কিছু কিছু স্তন্যপায়ী প্রাণী তাদের বাচ্চা প্রসবের জন্য উপযুক্ত সময় নির্ধারণ করতে পারে এবং সেই সময়টুকুতে গর্ভের ভ্রূণের স্বাভাবিক বিকাশ স্থগিত থাকে। ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটনের মেডিসিন ইন্সটিটিউট ফর স্টেম সেল এন্ড রিজনেটিভ বিভাগের এক দল গবেষক এই পুরো কার্যকলাপ কিভাবে সম্পন্ন হয়ে থাকে সেটি উদ্ঘাটন করেছেন। গবেষণাটি ডেভেলপমেন্টাল সেল নামক একটি কোষীয় বিজ্ঞান ভিত্তিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
গবেষকগণ দেখতে পেয়েছেন প্রায় ১৩০ বা তার চেয়ে বেশি প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণীসহ কিছু মারসুপিয়াল বা পেটের থলিতে বাচ্চা রাখে এমন প্রজাতির ক্ষেত্রেও বিষয়টি ঘটে থাকে। এই গবেষণার ফলাফল শুধুমাত্র বিলম্বিত ভ্রূণ প্রতিস্থাপনের বোধগম্যতাকেই সহজ করবেনা সেই সাথে কিছু কিছু টিউমারের কোষগুলো কিভাবে দ্রুততার সাথে বিভাজিত হয়ে পরে হঠাৎ নিষ্ক্রিয় অবস্থায় পতিত হয় সেটারও একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে।
গর্ভাবস্থার স্থগিত অবস্থাকে এমব্রায়নিক ডায়োপজ বলা হয়ে থাকে, যেখানে প্রাথমিক স্তরের ভ্রূণটি মায়ের জরায়ুতে পৌঁছানো থেকে বিরত রাখে। জরায়ুতেই একটি ভ্রূণ বেড়ে উঠার জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি লাভ করে থাকে। কিন্তু জরায়ুতে না যাওয়ায় ভ্রূণটি বেড়ে উঠার পরিবর্তে শস্য বীজের মতো সুপ্ত অবস্থায় থাকে যতক্ষণ না নির্দিষ্ট অণু নিয়ামকরা এটিকে অঙ্কুরিত হওয়ার প্রস্তাব দেয়।
ডায়াপজ বা বিলম্বিত স্থাপন হচ্ছে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বিশেষ করে যখন নবজাতকের জন্য খাদ্যের সংকট দেখা দেয়, মায়ের শরীরে চর্বির অভাব কিংবা বুকের দুধ ছাড়েনি এমন বাচ্চা থাকে সেখান থেকে রক্ষার জৈবিক কৌশল।
ভাল্লুক, আরমাদিলোস, সিল, কিছু কিছু ভোঁদড়, ব্যাজার এবং নেউল জাতীয় প্রাণীর প্রজনন চক্রের নিয়মিত অংশ হিসেবে মৌসুমি ডায়াপজ হয়। উদাহরণস্বরূপ, অনেক ধরণের ভাল্লুক বসন্তের শেষের দিকে কিংবা গ্রীষ্মের প্রথম দিকে প্রজনন করে থাকে। স্ত্রী ভাল্লুক তখন নির্ভেজালভাবে খাবারের জন্য শিকার করে। যখন স্ত্রী ভাল্লুক গুলোর শরীরে যথেষ্ট পরিমাণে চর্বি ও ওজন থাকে তখন তারা এক বা একাধিক ভ্রূণ কয়েক মাস পর জরায়ুতে স্থাপন করে এবং তাদের আবাস স্থলে ফিরে যায় ও শীতের শেষ দিকে যে কোন শাবক জন্মগ্রহণ করতে পারে।
ভ্রূণের বিকাশে জৈব-রাসায়নিক পদার্থ কিভাবে সংরক্ষণ করে বা ছেড়ে দেয় তা জানার জন্য গবেষক দলের প্রধান হুসেইন, রুহোলা-বাকের এবং তাঁদের দল স্ত্রী হরমোনের মাত্রা হ্রাস করে একটি স্ত্রী ইঁদুরের উপর ডায়োপজ মডেল প্রয়োগ করেছিলেন। এরপর তাঁরা ভ্রূণকে দ্রুত জরায়ুতে প্রেরিত এবং দেরিতে জরায়ুতে প্রেরিত ডায়াপজ ভ্রূণের সাথে তুলনা করেন।
কিভাবে বিপাকীয় ও সাংকেতিক পথগুলো সুপ্ত এবং সক্রিয় উভয় অবস্থায় ইঁদুরের ভ্রূণের নিয়ন্ত্রণ করে সে বিষয়ে গবেষণাগারে বিস্তর গবেষণা চালানো হয়েছে। মেটাবলিজম বা বিপাক জীবন রক্ষাকারী রাসায়নিক ক্রিয়াকলাপে কোষগুলোর পদার্থকে শক্তিতে রূপান্তর করতে, উপাদান তৈরীতে এবং বর্জ্য অপসারণের কাজে সম্পৃক্ত থাকে। এই প্রতিক্রিয়ার শেষ অবস্থাকে বলা হয় মেটাবলিটিস আর একে বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা মূলত কী কারণে ডায়োপজ হয়ে থাকে এবং কোষগুলো কিভাবে এই অবস্থা থেকে মুক্তি পায় তার একটা পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরতে পারবেন।
বিজ্ঞানীরা কোষের অবস্থা জানার সময় জিনের প্রতিক্রিয়ার দিকেও নজর রেখেছিলেন। তাঁরা স্থগিত ও সক্রিয় অবস্থায় ডিএনএ সংকেত রূপান্তর হওয়ার পেছনে কিভাবে এবং কিসের প্ররোচনা থাকতে পারে, কি ধরণের এবং কি পরিমাণ প্রোটিন তৈরী হয় তা উদ্ঘাটন করেছেন।
এমব্রায়নিক স্টেম সেল গবেষক রোহোলা-বাকারের মতে, ডিএনএ নিজেই নিজের পরিবর্তন করে এর পরিবর্তে একই ডিএনএ সংকেতে এপিজেনেটিক পার্থক্যের রূপান্তর আমাদের বুঝতে সাহায্য করবে কিভাবে ভ্রূণ ডায়াপজে প্রবেশ করে এবং মুক্ত হয়।
আরও কিছু অনুসন্ধানের মাধ্যমে দেখা গেছে যে, এক দল প্রোটিন ভ্রূণ কোষকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করেছে। জিনগুলোর ক্রিয়াকলাপও এই প্রোটিনগুলোর সাথে সম্পর্কিত ছিল সেই সাথে নির্দিষ্ট পরিমাণ অ্যামিনো এসিড ডায়াপজের ভ্রূণগুলোতে কাজ করতে থাকে। গবেষকগণ কিছু অতিরিক্ত তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন যা mTOR নামক এক অনুঘটক এনজাইম বিপাকীয় উপাদানকে প্রভাবিত করে থাকে। এটি অন্যান্য কোষের বিস্তার, বৃদ্ধি এবং প্রোটিন সংশ্লেষণ নিয়ন্ত্রণ করে। কোষের পুষ্টি এবং শক্তি সঞ্চয় করার প্রক্রিয়াতেও mTOR “নজর” রাখে।
ডায়াপজ সম্পর্কে ধারণা সংগ্রহ বন্যপ্রাণীর চিকিৎসা এবং জীববিজ্ঞানের জ্ঞানকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করবে। অধ্যাপক ক্যারল বলেন, পরিবেশগত ভার্সাম্যহীনতা এবং কিছু প্রজাতির বেঁচে থাকার জন্যে অপরিহার্য পদ্ধতি। প্রাণিদের মধ্যে ডায়োপজের প্রক্রিয়া সম্পর্কিত গবেষণার একটি গুরুত্ব রয়েছে। যেমন, ভিট্রো ফার্টিলাইজেশনের মাধ্যমে মানুষের বাচ্চার জন্মদানের ক্ষেত্রে আরও সহায়তা পাওয়া যায় কিনা তা খুঁজে দেখা। হুসেইন বিশ্বাস করেন, ভবিষ্যৎ ক্যান্সারের গবেষণায়ও এটি তাত্পর্যপূর্ণ হতে পারে। [technologynetworks অবলম্বনে]
-শফিকুল ইসলাম