এখন আমরা জানি, মহাবিশ্বের মাত্র ৪ শতাংশ দৃশ্যমান বস্তু দিয়ে গড়ে উঠেছে। ৯৬ শতাংশই রয়ে গেছে অদৃশ্য। অদৃশ্য ভরের ২১ শতাংশ ডার্ক ম্যাটার বাকি ৭৫ শতাংশ ডার্ক এনার্জি। এ বিশাল ডার্ক ম্যাটার আর ডার্ক এনার্জিকে আমলে নিয়েই বিগ ব্যাং, মহাবিশ্বের প্রসারণ ইত্যাদি ব্যাখ্যা করা যায়। ব্যাখ্যা করা যায় আইনস্টাইনের মহাকর্ষও। অর্থাৎ এর অসিত্মত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। শুধু কি এতে মন ভরে? বিজ্ঞানীরা জানতে চান, সেই ভুতুড়ে গুপ্ত বস্তুগুলো আসলে কী দিয়ে তৈরি?
মহাবিশ্বের সৃষ্টিতত্ত্বের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মডেল প্রতিষ্ঠিত করেন স্টিভেন ওয়েনবার্গ, আবদুস সালাম আর সেলডন গ্ল্যাশো। সেই মডেলে আমাদের পরিচিত সব বস্তুকণা (ফার্মিওন) ও বলবাহী কণাদের (বোসন) স্থান হয়েছে। কিন্তু গুপ্ত কণাদের খোঁজ ওই মডেল দিতে পারে না। ১৯৭০-এর দশকে ‘সুপারসিমেট্রি’ মডেল দাঁড় করানো হয়। উদ্দেশ্য কৃষ্ণগহ্বর কিংবা ডার্ক ম্যাটারের মতো বিষয়গুলো—যেখানে নিউটন-আইনস্টাইনের মডেল অকার্যকর, কোয়ান্টাম মেকানিকসও ঠিকঠাক কাজ করে না—সেসব বিষয় ব্যাখ্যা করা। সুপারসিমেট্রির সূত্র ধরেই বিজ্ঞানীরা ডার্ক ম্যাটারের জন্য একধরনের কণার কথা বলেন। নাম তার উইম্প। পূর্ণাঙ্গ নাম উইকলি ইন্টার্যাক্টিং ম্যাসিভ পার্টিক্যালস (Weakly interacting massive particles)| অর্থাৎ দুর্বল মিথস্ক্রিয়াশীল ভারী কণা। বিজ্ঞানীদের দাবি, এটা এমন এক কণা শুধু মহাকর্ষ বলের সঙ্গেই এর মিথস্ক্রিয়া ঘটায়। বিদ্যুৎম্বকীয়, সবল নিউক্লীয় বল, এমনকি দুর্বল বলের সঙ্গেও এর মিথস্ক্রিয়া নেই। তাই কঠিন পদার্থ কিংবা ফোটনের সঙ্গেও এর সংঘর্ষের কোনো সুযোগ নেই। আর আলোর সঙ্গেই যদি সখ্য তৈরি না হয়, সেটা আমাদের চক্ষু-কর্ণের মানভঞ্জন ঘটাবে কী করে?
অনেক পদার্থবিদের ধারণা, খুব কম শক্তির দুর্বল নিউক্লীয় বলের সঙ্গে উইম্প কণার মিথস্ক্রিয়া ঘটতে পারে। মার্কিন বিজ্ঞানী ক্যাথরিন ফ্রিসির ধারণা, কোনো কোনো উইম্প কণা কালেভদ্রে বস্তুকণার নিউক্লিয়নগুলোর (প্রোটন ও নিউট্রনের সাধারণ নাম নিউক্লিয়ন) সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটাতে পারে। নিউক্লিয়নের সঙ্গে উইম্পের সংঘর্ষ ঘটার আশঙ্কা কতটা—তা নিয়ে কয়েকটি পরীক্ষা চালানো হয়েছে সার্নের এলএইচসিতে। কিন্তু কোনো ফলই উইম্পের হদিস দিতে পারেনি। উইম্প ও ডার্ক ম্যাটার গবেষণার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ডাকোটার সানফোর্ড আন্ডারগ্রাউন্ড রিসার্চ ফ্যাকাল্টিতে বসানো হয়েছে লাক্স (লার্জ আন্ডারগ্রাউন্ড জেনন) নামে এক বড়সড় ডিটেক্টর, মাটির দেড় হাজার মিটার গভীরে একটি বিশেষ এক পাথরের চেম্বারে। এই পাথুরে দেয়াল ভেদ করে পরমাণুর নিউক্লিয়াস থেকে ক্ষয় হওয়া তেজস্ক্রিয় বিকিরণ বেরিয়ে যেতে পারে না। আসলে দুর্বল নিউক্লীয় বলের প্রভাবেই তেজস্ক্রিয় রশ্মি বিকিরিত হয়। অর্থাত্ লাক্স ডিটেক্টর দুর্বল নিউক্লীয় বলের বিশাল আধার। এ কারণেই তেজস্ক্রিয় রশ্মি ধরে রাখার এই আয়োজন।
দুই মিটার উঁচু একটা টাইটেনিয়ামের ট্যাংকে ৩৭০ কেজি জেনন গ্যাসকে ১০৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রাখা হয়েছে। নিচের দিকে আছে একটি ইলেকট্রিক ফিল্ড। বিজ্ঞানীদের আশা, কখনো হয়তো জেননের পরমাণুর সঙ্গে উইম্পের সংঘর্ষ ঘটবে। সংঘর্ষের পর জেনন পরমাণুটি স্থিতিশীল হওয়ার সময় একটা মুক্ত ইলেকট্রন তৈরি করবে। সেই সঙ্গে নির্গত হবে আলোক বিকিরণ। সেই মুক্ত ইলেকট্রন আবার ইলেকট্রিক ফিল্ডের প্রভাবে ত্বরিত হবে এবং দ্রুত ট্যাংকের ওপরে উঠে আসবে। ত্বরিত এই ইলেকট্রন ট্যাংকের ওপরের স্তরে এসে আরও আলো বিকিরণ করবে। পুরো ব্যবস্থাটিতে রাখা আছে অত্যন্ত শক্তিশালী এক লাইট ডিটেক্টর। এটি ট্যাংকের জেনন ও উইম্পের সংঘর্ষ থেকে আসা আলো আলাদা করে চিনতে পারবে। মাপতে পারবে ত্বরিত ইলেকট্রন থেকে বিকিরিত আলোর ঠিকঠাক উজ্জ্বলতাও। যদি ডার্ক ম্যাটার কণা আঘাত করে জেননকে, এই প্রক্রিয়ায় সে ধরা পড়বে লাক্সের ডিটেক্টরে।
সম্প্রতি লাক্সের ডিটেক্টরে ধরা পড়া কিছু সিগন্যাল বিজ্ঞানীদের আশাবাদী করেছিল। ডিটেক্টরের ডাটা নিয়ে তাঁরা কোমর বেঁধে গবেষণা শুরু করেন। সেগুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণ করে একটা গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত জার্নাল ফিজিক্যাল রিভিউ লেটারস–এ। সেই গবেষণাপত্র বলছে, যতটা আশা নিয়ে বিজ্ঞানীরা ডাটা বিশ্লেষণে নেমেছিলেন, সেই আশার ফুল এখনই ফুটছে না। অর্থাত্ হিসাব বলছে, লাক্সের জেননে এখনো আঘাত হানেনি উইম্প। তাই বলে রণে ভঙ্গ দেননি বিজ্ঞানীরা। ডার্ক পার্টিকেল কণা আজ ধরা দেয়নি তো কি হয়েছে, একদিন না একদিন ফাঁদে তাকে পড়তেই হবে। তাঁদের মতো গোটা বিশ্বের বিজ্ঞানপ্রেমীরা আশায় বুক বাঁধছেন—দশকের পর দশক ঘুরিয়েও যেমন করে হিগস বোসন কিংবা ভাইল ফার্মিওন ধরা পড়েছে বিজ্ঞানীদের জালে, উইম্পও একদিন লাক্সের জালে জড়িয়ে ফেলবে নিজেকে।
চলবে…
আবদুল গাফফার রনি’র বইগুলি ঘরে বসে অর্ডার করতে ক্লিক করুন এখানে
এই বইয়ের সব পর্ব
- গুপ্ত ভরশক্তির খোঁজে
- প্রাচীন মহাবিশ্ব
- আধুনিক মহাবিশ্ব
- মহাবিস্ফোরণ
- কী ঘটেছিল মহাবিস্ফোরণের পর?
- গ্রাভিটেশনাল লেন্সিং
- জুইকি থেকে রুবিন
- যা চেয়েছি আর যা পেয়েছি
- ছায়াপথ স্তবক
- মূল কণিকাদের গল্প
- স্ট্যান্ডার্ড মডেল
- প্রতিসাম্যতা
- ডার্ক পার্টিকেলের খোঁজে
- মিলেনিয়াম সিমুলেশনে ডার্ক ম্যাটার
- নিউট্রিনো কি ডার্ক ম্যাটার?
- স্ট্যান্ডার্ড মডেলের ত্রুটি সুপারসিমেট্রিতে সমাধান
- ডার্ক ম্যাটারের প্রার্থী কারা?
- কীভাবে শনাক্ত হবে ডার্ক পার্টিকেল?
- গামা রশ্মির সন্ধানে
- মহাবিশ্বের সম্প্রারণ ও ডার্ক এনার্জি
- সুপারনোভার জন্ম
- আদর্শ বাতির খোঁজে
- আদিম আলোয় বিশ্ব দেখা
- মহাকাশের মানচিত্রে গুপ্ত ভরশক্তি
- কুইন্টেসেন্স তত্ত্ব
- ডার্ক ফোটনের সন্ধানে
- উপসংহার