কাগজে-কলমে শ্বেত গহ্বরের (white hole) অস্তিত্ব আছে আর এই ধারনা কৃষ্ণগহ্বরের (black hole) ধারনার ঠিক উল্টো। কৃষ্ণগহ্বর সবকিছু টেনে নেয়, আর শ্বেত গহবর সব কিছু উগড়ে দেয়। কৃষ্ণগহ্বরের ফাঁদ থেকে কিছুই বেরিয়ে আসতে পারে না, আর শ্বেত গহ্বর কিছুই ধরে রাখতে পারে না।
আপেক্ষিকতার গাণিতিক গণনার হিসেবে আমরা উভয় ধরনের গহ্বরই পেয়ে থাকি, কিন্তু কৃষ্ণগহ্বরের কথা শোনা যায় অথচ শ্বেত গহ্বরের কথা শোনা যায় না কেন? কারণ, শ্বেত গহ্বরের অস্তিত্ব সনাক্ত হয়নি তবে গাণিতিক ভাবে এদের উপস্থিতি সম্ভব। আরেকটি বিষয় হলো, সময়কে আমরা শুধু অতীত থেকে ভবিষ্যৎমুখেই প্রবাহিত হতে দেখি। কিন্তু আপেক্ষিকতা অনুযায়ী ঋনাত্মক দিকেও সময় অতিবাহিত হতে কোনো সমস্যা থাকার কথা নয়। কাজে যদি কখনো কোনো শ্বেত গহ্বর তৈরি হয়েও যায়, তা হবে খুবই অস্থিতিশীল এবং মূহুর্তের মধ্যেই রূপান্তরিত হয়ে কৃষ্ণ গহ্বরে পরিণত হয়ে যাবে।
আরেকটি সমস্যা হলো এন্ট্রপি। নানাবিধ প্রক্রিয়ায় সার্বিকভাবে জগতের এনট্রপি বৃদ্ধি পাওয়ার কথা, কিন্তু কনসেপ্ট অনুযায়ী শ্বেতগহবর এন্ট্রপি হ্রাস করবে। কাজেই যদি কোথাও শ্বেত গহ্বর তৈরি করতে হয়ে তাহলে তা হবে বাহ্যিক এন্ট্রপির পরিমান বিপুলভাবে বৃদ্ধি করে যাতে সার্বিকভাবে প্রক্রিয়াটিতে এন্ট্রপির পরিমান বৃদ্ধি হয়।
যেহেতু, শ্বেত গহ্বরগুলো হচ্ছে বিপরীত-কৃষ্ণগহ্বর তাই এরাও একটি মহাকর্ষীয় সিঙ্গুলারিটি তৈরি করবে। এই সিঙ্গুলারিটি হচ্ছে স্থান-কালের একটি বিন্দু যেখানে মহকর্ষীয় ক্ষেত্র অসীমাকার ধারন করবে। তবে শ্বেত গহ্বরগুলোর ক্ষেত্রে কৃষ্ণগহ্ববরের মত কোনো ইভেন্ট হরাইজন থাকবে না। সাধারণ আপেক্ষিকতার নীতিমালা অনুসারে মহাবিশ্ব ইভেন্ট হরাইজনযুক্ত এধরনের সিঙ্গুলারিটি ধারণ করতে পারে না, কেননা ইভেন্ট হরাইজনের প্রসঙ্গ টানা হয়েছিলো কৃষ্ণগহ্বরের সন্নিকটে স্থান-কালের ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য। তবে নতুন কিছু তত্ত্ব ইভেন্ট হরাইজন ছাড়াই শ্বেত গহ্বরের সিঙ্গুলারিটির অস্তিত্ব ব্যাখ্যা করছে।
জোতিঃপদার্থবিদগণ সবসময়ই ভেবেছেন কোনো বস্তু যখন কৃষ্ণগহবরের অভ্যন্তরে পতিত হয় তখন তাতে তথ্যের বিনাশ ঘটে কিনা? এই ভাবনা থেকে ২০১৪ সালে একটি নেচারে প্রকাশিত গবেষণাপত্র অনুযায়ী একটি সিমুলেশন চালানো হয় যাতে দেখা যায়, কৃষ্ণগহ্বরের জীবনের শেষ পর্যায় এটি একটি শ্বেত গহ্বরে পরিণত হচ্ছে এবং এটি যেই বস্তুগুলো এতদিন শোষনকরে নিয়েছিলো সেগুলো আবার বের করে দিচ্ছে।
ফ্রান্সেরএইক্স মার্সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্লো রোভেল্লি এবং হ্যাল হ্যাগার্ডের মডেল অনুযায়ী একটি কৃষ্ণগহ্বর গঠিত হওয়ার পরপরই লুপ কোয়ান্টাম গ্রাভিটি নামক প্রক্রিয়ায় কৃষ্ণগহ্বর শ্বেত গহ্বরে পরিণত হওয়ার কথা। এর অর্থ হলো, যখন একটি তারকা তার নিজের অভিকর্ষের কারণে ক্রমশঃ সংকুচিত হতে শুরু করে এটি একটি মাত্র পর্যন্ত এই প্রক্রিয়াটি চালিয়ে যায়। তারপর একসময় এটি আর সংকুচিত হতে পারে না এবং কোয়ান্টাম বাউন্স নামক একপ্রকার চাপ প্রযুক্ত হয়। এই পরিস্থিতিতে এটি একটি শ্বেত গহ্বরে পরিণত হয়। এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি ঘটতে এক সেকেন্ডে সহ্স্রভাগ মাত্র সময় লাগতে পারে। তবে এই অবস্থায় যেহেতু এখানে আপেক্ষিকতা অনুযায়ী কাল দীর্ঘায়ণ ঘটবে কাজেই বাইরে থেকে দেখলে এই প্রক্রিয়াটি ঘটতে শতকোটি বছর লাগতে দেখা যাবে।
২০০৬ সালে হয়তোবা শ্বেত গহ্বর পর্যবেক্ষণ করার একটি ঘটনা ঘটেছিলো যখন বিজ্ঞানীরা হঠাৎ করে শূন্য হতে বিপুল পরিমান সাদা আলোর বিস্ফোরণ ঘটতে দেখেছিলেন এবং তা পুনরায় শূণ্যে মিলিয়ে গিয়েছিলো। তবে তদোবধি এধরনের আর একটি ঘটনাও তাঁরা পর্যবেক্ষণ করতে পারেন নি ফলে নতুন কোনো তথ্যও পাওয়া যায় নি এই বিষয়ে। দশ বছর আগের সেই ঘটনাটির মতো আরেকটি ঘটনা পর্যবেক্ষণ না করা পর্যন্ত আমরা কেবল অপেক্ষাই করে যেতে পারি। কিন্তু এভাবে চিন্তু করে দেখুন, জ্ঞানের অগ্রগতির এক পর্যায়ে কৃষ্ণগহ্বরও কেবল একটি তাত্ত্বিক ধারনাই ছিলো, কাজেই আমরা যদি শ্বেত গহ্বরের বাস্তব অস্তিত্বের বিষয়ে আশাবাদী হই তাহলে তা হয়তো পাগলামী হবে না।
⚫ বিজ্ঞানপত্রিকা ডেস্ক
বিজ্ঞান পত্রিকা প্রকাশিত ভিডিওগুলো দেখতে পাবেন ইউটিউবে। লিংক:
১. টেলিভিশনঃ তখন ও এখন
২. স্পেস এক্সের মঙ্গলে মানব বসতি স্থাপনের পরিকল্পনা
3. মাইক্রোস্কোপের নিচের দুনিয়া