টার্ডিগ্রেডঃ চরম প্রতিকূলতায় পরম স্বচ্ছন্দে বেঁচে থাকা প্রাণীর গল্প

0
582

[অতনু চক্রবর্ত্তী রচিত জীববিজ্ঞানের প্রতি ভালবাসা বইটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হবে বিজ্ঞান পত্রিকায়। আজ রইল এর তৃতীয় অধ্যায়। বইয়ের সূচীপত্র (সবগুলো অধ্যায়ের লিংক পেতে), উৎসর্গপত্র, ভূমিকা ও বিষয়বস্তুর জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন। ]

আচ্ছা পানি পান না করে একজন মানুষ সর্বোচ্চ কত সময় বেঁচে থাকতে পারে জানো ? –  ১০০ ঘণ্টা। কিন্তু এমন একটি প্রাণী রয়েছে যেটি দশকের পর দশক পানি না গ্রহণ করে থাকতে পারে। শুধু তাই না, এই প্রাণিটি যেকোন প্রতিকূল পরিবেশের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে বেঁচে থাকতে পারে বছরের পর বছর। তীব্র তেজস্ক্রিয়তা কিংবা ভয়ংকর শীত – কোন কিছুই কাবু করতে পারে না একে। এর নাম টার্ডিগ্রেড।

টার্ডিগ্রেড

টার্ডিগ্রেড কিন্তু দশাসই চেহারার নয় একদমই। এরা দৈর্ঘ্যে হয় এক মিলিমিটারের মত। এদের পায়ের সংখ্যা আট; সাথে প্রত্যেকটিতে আছে নখওয়ালা থাবা। অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে এদের গোলগাল ভল্লুকের আণুবীক্ষণিক সংস্করণ মনে হয়। ১৭৭৩ সালে জার্মান বিজ্ঞানী ইয়োহান অগাস্ট গুজ প্রথম এদের পর্যবেক্ষণ করেন। চলাফেরায় অত্যন্ত ধীর বলে জর্মন শব্দ টার্ডিগ্রাডা( যার অর্থ “ক্ষুদ্র পদক্ষেপ”) র উপর ভিত্তি করে এদের এমন নাম রাখা হয়েছে। এর পরে বিখ্যাত ইতালীয় বিজ্ঞানী স্পালাঞ্জানি টার্ডিগ্রেডদের অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা সম্পর্কে ইংগিত দেন। 

টার্ডিগ্রেড প্রাণীটির পানি ছাড়া বেঁচে থাকার যে ক্ষমতা সেটি সম্পর্কে জানবার আগে চলো আগে জানি আসলে আমাদের জীবনধারণের জন্য পানি কেন প্রয়োজনীয়? 

আসলে আমাদের বেঁচে থাকতে হলে যে সব শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয় তার জন্য পানি অত্যাবশ্যক। কোষে কোষে যে বিভিন্ন বিপাকীয় প্রক্রিয়া চলে সেই সকল প্রক্রিয়া পানি ছাড়া চলতে পারে না। কিন্তু এনহাইড্রোবায়োসিস নামের একটি প্রক্রিয়ার সাহায্যে টার্ডিগ্রেডগুলি একরকম পানি ছাড়া দৈহিক বিভিন্ন বিপাক ক্রিয়াকে বলতে গেলে একরকম বন্ধই করে দিয়ে বেঁচে থাকতে পারে। যখন পানি থাকে না তখন টার্ডিগ্রেড নিজেদেরকে মাথাগুঁজে হাঁটু মুড়ে বলের মত করে ফেলে। টার্ডিগ্রেডদের জীবনের এই দশাকে “Tun দশা” বলা হয়। বিজ্ঞানীরা এটাও মনে করেন যে এই দশায় থাকার সময় টার্ডিগ্রেডের কোষে থাকা একটি বিশেষ ধরণের অণু ম্যাট্রিক্সের মত চটচটে কোন একটা পদার্থ সৃষ্টি করে কোষের পানির অভাব দূর করে। যদি কোষে পানি না থাকে তবে পানিহীনতার কারণে কোষের বিভিন্ন উপাদান নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা। যেমন ডিএনএ , প্রোটিন কিংবা অন্যান্য প্রাণরাসায়নিক কাঠামোগুলির পানি না থাকলে ভেঙ্গেচুরে যাওয়ার কথা। অথচ এই ম্যাট্রিক্সের কারণে কী অদ্ভুত ভাবে এই সমস্ত অঙ্গাণুগুলি তা থেকে রক্ষা পায়! আবার যখন পানি ফিরে আসায় টার্ডিগ্রেড অনুকূল পরিবেশ পায় তখন এই ম্যাট্রিক্স নষ্ট হয়ে যায়। আর কার্যকরী অবস্থাতেই অন্যান্য অঙ্গাণু কিংবা প্রাণরাসায়নিক কাঠামোগুলি আগের মত কাজ করা শুরু করে। 

এবার আসি এদের বাসস্থান প্রসঙ্গে। এরা কোথায় বাস করে এ প্রশ্ন করার চেয়ে এরা কোথায় বাস করে না এ প্রশ্ন করা বেশি যৌক্তিক। কোথায় নেই এরা? যেহেতু প্রতিকূল পরিবেশে বেঁচে থাকা এদের জন্যে খুব ই সম্ভব তাই পাহাড় পর্বত , ক্ষেত  খামার , বন জঙ্গল , সমুদ্র -সবখানেই এদের অস্তিত্ব বিদ্যমান। শুধু তাই নয় বরফে ছাওয়া এন্টার্কটিকাতে কিংবা মহাশূণ্যেও এরা বেঁচে থাকতে পারে।  তেজস্ক্রিয় বিকিরণে টিকে থাকার অনন্য ক্ষমতার কারণে টার্ডিগ্রেডকে মহাশূণ্যে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।  ২০০৭ সালে কয়েক প্রজাতির টার্ডিগ্রেডকে পানিশূন্য অবস্থায় নাসার FOTON-M3 মিশনে একটি কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে প্রেরণ করা হয়। মহাজাগতিক বিভিন্ন বিকিরণকে প্রত্যক্ষ করে এদেরকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয়। এর পরে পানি দেওয়ার ৩০ দিন পর এরা আবার বেঁচে ওঠে। ২০১১ সালে এদের আবার STS-134 নামের নাসার আরেকটি মিশনেপাঠানো হয়। এবার ও টার্ডিগ্রেডরা বেঁচে থাকতে সক্ষম হয়। এই বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্য বিজ্ঞানীদের আগ্রহের কারণ হয়ে উঠল। এই বৈশিষ্ট্যকে কাজে লাগিয়ে তেজস্ক্রিয়তার মুখে বিভিন্ন জীবের টিকে থাকার কৌশল সম্পর্কে বিজ্ঞান জানতে পারলে তা বেশ বৈপ্লবিক একটি পরিবর্তন আনতে পারবে এ কথা বলা ই বাহুল্য। 

স্ক্যানিং ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপে দেখা টার্ডিগ্রেড

এই বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ধারায় বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে বেশ কিছু সফলতার মুখও দেখেছেন। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন Intrinsically Disordered Proteins বা সংক্ষেপে আইডিপি নামের কিছু প্রোটিন নির্দেশকারী জিন এই লেখায় প্রথম দিকে বলা টার্ডিগ্রেডের এনহাইড্রোবায়োসিস প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই প্রোটিনগুলির একটা মজার বৈশিষ্ট্য আছে। সাধারণত প্রায় সব প্রোটিনগুলির একটি নির্দিষ্ট কাঠামো রয়েছে। এই কাঠামোর একটু এদিক ওদিক হলেই প্রোটিনগুলি আর কাজ করে না। কিন্তু এরা সেরকম না। এদের নির্দিষ্ট কোন ত্রি মাত্রিক কাঠামো নেই। এই আইডিপি নির্দেশক জিনগুলি ব্যাকটেরিয়ার ক্রোমোজোমে প্রবেশ করিয়ে বিজ্ঞানীরা দেখেন ব্যাকটেরিয়াতে সংশ্লেষিত আইডিপিগুলি ও ব্যাকটেরিয়াকে পানিশূন্যতায় টিকে থাকতে সাহায্য করে।  অনেকে মনে করতেন যে যেহেতু এই প্রাণীটি অক্সিজেন ছাড়া মহাশূন্যেও টিকে থাকতে পারে সেহেতু এরা বহির্বিশ্বের কোন গ্রহ থেকে এসেছে কিনা। কিন্তু ব্যাপারটা এরকমও নয়। আর দশটা প্রাণীর মতই টার্ডিগ্রেডও এই পৃথিবীতে বিবর্তিত হয়েছে। আর এদের বিবর্তন প্রায় ১১০০ টির ও বেশি ভিন্ন ভিন্ন টার্ডিগ্রেডের প্রজাতির সৃষ্টি করেছে। আরও মজার ব্যাপার হল টার্ডিগ্রেডের জিনগত বিশ্লেষণ করে দেখা গিয়েছে যে তাদের জিনের সাড়ে সতের শতাংশ ই এসেছে অন্যান্য প্রজাতি থেকে। এই “অন্যান্য” প্রজাতির মধ্যে রয়েছে উদ্ভিদ, ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাস। এই সবকিছু মিলিয়ে স্বতন্ত্র অভিব্যক্তির মাধ্যমে টার্ডিগ্রেড হয়ে উঠেছে অপ্রতিরোধ্য। এর পরবর্তীতে টোকিও বিশ্ববদ্যালয়ের একদল গবেষক টার্ডিগ্রেডের একটি প্রজাতির পুরো জিনোম সিকোয়েন্স বের করেন। এই গবেষণাতে দেখা যায় এই প্রজাতির ক্ষেত্রে অন্যান্য প্রজাতি থেকে পাওয়া ডিএনএ রয়েছে শতকরা এক দশমিক দুই ভাগ। যদিও জীববিজ্ঞানীদের কাছে এই সংখ্যাটা খুব বিশেষ নয় তারপরেও মজার ব্যাপারটা হল এই টার্ডিগ্রেডে থাকা অধিকাংশ অনন্য জিন ই প্রতিকূল পরিবেশ থেকে বাঁচাতে টার্ডিগ্রেডকে সাহায্য করে। এছাড়া টার্ডিগ্রেডের কোষে Dsup (Damage suppressor Protein) নামের আরেকটা প্রোটিন রয়েছে। এই প্রোটিনটি মূলত বিভিন্ন উচ্চ তেজস্ক্রিয় বিকিরণ থেকে টার্ডিগ্রেডের ডিএনএ কে রক্ষা করে। এই প্রোটিনটিকে যদি কোনভাবে মানুষের দেহে স্থানান্তর করা যায় তাহলে মানুষ কিন্তু বিভিন্ন তেজস্ক্রিয় বিকিরণকে উপেক্ষা করে বেঁচে থাকতে পারবে। এর ই মাঝে পরীক্ষাগারে মানুষের কোষে এই প্রোটিন যুক্ত করে দেখা গেছে কোষের বিকিরণ সহ্য করবার ক্ষমতা প্রায় চল্লিশ শতাংশ বেড়ে গেছে! বিবর্তনের পথ ধরে টিকে থাকা টার্ডিগ্রেড তা ই এভাবে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও বিভিন্ন অনন্য বৈশিষ্ট্য অর্জন করে নিজেদেরকে প্রাণীজগতে বেশ তাৎপর্যময় একটি স্থান দিয়েছে। বিজ্ঞানীরা তাই আশাবাদী এই প্রাণীটিকে নিয়ে। কে বলতে পারে ভবিষ্যতের পৃথিবী যদি আমাদের আজকের পৃথিবী অপেক্ষা আরও প্রতিকূল পরিবেশের সম্মুখীন করায় মানুষকে তাহলে মানুষের টিকে থাকার কৌশল আবিষ্কারে টার্ডিগ্রেড সম্পর্কে জ্ঞান হয়ত বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে!

-অতনু চক্রবর্ত্তী
বুসান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, দক্ষিন কোরিয়া

[অতনু চক্রবর্ত্তী রচিত জীববিজ্ঞানের প্রতি ভালবাসা বইটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হবে বিজ্ঞান পত্রিকায়। আজ রইল এর তৃতীয় অধ্যায়। বইয়ের সূচীপত্র (সবগুলো অধ্যায়ের লিংক পেতে), উৎসর্গপত্র, ভূমিকা ও বিষয়বস্তুর জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন। ]

বিজ্ঞান পত্রিকা প্রকাশিত ভিডিওগুলো দেখতে পাবেন ইউটিউবে। লিংক:
১. স্পেস এক্সের মঙ্গলে মানব বসতি স্থাপনের পরিকল্পনা
২. মাইক্রোস্কোপের নিচের দুনিয়া

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.