজা এবং এতে প্রচুর চিনি রয়েছে যা আমাদের ডোপামিন নিঃসরণ বৃদ্ধি করে। কিন্তু আমরা এটিও জানি রোজ আইসক্রিম খেলে আমাদের ওজন বেড়ে যাবে, স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটবে এবং আমরা অস্বস্তি বোধ করবো। এসকল কারণ রোজ আইসক্রিম খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে আমাদের অনুৎসাহিত করবে।
আমাদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সিদ্ধান্তগুলো নির্ভর করে সিদ্ধান্ত থেকে প্রাপ্ত সম্ভাব্য ফলাফলের উপর এবং সবচেয়ে ভাল ফলাফল অর্জনের সক্ষমতার জন্যে যে কৌশল অবলম্বন করা দরকার সেই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে আমাদের প্ররোচিত করে। কিন্তু বারবার একই সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরও ফলাফল যদি একই থাকে তাহলে আমাদের সিদ্ধান্তটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত থেকে অভ্যাসবশত হওয়ার দিকে ধাবিত হয়। একই সিদ্ধান্ত সবসময় সবচেয়ে ভাল ফলাফল নাও দিতে পারে তাই সময়ের সাথে সাথে কোন ফলাফলটি তুলনামূলকভাবে ভাল সেটি আমরা বুঝে ফেলি। তাই তখন আমরা প্রকৃত ফলাফল না পেলেও অভ্যাসবশত সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করি। জুয়াখেলা একটি বাস্তব উদাহরণ কিভাবে এই প্রক্রিয়াটি সমস্যার তৈরি করে। ক্যাসিনোর জুয়া খেলার যন্ত্রটি আপনাকে মাঝে মাঝে ভাল ফলাফল দেয় যেন আপনি খেলা অব্যাহত রাখেন কিন্তু যন্ত্রটি এমনভাবেই প্রোগ্রাম করা থাকে যেন আপনি শেষ পর্যন্ত আপনার অর্থ হারান।
ভুল সিদ্ধান্তের বেড়াজালে আটকে পড়াঃ
এসব কারণে সিদ্ধান্ত গ্রহণের যে কোনো পর্যায় আমাদের অস্বাভাবিক আচরণের দিকে ঠেলে দিতে পারে। আসক্তি হচ্ছে কোনো অভিজ্ঞতা লাভের জন্যে (জুয়ায় জয়ী হওয়া, যৌনক্রিয়া, মাদকদ্রব্য প্রভৃতি) একজন ব্যক্তির সর্বদা সচেষ্ট থাকা। ব্যাপারটা এমন হয়ে দাঁড়ায় যে একজন ব্যক্তি একটা নির্দিষ্ট প্রতিক্রিয়া লাভের জন্যে ব্যাপারটি আগেরমত তৃপ্তিকর মনে না হলেও বারবার তা করতে থাকে।
কিভাবে আসক্তির তৈরি হয় এবং এটা চলতে থাকে তা সম্পর্কে আমরা এখনো খুব কম জানি কিন্তু জিনগত এবং পরিবেশগত কারণগুলো একজন ব্যক্তিকে মারাত্মক ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বেশি তৃপ্তিদায়ক নতুন কোনো মাদকদ্রব্য (দেহে ক্রিয়া করার প্রক্রিয়া বা ডোপামিন নিঃসরণ করার পরিমাণের উপর নির্ভরশীল) খুঁজে পেলে তা আরো অধিক মাদক গ্রহণে উৎসাহিত করে। ব্যাপারটি আসক্তিতে পরিণত হয় যদি আচরণগুলো অভ্যাসবশত আচরণে পরিণত হয় এবং খারাপ দিকগুলোর ব্যাপারে কম সংবেদনশীলতা প্রদর্শিত হয়।
কোনো তৃপ্তিকর অভিজ্ঞতা অনুভূত হওয়ার জন্যে ডোপামিন নিঃসরণ খুবই প্রয়োজনীয় এবং সেই অনুভূতিটী বারবার লাভের জন্যে প্ররোচিত ডোপামিন প্ররোচিত করে। তাই এই ডোপামিন নিঃসরণ থেকেই এবং বারবার অনুভূতি লাভের প্ররোচনা পরবর্তীতে আসক্তির সৃষ্টি করে।
ফলাফলস্বরূপ বারবার তৃপ্তিকর অনুভূতি লাভ, অভ্যাসগত আচরণে পরিণত হওয়ার দরুণ খারাপ দিকগুলোকে উপেক্ষা করে আসক্তিগুলো আমাদের মস্তিষ্কের সিদ্ধান্ত-গ্রহণের ক্ষমতার উপর প্রভাব বিস্তার করে। এমতাবস্থায় ফলাফলের কথা বিবেচনায় ডোপামিন নিঃসরণ থেকেও অবচেতন মন বেশি কাজ করে। ব্যক্তির আকুতি থাকে এমন “মাদকদ্রব্য গ্রহণ বন্ধ করতে হবে অথবা কাজটি আর করার যাবে না” কিন্তু এটি বাস্তবে কোনো কাজে দেয় না। তাই আসক্তি থেকে রেহাই পেতে বিভিন্ন ধরনের পন্থা অবলম্বন করা প্রয়োজন। এই অভ্যাসগত আচরণগুলোকে দুর্বল করার জন্যে দেহের স্নায়ুবিক রসায়নে সাম্য নিয়ে আসার উদ্দেশ্যে চিকিৎসা পদ্ধতি কিভাবে উন্নত করা যায় তা নিয়ে এখনো অনুসন্ধান চলছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতার উন্নয়ন এবং মস্তিষ্ককে এক্ষেত্রে সহযোগিতা করার জন্যে আচরণগত থেরাপি কিংবা সামাজিক সমর্থন অনিবার্যভাবে জরুরি।
[কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ James Kesby, Advance Queensland Research Fellow, University of Queensland উৎসঃ www.theconversation.com]
-আবরার আলী