কোনো ঘূর্ণায়মান বস্তুর জড়তার ভ্রামক বলে একটি বিষয় থাকে যার মাধ্যমে ওই বস্তুটির কৌনিক গতির পরিবর্তন করা কতটা কঠিন তা নিরূপন করা যায়। একটি ঘুর্ণায়মান বস্তুর অধিকাংশ ভর যদি এর ঘূর্ণন অক্ষের কাছাকাছি বিন্যাস্ত থাকে তাহলে এর যে ঘূর্ণন গতি থাকবে, ভর অক্ষের নিকট হতে পরিধির দিকে সরিয়ে নেওয়া হলে জড়তার ভ্রামক বৃদ্ধি পাবে এবং ঘূর্ণন হ্রাস পাবে। এই পরীক্ষাটি আপনারা নিজেরাও করে দেখতে পারেন। একটি রিভলভিং চেয়ারে বসে দুই হাতে দুটি কাছাকাছি ভরের বস্তু নিয়ে হাতদুটো দুটিকে প্রসারিত করে দিন। এবার আপনার একজন বন্ধুকে বলুন চেয়ার সমেত আপনাকে ঘুরিয়ে দিতে। এবার আপনি হাতদুটো ভিতরের দিকে নিয়ে আসলে দেখতে পাবেন ঘূর্ণন বৃদ্ধি পেয়েছে, আবার প্রসারিত করে দিলে দেখবেন ঘূর্ণন হ্রাস পেয়েছে। ভরবেগের সংরক্ষণ সূত্রের কারণে এমনটি ঘটে। প্রসারিত অবস্থায় হাতে ধরা বস্তুগুলো পরিধির দিকে থাকে তাই পরিধির উপর তাদের রৈখিক বেগ বেশী থাকে। কিন্তু হাত গুটিয়ে নিলে যেহেতু পরিধি হ্রাস পায় তাই পরিধি বরাবর বস্তুর বেগও হ্রাস পায়। কিন্তু ভরবেগ যেহেতু সংরক্ষিত থাকতে হবে আর ভর যেহেতু সুনির্দিষ্ট তাই ঘূর্ণন গতি বৃদ্ধির মাধ্যমে বস্তুর পরিধি বরাবর বেগকে ঠিক রাখা হয়। যাঁরা বরফের উপর ফিগার স্কেটিং করেন তাঁরাও এভাবে হাত/পা প্রসারিত করে ও গুটিয়ে নিয়ে ঘূর্ণন হ্রাস বৃদ্ধি করেন।
এবার পৃথিবীর ঘূর্ণনের বিষয়টি চিন্তা করা যাক। পৃথিবী নিজ অক্ষ বরাবর মোটামুটি ২৪ ঘন্টায় একবার ঘুরে আসে। এখন পৃথিবীর কিছু ভর যদি কেন্দ্রের দিক হতে পরিধির দিকে সামান্য ঠেলে দেওয়া যায় তাহলে কৌনিক ভারবেগ স্থির রাখার জন্য উপরের একই নিয়মে এর গতি কিছুটা হ্রাস পাবে।
চীনের তৈরি থ্রি গোর্জ ড্যামের মাধ্যমে এই কাজটি কিছুটা করা হয়েছে। এই বাঁধের কাজ ২০০৬ সালে সমাপ্ত হয় এবং ২০১২ সাল হতে এই বাঁধে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়। এই বাঁধের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২২৫০০ মেগাওয়াট যা বাংলাদেশের সব কেন্দ্র মিলিয়ে মোট দাবীকৃত উৎপাদন ক্ষমতার চেয়েও প্রায় একতৃতীয়াংশ বেশী। কংক্রিট এবং ইস্পাতে তৈরি বাঁধটি দৈর্ঘ্যে ২৩৩৫ মিটার এবং সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে এর উচ্চতা ১৮৫ মিটার। এই বাঁধের মাধ্যমে যে জলাধার তৈরি হয়েছে তার গড় দৈর্ঘ্য ৬৬০ কিলোমিটার এবং গড় প্রস্থ ১.১২ কিলোমিটার।
এই বাঁধের মাধ্যমে ৩৯ ট্রিলিয়ন কেজি পানি সমুদ্র সমতল হতে ১৭৫ মিটার উপরে সঞ্চিত হয় যা পৃথিবীর ভরকে খুব সামান্য পরিমানে হলেও কেন্দ্রের দিক হতে পরিধির দিকে ঠেলে দেয়। নাসার গবেষকগণ হিসেব করে বের করেছেন এই পরিমান ভরের স্থানান্তরের কারণে পৃথিবীর আহ্নিক গতি কমে গেছে ৬০ মাইক্রোসেকেন্ড! এই বাঁধের ফলে পৃথিবীর বিষুব অঞ্চল আগের চেয়ে কিছুটা গোল হয়েছে এবং মেরুঅঞ্চল কিছুটা চ্যাপ্টা হয়েছে (খুব সামান্য)। এই বাঁধের পানির কারণে মেরুর অবস্থান প্রায় ২ সেন্টিমিটার সরে গেছে।
পৃথিবীর অন্যান্য বস্তুর ওঠানামার কারণেও ঘূর্ণন গতির পরিবর্তন ঘটে। যেমন: একটি সুউচ্চ ভবন নির্মান করলেও ভূ-পৃষ্ঠ হতে নির্মান সামগ্রী পরিধির দিকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এভাবে সমগ্র একটি শহর সার্বিকভাবে ঘূর্ননে কিছুটা প্রভাব তৈরি করতে পারে। এর পরিমান খুব সামান্য হলেও তা হিসেব করে বের করা সম্ভব। [Business Insider এবং উইকিপিডিয়া অবলম্বনে]
-ইমতিয়াজ আহমেদ
সম্পাদক, বিজ্ঞান পত্রিকা
বিজ্ঞান পত্রিকা প্রকাশিত ভিডিওগুলো দেখতে পাবেন ইউটিউবে। লিংক:
১. স্পেস এক্সের মঙ্গলে মানব বসতি স্থাপনের পরিকল্পনা
২. মাইক্রোস্কোপের নিচের দুনিয়া