কোয়ান্টাম ফিজিক্স-৩১ : অনিশ্চয়তাই কোয়ান্টামের নিশ্চয়তা

0
358

[বইটির সূচীপত্র এবং সবগুলো খন্ডের লিংক একত্রে দেখুন এখানে]

কোয়ান্টাম বলবিদ্যা প্রতিষ্ঠিতি হলো, কিন্তু একটা বিতর্ক থামল না। ইলেকট্রন কণা না তরঙ্গ। হাইজেনবার্গ ইলেকট্রনকে কণা ধরেই ম্যাট্রিক্স বলবিদ্যার জন্ম দিয়েছিলেন। অন্য দিকে শ্রোডিংগারের বলবিদ্যা গড়ে উঠছে ইলেকট্রনকে কণা ধরেই। তাই স্বাভাবিকভািবেই প্রশ্ন উঠল ইলেকট্রন আসলে কী? কণা না তরঙ্গ? অনেক বিজ্ঞানীই ইলেকট্রনকে তরঙ্গ হিসাবে মানতে নারাজ। তাছাড়া আরেকটা প্রশ্নও বড় হয়ে দেখা দিল। কার কথা ঠিক- হাইজেনবার্গ নাকি শ্রোডিংগারের?

এই বিতর্কে জল ঢেলে দিলেন শ্রোডিংগার নিজেই। বললেন, গণিতের হিসাব-নিকাশের পদ্ধতি এক না হতে পারে কিন্তু দুজনের সার-বক্তব্য একই। একটা তত্ত্ব আরেকটা তত্ত্বকে কখোনই বাতিল করে না। ইলেকট্রন একই সাথে কণা ও তরঙ্গ। যে কথা বলেছিলেন দ্য ব্রগলি আগেই। শুধু ইলেকট্রন নয়, সকল বস্তু একই সাথে কণা ও তরঙ্গ। তারপরেও ইলেকট্রনের এই দ্বৈত চরিত্র মানতে পারলেন না কিছু বিজ্ঞানী। এদের তালিকায় আছেন ক্লিনটন ডেভিসন। সেই ডেভিসন, যিনি ইলেকট্রনের ব্যাতিচার পরীক্ষা করে কণাটির তরঙ্গ চরিত্রের প্রমাণ দিয়েছিলেন, তিনিই কিনা এর তরঙ্গ চরিত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করে একটা প্রবন্ধ লিখেলেন। এসময় একটা রসিকাতা বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে বিজ্ঞানীদের মধ্যে। শোম, বুধ আর শুক্রবারে ইলেকট্রন হবে কণা; শনি, মঙ্গল আর বৃস্পতিবারে ইলেকট্রন হলো তরঙ্গ। আর রোববার তার ছুটি। এই সঙ্কট দূর করতে আবার এগিয়ে এলেন ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ। দিলেন তাঁর যুগান্তকারী অনিশ্চয়তা তত্ত্ব।

দুই

হাইজেনবার্গ বললেন, কোয়ান্টাম কণিকারা আসলে একই সাথে কণা ও তরঙ্গ বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে চলে। তবে তাদের দুটো চরিত্রই একই সাথে অনুধাবন বা পরিমাপ করা যাবে না। আলাদা আলাদাভাবে দুটো চরিত্রই বের করা সম্ভব। পদার্থবিদ্যায় আসলে সূক্ষ্মমাপের কদর বেশি। যদিও কার্নোর ফর্মুলা বলে কোনো যন্ত্রই শতভাগ কর্মদক্ষতা অর্জন করতে পারে না। কার্নো বলেছিলেন, তাপীয় ইঞ্জিনের এই বৈশিষ্ট্যের কথা। তবে সব যন্ত্রের ক্ষেত্রেই এই কথাটা সত্যি।

চিরায়ত বলিবিদ্যায় ছোট ছোট ত্রুটিকে এড়িয়ে হিসাব বের করা যায় সহজেই। ধরা যাক, আপনি একটা বিশাল পাথর খন্ডের ভর মাপতে চান। কী করবেন? টনের হিসাব করবেন। কত টন তার ভর সেটাই আপনার কাছে বড় বিষয়। একটু সূক্ষ্মভাবে হিসাব কষতে চাইলে হয়তো কেজি বা গ্রামের হিসাব কষবেন। হয়তো সেটার ভর দাঁড়াবে ২০ টন ২ কিলোগ্রাম ৩৫০ গ্রাম। এরচেয়ে ক্ষুদ্র হিসাব করার চিন্তাও হয়তো করবেন না। তাই আপনার ভর মাপার যন্ত্রটি শতভাগ শুদ্ধ হিসাবটা যে দেয়নি সেকথা আপনার ভাবনাতেই আসেনি। ধরা যাক, যন্ত্রটির যান্ত্রিক ত্রুটি ছিল ২০ মাইক্রো গ্রাম। ২০ টনের একটা বস্তুর ভর মাপতে গিয়ে ২০ মাইক্রোগ্রামের হিসাব নিয়ে কে মাথা ঘামায় বলুন। এইটুকু ত্রুটি গণনায় না ধরলেও আপনার হিসাব মিলে যায়।

বস্তু খুব ক্ষুদ্র হলে তখন আর ক্ষুদ্র ত্রুটিকেও অবহেলা করার জো থাকে না। ধরা যাক, এবার খুব ক্ষুদ্র একটা বস্তু নিলেন। সেটা হতে পারে একটা চিনির দানা। সেটার রাসায়ানিক বিশ্লেষণ করতে চান। এজন্য ওটার ভর জানা জরুরি। কিন্তু তখন তো মাইক্রো গ্রাম ভরকে অবহেলা করলে চলবে না। নিতে হবে আরো সূক্ষ্ম মাপ। তবে মাপ যত সূক্ষ্মই হোক শেষ পর্যন্ত কিছুটা ত্রুটি রয়েই যাবে। এই ত্রুটি পাথরের ভর মাপার যন্ত্রের ত্রুটির মতো অত বড় নয়। তবুও ত্রুটি। তবে সেই ত্রুটিটাকে আপনি বাদ দিয়েই হিসাবটা কষে ফেলতে পারেন। তেমন কোনো সমস্যা এখানেও দেখা দেবে না।
পারমাণবিক কণাদের ভর, আকার অত্যন্ত ক্ষুদ্র। তাদের ক্ষেত্রে অতি সামান্য ত্রুটিও তাই হিসাবে গোলমাল পাকিয়ে বসবে। ইলেকট্রনের মতো হালকা কণিকার ক্ষেত্রে ত্রুটি থাকলে সমস্যা আরো প্রকাট হয়ে ওঠে। তাহলে উপায়? সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মাপ নিতে হবে। একচুল এদিক ওদিক হলে চলবে না। কিন্তু যান্ত্রিক ত্রুটি যে ঝামেলা বাঁধাবে। হুম, যন্ত্রিক ত্রুটিকে মেনে নিয়েই হিসাব কষতে হবে। কীভাবে? অনিরশ্চয়তার সূত্র দিয়ে।

চিরায়ত বলবিদ্যায় বস্তুর পরিমাপের ছোটখাটো বিচ্যূতিকে আমরা সহজেই অবহেলা করতে পারি। তাই একই সাথে একাধিক হিসাব একটা গাণিতিক সমীকরণের সাথে পরিমাপ করতে পারি। কিন্তু ইলেকট্রনের ক্ষেত্রে এই তত্ত্ব আর খাটবে না। ইলেকট্রনের অবস্থান আর বেগ একই সাথে নিখুঁতভাবে মাপা সম্ভব নয়।

একটা নির্দিষ্ট সময়ে কিন্তু আমরা একটা ট্রেনের গতিবেগ ও অবস্থান একই সাথে মাপতে পারি। মাপতে পারি কারণ, ট্রেন আমরা দেখতে পাচ্ছি খালি চোখে। ট্রেনের ওপর সূর্যের আলো পড়ছে। কোয়ান্টামের ভাষায় যেগুলোকে বলে ফোটন কণার ঝাঁক। সেই আলো ট্রেনের ওপর থেকে প্রতিফলিত হয়ে আমাদের চোখে এসে পড়ছে। তাই আমরা ট্রেনকে দেখছি, সেটার ভরবেগ, অবস্থান মাপতে পারছি। সেই ফোটন কণার ঝাঁকের ক্ষমতা নেই ট্রেনের ওপর আঘাত হেনে তার গতিবেগের বিচ্যূতি ঘটায়।

ইলেকট্রনের ক্ষেত্রে এরকমটি হবে না। ইলেকট্রনের অবস্থান বা ভরবেগ মাপতে হলে ইলেকট্রনকে আমাদের দেখতে পেতে হবে। নিজেরা যদি দেখতে নাও পাই এমন যন্ত্র দরকার হবে যেটা ইলেকট্রনকে শণাক্ত করতে পারবে। সেজন্য দরকার হবে আলোর। ইলেকট্রনের অবস্থান কোথায় সে খবর এনে দেবে যন্ত্র থেকে ছুড়ে মারা কোনো আলোক রশ্মি। অর্থাৎ ফোটন কণা। ফোটন কণার শক্তি তো আর চুপচাপ বসে থাকবে না। হালকা-পলকা ইলেকট্রনকে বেশ ভালোমতোই আঘাত করবে। ইলেকট্রন সেই আঘাত পুরোপুরি হজম করতে পারবে না। হয় তার অবস্থান বদলে যাবে নইলে বদলে যাবে ভরবেগ।

হাইজেনবার্গ বললেন, যত সূক্ষ্মভাবেই মাপি না কেন আমরা একই সাথে ইলেকট্রনের ভরবেগ ও অবস্থান দুটোই পরিমাপ করতে পারব না। দুটোকে আলাদা আলাদাভাবে মাপতে হবে। ধরে নেওয়া যাক, খুব সূক্ষ্মভাবে মাপলে ইলেকট্রনের অবস্থানের সর্বনিন্ম ত্রুটি অর্থাৎ বিচ্যূতি আসবে Δx। সবচেয়ে আধুনিক যন্ত্র দিয়ে মাপলেও এরচেয়ে কম ত্রুটি পাওয়া সম্ভব নয়। তারপর যন্ত্রটি দিয়ে আমরা ইলেকট্রনের যে অবস্থান পাব তা থেকে Δx পরিমাণ ত্রুটি বাদ দিলেই ইলেকট্রনের আসল অবস্থান পেয়ে যাব। হাইজেনবার্গ বলেলেন এভাবে যে মুহূর্তে আমরা ইলেকট্রনের সঠিক অবস্থানটা মাপছি, তখন তার ভরবেগের ত্রুটি অসীম হয়ে যাচ্ছে। অসীম ত্রুটিকে তো আর মূল মানের সাথে বিয়োগ করে ত্রুটিমুক্ত করা যায় না। সেই ধরনের হিসাবই অবান্তর। তাই যে সময় অবস্থান আমরা সূক্ষ্মভাবে মাপছি, সেই মুহূর্তে ভরবেগের মান পরিমাপ করা অসম্ভব।

আমরা ভরবেগের সর্বনিন্ম ত্রুটি ধরে নিতে পারি Δp। এটাকে আমলে নিয়ে যদি কোনো একটা নির্দিষ্ট সময়ে ইলেকট্রনের ভরবেগ সূক্ষ্মভাবে মাপার চেষ্টা করি, হাইজেনবার্গের মতে তখন অবস্থানের ত্রুটি অসীম হয়ে যাবে। হাইজেনবার্গ এই দুই ত্রুটিকে একটা সমীকরণে বেঁধে ফেললেন। সেটা হলো অবস্থান আর ভরবেগের ত্রুটির গুণফল ছোট প্ল্যাঙ্ক ধ্রুবকের অর্ধেকের সমান। অর্থাৎ-
\Delta E\Delta t\ge \frac { \hbar  }{ 2 }

ছোট প্ল্যাঙ্ক ধ্রুবক ħ, এর মান  h/2π এর সমান।

তিন

এখন একটা প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দেয়। তাহলে কী আমরা ইলেকট্রনের ভরবেগ ও অবস্থান কখোনোই সূক্ষ্মভাবে মাপতে পারব না?

পারব তবে এক সাথে নয়, আলাদা আলাদাভাবে। একটা মাপতে গিয়ে আরেকটার বিচ্যূতি অসীম হয়ে যাচ্ছে। তাই আলাদা আলাদাভাবে মাপা যেতে পারে। প্রথমে আমরা অবস্থান মাপতে পারি, তারপর মাপতে পারি ভরবেগ। দুই মানকে গণিতের ছাঁচে ফেলে হিসাব কষে দেখতে পারি।

হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা সূত্রে কিছুটা সীমাবদ্ধতা ছিল। বিশেষ করে অনিশ্চয়তার উৎস কোথায় ইলেকট্রনের ধর্মে না পরীক্ষাধীন যন্ত্রে। আসলে দু দিকেই অনিশ্চিয়তা আছে। সেই বিষয়টা আরো ভালোভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য ১৯২৭ সালে বোর সম্পূরক নীতির জন্ম দিলেন। আসলে বোরো সম্পূরক নীতি প্রবর্তন করে হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতিরই পূর্ণতা দিলেন। তিনি বললেন, ইলেকট্রনের একই মুহূর্তের অবস্থান ও ভরবেগ মাপা যেমন অসম্ভব। তেমনি অসম্ভব একই যন্ত্র দিয়ে দুটোকে মাপা। বোরের কথার অর্থ হলো, যে যন্ত্র দিয়ে আপনি অবস্থান মাপতে পারবেন, সেই একই যন্ত্র দিয়ে ইলেকট্রনের ভরবেগ পরিমাপ করতে পারবেন না। ভরবেগ মাপার জন্য সম্পূর্ণ আলাদা যন্ত্রের দরকার হবে। ভরবেগ মাপার যন্ত্রটি হবে অত্যন্ত হালকা, এই যন্ত্রের সাহায্যে ভরবেগের ত্রুটি আপনি সর্বনি¤œ মানে নিয়ে আসতে পারবেন। আবার অবস্থান নির্ণয়ের যন্ত্রটি হবে খুবই ভারি। সেটা ভরবেগের ত্রুটি অসীমে নিয়ে যাবে, কিন্তু অবস্থানের ত্রুটি সর্বনিন্ম মানে নামিয়ে দেবে।

হাইজেনবার্গ আর বোরের সূত্র ধরে ইলেকট্রনের অবস্থান ও ভরবেগ  আলাদা আলাদাভাবে মেপে নিশ্চিতভাবেই ইলেকট্রনের ভরবেগ ও অবস্থান মাপতে পারবেন। অনেকটা বদ্ধ ঘরের ছিদ্র দিয়ে ঘরের ভেতরের ছবি তোলার মতো ব্যাপার। ধরুন, একটা ঘরের জানালা-দরজা সব বন্ধ। আপনি ঘরটার ভেতরের সবকিছুর ছবি তুলবেন। এজন্য ক্যামেরার লেন্স রাখার মতো একটা ছিদ্র আছে। তাহলে কি ঘরের ভেতরের সবকিছু একটা ছবিতে তুলে আনতে পারবেন? পারবেন না। আপনি যেদিক থেকে ছবি তুলছেন, সেদিকের অনেক কিছু অনুপস্থিত থেকে যাবে ছবিতে। সেই ছবি কাউকে দেখিয়ে যদি বলেন, ছবি দেখে পুরো ঘরের হবহু বর্ণনা দিতে সেটা সম্ভব নয়। সেটা করতে হলে আপনাকে আরেকটা ছবি তুলতে হবে, ঘরের উল্টো দিকের কোনো ছিদ্র থেকে। দুই ছবি মিলিয়ে পুরো ঘরের নিখুঁত বর্ণনা করা তখন অসম্ভব নয়।

চার

অনিশ্চয়তা কিন্তু শুধু ইলেকট্রনের ভরবেগ আর অযস্থানের ক্ষেত্রেই ঘটে না। এমন আরো কিছু যুগল বৈশিষ্ট্য আছে। সেগুলোর একটা নিশ্চিত করে মাপতে গেলে আরেকটার ত্রুটি অসীম হয়ে যায়। যেমন, সময় ও শক্তি। কোনো একটি বিন্দুতে ইলেকট্রনের অবস্থান মপছেন, তখন শক্তি আর সময় একইসাথে নিখুঁতভাবে বের করতে পারবেন না। শক্তি-আর সময়ের ত্রুটিকেও অনিশ্চয়তা সমীকরণে ফেলতে পারবেন একইভাবে। সেই সমীকরণটা হবে
\Delta E\Delta t\ge \frac { \hbar  }{ 2 }

তেমনি কৌণিক ভরবেগ আর কোণের ভেতরে অনিশ্চয়তা দেখা দেবে। সেই ত্রুটির জন্য অনিশ্চয়তার সমীকরণটা দাঁড়াবে:
\Delta E\Delta \theta\ge \frac { \hbar  }{ 2 }

[বইটির সূচীপত্র এবং সবগুলো খন্ডের লিংক একত্রে দেখুন এখানে]
বিজ্ঞান পত্রিকায় সম্পূর্ণ বইটি পড়া যাবে। তবে কেউ সংগ্রহে রাখতে চাইলে অনলাইনে কেনা যাবে ০১৫৫ ৭৭৭ ৯৩২৩ নম্বরে ফোন করে।

-আব্দুল গাফফার রনি
বিজ্ঞান লেখক
[লেখকের ফেসবুক প্রোফাইল]

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.