বর্তমান যুগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আমাদের জীবনে গভীর প্রভাব বিস্তার করে রেখেছে। মুহূর্তের মধ্যেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে আমরা আমাদের জীবনের নানান ঘটনা, গল্প, ছবি, অভিজ্ঞতা ইত্যাদি বন্ধু ও আপনজনের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারি। কিন্তু উদ্ভিদেরও কি কোন সামাজিক জীবন থাকতে পারে? তারাও কি একে অপরের সাথে যোগাযোগ করে তথ্য আদান প্রদান করতে পারে?
উদ্ভিদের যোগাযোগের বহুল পরিচিত একটি মাধ্যম হচ্ছে রাসায়নিক। ধরা যাক, গাছের কোন এক শাখায় যদি কোন ক্ষতিকর কীট আক্রমণ করে বসে, তবে সেই শাখার মাধ্যমে উদ্ভিদ কিছু উদ্বায়ী রাসায়নিক পদার্থ নিঃসরণ করে যা অন্য উদ্ভিদের জন্য সতর্কবার্তারূপে ব্যবহৃত হয় এবং অন্য উদ্ভিদগুলো এর মাধ্যমে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আরও দৃঢ় করে তোলে। তবে আক্রান্ত উদ্ভিদ এই রাসায়নিক দ্রব্য নিঃসরণ করে সেই একই উদ্ভিদের অন্য শাখা প্রশাখার জন্য।
তবে সম্প্রতি গবেষণায় এটা উন্মোচিত হয়েছে যে উদ্ভিদের পারস্পারিক যোগাযোগে ছত্রাক একটি অনন্য ভূমিকা পালন করে থাকে। ছত্রাক খাদ্য তৈরি করতে পারে না এবং উদ্ভিদ বা প্রানী দেহে পরজীবী হিসেবে বাস করে। বহুকাল ধরে ছত্রাকসমূহ কে উদ্ভিদের জন্য ক্ষতিকর মনে করা হয়। তবে কিছু ছত্রাক বিভিন্ন গাছপালার সাথে একটি মিথোজীবী সম্পর্কে আবদ্ধ যেখানে তারা সালোকসংশেষণের মাধ্যমে তৈরি শর্করা জাতীয় উপাদান উদ্ভিদ দেহ থেকে আহরণ করে এবং বিনিময়ে নাইট্রোজেন, ফসফরাস জাতীয় উপাদান বিভিন্ন এনজাইমের মাধ্যমে উদ্ভিদ দেহে সরবরাহ করে থাকে। শুধু তাই নয়, তারা বিভিন্ন উদ্ভিদের মাঝে যোগাযোগেও সাহায্য করে।
অধিকাংশ ছত্রাক বহুকোষী এবং এদের দেহ সূত্রাকার, শাখান্বিত এবং আনুবীক্ষণিক। ছত্রাকের এই সূত্রাকার শাখা প্রশাখা (হাইফি) মাটি ভেদ করে বিভিন্ন গাছের মূল বা মূলরোমের চারদিকে বা অভ্যন্তরে জালের মতো বেষ্টন করে রাখে। ছত্রাক ও মূলের এই ধরনের এসোসিয়েশনকে মাইকোরাইজা (mycorrhiza; greek; mycos – fungi; riza – root) বলে। এইভাবে মাটির নিচে হাইফি নেটওয়ার্ক দ্বারা গাছগুলো একে অপরের সাথে যুক্ত থাকে যেটাকে বিজ্ঞানীরা Wood-Wide Web বলে অভিহিত করেন।
এই আশ্চর্য নেটওয়ার্কের মাধ্যমে গাছপালা একে অপরের মধ্যে শর্করা, নাইট্রোজেন, ফসফরাস ইত্যাদি উপাদান দেওয়া নেওয়া করে। কোন মৃতপ্রায় গাছ তার সকল উপাদান এই নেটওয়ার্কে প্রদান করতে পারে যেন সেই পরিপোষক পদার্থ তার প্রতিবেশি গাছ ব্যবহার করতে পারে। একই ভাবে নতুন বীজ তার পারিপার্শ্বিক উদ্ভিদগুলো থেকে বেড়ে ওঠার জন্য সহায়তা পেয়ে থাকে। শুধু তাই নয়, ক্ষতিকর কীটপতঙ্গের আক্রমণের ফলে তারা এই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ নিঃসরণ করে অন্য উদ্ভিদকে সতর্ক করে দেয়। এভাবে তারা অন্যান্য জীবের মত ‘সারভাইভাল অব ফিটেস্ট’ পদ্ধতি না অনুসরণ করে সবাইকে বেড়ে ওঠার সুযোগ করে দেয়। তবে এই নেটওয়ার্কের কিছু ক্ষতিকর দিকও আছে। উদাহরণস্বরূপ, অরকিডের কিছু প্রজাতি এই নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে অন্যান্য গাছপালা থেকে উপাদান জোরপূর্বক শুষে নিতে পারে। আবার ব্ল্যাক ওয়ালনাট সিস্টেমে বিষাক্ত উপাদান ছেড়ে দিয়ে অন্যান্য উদ্ভিদকে প্রতিঘাত করার চেষ্টা করে। এইভাবে বিবেচনা করলে বনজঙ্গলকে অনেক গুলো প্রজাতির সমষ্টি নাকি একক কোন মহা জীব হিসেবে গণ্য করা উচিত অথবা উদ্ভিদের মধ্যেও কি দেওয়া নেওয়া বা বন্ধুত্বের মত অনুভূতি থাকতে পারে কি না এই ধরনের বেশ কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে Wood-Wide Web। [ হেডারের ছবি: theconversation.com হতে সংগৃহীত ]
–নিতেশ কুমার কসেরা