কোয়ান্টাম ফিজিক্স-২৭ : বাঙালির কোয়ান্টাম যাত্রা

0
888

[বইটির সূচীপত্র এবং সবগুলো খন্ডের লিংক একত্রে দেখুন এখানে]

১৯২৪ সাল। মহাবিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন তখন জার্মানির জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক। একদিন তাঁর কাছে একটা চিঠি আসে। চিঠির সাথে একটা একটা গবেষণাপত্র। প্রেরক তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রিডার সত্যেন্দ্রনাথ বসু। আইনস্টাইন চিঠিটা পড়লেন মন দিয়ে। তাতে একটা অনুরোধ। সাথে যে গবেষণাপত্রটা পাঠিয়েছেন তরুণ বিজ্ঞানী, সেটা জার্মান ভাষায় অুনবাদ করে ছাপানোর ব্যবস্থা করতে হবে শাইটসিফ্রট ফ্যুর ফিজিকে। আইনস্টাইন তখন বিজ্ঞান জগতের সুপাার স্টার। তাঁর কাছে এভাবে চিঠি লিখতে বুকের পাটা লাগে। শুধু প্রবন্ধ ছাপানোর সুপারিশ করার অনুরোধ হলে কথা ছিল। আইনস্টাইন তখন নিজের কাজ নিয়েই ভীষণ ব্যস্ত। পৃথিবীর অন্যপ্রান্তের কোন এক অখ্যাত তরুণ কিনা আবদার করেছেন তাঁর লেখা অনুবাদের।
আইনস্টাইন বিরক্ত হননি। ছুঁড়েও ফেলে দেননি প্রবন্ধটা। মন দিয়ে পড়েন। মনে ধরে প্রবন্ধের বিষয়বস্তু। কোয়ান্টাম তত্ত্বের একটা দুর্বলতার কথা বলা হয়েছে প্রবন্ধে। দেওয়া হয়েছে সেটার সমাধান। আইনস্টাইন নিজেও এই সমস্যা নিয়ে এক সময় কাজ করেছেন, কিন্তু সমাধানটা বের করতে পারেননি। পরে তো কোয়ান্টাম তত্ত্ব নিয়ে গবেষণাই ছেড়ে দিয়েছিলে তিনি। বোসের পেপার যখন পড়ছেন, তখন তিনি ব্যস্ত পদার্থবিদ্যার একীভূত তত্ত্ব নিয়ে। অবশ্য সত্যেন বোস নামটা তাঁর অজনা নয়। আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বের প্রবন্ধগুলো জার্মান ভাষায় প্রকাশ হয়। সেগুলো ইংরেজিতে প্রথম অনুবাদ করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই তরুণ গবেষক মেঘনাদ সাহা আর সত্যেন্দ্রনাথ বসু।

চিন্তমগ্ন সত্যেন বোস

তরুণ বিজ্ঞানীর আবদার রাখলেন আইনস্টাইন। ইংরেজিতে লেখা সত্যেন বোসের প্রবন্ধটি জার্মান ভাষায় অনুবাদ করলেন। তারপর পাঠিয়ে দিলেন সাইটশিফ্রট ফ্যুর ফিজিক-এ। সাথে লিখে দিলেন একটা ছোট্ট নোট- ‘বোসের এই কাজটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে আমি অনত্র আলোচনা করব।’ এই একটা নোটই পাল্টে দিল এদেশের বিজ্ঞানচর্চার ইতিহাস। কোয়ান্টাম তত্ত্বের মহাসড়কে যুক্ত হলেন এদেশের এক বিজ্ঞানী। সেইসাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামটাও ইতিহাসের সোনার অক্ষরে লেখা হয়ে গেল।

১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন সত্যেন বোস। রিডার পদে। এজন্যও তাকে কাঠখড় কম পোড়াতে হয়নি। একই পদে বেশ কয়েকজন প্রতিদ্বন্দ্বী দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। সবচেয়ে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী প্রিয় বন্ধু মেঘনাদ সাহা। সাহার সাথে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীতা ছোটকাল থেকেই। এন্ট্রাস (বর্তমানের এসএসসির সমতুল্য) পাশ করেছেন দুজন একই বছরে, ১৯১১ সালে। মেঘনাদ সাহা সেই পরীক্ষায় গোটা বাংলায় প্রথম হয়েছিলেন। সত্যেন বোস হয়েছিলেন দ্বিতীয়। আইএসএসি পরীক্ষায় ফল যায় উল্টে । এবার প্রথম হন সত্যেন বোস, মেঘনাদ হন তৃতীয়। স্কুল, কলেজ ছিল দুজনের আলাদা আলাদা। পরে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তে গিয়ে দুজনের সাক্ষাত, পরিচয়, বন্ধুত্ব।

রিডার পদে সাহা বরং যোগ্যতায় খানিকটা এগিয়ে ছিলেন। তাঁর পিএইচডি ডিগ্রি ছিল, সত্যেন বোসের সেটা ছিল না। ততোদিনে মেঘনাদ সাহার তাপ-আয়নন তত্ত্ব হৈ চৈ ফেলে দিয়েছে জ্যোতির্বিজ্ঞানে। তবুও সত্যেন বোসকেই নিলেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বিশ্বখ্যাত ফিলোসফিক্যাল ম্যাগাজিনে সদ্য প্রকাশ হয়েছে বোসের দুটি প্রবন্ধ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বড় করে দেখে  সেগুলোকেই। সত্যেন বোস ঢাকায় চলে এলেন সপরিবারে। বেতন ৪ শ টাকা। সেই সময়ের হিসাবে সেটা মন্দ নয়।

সত্যেন বোসের জন্ম ১৮৯৪ প্রথম দিনে । কলকাতার ২২ নং ঈশ্বর মিল লেনে। বাবা সুরেন্দ্র নাথ বসু ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ের হিসাব রক্ষক। মা আমোদিনী পুরোপুরি গৃহিনী। সাধারণ একটা স্কুলে তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু। ১৯০৭ সালে ভর্তি হন কলকাতার বিখ্যাত হিন্দু স্কুলে। উপন্দ্রনাথ বক্সী সেই স্কুলের অঙ্ক শিক্ষক। সত্যেন বোসদের টেস্ট পরীক্ষায় এক অদ্ভুত কান্ড করে বসলেন বক্সী মশাই।  অঙ্কে বোসকে দিলেন এক শতে ১১০ নম্বর! তাঁর একটা যুক্তি ছিল। সত্যেন বোস সবগুলো অঙ্ক ঠিক ঠিক করেছেন। কিন্তু জ্যামিতি করেছেন কিছু বেশি। সাধারণ নিয়মের বাইরে গিয়ে বিকল্প পদ্ধতিতে করেছেন সেগুলোর সমাধান। তাই মোট মার্কের চেয়ে ১০ মার্ক বেশি পাওনা তাঁর।

সত্যেন্দ্রনাথ বসু এন্ট্রাস পাস করেন হিন্দু স্কুল থেকেই। তারপর কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ আইএসসি। সেখান থেকেই গণিতে বিএসসি ড্রিগি লাভ, প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে। এমএসসি  মিশ্র গণিতে।  এবারও প্রথম শ্রেণীতে প্রথম। রেকর্ড শতকরা ৯২ মার্ক নিয়ে। সাহা আর সত্যেন বোস দুজনেই শিক্ষকতা শুরু করলেন রাজারবাগ বিজ্ঞান কলেজে। সেখানকার এক শিক্ষক তাঁদের নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রুপ করেন। প্রেসিডেন্সিতে নাকি ভালো গণিতের শিক্ষক নেই। তাই সেখান থেকে যারা বের হন, গণিতের তাঁরা কিস্যুটি বোঝেন না। বিদ্রুপ সহ্য হলো না মেঘনাদ আর সত্যেন বোসের। দুজন গণিত বিভাগ থেকে ইস্তফা দিয়ে পদার্থবিদ্যা বিভাগে যোগ দিলেন। ভাগ্যিস পদার্থবিদ্যায় এসেছিলেন, নইলে বাঙালি পদার্থবিজ্ঞানের দুই দিকপালকে পেত কি না কে জানে?

বিখ্যাত বাঙালি বিজ্ঞানীদের সাথে সত্যেন বোস (দাঁড়ানো বাঁ থেকে দ্বিতীয়)

ফিরে যাই বোসের প্রবন্ধে। কী বলেছিলেন সত্যেন বোস, যেটা শুনে আইনস্টাইনও মুগ্ধ হলেন! ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে পদার্থবিজ্ঞান পড়ে এক অদ্ভুত সমস্যায়। কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ ব্যখ্যা করতে পারছে না চিরায়ত বলবিজ্ঞান। এমনকী ম্যাক্সওয়েলর বিদ্যুৎচুম্বকীয় তত্ত্বেও নেই তার ব্যাখ্য। সমাধানে এগিয়ে এলেন বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী; লর্ড র‌্যালে, চার্লস র‌্যামজে, উইলহেম ভীন। কিন্তু খুঁত রয়ে গেল সবার তত্ত্বে । তখন জার্মান বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক প্রকাশ করলেন তাঁর বৈপ্লাবিক কোয়ান্টাম তত্ত্ব। সেই তত্ত্বে বিকিরণ বা আলোকে দেখানো হলে গুচ্ছগুচ্ছ শক্তির ঝাঁক আকারে। প্ল্যাঙ্কের সেই শক্তিগুচ্ছের নাম কোয়ান্টাম। ১৯০৫ সালে আইনস্টাইন ফটো-তড়িৎক্রিয়ার ব্যাখ্যায় ব্যবহার করলেন কোয়ন্টাম তত্ত্ব। তিনি আলোর সেই গুচ্ছকে বললেন আলোর কণা। নাম দিলেন ফোটন। তখন থেকেই সত্যিকার অর্থে প্রতিষ্ঠিত হলো প্ল্যাঙ্কের কোয়ন্টাম তত্ত্ব।

সত্যেন বোসের প্রবন্ধটা সাইটশিফ্রট ফ্যুর ফিজিকে ছাপা হলো ১৯২৪ সালের জুন মাসে। ততদিনে কোয়ান্টাম তত্ত্ব নিয়ে মৌলিক কাজ হয়েছে তিনটে। প্ল্যাঙ্ক, আইনস্টাইন আর বোর করেছেন কাজ তিনটি। চতুর্থ কাজটি করলেন আমাদের সত্যেন বোস- কোয়ন্টাম জগতে একেবারে আনকোরা নাম। চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানে আগে জন্ম হয়েছে বলবিদ্যার। তারপর সেখানে ঢুকেছে পরিসংখ্যান। কিন্তু কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের জন্য তখনো বলবিদ্যার জন্ম হয়নি। তাঁর আগেই কেয়ান্টাম পরিসংখ্যানের জন্ম দিলেন সত্যেন্দনাথ বসু। পরিসংখ্যান বিদ্যার কাজ হলো সূক্ষ্ম গণনাকে কাঠামোবদ্ধ করে বৃহৎ মানে নিয়ে যাওয়া। তড়িচ্চুম্বকীয় তত্ত্বে তেমনটাই করে দেখিয়েছিলেন জার্মান বিজ্ঞানী জেমস ক্ল্যার্ক ম্যাক্সওয়েল। বস্তুকে অতি ক্ষুদ্র কণার সমষ্টি ধরে নিয়েছিলেন। তারপর সেগুলো বিন্যাস করে একটা গড়মান বের করে বস্তুর তাপ, চাপের মতো ভৌত বিষয়গুলির মান বের করা চেষ্টা করেছিলেন। এজন্য শুধু নিউটনীয় গতিবিদ্যা হলেই চলে। কিন্তু পরমাণুর ভেতরের জগতে নিউটনীয় বলবিদ্যা অচল। সেটা ডেনিশ বিজ্ঞানী নীলস বোর দেখিয়েছেন। তাই পরমাণু মডেলে কোয়ান্টাম তত্ত্ব প্রয়োগ করা হলো। কিন্তু ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের মুল কোয়ান্টাম তত্ত্বেই তো গলদ রয়েছে। প্ল্যাঙ্কের সমীকরণের ডানদিকে দুটো অংশ। একটা অংশে আলোকে বিকিরণ শক্তি হিসেবে দেখানো হয়েছে। আরেকটা অংশে আলোকে দেখানো হয়েছে গুচ্ছশক্তির কণা হিসেবে। সমস্যটা হলো, ডানদিকের প্রথম অংশটির হিসাব করতে হচ্ছিল ম্যাক্সওয়েলর তড়িচ্চুম্বকীয় সমীকরণের সাহায্যে। কিন্তু কোয়ান্টাম তত্ত্বকে নিউটন এবং ম্যাক্সওয়েল কারো সমীকরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করা ঠিক নয়। সেটা সমাধান করার মতো কোনো স্বতন্ত্র অঙ্ক প্ল্যাঙ্কের জানা ছিল না। আইনস্টাইনই প্রথম বিষয়টা নিয়ে কাজ করেন। একটা সমাধানও বের করেন তিনি। কিন্তু আইনস্টাইনের সমাধানটা ঠিক ছিল না। অথচ প্ল্যাঙ্কের সেই তত্ত্ব ধরেই আইনস্টাইনের ফটোতড়িৎ ক্রিয়া, বোরের কোয়ন্টাম পরমাণুর মডেল গড়ে উঠেছে। তাই এই তত্ত্বগুলোতেই সেই ত্রুটির প্রভাব পড়েছিল। সত্যেন বোস ত্রুটিটারই মূল উৎপাটন করতে চাইলেন। সেটা এক দিনে হয়নি।
সত্যেন বোস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের কোয়ান্টাম তত্ত্ব পড়াতেন। একদিন সেটাতেই হলো ভুল । ভুল কখনো কখনো আশির্বাদ বয়ে আনে। ‘ভুল’ ক্যাকুলেশনের যে ‘ভুল’ সমাধান বেরুলো সেটা এক কথায় অভূতপূর্ব! সেটাতে কোয়ান্টামের পুরনো ত্রুটিটা ‘নেই’ হয়ে গেছে। চমকে উঠলেন সত্যেন বোস। বুঝতে পারলেন প্ল্যাঙ্ক সূত্রের ফাঁকটা তিনি দেখে ফেলেছেন। যেটা দেখার চেষ্টা করছিলেন আইনস্টাইন, ডিবাইয়ের মতো কোয়ান্টামের দিকপালও। কিন্তু ঠিকঠাক ফাঁকটা তাঁরা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। সত্যেন বোস পেলেন। ওই ভুল থেকেই। পুরো ক্যালকুলেশনটা তিনি নোট করে নিলেন। তারপর সেটা নিয়ে চলল কাঁটাছেঁড়া। দীর্ঘ পরিশ্রমের পর স্যত্যেন বোস প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্ত্বকে ত্রুটিমুক্ত করতে সমর্থ হলেন।

ম্যাক্সওয়েলন যেমন বস্তুকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণায় ভাগ করে তাতে পরিসংখ্যান বসিয়েছিলেন, সত্যেন বোস তেমন কাজটিই করলেন আলোর ক্ষেত্রেও। প্ল্যাঙ্ক বিকিরণ বা আলোকে বলেছিলেন শক্তির গুচ্ছ হিসেবে। আইনস্টাইন সেটার নাম দিলেন আলোর ফোটন কণা। কণাই যদি হবে তবে সেটাতে তরঙ্গ সমীকরণ কেন, তাও আবার ম্যাক্সওয়েলের তরঙ্গ সমীকরণ থেকে পাওয়া রাশি। সত্যেন বোস তড়িচ্চুম্বকীয় রাশিটাই বাদ দিলেন প্ল্যাঙ্ক সমীকরণ থেকে। রাখলেন শুধু কণাবাদী কোয়ান্টাম রাশি। এজন্য তিনি কণাকে আরো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাগে ভাগ করলেন। এসব ক্ষুদ্র ভাগের একেকটার নাম দিলেন কোষ। তারপর পরিসংখ্যানের সাহায্যে সেগুলোর সমাহার ঘটালেন, এবং ব্যাখ্যা করলেন আলোর কোয়ান্টাম গুণাবলি।

সত্যেন বোস আলোর ফোটনের তরঙ্গ চরিত্র বাদ দিয়েই পুরো হিসাবটা মিলিয়ে ফেললেন কোয়ন্টাম তত্ত্ব দিয়ে। তাই বলে কিন্তু আলোর তরঙ্গ ধর্মের বিলোপ ঘটানোর চেষ্টা করেননি। বরং প্রতিষ্ঠা করলেন আলোর কণাতত্ত্বের সূম্পূর্ণ একটা কোয়ান্টাম সমীকরণ। সাইটশ্রিফট ফ্যুর ফিজিকে সত্যেন বোসের সেই প্রবন্ধ প্রকাশের পর হৈ চৈ পড়ে গেল বিজ্ঞান দুনিয়ায়। রাতারাতি সত্যেন বোসের নাম জেনে গেলেন বড় বড় বিজ্ঞানীরা। চিরদিনের মতো বিজ্ঞানের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে গেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামও।

বোসের প্রবন্ধ যখন প্রকাশ হচ্ছে তখনো অস্ট্রিয়ান বিজ্ঞানী উলফগ্যাং পাউলি স্পিন ধারণার প্রবর্তন করেন নি। সত্যেন বোসের তো জানার কথাই নয়। আলোর কণা চরিত্র বেশ ভালোভাবে ব্যখ্যা করা যায় বোসের পরিসংখ্যান দিয়ে। কিন্তু বস্তু কণার কোয়ান্টাম চরিত্র ঠিক ঠাক ব্যাখ্যা করতে পারে না বোসের পরিসংখ্যান। কারণ ওই স্পিন। বস্তুকণাগুলো নিজ অক্ষের ওপর ঘোরে। কণাগুলোর চার্জ থাকে। একই চার্জের একই ভরের দুটি কণা একই শক্তিস্তরে পাশাপাশি থাকতে পারে না। পাউলি বললেন, এই সমস্যার একটা সমাধান আছে, যদি সমধর্মী দুটি কণা পরস্পরের বিপরীত দিকে ঘোরে। বস্তুকণাদের এই বিপরীতমুখি স্পিন বৈশিষ্ট্যের খবর ছিল না বোস-আইনস্টাইন তত্ত্বে। তাই বস্তুকণাদের জন্য আরেক ধরনের পরিসংখ্যানের প্রয়োজন হলো। দরকার পড়ল বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যানের পরিমার্জনেরও। পরিমার্জিত সেই পরিসংখ্যান তৈরি করলেন এনরিকো ফার্মি ও পল ডিরাক। সেই পরিসংখ্যানের নাম তাই ফার্মি-ডিরাক পরিসংখ্যান। এরপর ঘটে বাঙালির জন্য গর্ব করার মতো ঘটনা। মহাবিশ্বের তাবৎ বস্তুকণাকে দুটো ভাগে ভাগ করা হলো। যেসব কণা ফার্মি-ডিরাক পরিসংখ্যান মেনে চলে তাদের নাম দেওয়া হলো ফার্মিওন। আর যেসব কণা বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান মেনে চলে তাঁদের নাম হলো বোসন কণা।
এরপর বোসের পরিসংখ্যান নিয়ে কাঁটাছাড়া শুরু করেন আইনস্টাইন। আরও পরিমার্জিত করে সুন্দর কাঠামোতে দাঁড় করান সেটাকে। এজন্যই পরিসংখ্যানটির নাম হয়ে যায় বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান। এই পরিসংখ্যানের সূত্রধরেই জন্ম হয় বোস-আইনস্টাইন ঘনীভবনের (Bose-Einstein condensation) । এটাকে বলে পদার্থের ৫ম অবস্থা। এ এক আশ্চর্য অবস্থা। পরম শূন্য তাপমাত্রার খুব কাছাকাছি তাপমাত্রায় গ্যাসীয় পদার্থের পরমাণুগুলো সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। অনেকটা ফোটনের মতো আচরণ করে পরমাণুগুলো। বস্তুর ওই অবস্থাকে কঠীন, তরল, বায়বীয় বা আয়নিত কোনোটার সাথেই মেলানো যায় না। তাই ওই অবস্থার নাম দেওয়া হলো বোস-আইনস্টাইন ঘণীভূত অবস্থা। তবে অত সহজে মেলেনি এই ঘনীভবনের দেখা। অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত। বোস-আইনস্টাইন ঘনীভবনের অস্তিত্ব পরীক্ষাগারে প্রমাণের জন্য ২০১১ সালে তিন পদার্থবিদ পেয়েছেন নোবেল পুরস্কার।

সাইটশ্রিফট ফ্যুর ফিজিকে প্রবন্ধ ছাপা হবার পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও সত্যেন বোসের কদর বেড়ে যায়। অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ওপর নাখোশ সত্যেন বোস। কারণ তাঁর রিডার পদটির স্থায়ী করা হয়নি। দুই বছরের জন্য মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে মাত্র। বেতন বাড়ানো হয়েছে মাত্র মাসিক মাত্র এক শ টাকা। সত্যেন বোস সেটা নিয়ে আপত্তি তুলেছিলেন। সাথে আরেকটা আবেদন ছিল, ইউরোপ ভ্রমণের জন্য ছুটি আর সাড়ে বারো হাজার টাকা অনুদান। আনন্দ ভ্রমণের জন্য নয়, ইউরোপীয় বিজ্ঞানীদের সাথে কাজ করার জন্য ইউরোপে যেতে চান তিনি। সেই আবেদনটাও ঝুলে ছিল। প্রবন্ধ প্রকাশ হলো, সত্যেন বিজ্ঞানী বনে গেলেন, তখন সদয় হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও। ছুটি মঞ্জুর করা হলো সত্যেন বোসের। আর অনুদান হিসেবে দেওয়া  হলো ১৩,৮০০ টাকা। সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর পি জে হার্টসের দেওয়া একটা সুপারিশপত্র। সুপারিশটা বিখ্যাত বিজ্ঞানী রাদারফোর্ডের উদ্দেশ্যে।

রাদারফোর্ড তখন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাঞ্চেস্টারে তাঁর বিখ্যাত ছাত্রদের নিয়ে গবেষণা করছেন। কিন্তু রাদাফোর্ডের ল্যাবরেটরিতে তখন আর জায়গা ছিল না। সত্যেন বোস তাই জার্মানি আর ফ্রান্সেই কাটিয়ে দিলেন দুটো বছর। এর মধ্যে তিনি হাইজেনবার্গের সান্নিধ্য পেয়েছেন। কাজ করেছেন দ্য ব্রগলির রঞ্জন রশ্মি গবেষণা কেন্দ্রে। কাজ করেছেন মাদাম কুরির রেডিয়াম ইনস্টিটিউটেও।

দুবছরের ইউরোপযাত্রা শেষ হবার আগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানে অধ্যাপকের পদ খালি হয়। সেই পদে যোগদানের জন্য আবেদন করেন সত্যেন বোস। তখন তাঁর হাতে রয়েছে আলবার্ট আইনস্টাইন, পল ল্যাভেঞ্জা আর হেরমান মার্কের মতো নামি-দামি বিজ্ঞানীদের সুপারিশপত্র। কিন্তু সত্যেন বোসের প্রতিদ্বন্দ্বী দেবেন্দ্র মোহন বসু (ডি এম বোস) অভিজ্ঞাতায় অনেক এগিয়ে। তাছাড়া বিখ্যাত কোয়ান্টাম তত্ত্ববিদ অর্নাল্ড সোমারফেল্ডের সুপারিশ ছিল ডি এম বোসের পক্ষে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ডি এম বোসকেই নির্বাচিত করলেন। সত্যেন বোস তখন ফিরে এসে যোগ দিলেন সেই রিডার পদে। এবার বেতন বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাড়ে ছয় শ টাকায়। তবে সে পদে বেশিদিন থাকতে হলো না সত্যেন বোসকে। ডি এম বোস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেননি। সুতরাং অধ্যাপকের পদে সত্যেন বোসই নিয়োগ পেলেন।

টানা ১৯ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন সত্যেন বোস। ১৯৪৫ সাল নাগাদ চরম ওঠে এদেশের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি। সেই মুহূর্তে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রস্তাব আসে বসুর কাছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে ইস্তফা দিয়ে চলে যান কলকাতায়। ছিন্ন হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে তাঁর দীর্ঘ ২৪ বছরের আত্মীক সম্পর্ক।

১৯৭৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি কলকতায় মৃত্যু বরণ করেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু। তখন তাঁর বয়স আশি পেরিয়ে গেছে। তার আগে ঢাকা থেকে গিয়ে কিছুদিন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর অব এমিরেটাস পদে ছিলেন। অবসরের পর চলে যান বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে। উপাচার্য হয়ে। মনেপ্রাণে বিজ্ঞানী, আবার খাঁটি বাঙালিও ছিলেন সত্যেন বোস। গান পছন্দ করতেন, সাহিত্য-সাস্কৃতির আড্ডায় তাঁর উপস্থিতি ছিল নিয়মিত। নিজেও গান করতেন। এস্রাজে সুর তুলতে পারতেন দক্ষ শিল্পীর মতো করে। বিজ্ঞান বিষয়ক লেখালেখি করতেন বিভিন্ন পত্রিকায়। বাংলা ভাষায়। নিজে ইংরেজি, জার্মান ও ফরাসী ভাষায় সমান দক্ষ। তবু বিজ্ঞাচর্চার ক্ষেত্রে তিনি বাংলাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। হয়তো এজন্যই নির্দ্বিধায় ঊচ্চারণ করতে পেরেছেন, ‘যাঁরা বলছেন বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান শিক্ষা সম্ভব নয়, হয় তাঁরা বাংলা জানেন না অথবা বিজ্ঞান বোঝেন না।’ সত্যেন বোসের এই উক্তিই আজ আমাদের পথ দেখাচ্ছে। বাংলাদেশে পড়ে বাংলাভাষায় বিজ্ঞানচর্চা করে বহুবিজ্ঞানী আজ বিশ্ববিজ্ঞানের মঞ্চ কাঁপাচ্ছেন। সত্যেন বোস ১৯২০ দশকে তার প্রবন্ধের মাধ্যমে কণাবিজ্ঞানে যাত্রা শুরু করেছিলেন, বাঙালির সেই যাত্রা আজও অব্যাহত রয়েছে। তাই অধ্যাপক জাহিদ হাসানের মতো বিজ্ঞানীরা ভাইল ফার্মিয়ন আবিষ্কার করে দেখাচ্ছেন পদার্থবিজ্ঞানে বাঙালিকে নোবেল পাবার স্বপ্ন।

[বইটির সূচীপত্র এবং সবগুলো খন্ডের লিংক একত্রে দেখুন এখানে]
বিজ্ঞান পত্রিকায় সম্পূর্ণ বইটি পড়া যাবে। তবে কেউ সংগ্রহে রাখতে চাইলে অনলাইনে কেনা যাবে ০১৫৫ ৭৭৭ ৯৩২৩ নম্বরে ফোন করে।

-আব্দুল গাফফার রনি
বিজ্ঞান লেখক
[লেখকের ফেসবুক প্রোফাইল]

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.