প্রায় ৫ বছর আগে ২০১১ সালের ৮ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা থেকে বৃহস্পতির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে মনুষ্যবিহীন মহাকাশযান জুনো। প্রায় ২৭০ কোটি কিলোমিটার পথ পারি দিয়ে গত সোমবার (৪ জুলাই, ২০১৬) এটি বৃহস্পতির কক্ষপথে প্রবেশ করে। এর পেছনে খরচ হয়েছে ১১০ কোটি মার্কিন ডলার।
পাঠানোর উদ্দেশ্য বৃহস্পতি সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহ করা। বৃহস্পতির উদ্ভব, এর মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র ও চুম্বক ক্ষেত্র সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করবে। এছাড়া বৃহস্পতির অন্যান্য রহস্য নিয়েও গবেষণা করবে। গ্যাসীয় গ্রহটির কেন্দ্রে পাথুরে গঠনের অস্তিত্ব আছে কিনা, এর বায়ুমণ্ডল ব্যবহার করে পানি আহরণ করা যাবে কিনা ইত্যাদি। এর উদ্ভব সংক্রান্ত রহস্য জানা মানে সৌরজগত সংক্রান্ত রহস্য জানা, আদতে পরোক্ষভাবে পৃথিবী সম্পর্কেও তথ্য জানা। পৃথিবীর উদ্ভব রহস্য, পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্বের রহস্য, প্রাণ ধারণের জন্য পৃথিবীর বর্তমান অত্যানুকূল পরিবেশ ইত্যাদি সম্পর্কেও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তথ্য দিয়ে সাহায্য করবে এই মহাকাশযান।
তার উপর বৃহস্পতির জন্য পৃথিবীবাসীর আলাদা একটা মায়া থাকা স্বাভাবিক। সৌরজগতের বেশিরভাগ মহাজাগতিক বিপর্যয় নিজের বুকে টেনে নেয় এই গ্রহটি। এর শক্তিশালী আকর্ষণে গ্রহাণু, ধূমকেতু সহ অন্যান্য আন্তঃনাক্ষত্রিক বিপত্তিকে নিজের শক্তিশালী আকর্ষণে বেধে ফেলে। ফলে পৃথিবীর জন্য ঘটমান অনেক দুর্ঘটনাই চলে যায় বৃহস্পতির বুকে। বেশি ভরবাহী বৃহস্পতি যদি না থাকতো তাহলে পৃথিবীর না জানি কী অবস্থা হতো!
জুনো বর্তমানে বৃহস্পতিকে উপবৃত্তাকার কক্ষপথে প্রতি সাড়ে ৫৩ দিনে একবার করে প্রদক্ষিণ করছে। এই অবস্থায় এর গতিবেগ অবিশ্বাস্য রকমে বেশি। এই কক্ষপথে এর প্রাথমিক গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১ লক্ষ ৬৫ হাজার মাইল। প্রতি সেকেন্ডে ২ হাজার ৭৫০ মাইল! এত বেশি গতিবেগের কারণ হলো বৃহস্পতির শক্তিশালী মহাকর্ষ। সৌরজগতে বৃহস্পতিই সবচেয়ে বড় ও ভারী গ্রহ। যে গ্রহের ভর যত বেশি তার আকর্ষণ ক্ষমতা তত বেশি। যার আকর্ষণ যত বেশি তার আশপাশ দিয়ে উড়ে যাওয়া কোনো বস্তুর গতিবেগ তত বেশি হবে। জুনোর বেলায় এমনটা হয়েছে।
তবে দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করা স্পর্শকাতর যন্ত্রপাতি সম্পন্ন একটি যান এত বেশি বেগে চললে এটা তার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। সময়মতো এত উচ্চ বেগ কমিয়ে না আনতে পারলে এটি স্লিংশট ইফেক্ট (slingshot effect) নামে পদার্থবিজ্ঞানের এক ধরনের নীতির প্রভাবে বৃহস্পতির আকর্ষণ কাটিয়ে বাইরের দিকে চলে যাবে। অন্যান্য মহাকাশযানের বেলায় যেমনটা হয়েছিল। যেমন ক্যাসিনি। ক্যাসিনি তার যাত্রাপথে কয়েকবার স্লিংশট ইফেক্টের মাধ্যমে ভারী গ্রহের মহাকর্ষীয় টানকে ব্যবহার করে নিজের গতিবেগ বাড়িয়েছিল। বিজ্ঞানীরা ইচ্ছা করেই সূর্য ও অন্যান্য গ্রহের মহাকর্ষীয় সুবিধা ব্যবহার করেছিল। তবে জুনোর বেলায় এটি প্রযোজ্য নয়। তাই গবেষক বিজ্ঞানীরা এর জন্য ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। ভেতরের ইঞ্জিন ও নিজস্ব জ্বালানী ব্যবহার করে এর বেগ কমিয়ে আনা হবে ঘণ্টায় ১ হাজার ২১২ মাইল। এমন পরিস্থিতিতে আসার পর একে ব্যবহার করে তথ্য সংগ্রহ শুরু করা হবে।
এই অবস্থায় কিছুদিন তথ্য সংগ্রহ করার পর একে আরো কম দূরত্বের একটি কক্ষপথে নিয়ে যাওয়া হবে। তখন বৃহস্পতি আরো কাছে চলে আসবে এবং এর সম্পর্কিত অনেক তথ্য আরো পরিষ্কার হবে। ঐ কক্ষপথের আবর্তনকাল হবে ১৪ দিন- প্রতি ১৪ দিনে একবার করে প্রদক্ষিণ করবে। জুনোর এই মিশনের মাধ্যমে বৃহস্পতি তথা সৌরজগতের অনেক রহস্যের কিনারা হবে এবং অনেক নতুন ও অজানা তথ্য বেরিয়ে আসবে। [IFLScience অবলম্বনে]
-সিরাজাম মুনির শ্রাবণ