[বইটির সূচীপত্র এবং সব খন্ডের লিংক একত্রে দেখুন এখানে]
এক
বইয়ের একেবারে প্রথম অধ্যায় আমরা দেখেছিলাম আলো এক প্রকার শক্তি। সেটা প্রাকৃতিক শক্তি। এমন শক্তি আর কী কী আছে? খুব সহজ তাই না। বিদ্যুৎ চুম্বুক, তাপ, আরেকটা আছে পারমানবিক শক্তি। এর মধ্যে চুম্বক ও বিদ্যুৎ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে আগেই। বাকি থাকে তাপ আর পারমানবিক শক্তি। পারমাণবিক শক্তির কথা পরে হবে।
আমরা আগের অধ্যায়গুলোতে দেখলাম, আলো, বিদ্যুৎ আর চুম্বক শক্তি আসলে আলাদা নয়। বরং তড়িৎচুম্বক শক্তির তিনটি ভিন্ন দশা হলো আলো বিদ্যুৎ ও চুম্বক শক্তি। শব্দ শক্তিকেও তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গে রূপান্তর করা যায় বেতার যন্ত্রের সাহায্যে। তবু আলো-চুম্বক ও বিদ্যুৎ শক্তি থেকে শব্দ শক্তি আলাদা। শব্দ মূলত যান্ত্রিক শক্তি। সেখানে বায়ুমন্ডল নেই সেখানে এই শক্তির কোনো অস্তিত্ব নেই। তাই একে একেবারে প্রাকৃতিক শক্তির কাতারে ফেলা যায় কিনা, তাতে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আলো, বিদ্যুৎ আর চুম্বক শক্তি শূন্য মাধ্যতেও প্রভাব বিস্তার করতে পারে। তৈরি করতে পারে বলক্ষেত্র। কিন্তু শব্দ মাধ্যম ছাড়া চলতে পারে না। শূন্যমাধ্যম বলক্ষেত্রও তৈরি করতে পারে না। তাই শব্দকে তড়িৎচুম্বকীয় শক্তির সাথে ঠিক মেলানো যায় না। তাহলে বাকি যে শক্তিটা রয়েছে সেটা কী? তাপের কথা বলা হচ্ছে।
তাপ কি শব্দের মতো অপ্রাকৃত শক্তি?
তাপও মাধ্যমের সাহায্যে চলে। তবে তাপের চলাচলাচলের তিনটি প্রক্রিয়া আছে। পরিবহন, পরিচালন ও বিকিরণ। পরিবহন ও পরিচালন পদ্ধতিতে তাপ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে মাধ্যমের দরকার হয়। তবে এ প্রক্রিয়ায় তাপ বেশিদূর যেতে পারে না। মধ্যমের অণুগুলো এক সময় তাপ শোষণ করে তাপের শক্তি নিঃশেষ করে ফেলে। তাপ বহুদূর যেতে পারে কেবল বিকিরণ পদ্ধতিতে। বিকিরণ পদ্ধতিতে তাপ সঞ্চালন হতে কোনো মাধ্যমের দরকার হয় না। প্রমাণ পেতে বেশিদূর যেতে হয় না।
আমাদের পৃথিবীতে যে তাপের এত কারবার, এর প্রধান উৎস সূর্য। সূর্য থেকে পৃথিবীর দুরত্ব ১৬ কোটি কিলোমিটার। আমাদের পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের সীমা বেশিদূর পর্যন্ত বিস্তৃত নয়। বায়ুমন্ডলের শেষ ভাগ থেকে সূর্য পর্যন্ত প্রায় ১৫ কোটি কিলোমিটার শূন্যস্থান। এই স্থান পেরিয়েই সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো এসে পৌঁছায়। সেটা কীভাবে সম্ভব? সম্ভব, যদি তাপেরও তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গের মতো বৈশিষ্ট্য থাকে।
আধুনিক বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে সূর্য থেকে পৃথিবীতে তাপ আসে আলোর গতিতে। আর এই বিষয়টিই তাপ আর মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ খুঁজে বের করতে সহায়তা করেছে বিজ্ঞানীদের। তবে আগেকার বিজ্ঞানীদের হাতে কাল্পনিক হাতিয়ার ছিল। তাঁরা ইথারে বিশ্বাস করতেন। আর ভাবতেন ইথারই বোধহয় তাপকে সূর্য থেকে পৃথিবীতে বয়ে আনে। আমরা ইথারের পতন নিয়ে আগের অধ্যায়গুলোতে আলোচনা করেছি।
বিকিরণ তাপের কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। আলোর মতো বিকিরণ শক্তিও প্রতিফলন, প্রতিসরণ, অপবর্তন ও ব্যাতিচার ধর্ম মেনে চলে।
দুই
কোনো বস্তুর ওপর বির্কীণ তাপ পড়লে সেখানে তিনটি ঘটনা ঘটে। কিছু কিছু বিকির্ণ শক্তি ওই বস্তুটা শোষণ করে। কিছু পরিমাণ বিকির্ণ শক্তি বস্তু থেকে প্রতিফলিত হয়। কিছু শক্তি ওই বস্তু ভেদ করে চলে যায় ঠিক যেমনটা ঘটে আলোর ক্ষেত্রে। অনেকে হয়তো বলবেন, বস্তু স্বচ্ছ না হলে আলো ভেদ করে যায় কীভাবে? দৃশ্যমান আলো অস্বচ্ছ বস্তু ভেদ করতে পারে না। রেডিও তরঙ্গ, এক্স রে, গামা রে এদের কিন্তু ভেদনক্ষমতা যথেষ্ট। আসলে আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের ওপর নির্ভর করে সে অস্বচ্ছ বস্তু ভেদ করতে পারবে কি পারবে না। বিকির্ণ তাপ বা শক্তির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। কিন্তু এমন কোনো বস্তু আছে যে আলোকে পুরোপুরি গ্রাস করে নিতে পারে?
সবরকম আলো, বিকির্ণ তাপ শক্তি সে বস্তু শোষণ করবে, এমন একটা বস্তুর কথা ভাবলেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু বাস্তবে এমন বস্তু মিলল না। দেখা যায় কালো রংয়ের বস্তু সবচেয়ে বেশি আলো তাপ শোষণ করতে পারে। কেন পারে? আসলে কালো কোনো রং নয়। কালো মানে রংয়ের অভাব। কোনো বস্তুর ওপর আলো পড়লে সেই বস্তু থেকে প্রতিফলিত হয় কিছু আলো। বাকি আলো শোষণ করে নেয় সেই বস্তু। কিন্তু দৃশ্যমান আলোক বর্ণালির সর রংয়ের আলো সব বস্তু শোষণ করতে পারে না। গাছের পাতা সূর্যের সাদা আলো থেকে সবুজ বাদে সবকটা রংয়ের আলো শোষণ করে নেয়। কিন্তু সবুজ আলো শোষণ করতে পারে না। সবুজ আলো প্রতিফলিত হয়ে আমাদের চোখে এসে পড়ে বলেই গাছের পাতা আমরা সবুজ দেখি। তেমনি শরীরের রক্ত লাল বাদে সব আলো শোষণ করে নেয় বলে রক্তের রং লাল।
এতো গেল দৃশ্যমান বর্ণালীর কথা। কিন্তু সে যেসব আলো দেখতে পাই না সেগুলো যদি প্রতিফলিত বা শোষিত হয় তখন কী হয়?
বস্তুর রংয়ের ক্ষেত্রে দৃশ্যমান আলো মূল ভূমিকা পালন করে। তাই অদৃশ্য আলো যেমন রেডিও তরঙ্গ, গামা রে ইত্যাদি বস্তুর স্বাভাবিক রংয়ের ওপর কোনো প্রভাব ফেলে না। কিন্তু ওসব আলো নাইট ভিশন চশমা দিয়ে অন্ধকারে দেখতে কাজে লাগে। শরীরের ভেতরের রোগ-ব্যাধির ছবি তুলতেও অদৃশ্য আলোর ভূমিকা বিরাট। কিন্তু সেসব আমাদের আলোচনা বিষয় নয়।
আবার ফিরে আসি কালো বস্তুতে। কালো বস্তু মূলত দৃশ্যমান আলোর প্রায় সবটুকুই শোষণ করে নেয়। তাই কোনো রং আমরা দেখতে পারি না। আর রংয়ের অভাবের কারণেই সেই বস্তুটার রং কালো। এখানে কিন্তু একটা ঘাপলা আছে। কোনো বিজ্ঞ বন্ধু হয়তো প্রশ্ন করে বসতে পারেন, কালো বস্তু আলো প্রতিফলন যদি না-ই করবে, তা হলে তাকে আমরা দেখি কী করে?
হুম, প্রশ্ন বটে একখান। আগেই বলেছি, কালো বস্তু দৃশ্যমান আলোর ‘প্রায় সবটুকুই’ শোষণ করে নেয়। ‘প্রায় সবটুকু কিন্তু ‘সবটুকু’ নয়।
কিন্তু বিজ্ঞানীদের তো ‘প্রায়ই’-এ মন ভর না। তারা একটা আদর্শ কালো বস্তু চাইলেন। যে বস্তু সব আলো শুষে নেবে। দৃশ্যমান অদৃশ্যমান সব। শুষে নেবে বিকির্ণ শক্তি ও তাপ। কিছু ফিরিয়ে দেবে না। কিন্তু এমন কালো বস্তুর সন্ধান মিলল না। সুতরাং কল্পিতই থেকে গেলো আদর্শ কালো বস্তু। বিজ্ঞানীরা যার নাম দিলেন ‘ব্ল্যাক বডি’। ভালো বাংলায় যাকে বলে আদর্শ কৃষ্ণবস্তু। ‘কৃষ্ণবস্তু’ কথাটা একটা উচ্চমার্গীয়। কিন্তু শুনতে ভাল লাগে, তাই আমরা আদর্শ কালোবস্তু বা শুধু ‘কালো বস্তু’ না বলে ‘কৃষ্ণবস্তু’ লিখব।
পৃথিবীতে যত কালো বস্তু আছে আদর্শ কৃষ্ণবস্তুর কাছাকাছি হলো কালো ভেলভেট। কিন্তু কালো ভেলভেটও আদর্শ কৃষ্ণ বস্তু নয়। সেও কিছুটা আলো ফিরিয়ে দেয়। কিন্তু পদার্থ-বিজ্ঞানে ‘আদর্শ’ বিষয়টা বহু পুরোনো। প্রায় সবক্ষেত্রেই, কোনো না কোনো বস্তুকে বা মানকে আদর্শ ধরে নেওয়া হয়। যেমন, আদর্শ তাপমাত্রা, আদর্শ চাপ। মাপজোখের ক্ষেত্রে পানিকে আদর্শ বস্তু ধরে অনেক হিসাব-নিকাশ কষতে হয়। বিবিকিরণ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেও আদর্শ কৃষ্ণবস্তু অপরিহার্য হয়ে উঠল। তখন বিজ্ঞানীরা ভাবলেন তারা পরীক্ষাগারেই কৃষ্ণবস্তু তৈরি করবেন।
আদর্শ কৃষ্ণবস্তুর প্রথম ধারণা দেন বিজ্ঞানী গুস্তভ কার্শফ ১৮৬০ সালে। ১৮৯৫ সাল নাগাদ কৃষ্ণ বস্তু তৈরি হয়। এরমধ্যে ফেরি আর ভিয়েনের কৃষ্ণবস্তু বেশি পরিচিত। ফেরির কৃষ্ণবস্তুটা দুই দেয়ালের ধাতব গোলক দিয়ে তৈরি। গোলকটির দুই দেয়ালের মধ্যে বায়ুশূন্য ফাঁপা। কেন্দ্রভাগও ফাঁপা। বাইরের দেয়ালের বাইরের পৃষ্ঠ নিকেল দিয়ে পালিশ করা। ভেতরের দেয়ালের ভেতরের পৃষ্ঠে থাকে ভুষা বালির প্রলেপ। গোলকের একদিকে ছোট্ট একটা ছিদ্র থাকে। ছিদ্রের ঠিক উল্টো দিকে দেয়ালে আছে পিরামিডের মতো একটা তল।
ছিদ্র দিয়ে ঢোকা বিকির্ণ তাপ শক্তি সেই পিরামিড তলে গিয়ে পড়ে। পিরামিড তলের কারণে আলো আর সোজা বিপরীত পথে ফিরে আসতে পারে না। বিকির্ণ তাপশক্তি সেই তলে প্রতিফলিত ও শোষিত হয়। প্রতিফলিত রশ্মি গিয়ে আবার দেয়ালের আরেক স্থানে পড়ে। সেখানেও বিকির্ণ তাপশক্তি শোষিত ও প্রতিফলিত হয়। সেখান প্রতিফলিত রশ্মি আবার দেয়ালের আরেক জায়গায় পড়ে। এভাবে বার বার প্রতিফলিত হবার ফলে সকল স্থানে কিছু না কিছু শক্তি শোষিত হয়। বিকিরণের শক্তি ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ে। একসময় পুরো বিকির্ণ শক্তিই দেওয়ালের বিভিন্ন স্থানে শোষিত হয়ে পুরোপুরি শক্তি হারিয়ে ফেলে। অর্থাৎ সবটুকু শক্তি শোষণ করে নেয়, সেই কৃষ্ণবস্তু।
ভীনের কৃষ্ণবস্তু গোলাকার নয়, আয়তাকার। তবে কার্যপদ্ধতি একই। যাইহোক, এবার ফিরে আসার যাক কৃষ্ণবস্তুর কারিশমায়।
কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণের ওপর প্রথম একটা সূত্রটাও দিয়েছিলেন জার্মান পদার্থবিদ গুস্তভ কার্শফ। তিনি বলেন, কোনো বস্তুর তাপমাত্রা যদি পরিবেশের তাপমাত্রার চেয়ে কম হয়, সেই বস্তু নির্দিষ্ট তরঙ্গ দৈর্ঘের বিকিরণ শোষণ করে নিজের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করবে। আবার কোনো বস্তুর তাপমাত্রা যদি পরিবেশের তাপমাত্রার চেয়ে বেশি হয় তবে সেই বস্তু নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘের আলো বিকিরণ করে তরঙ্গদৈর্ঘ হ্রাস করবে।
তখনাকার বিজ্ঞানীরা জানতেন, কোনো বস্তুকে ক্রমাগত উত্তপ্ত করতে থাকলে তার বিকিরণের পরিমাণটাও বাড়তে থাকে। সাথে সাথে বিকিরণের রংয়েরও পরিবর্তন ঘটে। একটা লোহাকে উত্তপ্ত করলে বিকিরণের ব্যপারটা স্বচক্ষে দেখা সম্ভব।
লোহাকে উতপ্ত করলে প্রথমে লোহা শুধু গরমই হবে। রংয়ের কোনো পরিবর্তন হবে না। কিন্তু আরও উতপ্ত করলে তখন হালকা লাল রংয়ের আভা দেখা দেবে। তারমানে বিকিরণের রং পরিবর্তনের বিষয়টা তখন স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এখন যদি তাপমমাত্রা আরও বৃদ্ধি করা যায়? লোহার রং তখন গাঢ় লাল হয়ে উঠবে। তাপমাত্রা ৫০০ ডিগ্রির ওপরে উঠলেই কেবল লোহার রং লাল হবে। তাপাত্রা ৮০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠলে গরম লোহা তখন ছড়াবে উজ্বল হলুদ দ্যূতি। তারমানে বিকিরণের তৈরঙ্গদৈর্ঘ্য কমছে। কারণ লালের চেয়ে হলুদ রংয়েল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য কম। লাল থেকে কিন্তু সরাসরি লোহার রং একবারেই হলুদ হয় না। ৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের পরে তাপমাত্রা ধীরে বাড়াতে একসময় কমলা রং দেখা যাবে।
৮০০ ডিগ্রি থেকে তাপমাত্রা ধীরে ধীরে বাড়াতে থাকলে নিউটনের বর্ণালী বেনিআসহকলার বাকি রংগুলোও একে একে দেখা যাবে। সবুজ, আসমানী, নীল আর বেগুনি। তারপর লোহার তাপমাত্রা বাড়তে বাড়তে একসময় হবে সূর্য পৃষ্ঠের সমান। তখন সেই উতপ্ত লোহার রং উজ্জ্বল সাদা দেখাবে।
কোনো বস্তুর তাপমাত্রা কতটা বাড়ালে কতটুকু কতটুকু তাপ কিংবা আলোকরশ্মি বিকিরণ করবে সেটা তুলনা করার জন্য একটা আদর্শ কৃষ্ণবস্তুর দরকার হয়ে পড়ে।
আদর্শ কৃষ্ণবস্তু তৈরি হলো। বিজ্ঞানীরা সেটা নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন। লোহার টুকরোর মতো কৃষ্ণবস্তুকেও উতপ্ত করা হলো। ধরা যাক, ৭০০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় কৃষ্ণবস্তুকে উৎপত্ত করা হয়েছে। ওই তাপমাত্রায় কৃষ্ণবস্তুটি যে তাপমাত্রা ও আলোকরশ্মি বিকিরণ করবে তা অন্য যেকোনো বস্তুর চেয়ে বেশি। কারণ কোনো বস্তুই কৃষ্ণবস্তুর মতো শতভাভাগ তাপমাত্রা শোষণ করতে পারে না। তাই কোনো বস্তুর বিকির্ণ তাপ ও আলো কৃষ্ণবস্তুর সমান হবে না।
কৃষ্ণবস্তু তো পাওয়া গেল, এবার এর বিকিরণের জন্য একটা সমীকরণ দরকার। বিকিরণ সম্পর্কিত প্রথম সমীকরণটা দাঁড় করালেন দুই অস্ট্রিয়ান বিজ্ঞানী জোসেফ স্টিফেন ও লুডভিগ বোলৎজম্যান। সেটা হলো,
এই সূত্রের সার কথা হলো কৃষ্ণবস্তু থেকে তাপ ও আলোর আকারে বিকির্ণ মোট শক্তি E-এর পরিমাণ বস্তুর পরম তাপমাত্রা T-এর সমানুপাতিক। সমীকরণে একটা ধ্রুবক K ব্যবহার করা হয়েছে, এটা বোলৎজম্যান ধ্রুবক।
পরম তাপমাত্র কি? একটা প্রশ্ন। সেটা জানতে হলে জানতে হবে পরমশূন্য তাপমাত্রা কী? প্রকৃতিতে এমন একটা তাপমাত্রা আছে যার এর নিচে কোনো বস্তুর তাপমাত্রা নামতে পারে না। সেই তাপমাত্রায় সকল গ্যাসের আয়তন গাণিতিকভাবে শূন্য। কেলভিন স্কেলে এই তামাত্রার মান শূন্য ডিগ্রি কেলিভিন। সেলসিয়াস স্কেলে সেই তাপমাত্রার মান ২৭৩.১৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বিট্রিশ বিজ্ঞানী লর্ড কেলভিন পরমশূন্য পরম তাপমাত্রার ধারণা দেন। শুন্য ডিগ্রি কেলভিন -২৭৩ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রার ওপরে যেকোনো তাপমাত্রাই বস্তুর পরম তাপমাত্রা হতে পারে।
ধরা যাক, কৃষ্ণবস্তুর পরম তাপমাত্রা দ্বিগুণ করা হলো। তাহলে সমীকরণ অনুসারে বিকির্ণ শক্তির পরিমাণ বাড়বে ১৬ (২x২x২x২) গুণ। পরম তাপমাত্রা ৩ গুণ বাড়ালে বিকির্ণ শক্তির পরিমাণ বাড়বে ৮১ গুণ!
১৮৯৩ সালে জার্মান পদার্থবিদ উইলহেম ভীন কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণের আরেকটি সূত্র আবিষ্কার করেন। এই সূত্রে ভীন বলেন, বস্তুর তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে কৃষ্ণবস্তু যে পরিমাণ বিকিরণ নিঃসরণ করে তার সর্বোচ্চ তরঙ্গদৈর্ঘ্য ক্রমেই কমতে থাকে। ধরা যাক, সাধারণ তাপমাত্রায একটা কৃষ্ণবস্তু একই সাথে অনেকগুলো আলোকরশ্মি বিকিরণ করে। এদের মধ্যে সর্বোচ্চ তরঙ্গদৈর্ঘ্য ও সবচেয়ে ছোট তরঙ্গদৈর্ঘের বিকিরণ থাকে সবচেয়ে বেশি।
ধরা যাক, একটা স্বাভাবিক তাপমাত্রায় সর্বোচ্চ তরঙ্গদৈর্ঘের বিকিরণ হলো বেতার তরঙ্গ। কৃষ্ণবস্তুর তাপমাত্রা বাড়ানো হোক এবার । তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে রেডিও তরঙ্গের বিকিরণ কমতে থাকতে থাকবে। একসময় দেখা যায় কৃষ্ণবস্তু লাল আলো বিকিরণ করতে শুরু করেছে। তখন বিকিরণে বর্ণালীর সবচেয়ে উজ্বল লং আলো হবে লাল। সর্বোচ্চ তরঙ্গদৈর্ঘ্যও তখন লালের। এরপর কৃষ্ণবস্তুর সবচেয়ে উজ্জ্বল রং হবে পর্যায়ক্রমে কমলা, হলুদ, সবুজ, আসমানী, নীল, বেগুনি ইত্যাদি। অর্থাৎ তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে বিকিরণের তরঙ্গদৈর্ঘ্য কমতে থাকে। কমতে কমতে নিউটনের বর্ণালী অনুযায়ী লাল থেকে বেগুনির দিকে যাবে। ভীনের সূত্র বলে, সর্বোচ্চ তাপমাত্রায় সবচেয়ে বড় উজ্জ্বল বিকিরণ হওয়ার কথা বেগুনি রংয়ের। অর্থাৎ কৃষ্ণবস্তুটির চেহারা তখন বেগুনি রংয়ের হওয়া উচিৎ। কিন্তু পরীক্ষা করে ফল পাওয়া গেল অন্যরকম। বেগুনি আলোতে আসার পরও কুষ্ণবস্তুতে তাপমাত্রা বাড়ানো যায়। এবং সর্বোচ্চ তাপমাত্রায় বস্তুটি উজ্জ্বল সাদা রং বিকিরণ করে।
তাহলে কি ভীনের সূত্র ভুল? বিজ্ঞানীরা বললেন, না ভুল নয়। সর্বোচ্চ তাপমাত্রায় বেগুনি রংয়ের বিকিরণের পাশাপাশি অন্য রংয়ের বিকিরণও কমবেশি থাকে। তাই সব মিলেমিশে সাদা রং ধারণ করে কৃষ্ণবস্তু।
তাই যদি হয়, এরপরেও কি তাপমাত্রা বাড়ানো সম্ভব? অঙ্ক বলে সম্ভব। আর এখানেই গোলবেঁধে যায়। গণিতিক আর পরীক্ষালব্ধ ফলে বিরোধ দেখা যায়। ভীনের সূত্রে সমাধান মেলে না। ১৮৯০ দশকের শেষদিকে দুই বৃটিশ পদার্থবিদ লর্ড রেলে আর জেমস জিনস কৃষ্ণ বস্তুর নতুন একটি সূত্র দিলেন।
আমরা এর আগে স্টিফেন-বোলৎসম্যান এবং ভীনের দুটো সূত্র দেখলাম। দুটো দুইভাবে কুষ্ণবস্তুর বিকিরণ ব্যাখ্যা করতে পারে। কিন্তু একই সাথে দুই ধরনের ব্যাখ্যা কোনো সূত্রই করতে পারে না। তারমানে স্টিফেন-বোলৎসম্যান সূত্র কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণের সবগুলো বৈশিষ্ট্যের অর্ধেক ব্যাখ্যা করতে পারে। বাকি অর্ধেক ব্যাখ্যা করতে হলে ভীনের দ্বারস্থ হতে হয়। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞান সবসময় ঐক্যবদ্ধ সূত্র দাবি করে। যেমনটি করেছিলেন নিউটন। নিউটন তাঁর সূত্রে দেখিয়েছিলেন যে কারণে একটা আপেল গাছ থেকে পড়ে সেই একই কারণে পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘোরে। ম্যাক্সওয়েল দেখিয়েছিলেন যে বলের কারণে একট চুম্বক লোহার টুকরোকে আকর্ষণ করে, সেই একই বলের কারণে বৈদ্যুতিক পাখা ঘোরো। আবার সেই একই বল লুকিয়ে থাকে আলোর ভেতরেও।
কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণের ক্ষেত্রেও এমন একটা ঐক্যবদ্ধ তত্ত্বের দরকার হয়ে পড়ল। আর সে চেষ্টাই করলেন রেলে-জিনস। রেলে-জিনস তাদের সূত্রে বললেন, কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণের তীব্রতা তাদের পরমশূন্য তাপমাত্রার সমানুপাতিক এবং তরঙ্গদৈর্ঘের ব্যস্তানুপাতিক। তবে এই সূত্রটা সেভাবে সফলতার মুখ দেখেনি। ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘের তরঙ্গের ব্যাখ্যা দিতে পারলেও বৃহৎ তরঙ্গদৈর্ঘের বিকিরণের ব্যাখ্যা দিতে পারে না রেলে-জিনস তত্ত্ব। এই তত্ত্ব থেকে দেখা যায়, তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে বিকিরণের তরঙ্গদৈর্ঘ্য ক্রমেই কমতে থাকে।
কমতে কমতে তরঙ্গদৈর্ঘ কত ছোট হবে? রেলে-জিনস তত্ত্ব বলে সেটা অসীমেও চলে যেতে পারে। তার মানে, তাপমাত্রা যখন সর্বোচ্চ তখন এর তরঙ্গদৈর্ঘ অসীম মানের ক্ষুদ্র হবে। কিন্তু আলো কিংবা বিকিরণের তরঙ্গদের্ঘ্য কমতে কতে কি অসীম পরিমাণ ক্ষুদ্র হওয়া সম্ভব? সম্ভব নয়। বড়জোর শূন্য হতে পারে। সত্যি বলতে কি, বাস্তবে কোনও তরঙ্গেরই তরঙ্গদৈর্ঘ্য শূন্য হওয়া সম্ভব নয়। তরঙ্গদৈর্ঘ্য শূন্য হলে তরঙ্গ তত্ত্বই ভেঙে পড়ে। তরঙ্গ হতে হলে তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য শূন্য হলে চলবে না। নূন্যতম মান থাকতে হবে। সেই মানটা কত, সেটা পরের অধ্যায়েই আমরা জানতে পারব।
আবার ফিরে যায় রেলে-জিনস তত্ত্বে। তরঙ্গ দৈর্ঘ্য শূন্য আর অসীমের কথা বাদই দিলাম। রেলে-জিনস তত্ত্ব যদি আংশিক ঠিক হয় তবে ‘বেগুনি বিপর্যয়’ ঘটার কথা। সেটা আবার কেমন। রেলে-জিনসের সূত্রানুযায়ী, তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণের তরঙ্গদৈর্ঘ্য কমতে থাকবে। কমতে একসময় বেগুনি আলোতে পৌঁছুবে। তারপর আরও কমলে কৃষ্ণবস্তুর রং অতিবেগুনিতে পৌঁছে যাবে। তারপর আরও ছোট তরঙ্গদৈর্ঘের আলো বিকিরণ করবে। এই যে বেগুনি বিকিরণের পরেও তরঙ্গদৈর্ঘ্য কমতে থাকে, একেই বিজ্ঞানীরা ‘বেগুনি বিপর্যয়’ নাম দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবে বেগুনি বিপর্যয়ের কোনো হদিস মেলেনি।
তাহলে অঙ্ক একরকম বলছে, পরীক্ষার ফল বলছে আরেকরকম। পর্দাবিজ্ঞানের কোনো পরীক্ষার ফল যদি অঙ্ক দিয়ে না মেলানো যায় তবে সেটার কোনো মূল্যই থাকনে। গণিতের ছাঁচে তাকে ফেলতেই হবে। কিন্তু কোনোভাবেই কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণকে পরিপূর্ণ একটা গাণিতিক কাঠামোত দাঁড় করানো গেল না। নিউটনের বলবিদ্যা তো এক্ষেত্রে একেবারেই অচলই। ব্যর্থ ম্যাক্সওয়েলের তড়িৎগতিবিজ্ঞানও।
তাহলে উপায়? কে দেবে এর সমাধান। তখনই দৃশ্যপটে হাজির পদার্থবিজ্ঞানের আরেক বিপ্লবী ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক। তবে তাঁর গল্প আর এই অধ্যায়ে নয়।
[বইটির সূচীপত্র এবং সব খন্ডের লিংক একত্রে দেখুন এখানে]
-আব্দুল গাফফার রনি
বিজ্ঞান লেখক
[লেখকের ফেসবুক প্রোফাইল]
বিজ্ঞান পত্রিকা প্রকাশিত ভিডিওগুলো দেখতে পাবেন ইউটিউবে। লিংক:
১. টেলিভিশনঃ তখন ও এখন
২. স্পেস এক্সের মঙ্গলে মানব বসতি স্থাপনের পরিকল্পনা