চাঁদে মানুষ গমনের বিষয় নিয়ে সন্দেহ ও বাস্তবতা

10
2001

মানুষ ফ্যান্টাসী পছন্দ করে। বস্তবতার কাটখোট্টা জগৎ তাকে যথাযথভাবে বিনোদিত বা আকৃষ্ট করে না। ফলে একশ্রেনীর মানুষ বিভিন্ন ধরনের ঘটনা, তত্ত্ব এসবের বিকল্প ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা করে বা এধরনের কর্মকান্ডে সমর্থন ও আস্থা স্থাপন করে আনন্দ লাভ করে। এভাবেই বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব প্রচলিত হয়। এগুলোর প্রতিষ্ঠার পেছনে সামাজিক বা রাজনৈতিক কারণও জড়িত থাকে। গতশতাব্দীর সবচেয়ে বহুল প্রচলিত ষড়যন্ত্রতত্ত্বগুলো নির্মিত হয়েছে চাঁদে মানুষ অবতরণ নিয়ে। একশ্রেনীর মানুষের কাছে মানুষ্যবাহী চন্দ্রাভিযান পুরোপুরি ধাপ্পাবাজি হিসেবে পরিগণিত এবং এটি যে শুধু তাঁরা বিশ্বাস করেন তাই নয় এর স্বপক্ষে প্রচুর যুক্তি-প্রমাণ হাজির করেন। তবে বলাই বাহুল্য সেসব যুক্তি-প্রমাণে প্রচুর ফাঁক-ফোঁকর থেকে যায় আর সেকারণেই সেগুলো ষড়যন্ত্র তত্ত্ব হিসেবে পরিচিত। অথচ চাঁদে মানুষ পাঠানোর জন্য নাসা বিপুল সময় ধরে প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে, বিপুল পরিমান মানুষ এই অভিযানগুলো সফল করার জন্য কাজ করেছে। মানুষ চাঁদে যায়নি এর স্বপক্ষে এত বেশী যুক্তি-প্রমান হাজির করা হয়েছে যে সেসব বিস্তারিত লিখতে গেলে একটি বই হয়ে যাবে। তাই এখানে শুধুমাত্র উল্লেখযোগ্য কয়েকটি যেগুলো বহুল প্রচলিত এবং সাধারণ মানুষের একটি অংশেরও যেসব বিষয়ে কৌতুহল আছে সেগুলো ব্যাখ্যাপূর্বক খন্ডন করা হলো। যাঁরা এই বিষয়ে আরো বিস্তারিত জানতে চান তাঁরা এই উইকিপিডিয়া আর্টিকেলটি পড়তে পারেন।

ষড়যন্ত্র-১: চাঁদের মাটিতে মানুষ পা রাখেনি এই ষড়যন্ত্রতত্ত্বে যাঁরা বিশ্বাস করেন তাঁরা তাঁদের বিশ্বাসের পক্ষে যুক্তি হিসেবে চন্দ্রাভিযানের এইধরনের ছবিগুলো হাজির করেন। ছবিতে কালো আকাশে কোনো তারা দেখা যাচ্ছে না (নিচের প্রথম ছবি)। তাঁদের ভাষ্য হলো যেহেতু চাঁদে বায়ুমন্ডল নেই তাই সূর্যালোক চাঁদের বায়ুমন্ডলে বিক্ষিপ্ত হয়ে তারাগুলোকে অদৃশ্য করতে পারবে না। সেই ক্ষেত্রে ব্যাকগ্রাউন্ডে ঝকঝকে তারার অবস্থান থাকার কথা।

কিন্তু দ্বিতীয় ছবিটি দেখুন, এটি আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন (ISS) থেকে তোলা পৃথিবী পৃষ্ঠের ছবি যেটি পৃথিবীকেই আবর্তন করে ঘুরছে। একই যুক্তি অনুসারে এখানে ব্যাকগ্রাউন্ডে তারার উপস্থিতি থাকার কথা কিন্তু তা নেই। এই দ্বিতীয় ছবিটি নিয়েও যদি কারো সন্দেহ থাকে তাহলে এই লিংক থেকে ISS এর লাইভ ভিডিও সম্প্রচার দেখতে পাবেন, সেখানেও কোনো তারা নেই।

আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন থেকে তোলা পৃথিবীপৃষ্ঠের ছবি, পেছনে কালো পটভুমি।

ব্যাকগ্রাউন্ডে তারা না দেখা যাওয়ার কারণ হচ্ছে এক্সপোজার। ছবি তোলার সময় লেন্সের এক্সপোজার কমিয়ে বা বাড়িয়ে আলোর পরিমান নিয়ন্ত্রিত করা হয় (মূলতঃ শাটার স্পীডের মাধ্যমে তা করা হয়)। যদি এক্সপোজার বেশী হয় তাহলে অনেক ক্ষীণ আলোর উৎসও ছবিতে ধরা পড়বে। দিনের বেলায় চাঁদ এবং পৃথিবী পৃষ্ঠের তুলনায় তারাগুলোর উজ্জ্বলতা অতি অতি অতি ক্ষীণ। এই ছবিগুলোতে যদি এক্সপোজার বাড়ানো হতো তাহলে তারা হয়তো দৃশ্যমান হতো কিন্তু সেই ক্ষেত্রে চাঁদ ও পৃথিবী পৃষ্ঠ অতিরিক্ত এক্সপোজারের কারণে সাদা হয়ে যেত এবং এগুলোর পৃষ্ঠের অনেক বৈশিষ্ট্য ছবিতে আর পাওয়া যেত না। আর এই ছবিগুলোর সাবজেক্ট হচ্ছে যথাক্রমে চাঁদ ও পৃথিবীর পৃষ্ঠ, ব্যাকগ্রাউন্ডের কালো আকাশ নয় তাই ক্যামেরার এক্সপোজার এমনভাবে রাখা হয়েছে যাতে এদের পৃষ্ঠের বৈশিষ্ট্যগুলো ছবিতে স্পষ্ট থাকে। নিচের ছবিতে দেখানো হলো কীভাবে এক্সপোজার পরিবর্তনের মাধ্যমে অপেক্ষাকৃত ক্ষীণ আলোর উৎসগুলোর ছবিও তোলা যায় এবং সেই ক্ষেত্রে উজ্জ্বল আলোর উৎসগুলো ওভার এক্সপোজড হয়ে সাদা হয়ে যায়।


ষড়যন্ত্র-২: অনেকে মনে করেন যদিও চাঁদের মাটিতে বাতাস নেই কিন্তু চাঁদে যে পতাকা স্থাপন করা হয়েছে তার ছবিতে দেখা যায় পতাকা উড়ছে। এখান থেকে তাঁরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এটি আসলে অ্যারিজোনার মরুভূমিতে নির্মিত হয়েছে!

ব্যাখ্যা: একটু ভালো করে নিচের ছবিদুটো লক্ষ্য করুন, পতাকা কি সত্যিই উড়ছে?

বাজ অলড্রিন পতাকাকে স্যালুট করছেন।
বাজ অলড্রিন পতাকাকে স্যালুট করছেন।
স্যালুট শেষে হাত নামিয়ে আনার পরেও পতাকার অবস্থান একই আছে।
স্যালুট শেষে হাত নামিয়ে আনার পরেও পতাকার অবস্থান একই আছে।

পতকার একপাশ যেমন ফ্রেমের সাথে যুক্ত উপরের অংশও কিন্তু একটি টিউবুলার অ্যালুমিনিয়ামের ফ্রেমের মাধ্যমে যুক্ত। সেটি এই ছবি থেকে স্পষ্ট না বোঝার কোনো কারণ নেই। আর নিচের অংশ কুঁকড়ে আছে দেখে দূর থেকে মনে হতে পারে পতাকা উড়ছে, সেটি একটি ভিজুয়াল ইলুশন তৈরির জন্য আরোপ করা হয়েছে। আর দুটি ছবির পার্থক্যগুলো দেখুন। বাজ অলড্রিন প্রথম ছবিতে পতাকাকে স্যালুট করছেন। সেই স্যালুটকৃত অবস্থায় তার ডান হাত মাথায় ঠেকানো, ভালো করে লক্ষ্য করলে ডান হাতের দুটি আঙ্গুল দেখতে পাবেন হেলমেটের উপরে। দ্বিতীয় ছবিতে হাত নিচে নেমে এসেছে কিন্তু দুটি ছবিতেই পতাকার উড়ন্ত অবস্থা হুবহু একই আছে। যদি পতাকা বাতাসেই উড়ত তাহলে কি কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধান হুবহু একই রকমের কোঁকড়ানো অবস্থায় থাকত?

ষড়যন্ত্র-৩: “ঈগল মুন-ল্যান্ডার এবং পাথরের উৎপন্ন ছায়ার দিক ভিন্ন। চাঁদে কি দুইটা সূর্য আলো দেয়?”

ব্যাখ্যা: একই উৎসের ভিন্ন ভিন্ন বস্তুর ছায়ার দিক নির্ভর করবে অনেকগুলো বিষয়ের উপর এবং এসবের উপর নির্ভর করে ছায়ার দিক কিছুটা ভিন্ন ভিন্ন দেখাতে পারে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে দর্শক (এই ক্ষেত্রে ক্যামেরা), ছায়া ধারনকারী পৃষ্ঠের ঢাল, ক্যামেরার লেন্সের ওয়াইডনেস ইত্যাদি।

11887972_817195358377775_3488378326064972879_n
চাঁদের মাটিতে তোলা ছবি, ঈগল চন্দ্রযান এবং চন্দ্রপৃষ্ঠের কিছু বস্তুর ছায়া দেখে আলোক উৎস ভিন্ন মনে হচ্ছে।
11222395_817195361711108_5615785936942016715_n
ওয়ার্কশপে চাঁদে তোলা ছবির মতো করে মডেল তৈরি করে ছায়া পরীক্ষা করা হচ্ছে।

প্রথম ছবিটি চাঁদের পৃষ্ঠে তোলা। যে ছবিটি দেখে ষড়যন্ত্রকারীরা আলোর উৎস নিয়ে প্রশ্ন করে। এই ছবির বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের আদলে দ্বিতীয় ছবির সেট তৈরি করা হয়েছে ওয়ার্কশপে। চাঁদের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের আদলে তৈরি বস্তুর পাশাপাশি এতে একটি মার্কারও রাখা হয়েছে বোঝার জন্য। এই মার্কার এবং খেলনা মুনল্যান্ডারের ছায়া থেকে এটি স্পষ্ট যে এই দুটির ছায়া তৈরি হচ্ছে একই উৎস থেকে। কিন্তু মাঝের বস্তুগুলোর ছায়ার কোণ থেকে মনে হচ্ছে এদের আলোর উৎস ভিন্ন। কিন্তু এই বস্তুগুলো যে বন্ধুর পৃষ্ঠের উপরে অবস্থিত তাতে ছায়া যেভাবে পড়ার কথা সেভাবেই পড়েছে। চন্দ্রপৃষ্ঠের জন্যও বিষয়টি একই ভাবে সত্য। যদি মাঝের বস্তুগুলোর ছায়া অন্যান্য বস্তুর একই সমতলে থাকত তাহলে তাদের ছায়াও মোটামুটি একই দিকে উৎপন্ন হত। এই ছবি থেকে আরেকটি ষড়যন্ত্র করা হয় সেটি হচ্ছে অ্যাস্ট্রোনট যেহেতু ছায়ার মধ্যে আছে সেহেতু তাকে অন্ধাকাচ্ছন্ন দেখানোর কথা। কিন্তু দ্বিতীয় ছবি থেকে এই ষড়যন্ত্রটিও খন্ডিত হয়ে যায়। আলোর উৎস থেকে চন্দ্র পৃষ্ঠে যে পরিমান প্রতিফলন ঘটবে তা অ্যাস্ট্রোনটের সাদা পোশাকে যথেষ্ট উজ্জ্বলতা তৈরি করবে। বিষয়টি যদি এখনো কারো কাছে অস্পষ্ট থাকে তাহলে সে মিথবাস্টারের ভিডিওটি দেখে নিতে পারে যেখানে পরীক্ষার মাধ্যমে এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বটির অসাড়তা প্রমাণ করা হয়েছে।

ষড়যন্ত্র-৪: “চাঁদে মানুষ যদি প্রায় সাড়ে তিনযুগ আগে গিয়ে থাকে তাহলে এখন যেতে পারছে না কেন? এ থেকেইতো বোঝা যায় চাঁদে কখনোই মানুষ যায় নি।”

ব্যাখ্যা: এটি একটি অত্যন্ত খোঁড়া প্রশ্ন। এই প্রশ্ন অনুযায়ী বলা যায় ছোট বেলায় আমি যদি একবার কক্সবাজার বেড়াতে গিয়ে থাকি এবং বড় হয়ে যদি আর না যাওয়া হয় তা থেকে প্রমাণ হয় আমি কখনো কক্সবাজারই যাই নি!

চাঁদে অভিযান বেশ খরচ সাপেক্ষ। চন্দ্রাভিযান উপলক্ষে কাজ করার জন্য নাসা চার লাখ মানুষ নিয়োগ দিয়েছিলো। চাঁদে মানুষ ছয়বার অভিযান করেছে এবং সেটি যেই প্রোজেক্টের আওতায় করা হয়েছিলো তা এখন আর বিদ্যমান নেই। এমনকি অ্যাপোলো প্রজেক্টের আওতায় আরো তিনটি অভিযান (অ্যাপোলো-১৮-২০) চালানোর কথা ছিলো কিন্তু বড় ধরনের প্রয়োজন ছিলনা বিধায় সেগুলো বাতিল করে দিয়ে সেই ফান্ড এবং সেই কাজে নিয়োজিত বাহন অন্য কাজে ব্যবহার করা হয়। মানুষ্যবাহী ছয়টি অভিযানে চাঁদে যেসব গবেষণা করার প্রয়োজন ছিলো যা করার জন্য মানুষ প্রয়োজন সেগুলো করা হয়েছে এবং চাঁদের শিলার যথেষ্ট পরিমান নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। এখন নতুন করে চাঁদে যেতে হলে পুরো প্রক্রিয়াটি আবার প্রথম থেকে শুরু করতে হবে, গভমেন্টকে রাজি করাতে হবে ফান্ডিংএর জন্য আর সত্যি বলতে এখন চাঁদে মানুষ পাঠানো খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। প্রথম যখন চাঁদে যাওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয় তখন রাশিয়ার সাথে স্পেস নিয়ে প্রতিযোগীতা ছিলো, গভমেন্টও তাই দু’হাতে টাকা দিতে কার্পন্য করেনি, এখন এমন কিছুও নেই।
যারা মনে করেন বিগত সাড়ে তিনযুগে প্রযুক্তিগতভাবে মানুষ অনেক অগ্রসর হয়েছে এখন মানুষ্যবাহী চন্দ্রাভিযান আরো সহজ হওয়ার কথা, তাই এখন চাঁদে মানুষ না পাঠানোর কোনো যুক্তি নেই। কিন্তু প্রযুক্তিগত অগ্রসরতার ফলাফল হওয়ার কথা আসলে সম্পূর্ণ বিপরীত। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ বরং মানুষের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস করে। একসময় যে কাজের জন্য মানুষ পাঠানোর প্রয়োজন হতো এখন সেকাজের জন্য মানুষ না হলেও চলে। মানুষ যতই প্রযুক্তিগত সক্ষমতা লাভ করছে ততোই সে ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলোকে মানুষের বদলে রোবটের মাধ্যমে করার চিন্তাভাবনা করছে। দুর্গত এলাকায় কীভাবে রোবটের মাধ্যমে উদ্ধার তৎপরতা চালানো যায় তা নিয়ে ভাবছে। ধারনা করা হয় ভবিষ্যতে মানুষ সরাসরি যুদ্ধ করবে না, বরং যুদ্ধের জন্য রোবট পাঠাবে।

কাজেই বর্তমান সময়ে চাঁদে মানুষ পাঠানো হবে সময়, অর্থ, শক্তি এবং সক্ষমতার অপচয়। যেই সক্ষমতা মানুষ ইতিমধ্যে প্রমাণ করেছে সেটি কিছু ষড়যন্ত্রকারীর কাছে নতুন করে প্রমাণ করার খুব বেশী প্রয়োজন নেই বরং যা প্রয়োজন তা হচ্ছে এই সক্ষমতা বৃদ্ধি করে আরো দুর্লভ কিছু অর্জনের চেষ্টা করা। মহাকাশ গবেষনা এজেন্সীগুলো সেই কাজই করে যাচ্ছে। তারা আগামী কয়েকবছরের মধ্যে মঙ্গলে মানুষ পাঠানোর চিন্তা-ভাবনা করছে এবং এই লক্ষ্যে যে ধরনের গবেষণাগুলো করা প্রয়োজন সেগুলোই করছে।

-ইমতিয়াজ আহমেদ
সম্পাদক, বিজ্ঞান পত্রিকা
[ফেসবুক প্রোফাইল]

বিজ্ঞান পত্রিকা প্রকাশিত ভিডিওগুলো দেখতে পাবেন ইউটিউবে। লিংক:
১. টেলিভিশনঃ তখন ও এখন
২. স্পেস এক্সের মঙ্গলে মানব বসতি স্থাপনের পরিকল্পনা

10 মন্তব্য

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.