বিপন্ন মৌমাছি ও আমাদের ভবিষ্যৎ

0
816

জীবনে একবারও মৌমাছির হুল ফোটেনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। গাছের মগডালে, জঙ্গলের আড়ালে অথবা শহুরে বাসায় ভেন্টিলেটরের ফোঁকরে মৌমাছির চাক থেকে হুল ফুটেছে অনেকেরই। ফুলে ফুলে উড়ে বেড়ানো মৌমাছির দৃশ্য মন ভালো করে দেয়ার মত আনন্দের। ছোট এই পতঙ্গটির কাছ থেকে আমরা যে শুধু মূল্যবান মধু পাই তা নয়, আমাদের খাদ্য নিরাপত্তায় এর ভূমিকা অপরিসীম।  বর্তমানে এই গুরুত্বপূর্ণ ছোট প্রাণিটির সংখ্যা বিভিন্ন কারণে কমে যাচ্ছে, যার ফলাফল ভয়াবহ। মৌমাছি কমে যাবার ফলে ভবিষ্যত পৃথিবী পড়তে পারে এক ভয়ানক খাদ্য সংকটে, হারিয়ে যেতে পারে অনেক উদ্ভিদ ও প্রাণীর প্রজাতি।

মৌমাছি আর্থ্রোপোডা পর্বের প্রাণি, পৃথিবীতে প্রায় বিশ হাজার প্রজাতির মৌমাছি আছে। বাংলাদেশে ১৮ প্রজাতির মৌমাছি আছে, যার মধ্যে ৪টি প্রজাতি মধু সংগ্রহ করে থাকে। আকার ও কাজের ভিত্তিতে মৌমাছিকে তিনটি সম্প্রদায়ে ভাগ করা যায়; রানী মৌমাছি, পুরুষ মৌমাছি ও কর্মী মৌমাছি। মৌমাছির আবাসস্থল হল মৌচাক, মৌচাকে খোপ বা প্রকোষ্ঠগুলো তৈরি করে দেয় কর্মী মৌমাছি, যাতে রানী মৌমাছি ডিম পাড়ে। দৈনিক প্রায় ২০০০টির মতো ডিম পাড়তে সক্ষম একটি রানী মৌমাছি। একটি খোপে একটিই ডিম পাড়া হয়, নিষিক্ত ডিমগুলো হয় কর্মী মৌমাছি আর অনিষিক্ত ডিমগুলো পরবর্তীতে পরিণত হয় পুরুষ মৌমাছিতে। ডিম থেকে লার্ভা হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর তিনদিন পর্যন্ত সব লার্ভাকেই রাজকীয় জেলি খাওয়ানো হয়। প্রথম তিনদিন সবাই রাজকীয় জেলি পেয়ে দ্রুত বেড়ে ওঠে।  তিনদিন পরে কেবল মাত্র যে লার্ভাটি রানী মৌমাছিতে পরিণত হবে, তার জন্য রাজকীয় জেলির ব্যবস্থা করা হয়। একটি মৌচাকে কেবল একটি রানী মৌমাছি থাকে। একাধিক রানী যদি মৌচাকে বড় হতে থাকে, তবে সবার আগে যেটি পূর্ণাঙ্গ হবে, সেটি অন্যগুলোকে মেরে ফেলে নিজে রানী হবার আশায়। কর্মী মৌমাছির প্রধান কাজ সব ধরনের বিপদ থেকে রানী মৌমাছিকে রক্ষা করা। পুরুষ মৌমাছি রানী মৌমাছির সাথে মিলিত হওয়ার পর মারা যায়।

 

কখনো কি ভেবে দেখেছেন মধু আর মোম দেয়া ছাড়া এই প্রাণিটির সাথে আমাদের অস্তিত্বও জড়িয়ে আছে? ছোট একটি পতঙ্গ হলেও আমাদের জীবনে মৌমাছির ভূমিকা অপরিসীম। বেঁচে থাকার জন্য মানুষের প্রয়োজনীয় খাবারের অধিকাংশের সাথেই আছে মৌমাছির ভূমিকা। মৌমাছি ফুলে ফুলে উড়ে উড়ে মধু খায়, এ সময় তার পায়ে আর বুকের পশমে করে বয়ে নিয়ে বেড়ায় অসংখ্য পরাগরেণু, যা পরাগায়নে সাহায্য করে। ফসল উৎপাদনে পরাগায়নের বিকল্প কিছু নেই। তাই মৌমাছি না থাকলে পৃথিবীতে অধিকাংশ ফল ও ফসলের উৎপাদনই বন্ধ হয়ে যাবে। প্রায় প্রতি ৩ গ্রাস খাবারের ১ গ্রাসে কোন না কোন ভাবে মৌমাছির সংস্পর্শ আছে। ফুল থেকে হয় এমন প্রায় ৮০ ভাগ ফসলের পরাগায়ন ঘটে মৌমাছির মাধ্যমে। প্রায় কয়েকশ বছর ধরে মৌমাছি পরাগায়নে সাহায্য করে আসছে, যার বিকল্প আর কোন কিছু নেই। বাদুর, পাখি, অন্যান্য পোকামাকড়, বাতাস ইত্যাদি পরাগায়নে সাহায্য করলেও মৌমাছি এক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করে। মৌমাছির সংখ্যা কমে যেতে থাকলে ফল, সবজি ও ফসলের উৎপাদন কমে যেতে থাকবে। ফলশ্রুতিতে, পৃথিবীতে দেখা দিবে খাদ্য সংকট। শুধুমাত্র মানুষের খাবারের জন্যই মৌমাছি প্রয়োজন তা নয়, আমাদের বাস্তুসংস্থানের স্বাভাবিকতা রক্ষার জন্যও মৌমাছি সমান গুরুত্বপূর্ণ। মৌমাছি যদি না থাকে তাহলে পৃথিবীর অসংখ্য উদ্ভিদের বংশবিস্তার ক্ষতিগ্রস্ত হবে।  বন, তৃণভূমিসহ অন্যান্য সকল জায়গার উদ্ভিদের ব্যপকতা কমে যাবে। উদ্ভিদের সাথে সাথে ক্ষতিগ্রস্ত হবে মাটি, পানি ও সমগ্র পরিবেশ। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, প্রকৃতিতে মৌমাছির অস্তিত্ব বিলীন হলে কি হবে তা ভাবার সময়টুকুই হয়তো আমরা পাবো না।

মহামূল্যবান এই প্রাণিটি আজ হুমকির মুখে। পৃথিবীব্যাপী ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে মৌমাছির সংখ্যা। ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ডের গবেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রে অক্টোবর ২০১৮ ও এপ্রিল ২০১৯ এর মাঝামাঝি সময়েই প্রায় ৪০ শতাংশ মৌমাছির কলোনী ধ্বংস হয় যা বিগত ১৩ বছরের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। একইভাবে, যুক্তরাজ্যের এক গবেষণায় দেখা যায়, ১৯৮০ থেকে ২০১৩ এর সময়কালে ৩৫৩ প্রজাতির বন্য মৌমাছির প্রায় এক তৃতীয়াংশ হারিয়ে গেছে, যা নেচার কমিউনিকেশন্স জার্নালে প্রকাশিত হয়। মৌমাছির পাশাপাশি অন্যান্য পোকামাকড়ের সংখ্যাও হ্রাস পাচ্ছে যা অসংখ্য পাখি, মাছ ও স্তন্যপায়ী প্রাণীর খাদ্য। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলসহ উত্তর পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তর পূর্বাঞ্চল এলাকা থেকে মুক্ত মৌমাছি ফুলের অভাবে মধু আহরণ করতে না পারায় চলে যাচ্ছে সুন্দরবনে। মৌমাছির প্রজনন বিঘ্নিত ও সংরক্ষণের অভাবে যে হারে উত্তরাঞ্চলসহ উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তর পূর্বাঞ্চল এলাকা থেকে মুক্ত মৌমাছি দক্ষিণ এলাকায় চলে যাচ্ছে, তাতে ভবিষ্যতে সুন্দরবন এলাকা ছাড়া দেশের অন্যসব অঞ্চলে মুক্ত মৌমাছি ও মৌচাকের দেখা পাওয়াটাই দুরূহ হয়ে পড়বে।

মৌমাছির সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার অনেকগুলো কারণের মধ্যে অন্যতম প্রধান কারণ কীটনাশকের ব্যবহার বৃদ্ধি। ক্রমবর্ধমান কৃষিকাজে ক্ষতিকর কীট পতঙ্গ দমনের জন্য ব্যপক হারে ব্যবহার করা হচ্ছে রাসায়নিক কীটনাশক, যার ফলে বন্ধুসম মৌমাছির ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে, পাতার উপরে কীটনাশক স্প্রে করা হচ্ছে, মৌমাছি মধুর সংগ্রহের জন্য সেই পাতার উপরে বসলেই মৌচাকে ফেরার আগেই তৎক্ষণাৎ মারা যাচ্ছে। এছাড়া বায়ু দূষণের ক্ষতিকর প্রভাবে কারণে মৌমাছির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। বায়ুতে অবস্থিত বিভিন্ন দূষিত গ্যাসের উপস্থিতির কারণে উদ্ভিদ থেকে আসা ঘ্রাণকে মৌমাছি সনাক্ত করতে পারে না, যার ফলে খাবার খুঁজে পেতে সমস্যা হয়। তাই খাবারের অভাবে এদের সংখ্যাও কমে যায়। পরিবেশের কথা আসলেই জলবায়ু পরিবর্তনের কথা চলে আসে। জলবায়ুর পরিবর্তনের অন্যান্য ক্ষতিকর দিকের পাশাপাশি, মৌমাছির বিস্তারেও এর ভূমিকা আছে। ফুল ফোটার ক্ষেত্রে ঋতুর অসামঞ্জস্যতা, তাপমাত্রা বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে মৌমাছি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার থেকে সৃষ্টি হওয়া রোগও মৌমাছির সংখ্যা কমে যাওয়ার উল্লেখযোগ্য কারণ। এছাড়া রয়েছে পরজীবির আক্রমণ, যেমন ভ্যারোয়া (Varroa) নামে এক ধরনের পরজীবি মৌমাছির শরীরে বংশবিস্তার করে এবং প্রয়োজনীয় স্নেহজাতীয় পদার্থ শোষণ করে, যার ফলে মৌমাছি দুর্বল হয়ে পড়ে ও মারা যায়। বনায়ন ধ্বংস, আবাসস্থল ধ্বংস, অপরিকল্পিত কৃষিকাজ ইত্যাদি কারণে দিন দিন অতি প্রয়োজনীয় মৌমাছির সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে।

প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা মৌমাছি ছাড়াও, মধু ও মোমের অর্থনৈতিক গুরুত্বের কারণে মৌমাছি চাষ করা হয়। মৌমাছি পালনের মাধ্যমে মৌমাছি ঘাটতি কিছুটা পূরণ করা সম্ভব। মৌমাছি সহায়ক বৃক্ষরোপণ, বনায়ন, কীটনাশকের ব্যবহার হ্রাস ইত্যাদি প্রয়োজনীয় উদ্যোগ খুব দ্রুত নিতে হবে। তা না হলে এই ক্ষুদে পতঙ্গটির অস্তিত্বের সাথে সাথে মানুষের অস্তিত্বেরও সংকট অবধারিত। ভবিষ্যতের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মৌমাছির সংখ্যা বৃদ্ধি ও সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে।

-ফৌজিয়া আহমেদ
প্রভাষক, পরিবেশ বিজ্ঞান
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.