চাঁদে মানুষ যদি চার যুগ আগে গিয়ে থাকে তাহলে এখন যেতে পারছে না কেন?

0
1865

মানুষের চন্দ্রাভিযান নিয়ে যাঁরা সন্দেহপোষণ করেন তাঁদের মনে এধরনের একটি প্রশ্ন রয়েছে। প্রথমত, এটি একটি অত্যন্ত খোঁড়া প্রশ্ন। এই প্রশ্ন অনুযায়ী বলা যায় ছোট বেলায় আমি যদি একবার কক্সবাজার বেড়াতে গিয়ে থাকি এবং বড় হয়ে যদি আর না যাওয়া হয় তা থেকে প্রমাণ হয় আমি কখনো কক্সবাজারই যাই নি!

চাঁদে মনুষ্যবাহী অভিযান কতটা খরচ সাপেক্ষ তা অনুধাবণ করলে কেউ সম্ভবতঃ ‘কেন এখন আর মানুষ চাঁদে যায় না’ সেই প্রশ্ন করত না। চন্দ্রাভিযান উপলক্ষে কাজ করার জন্য নাসা চার লাখ মানুষ নিয়োগ দিয়েছিলো। চাঁদের বুকে মানুষ ছয়বার অবতরণ করেছে এবং ১২ জন নভোচারী চাঁদের বুকে হেঁটেছেন (এ্যাপোলো-১১ হতে এ্যাপোলো-১৭, যার মধ্যে এ্যাপোলো-১৩ ব্যর্থ হয়)। তবে এই অভিযানগুলোর আগে মানুষ চাঁদে নামার প্রস্তুতি ও পরীক্ষামূলক আরো অনেকগুলো অভিযান করেছে। এর মধ্যে এ্যাপোলো-৮ এবং এ্যাপোলো-১০ মিশনের মাধ্যমে দুইবার চাঁদের কাছে গিয়ে প্রদক্ষিণ করে ফিরে এসেছে। চাঁদে অভিযান যেই প্রোজেক্টের (এ্যাপোলো প্রোজেক্ট) আওতায় করা হয়েছিলো তা এখন আর বিদ্যমান নেই। এমনকি অ্যাপোলো প্রজেক্টের আওতায় আরো তিনটি অভিযান (অ্যাপোলো-১৮-২০) চালানোর কথা ছিলো কিন্তু বড় ধরনের প্রয়োজন ছিলনা বিধায় সেগুলো বাতিল করে দিয়ে সেই ফান্ড এবং সেই কাজে নিয়োজিত রকেট অন্য কাজে ব্যবহার করা হয়। মনুষ্যবাহী ছয়টি অভিযানে চাঁদে যেসব গবেষণা করার প্রয়োজন ছিলো, যা করার জন্য মানুষ প্রয়োজন সেগুলো করা হয়েছে এবং চাঁদের শিলার যথেষ্ট পরিমান নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে, সেই শিলার নমুনা নিয়ে এখনো গবেষণা চলছে। এখন নতুন করে চাঁদে যেতে হলে পুরো প্রক্রিয়াটি আবার প্রথম থেকে শুরু করতে হবে, সরকারকে রাজি করাতে হবে অর্থায়নের জন্য আর সত্যি বলতে এখন চাঁদে মানুষ পাঠানো খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। প্রথম যখন চাঁদে যাওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয় তখন রাশিয়ার সাথে স্পেস নিয়ে প্রতিযোগীতা ছিলো, সরকারও তাই দু’হাতে টাকা দিতে কার্পণ্য করেনি, এখন এমন কিছুও নেই। চাঁদে অভিযান যতটা না ছিল বৈজ্ঞানিক, তার চেয়ে বেশী রাজনৈতিক। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, ১৯৬০ হতে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত নাসার মোট বাজেট ছিল ৫৬.৬ বিলিয়ন ডলার যার মধ্যে কেবল এ্যাপোলো প্রোজেক্টেরই বাজেট ১৯.৪ বিলিয়ন ডলার যা নাসার এতগুলো বছরের মোট বাজেটের একতৃতীয়াংশের বেশি। বর্তমান সময়ের হিসেবে যদি আমরা তুলনা করি তাহলে এই বাজেটে এক ডজনের বেশী পদ্মা সেতু নির্মান করা যায়!

যারা মনে করেন বিগত চার যুগে প্রযুক্তিগতভাবে মানুষ অনেক অগ্রসর হয়েছে এখন মানুষ্যবাহী চন্দ্রাভিযান আরো সহজ হওয়ার কথা, তাই এখন চাঁদে মানুষ না পাঠানোর কোনো যুক্তি নেই। কিন্তু প্রযুক্তিগত অগ্রসরতার ফলাফল হওয়ার কথা আসলে সম্পূর্ণ বিপরীত। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ বরং মানুষের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস করে। একসময় যে কাজের জন্য মানুষ পাঠানোর প্রয়োজন হতো এখন সেকাজের জন্য মানুষ না হলেও চলে। মানুষ যতই প্রযুক্তিগত সক্ষমতা লাভ করছে ততোই সে ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলোকে মানুষের বদলে রোবটের মাধ্যমে করার চিন্তাভাবনা করছে। দুর্গত এলাকায় কীভাবে রোবটের মাধ্যমে উদ্ধার তৎপরতা চালানো যায় তা নিয়ে ভাবছে। ধারনা করা হয় ভবিষ্যতে মানুষ সরাসরি যুদ্ধ করবে না, বরং যুদ্ধের জন্য রোবট পাঠাবে। এ্যাপোলো প্রজেক্টে চাঁদে মানুষ পাঠানোর পূর্বপ্রস্তুতির সময় একটি দূর্ঘটনায় উৎক্ষেপণ মঞ্চে তিনজন নভোচারী নিহত হয়েছিলেন। মনুষ্যবাহী যেকোনো অভিযানে নিরাপত্তার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয় আর সেটি করতে গিয়ে খরচ বেড়ে যায় কয়েকগুণ। মহাশূন্য অভিযানে সবসময়ই ঝুঁকি থেকে যায়।

কাজেই যদি বিশেষ প্রয়োজনীয়তা না থাকে তাহলে বর্তমান সময়ে চাঁদে মানুষ পাঠানো হবে সময়, অর্থ, শক্তি এবং সক্ষমতার অপচয়। যেই সক্ষমতা মানুষ ইতিমধ্যে প্রমাণ করেছে সেটি কিছু ষড়যন্ত্রকারীর কাছে নতুন করে প্রমাণ করার খুব বেশী প্রয়োজন নেই বরং যা প্রয়োজন তা হচ্ছে এই সক্ষমতা বৃদ্ধি করে আরো দুর্লভ কিছু অর্জনের চেষ্টা করা। মহাকাশ গবেষনা এজেন্সীগুলো সেই কাজই করে যাচ্ছে। তারা আগামী কয়েকবছরের মধ্যে মঙ্গলে মানুষ পাঠানোর চিন্তা-ভাবনা করছে এবং এই লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে।

অবশ্য সম্প্রতি নাসার বাইরে একাধিক মহাকাশ সংস্থা যেমন: ইসরো (Indian Space Research Organisation) এবং স্পেসএক্স চাঁদে মানুষ অবতরণের পরিকল্পনা নিয়েছে। ইসরো নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধির এবং স্পেসএক্স মঙ্গলে মানুষ পাঠানোর পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে চন্দ্রাভিযানের পরিকল্পনা করছে।

চাঁদে মানুষ গমনের বিষয় নিয়ে যেসব ষড়যন্ত্রতত্ত্ব বিদ্যমান তার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়গুলো নিয়ে ইউটিউবে একটি ভিডিও প্রকাশ করা হয়েছে। আগ্রহীরা দেখে নিতে পারেন।

-ইমতিয়াজ আহমেদ,
সম্পাদক, বিজ্ঞান পত্রিকা

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.