আমাদের শরীরে বিপুল পরিমান ব্যাকটেরিয়া সহ অন্যান্য অনুজীবের বাস তা আমরা সবাই জানি। অনেকে এও শুনেছেন হয়তো, আমাদের শরীরে যে পরিমান মানব কোষ রয়েছে ব্যাক্টেরিয়া রয়েছে তার দশগুণ। বছর তিনেক আগে বিজ্ঞান পত্রিকাতেই এই তথ্যটি দিয়ে পোস্ট দেওয়া হয়েছিলো।
এই তথ্য এতোই সুপ্রতিষ্ঠিত যে, বৈজ্ঞানিক গবেষণা পত্র, বৈজ্ঞানিক পত্র-পত্রিকায়, জনপ্রিয় বিজ্ঞান বইতে এই তথ্যের বহুল ব্যবহার রয়েছে। এর মাধ্যমে বোঝানোর চেষ্টা করা হয় মানুষের স্বাভাবিক জীবন-যাপনে ব্যক্টেরিয়া জাতীয় অনুজীব কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে এটি সত্য নয়!
২০১৬ সালে প্রকাশিত একটি রিভিউ গবেষণাপত্রে চার দশকের বিভিন্ন গবেষণা পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায় এই তথ্যের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তিই নেই। বরং ব্যক্টেরিয়া এবং মানব কোষের এই অনুপাত লক্ষ্য করা যায় ১.৩: ১ থেকে ১ : ১ পর্যন্ত। ১০ : ১ অনুপাতের তথ্যটি আগাগোড়া ভুল। এখান থেকে পাওয়া যায় কমবেশী প্রতিটি মানুষের শরীর প্রায় ১০০ ট্রিলিয়ন অনুজীবকে আশ্রয় দেয়। তবে এটিও শেষ কথা নয়।
অনুজীবের প্রকৃত সংখ্যা খুঁজে বের করার জন্য উইজম্যান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সের গবেষক রন মাইলো’র নেতৃত্ত্বে একদল জীববিজ্ঞানী মানবশরীরের অনুজীব নিয়ে প্রকাশিত চার দশকের যাবতীয় গবেষণা ঘেঁটে দেখেন। তাঁরা দেখতে পান ২০ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে বয়সের মোটামুটি ৭০ কেজি ওজনের এবং ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি উচ্চতার একজন মানুষের নিজস্ব ৩০ ট্রিলিয়ন কোষের বিপরীতে ৩৯ ট্রিলিয়ন ব্যাক্টেরিয়ার কোষ রয়েছে। এতে ব্যক্টেরিয়া এবং মানব কোষের অনুপাত দাঁড়ায় ১.৩:১। এটি নির্দেশ করে মানব কোষ এবং অনুজীবের সংখ্যা প্রায় সমান সমান।
তাহলে ইতিপূর্বে যে ১০:১ এর ধারনা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো তা এলো কেমন করে?
মানব কোষের দশগুণ ব্যক্টেরিয়া কোষের ধারনা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো ১৯৭০ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণা পত্রের উপর ভিত্তি করে। থমাস ডি. লাকি নামের একজন অনুজীববিদ হিসেব করে বলেছিলেন মানুষের একগ্রাম অন্ত্রীয় তরল বা মলের মধ্যে ১০০ বিলিয়ন অনুজীব রয়েছে। যেহেতু প্রতিটি মানুষের দেহে প্রায় এক কেজি পরিমানে এই বস্তু থাকে তাহলে মানুষের নিজস্ব কোষ ১০ ট্রিলিয়নের সাথে তুলনা করলে মোট অনুজীবের অনুপাত দাঁড়ায় ১০:১। গবেষণাপত্রটি প্রকাশের পরপরই সবাই এই তথ্য লুফে নেয় এবং প্রচার করতে শুরু করে। তবে কেবল ২০১৪ সাল নাগাদ এসেই একজন এই তথ্যের সত্যতা অনুসন্ধানে তৎপর হন।
জুডাহ এল রসনার নামের একজন অনুজীববিদ মাইক্রোব ম্যাগাজিনে একটি চিঠি লিখে জানান সাম্প্রতিকতম অনুসন্ধান অনুযায়ী মানুষের শরীরের নিজস্ব কোষের সংখ্যা আদৌ ১০ ট্রিলিয়নের কাছাকাছিও নয়। প্রকৃতপক্ষে মানুষের মোট কোষের সংখ্যা হিসেব করে বের করা মোটামুটি সাধ্যাতীত। তবে আধুনিক নানাবিধ পদ্ধতিতে ধারনা করে বলা যায় মোটামুটি ৭০ কেজি ওজনের এবং ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি উচ্চতার একজন মানুষের নিজস্ব কোষ রয়েছে গড়ে ৩০ ট্রিলিয়ন।
তাছাড়া অন্ত্রের যে অনুজীবের সংখ্যার হিসেব লাকি তাঁর ১৯৭০ সালের গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেছিলেন তা নিয়েও মাইলো আপত্তি তোলেন। তাঁরা বলেন, অন্ত্রের একগ্রাম পরিমান মল কখনো সম্পূর্ণ মানব শরীরের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না এবং সবকিছু বিবেচনা করে সমগ্র মানব শরীরে একটি অনুমিত অনুজীবের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৯ ট্রিলিয়ন। সেই হিসেবে অনুজীব এবং মানবকোষের অনুপাত দাঁড়ায় ১.৩:১ এ।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এমনকি ১.৩:১ এর অনুপাতটিও এখনো বিভিন্ন বিজ্ঞানের বই কিংবা গবেষণা পত্রে উল্লেখ না করাই শ্রেয়। কারণ নতুন এই গবেষণাও সম্পূর্ণ ভুল-ত্রুটি মুক্ত এমন নাও হতে পারে। এবং এটি প্রতিষ্ঠিত করতেও নানাবিধ অনুমানের আশ্রয় নিতে হয়েছে। বরং তাঁরা বলেন আপাতত সংখ্যার উল্লেখ না করে মানবদেহে অনুজীবের জগতের গুরুত্ব তুলে ধরাই যথাযথ হবে। [Science Alert অবলম্বনে]