কোয়ান্টামের জগৎ বড় বিস্ময়কর। বিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান বলেছিলেন, কোয়ান্টাম মেকানিকস আসলে কেউ বোঝে না। এরপর দশকের পর দশক কেটে গেছে। একথা আজও ফাইনম্যানের কথাটা যেন সত্যি বলে মনে হয়। কণা নিয়েই কারবার কোয়ান্টাম জগতের। আবার সেই জগৎই বলে, কণা শুধু কণা নয়, একই সঙ্গে তরঙ্গ। সেই অদ্ভুত জগৎকে আরও অদ্ভুত করে তুলেছে কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরি। আদুরে ভাষায় যাকে বলে কোয়ান্টাম ক্ষেত্রতত্ত্ব। ক্ষেত্রতত্ত্ব বলে, কণারা নিছকই কণা নয়, প্রতিটা কণা প্রতিটা বলের পেছনে রয়েছে একটা করে কোয়ান্টাম ক্ষেত্র। ক্ষেত্রটা আবার কী?
বৈদ্যুতিক বল ক্রিয়া করার জন্য বিদুেক্ষত্রের কথা বলেছিলেন বৃটিশ বিজ্ঞানি মাইকেল ফ্যারাডে। ফ্যারাডের সেই ক্ষেত্রতত্ত্বকেই গাণিতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন স্কটিশ বিজ্ঞানী জেমস ক্ল্যার্ক ম্যক্সওয়েল। তবে তিনি শুধু বিদ্যুতের কথা বলেননি, বলেছিলেন বিদ্যুত্চুম্বক ক্ষেত্রের কথা। ম্যক্সওয়েল বলেন শূন্যস্থান একেবারে শূন্য নয়। শূন্যস্থানেই লুকিয়ে আছে বলক্ষেত্র। বিদ্যুত্চুম্বকীয় বলের জন্য শূন্যস্থানের এই শক্তির নাম বিদ্যুৎ চুম্বকীয় বলক্ষেত্র। আলবার্ট আইনস্টাইনকেও আকর্ষণ করে এই বলক্ষেত্র। তিনি মহাকর্ষের জন্যও এমন বলক্ষেত্রের কথা বলে। বস্তুর মহাকর্ষ এর আশপাশের স্থানকালে বাঁকিয়ে দেয়। তখন সেই বড় বস্তুটার কাছে তুলনামূলক আরেকটা ছোট বস্তু রাখলে মনে বড় বস্তুটি ছোট বস্তুটিকে আকর্ষণ করছে।
কোয়ান্টাম বিজ্ঞানীরাও এই ক্ষেত্রতত্ত্ব দ্বারা আকর্ষিত হলেন। তারা চার প্রকার বলের জন্যও যেমন কোয়ান্টাম ক্ষেত্রের কথা বললেন, তেমনি প্রতিটি মৌলিক কণার জন্য ক্ষেত্রতত্ত্ব হাজির করলেন। ফিল্ড থিওরি বা ক্ষেত্রতত্ত্ব্ব বলে, আমাদের চারপাশের যে চেনাজানার জগৎ তার সবকিছুর পেছনেই রয়েছে কোয়ান্টাম ক্ষেত্রের অবদান। কোয়ান্টাম ক্ষেত্রগুলো স্থির নয়, কম্পনশীল। এদের বিভিন্ন মাত্রার কম্পন জন্ম দেয় একেকটি কণার। পুরো মহাবিশ্বের তাবৎ স্থানকাল জুড়ে লুকিয়ে আছে অনেকগুলো অদৃশ্য ক্ষেত্র। প্রতিটি ক্ষেত্রের বিস্তার গোটা স্থানকালের সমান। এসব ক্ষেত্রগুলিই জন্ম দেয় মৌলিক কণাদের। যেমন, মহাবিশ্ব জুড়েই ছড়িয়ে রয়েছে অদৃশ্য ইলেকট্রন ক্ষেত্র। এই ক্ষেত্রের বিশেষ কম্পনই হলো একেকটা ইলেকট্রন। তেমনি আরেকটি ক্ষেত্র হলো বিদুত্চুম্বকীয় ক্ষেত্র। এই ক্ষেত্রের বিশেষ কম্পনের ফলেই ফোটনের জন্ম। তেমনি কোয়ার্কদের জন্য রয়েছে কোয়ার্ক ক্ষেত্র, হিগস বোসনের জন্য হিগস ক্ষেত্র। স্থানকালের প্রতিটি বিন্দুতে রয়েছে ক্ষেত্রগুলোর নির্দিষ্ট মান। এই মানই ঠিক করে দেয় ওইসব ক্ষেত্রগুলো থেকে জন্ম নেয়া কণাদের ধর্ম।
স্থানকালের কোনো বিন্দুতে যদি কোয়ান্টাম ফিল্ডের মান শূন্য হলে তাহলে সেই বিন্দুতে কোনো কণা পাওয়া যাবে না। কিন্তু কোয়ান্টাম ফিল্ডের মান যদি শূন্য না হয়, কোনো কোনো মান থাকে সেই বিন্দুটি আসলে একটা কণায় পরিণত হয়। অর্থাৎ কোনো বিন্দুতে কোয়ান্টাম ফিল্ডের মানই হলো একটি করে কণা। কোয়ান্টাম ফিল্ড থেকে কণা পরিমাপ করা হয় যে পদ্ধতিতে, সেই পদ্ধতিকে বলে সেকেন্ড কোয়ান্টাইজেশন। এই পদ্ধতিতে প্রথমে ফিল্ডের কম্পনকে কোয়ান্টা আকারে পরিমাপ করা হয়। তারপর কোয়ান্টা থেকে কণাদের শক্তি বের হয়ে যায়।
কোয়ান্টাম মেকানিকস দাড়িয়ে আছে অনিশ্চয়তা তত্ত্বের ওপর। কণা-পদার্থবিজ্ঞান এই অদ্ভুত তত্ত্ব ছাড়া এক পাও এগুতে পারে না। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার আরেকটা ভিত্তি হলো ফরাসী বিজ্ঞানী দ্য ব্রগলির বন্তু তরঙ্গ। এই তত্ত্বে বলা হয় কোয়ান্টাম কণিকারা একই সঙ্গে কণা ও তরঙ্গ। সেটা পরে প্রমাণও হয়। কিন্তু অনিশ্চয়তা তত্ত্বের আবির্ভাবে কণাদের এই দ্বৈত ধর্ম অদ্ভুত অবস্থায় ফেলে পদার্থবিজ্ঞানকে। অনিশ্চয়তা নীতি বলে একটা কণা কইসঙ্গে কণা ও তরঙ্গ ঠিকই, তবে দুই ধর্মই আপনি চাইলে একসঙ্গে দেখতে পাবেন না। আপিনি যখন কণার তরঙ্গ ধর্ম মাপতে যাবেন, তখন সে তরঙ্গ হিসেবেই আপনার সামনে ধরা দেবে। আবার যদি কণার কণা ধর্ম মাপর চেষ্টা করেন, সে তখন কণা হিসেবেই নিজেকে জাহির করবে। অর্থাৎ আপনি কী ধরনের যন্ত্র দিয়ে কণাদের বৈশিষ্ট পরিমাপের চেষ্টা করছেন সেটাই নির্ধারণ করে দেবেন কণাদের আপনি কণা না তরঙ্গরূপে দেখবেন। শুধু তাই নয়। আরো আজব কাহিনি আছে এই কোয়ান্টাম জগতে। কোয়ান্টাম মেকানিক্স বলে আপনি যখন কণাদের খোঁজ নিচ্ছেন না, তখন তাদের অস্তিত্বই নেই! এ কথা শুনে আইনস্টাইন ভীষণ ক্ষেপেছিলেন, বলেছিলেন, ‘তাহলে আমরা যদি চাঁদের দিকে তাকিয়ে না থাকি, তাহলে কি চাঁদটা আকাশে থাকে না!’ চাঁদের ক্ষেত্রে কথাটা হয়তো ঠিক নয়, বৃহত্ স্কেলে কোয়োন্টামের এই অদ্ভুত তত্ত্বগুলো খাটে না, কিন্তু খুদে কণাদের জগতে এই আজব আজব তত্ত্বগুলোই ঠিক। এবং সেটা প্রমাণিত। কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরিতেও কণাদের অদ্ভুত আচরণের হদিস পাওয়া যায়। কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরি বলে, আমরা যখন কোয়ান্টাম ফিল্ডকে পর্যবেক্ষণ করিই তখনই কণাদের আবির্ভাব ঘটে। পর্যবেক্ষণ যখন করি না তখন এদের অস্তিত্ব নেই। অর্থাৎ কোয়ান্টাম ফিল্ডই হলো বাস্তবতা, কণারা হলো অলীক, যখন এদের আমরা দেখতে চাই, তখনই এরা দেখা দেয়।
এখন আপনি যদি স্থানকালের একস্থান থেকে আরেকস্থানে একটা ইলেকট্রন পাঠাতে চান তাহলে কী করতে হবে? ফিল্ড থিওরি অনুযায়ী আপানাকে ইলকট্রনকে সরাসরি সশরীরে পাঠানোর দরকার নেই। শুধু ইলেকট্রন ফিল্ডের সেই কম্পন, যার ফলে তৈরি হয়েছে ইলেকট্রন কণাটি, সেই কম্পন বা ঢেউটিই পাঠিয়ে দিন, কাজ চুকে যাবে। কণাগুলোর জন্ম হলো স্থানীয় কোয়ান্টাম ফিল্ড থেকে। যেমন পৃথিবীতে য়েসব ইলেকট্রন আছে সেগুলোর জন্ম পৃথবীর আশপাশে যে ইলেকট্রন ফিল্ড আছে তার কম্পন থেকে। পৃথিবীর আশপাশের কোয়ন্টাম ফিল্ডই হোক আর বহুদূরের অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সির কোয়ান্টাম ফিল্ডই হোক, সবত্র একটাই কোয়ান্টাম ফিল্ড। গোটা মহাবিশ্বে একটাই ইলেকট্রন ফিল্ড ছড়িয়ে আছে। তাই এই ফিল্ডের যেখানেই কম্পন উঠুক, সেই কম্পন থেকে যে ইলকট্রনই জন্ম নিক, সব ইলেকট্রনের একই রকম। মানে ভর, চার্জ, চেহারা চরিত্র ইত্যাদিতে একই হবে।
কোয়ান্টাম কণাদের মতো কোয়ান্টাম ফিল্ডগুলো দুই প্রকার। ফার্মিওনিক ফিল্ড আর বোসনিক ফিল্ড। কোনো একটা ফিল্ডের কম্পন আপনি পরিমাপ করলেন, তার ফলে যদি একটি মাত্র কোয়ান্টা পান। মানে একটি নির্দিষ্ট মান পান, তাহলে সেই ফিল্ডকে ফার্মিয়নিক ফিল্ড বলে। ফার্মিয়নিক ফিল্ড থেকে ফার্মিয়ন কণা পাওয়া যায। ইলেকট্রন ফিল্ড, কোয়ার্ক ফিল্ড ইত্যাদি হলো ফার্মিয়নিক ফিল্ড। অন্যদিকে বোসোনিক ফিল্ডকে যদি যদি পরিমাপ করেন, তাহলে একাধিক মান পাবেন। বোসনিক ফিল্ড থেকেই বোসন কণা পাওয়া যায়। বিদ্যুত্চুম্বকীয় ফিল্ড, গ্লুয়ন ফিল্ড এগুলো হলো বোসোনিক ফিল্ড।
বসোনিক ফিল্ডগুলো কী, সেগুলো সমপর্কে একটা জানা দরকার। আমরা আগের অধ্যায়েই বলেছি, বিদ্যুত্চুম্বকীয় বলের জন্য যে বলক্ষেত্র আছে, সেটাকে বলে বিদ্যুত্চুম্বকীয় ক্ষেত্র আছে। এই ক্ষেত্রের কম্পনের ফলে তৈরি হয় ফোটন কণা। তেমনি আছে সবল নিউক্লীয় বলক্ষেত্র, সেই বলক্ষেত্রের কম্পনের ফলে জন্ম হয় হয় গ্লুয়ন কণার। এছাড়া আছে দুর্বল নিউক্লীয় বলক্ষেত্র। এই বলক্ষেত্রের কম্পনের ফলে জন্ম ডব্লিউ ও জেড কণাদের।
এসব বলক্ষেত্রগুলো কীভাবে জন্ম হলো, এর প্রকৃতিই বা কেমন এজন্য ১৯৬০-এর দশকে স্ট্যান্ডার্ড মডেলের পাশাপাশি আরেকটি মডেলের প্রস্তাব করা হয়। সেটাকে বলে সিমেট্রি বা প্রতিসাম্যতা।
প্রতিসামত্যাটা আবার কী?
শব্দটার আক্ষরিক অর্থ থেকেই কিছুটা আঁঁচ করা যায়। কোনো পর্যবেক্ষণ বা বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়াকে স্থানকালের সব জায়গায় কি একই রকম দেখাবে। একটা তাসের কথা ভাবুন, ইস্কাপনের টিক্কা—একে স্থানকালের সব জায়গায় একইরকম দেখায় না। কিন্তু কিছু কিছু বস্তু আছে স্থানকালের যেখান থেকেই দেখুন চেহারা একই রকম হবে। একটা বৃত্ত বা গোলকের কথাই ভাবুন, একে যে পাশ থেকেই দেখুন একই রকম দেখাবে। অর্থাৎ কোনো বস্তুকে একটি অক্ষের সাপেক্ষে ঘোরানোর পর যদি বস্তুটি আবার আগের চেহারায় ফিরে আসে তাহলে সেটাকে প্রতিসাম্যতা বলে।
পদার্থবিজ্ঞানে এই প্রতিসাম্যতার ভূমিকা কী?
প্রতিসাম্যতা থেকেই প্রাকৃতিক বলক্ষেত্রগুলির জন্ম হয়। যেসব প্রতিসাম্যতার কারণে এই বলক্ষেত্রের উত্পত্তি সেগুলোকে বলে গেজ সিমেট্রি। এর আরেকটি অর্থ হলো পরিমাপগত প্রতিসাম্যতা। গেজ সিমেট্রির কারণেই মহাকর্ষ ও বিদ্যুত্চ্চুম্বকীয় বলক্ষেত্রগুলির জন্ম হয়। এসব বলক্ষেত্রর পাল্লা বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। এখন প্রশ্ন হলে সবল নিউক্লীয় বলকে আর দুর্বল নিউক্লীয় বলক্ষেত্রগুলোর জন্ম তাহেলে কীভাবে হয়? গেজ সিমেট্রির সঙ্গে এগুলোর সম্পর্কই বা কী?
গেজ সিমেট্রিতে ভাঙন ধরলেই কেবল স্বল্পপাল্লার বলক্ষেত্রগুলোর জন্ম হয়। আর অক্ষত থাকলে দূরপাল্লার বলক্ষেত্রগুলোর জন্ম হয়।
এখন কথা হচ্ছে কণাদের গেজ সিমেট্রিতে ভাঙন কেন ধরে? এর পেছনে আছে কোয়ান্টাম ফিল্ডগুলোর কারসাজি। হিগস ফিল্ড নামে একটা কোয়ান্টাম ফিল্ড আছে। এই ফিল্ডের প্রভাবে গেজ সিমেট্রিতে ভাঙন ধরে। সেই ভাঙনের ফলে সংকুচিত হয়ে যায় দুর্বল নিউক্লীয় বলক্ষেত্র। তাই খুব স্বল্প পাল্লার মধ্যে কাজ করে এই বল। হিগস ফিল্ডের সঙ্গে জড়িত কণা হিগস বোসনের প্রকৃতি বোসনিক। তাই এর সাথে জড়িত ফিল্ডও বোসোনিক ফিল্ড। হিগস ফিল্ড কিন্তু সবল, দুর্বল, বিদ্যুত্চুম্বকীয় কিংবা মহাকর্ষের মতো বলক্ষেত্র নয়। এটা হলো স্কেলার ফিল্ড। তার মানে এই ফিল্ডের নির্দিষ্ট কোনো দিক নেই।
স্থানকালের সবদিকেই এর প্রভাব সমান। হিগস ফিল্ড বলক্ষেত্র নয় বলেই এর সঙ্গে জড়িত কণা হিগস বোসনো কোনো বলবাহী কণা নয়। এই স্কেলার ফিল্ডের খোঁজ বিজ্ঞানীরা বহুদিন থেকেই করছিলেন। অবশেষে ২০১২ সালে সার্নের এলএইচসিতে হিগস বোসন কণার সন্ধান মেলে। সঙ্গে সঙ্গে প্রমাণিত হয় হিগস ফিল্ডের অস্তিত্বও।
কোনো বলের বাহকই যদি না হয়, হিগস ফিল্ডের তাহলে দরকার কী?
ফিরে আসি প্রতিসাম্যতায়। একটু আভিধানিক অর্থের দিকে যদি যাই, তাহলে সিমেট্রি বা প্রতিসাম্যতার অর্থ হলো, যে পবির্তন বস্তুর আকার বা চরিত্রে কোনো পার্থক্য ঘটায় না, তাকে সিমেট্রি বলে। একটা বর্গক্ষেত্রের কথায় ধরা যাক। একে ৯০০ কোণে ঘোরালে এর চেহারার কোরো পরির্তন হয় না। একে যদি ১৮০০ বা ২৭০০ কিংবা ৩৬০০ কোণে ঘোরালেও এর চেহারায় কোনো পরিবর্তন হয় না। আসলে এই বিষয়টিকেই প্রতিসাম্যতা বলে। অর্থাৎ একটা বর্গক্ষেত্র প্রতি ৯০০ অন্তর আগের চেহারায় ফিরে আসে। তাই বর্গক্ষেত্রের প্রতিসাম্যতা হলো ৯০০। তেমনি একটি আয়তক্ষেত্রকে ঘোরালে প্রতি ১৮০০ অন্তর এটা আগের চেহারায় ফিরে আসে। তাই আয়তক্ষেত্রের প্রতিসাম্যতা ১৮০০। তাই আয়েতক্ষেত্রের প্রতিহসাম্যতা ১৮০০। অন্যদিকে বৃত্তের কথা যদি ধরি। তাহলে এটাকে যে কোণেই ঘোরানো হোক একই রকম চেহারা দেখাবে সবসময়। তাই একটা বিষয় নিশ্চিত আয়তক্ষেত্রের চেয়ে বর্গক্ষেত্রের প্রতিসাম্যতা বেশি। আবার বর্গক্ষেত্রের চেয়ে বৃত্তের প্রতিসাম্যতা বেশি।
আবার একই বস্তুর অনেকগুলো প্রতিসাম্যতা থাকতে পারে। যেমন আয়তক্ষেত্রের কথায় ধরা যাক। আয়তক্ষেত্র ১৮০০ কোণে একবার ঘোরালে সে আবার আগের চেহারায় ফিরে আসে। কিন্তু সেটা ঘোরানো হচ্ছে কোন অক্ষের সাপেক্ষে? একটা বর্গক্ষেত্রের একেবারে কেন্দ্রীয় বিন্দুর সাপেক্ষে ঘোরালে ১৮০০ সে প্রতিসাম্যতা দেখায়। আয়তক্ষেত্রের অক্ষ যদি পাল্টানো হয়, তাহলেও এর তিনটি ১৮০০ প্রতিসাম্যতা পাওয়া যাবে।
ওপরের ছবিগুলো দেখলেই আয়তক্ষেত্রের তিনটি স্বাধীন প্রতিসাম্যতার বিষয়টা বোঝা যাবে। এই যে একাধিক স্বাধীন প্রতিসাম্যতা, এগুলোকে একসাথে সিমেট্রি গ্রুপ বলে।
প্রতিসাম্যতাকে ভৌতভাবে রূপান্তর করা যায়। তিন ধরনের রূপান্তর আছে প্রতিসাম্যতার—ঘূর্ণন, ট্রান্সেলশন এবং বুস্ট। ঘূর্ণনের ব্যাপারটা আগেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এবার আসা যাক ট্রান্সশ্লেষণে। ধরা কোণো কণার ক্ষেত্রে একই ভৌত প্রক্রিয়া, যেটাকে আমরা রূপান্তর বলি, সেটা স্থানকালের দুটি ভিন্ন অঞ্চলে একই সময়ে ঘটতে পারে। এই প্রক্রিয়াকে স্পেস ট্রান্সশ্লেষণ বলে। আরেকটি ট্রান্সশ্লেষণ হলো টাইম ট্রান্সশ্লেষণ। স্থানকালের একটা নির্দিষ্ট অঞ্চলে কিন্তু আলাদা আলাদা সময়ে দুটি আলাদা ভৌত প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়, তাহলে সেই ট্রান্সশ্লেষণকে টাইম ট্রান্সশ্লেষণ বলে। আর আছে বুস্ট।
কোনো কণার ভৌত রূপান্তর একাধিক জড় প্রসঙ্গ কাঠামোতে ঘটানো যায়। যেমন, পৃথিবীর কোনো পরীক্ষাগারে ঘটানো কোনো রূপান্তর মহাকাশে ছুটন্ত কোনো মহাকাশযানের ভেতরে ঘটানো যায়। এক্ষেত্রে ঘটনা দুটি একে একে-অপরের সাপেক্ষে গতিশীল। সুতরাং রূপান্তরের ফলাফলও আলাদা পাওয়া যেতে পারে। আলাদা আলাদা প্রসঙ্গ কাঠামোতে ঘটানো ভৌত রূপান্তরই হলো বুস্ট। এই যে তিনটি রূপান্তরের কথা আমরা বললাম—ঘূর্ণন, ট্রান্সলেশন, এবং বুস্ট—এদেরকে একসঙ্গে একটা গ্রুপে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। সেই গ্রুপটাকে বলে পয়েনকেয়ার-গ্রুপ। এই পয়েনকেয়ার-গ্রুপও একটি গেস-সিমেট্রি-গ্রুপ।
‘গেস’ শব্দটার অর্থ পরিমাপ করা। এখানে কী পরিমাপ করা হয়?
পরিমাপ করা হয় প্রতিসাম্যতা। সত্যি বলতে কী, স্থানকালের বিভিন্ন বিন্দুতে প্রতিসাম্যতা খুঁজে বের করাই হলো গেস সিমেট্রির মূল কাজ। অর্থাৎ স্থানকালে দুই বা তার চেয়ে বেশি বিন্দুতে কণাদের যে রূপান্তর সেগুলোর পরিমাপ করাই হলো গেস সিমেট্রি।
গেস-সিমেট্রি পরমাপ কিন্তু সবসময় করা সম্ভব নয়। স্থানকালের খুব খাছাকাছি বিন্দুতে কোয়ান্টাম ফিল্ডে কণাদের রূপান্তর পরিমাপ করা তেমন কঠিন নয়। সেটা করতে পারলেই গেস-সিমেট্রি সহজেই পরিমোপ করা যায়। কিন্তু স্থানকালের বিন্দু দুটি যদি কাছাকাছি না হয়ে বহুদূরের দুটি বিন্দু হয়, তখন কিন্ত হিসাব উল্টে যাবে—চাইলেই অত সহজে তখন গেজ-সিমেট্রি পরিমাপ করা যাবে না। কারণ আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতা। এই তত্ত্বানুযায়ী স্থানকালের-প্রতিটা অঞ্চেলর স্থান ও কাল স্বতন্ত্র বা স্বাধীন। একই সঙ্গে দুটি স্থানে যুগপত্ কোনো ঘটনা ঘটলে সেটা যুগপত্ পরিমাপ করা যায় না। অথচ গেস সিমেট্রিতে দুটি আলাদা বিন্দুতে যুগপৎ ঘটনা ঘটে, সেটা আগেই বলেছি। বহুদূরের দুটি বিন্দুতে যদি যুগপৎ রূপান্তার না মাপা যায় তাহলে গেস সিমেট্রিই বা কীভাবে মাপা যাবে?
গেস-সিমেট্রি মাপার বিশেষ পদ্ধতি আছে। গাণিতিক পদ্ধতি। এই পদ্ধতির জন্য দরকার হলো গেস ফিল্ডের। গেজ ফিল্ড নিজে স্থানকালে ছড়িয়ে থাকে। চুপটি করে বসে থাকে না। গেস ফিল্ড ফার্মিওনিক ফিল্ডগুলোকে যুক্ত করে।
ভাইল ফার্মিওন কণার জনক হারম্যান ভাইলের ভাষায়, গেস ফিল্ড হলো রেল লাইনের সাথে। আর রেল লাইনের দুটি পাটির মধ্যে ফাঁক থাকে। সেই ফাঁকের কমবেশি হয় মাঝে মাঝে। ফাঁকের সেই পরিবর্তনকে বলে ডাইনামিক্স বা গতিবিদ্যা। অর্থাৎ গেস ফিল্ডের কাজ হলো ফার্মিয়নিক ফিল্ডের গেস সিমেট্রিতে যে পরিবর্তন, সেটা পরিমাপ করা। এটাই আসলে ওই ফার্মিয়নিক ফিল্ডের গতিবিদ্যা বা ডাইনামিক্স পরিমাপ করা। এই পরিবর্তন যখন কোয়ান্টায়িত হয়, অর্থাৎ ফিল্ডের সেই পরিবর্তনের ফলে কম্পনের সৃষ্টি হয়, সেই কম্পন থেকে জন্ম নেয় ভরহীন বলবাহী বোসন কণা। মোটকথা গেস ফিল্ড থেকে কানেক্টিং ফিল্ড পাওয়া যায়, সেই ফিল্ড থেকেই জন্ম হয় মৌলিক বলগুলোর।
এক ফার্মিয়নিক ফিল্ডের সাপেক্ষে অন্য ফার্মিয়নিক ফিল্ডের গেস সিমেট্রির যে পরিবর্তন হয়, সেটা দিকনির্ভর। তারমানে সেই পরিবর্তনগুলো ভেক্টর রাশি। সোজা কথায় গেস ফিল্ড থেকে যেসব বোসন কণাদের জন্ম হয় তাদের দিক থাকে। আর সেই বোসনদের গতিব্যাখ্যা করার জন্য যে গতিবিদ্যার দরকার হয় সেটাও দিকনির্ভর।
গেস সিমেট্রিকে প্রকাশ করার জন্য কিছু গাণিতিক সমীকরণের সাহায্যে। ম্যাট্রিক্স সমীকরণ। এই ম্যাট্রিক্স আবার দুইধরনের। ঐকিক U(n) এবং গুচ্ছ ঐকিক-ম্যাট্রিক্স SU(n); এখানে n হলো ম্যাট্রিক্সের উপাদান। কোয়ার্কের কথা আমরা আগেই শুনেছি। এই কোয়ার্কদের জন্যও গেস সিমেট্রি আছে। আগেই বলেছি কোয়ার্কদের তিনটি কালার আছে। ধরা যাক, এই তিন কালারের কোয়ার্ক নিজেদের মধ্যে পরিবর্তন ঘটিয়ে একটি আরেকটিতে রূপান্তরিত হলো। এর ফলে যদি এদের সমীকরণগুলোর যদি নড়চড় না হয়, তখন এদের মধ্যে প্রতিসাম্যতা দেখা দেবে। সেই প্রতিসাম্যতা প্রকাশ করা হবে SU(3) দিয়ে। এখানে 3 হলো কোয়ার্কের কালার সংখ্যা এবং ঝট হলো গুচ্ছ-ঐকিক ম্যাট্রিক্স। এর জন্য যে গেস সিমেট্রি গ্রুপ তৈরি হয়, তাকে বলে কোয়ান্টাম ক্রোমোডাইনামিক্স বা QCD. আর এই গেস-সিমেট্রি গ্রুপ থেকে যে বলের উদ্ভব হয় তাকে বলে সবল নিউক্লিয় বল।
ফার্মিয়ন কণাদের চার্জ থাকে। কণাদের এই চার্জিত বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করার জন্য আছে গেস সিমেট্রি। এই ধরনের গেস সিমেট্রি ব্যাখ্যা করা জন্য রয়ে কোয়ান্টাম ইলেক্ট্রোডাইনামিক্স বা QED. এই গেস সিমেট্রির জন্য রয়েছে বিদ্যুতচুম্বকীয় বলক্ষেত্র। এই ক্ষেত্র থেকে বোসন নামের কণাদের উত্পত্তি। বিদ্যুত্চুম্বকীয় বলক্ষেত্রে ফোটন কণারা ঘূর্ণনের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে প্রতিসাম্যতা বিনিময় করে। এখানে দ্বিতীয় কোনো কণার দরকার হচ্ছে না। তাই ম্যাট্রিক্সের উপাদান n=1। তাই এক্ষেত্রে প্রতিসাম্যতা প্রকাশ করা হয় SU(1) দিয়ে। তেমনি দুর্বল নিউক্লীয় বলেদের জন্যও রয়েছে গেস সিমেট্রি। দুর্বল নিউক্লীয় বল ভারী পরমাণুর থেকে তেজস্ক্রিয় রশ্মি বিকিরণ করতে সাহায্য করে। তেজস্ক্রিয় রশ্মির মূল উপাদান নিউট্রিনো আর ইলেকট্রন। আর ইলেকট্রনগুলো পরস্পরের সঙ্গে প্রতিসাম্যতা দেখাতে পারে। এর ফলে যে গেস-সিমিট্রি দেখা যায় তা প্রকাশ করা যায় SU(2) এর মাধ্যমে। এখানে n=2; কারণ ইলেকট্রন ও নিউট্রিনো দুটি মাত্র উপাদান আছে এই ম্যাট্রিক্সে।
পদার্থবিজ্ঞানের স্ট্যান্ডার্ড-মডেল মূল ভিত্তি তিনটি গেস-সিমেট্রি-গ্রপ। সেটা হলো U(3)xSU(2)xU(1)। তবে মহাকর্ষ বলের স্থান হয়নি এই গেস-সিমেট্রিতে। কারণ স্থানকালের গেস-সিমেট্রির পরিবর্তন বা ডায়নামিক্সকে এখনো সফলভাবে কোয়ান্টাইজ করা যায়নি।
২০১২ সালে শনাক্ত হয় গিগস বোসন বা ইশ্বর কণা। এর সঙ্গে সঙ্গেই পূর্ণতা পায় পদার্থবিদ্যার স্ট্যান্ডার্ড মডেল। স্ট্যান্ডার্ড মডেলে মহাবিশ্বের সকল মৌলক কণাদের স্থান দেওয়া হয়েছে। হিগস বোসনের জন্য একটা স্থান ছিল তাতে। অন্য সকল কণা ততোদিনে আবিষ্কার করা হয়ে গেছে। সন্ধান মেলেনি কেবল হিগস বোসন কণার দেখা। তাই স্ট্যান্ডার্ড মডেলে হিগস বোসনের ঘরটি ফাঁকাই ছিল দীর্ঘদিন। হিগস বোসন কণা শনাক্তের ব্যাপারটা যখন নিশ্চিত হলেন বিজ্ঞানীরা, সেদিন থেকে সেই ঘরটা আর ফাঁকা রইল না। হিগস বোসন কণাকে বসানো হলো সেখানে। অর্থাৎ সম্পূর্ণরূপে পূর্ণতা পেল কণা পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে সফল মডেলটি। কিন্তু বিজ্ঞানে শেষ কথা বলেই কিছু নেই। তাই একটা সমস্যা সমাধানের সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা সমস্যা এসে হাজির হয়। কণা পদার্থবিজ্ঞানেও এলো নতুন সমস্য। স্যমস্যাটার নাম হাইয়েরর্কি প্রবলেম।
হাইয়েরর্কি প্রবলেমটাা কী?
একটা হিগস বোসনকে যদি শূন্যস্থানে রেখে দেওয়া হয়, তাহলে এরা ভার্চুয়াল কণাদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় জড়িয়ে পড়ে। ভার্চ্যুয়াল কণা আবার কী? এ প্রশ্নের জবাব দেয় কোয়ান্টাম মেকানিক্স। আর কোয়ান্টাম মেকানিক্স দাঁড়িয়ে আছে অনিশ্চয়তা তত্ত্বের ওপর, গতে শতাব্দীর কুড়ির দশকে যেটা দাঁড় করিয়েছিলেন জার্মান পদার্থবিদ ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ। সেই তত্ত্ব বিশ্লেষণ করেই বেরিয়ে আসে আরেকটা তত্ত্ব—কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশন। এই তত্ত্ব বলে, শূন্যস্থান আসলে শূন্য নয়। তার ভেতর লুকিয়ে আছে শক্তি। সেই শক্তির যোগান দেয় ভার্চুয়াল কণারা।
সাধারণ কণার আর তার প্রতিকণার ভর সমান, কিন্তু চার্জ উল্টো। ইলেকট্রন আর পজিট্রনের ভর সমান। কিন্তু পজিট্রনের চার্জ ধনাত্মক। তেমনি প্রোটনের আর অ্যান্টিপ্রোটনের ভর সমান কিন্তু প্রোটন ধানত্মক আর অ্যান্টিপ্রোটেন ভর ঋণাত্মক। নিউট্রনের চার্জ নেই, তবু এর প্রতিকণা অ্যান্টি নিউট্রন আছে। সেটা সম্ভব হয়েছে কোয়ার্কের কারণে। প্রতি-কোয়ার্ক দিয়ে তৈরি হওয়া হওয়া নিউট্রনই আসলে প্রতি-নিউট্রন। একজোড়া কণা আর প্রতিকণা পরস্পরের সংস্পর্শে এলে দুটোই ধ্বংস হয়ে যায়। পড়ে থাকে শুধু শক্তি, আলো বা ফোটন আকারে। একটা প্রোটন আর অ্যান্টিপ্রোটন পরস্পরর্কে ধ্বংস করে দেয়, তেমনি ইলেকট্রন পজিট্রনকে, নিউট্রন-অ্যান্টিনিউট্রনকে, কোয়ার্ক অ্যান্টি-কোর্য়ককে ধ্বংস করে দেয়।
শূন্যস্থানে আসলে সবসময় এই কণা-প্রতিকণার সৃষ্টি আর ধ্বংসের খেলা চলছে। বিজ্ঞানীরা বলেন, প্রতি মুহূর্তে সব জায়গায় কণা আর প্রতি কণার জোড়া তৈরি হচ্ছে। কিন্তু তারা খুব ক্ষণস্থায়ী। জন্মের সাথে সাথেই এরা পরস্পরের সাথে সংর্ঘষ ঘটিয়ে ধ্বংস হয়ে যায়। পড়ে থাকে শক্তি। সেই শক্তিই পরক্ষণে আবার একজোড়া কণা-প্রতিকণা তৈরি করে। এভাবেই শূন্যস্থান থেকে যেসব কণা ও প্রতিকণার জোড়া তৈরি হয় তাদেরকেই বলে ভার্চ্যুয়াল কণা। আর হিগস বোসনের সঙ্গে এই ভার্চুয়াল কণাদের মিথস্ক্রিয়া ঘটে।
ভার্চুয়াল কণাদের কথা এখন থাক। ফিরে আসি হাইয়ারার্কি প্রবলেমে। হিগস বোসন কণাদের ভার্চ্যুয়াল কণাদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার ফলে এদের ভরের পরিবর্তন ঘটার কথা। শূন্যস্থানে বা শূন্য শক্তিমাত্রায় হিগস বোসনের ভর ১২৫ GeV। কিন্তু জিউটি (গ্রান্ড ইউনিফাইড থিওরি) শক্তিমাত্রায় এর ভর হওয়ার কথা অনেক বেশি। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে জিইউটি শক্তিমাত্রাতেও হিগস বোসনের ভর একটুও বাড়ে না। আটকে থাকে সেই ১২৫GeV-তে। ভর কেন বাড়ে না? ভর হিসাব অনুযায়ী না বাড়ার এই সমস্যাকেই বলে হাইয়ারার্কি প্রবলেম। এই হাইয়ারর্কি প্রবেলেমর ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য জন্ম হয় সুপার সিমেট্রি তত্ত্বের।
সুপার সিমেট্রিতে যাওয়ার আগে আমাদের জেনে নেওয়া উচিৎ জিইউটি শক্তিমাত্রা কী? জিইউটি হলো সেই বিখ্যাত গ্র্যান্ড ইউনিফেকশন থিওরি। আমরা বারো অধ্যায়ে দেখেছি স্টিভেন ওয়েনবার্গ, আবদুস সালাম আর শেলডন গ্ল্যাশোরা তড়িত্চুম্বকীয় বল আর দুর্বল নিউক্লীয় বলকে একীভূত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই দুই একীভূত বলের নাম হয় তড়িৎ দুর্বল বল। তারপর থেকে বিজ্ঞানীরা আজও চেষ্টা করে যাচ্ছেন সবল নিউক্লীয় বল আর তড়িৎ দুর্বল বলকে একীভূত করার। অর্থাৎ সবল, দুর্বল নিউক্লীয় আর তড়িচ্চুম্বকীয় বলকে একত্রিত করার চেষ্টা চলছে। যে তত্ত্বের সাহায্যে এই তিনটি বলকে একত্রিত করার চেষ্টা করছেন বিজ্ঞানীরা সেই তত্ত্বকে বললে গ্র্যান্ড ইউনিফিকেশন থিওরি। যার সংক্ষিপ্ত রূপ হলো জিইউটি। যে শক্তিমাত্রায় এই তিন বলকে একত্রিত করার সম্ভব সেই শক্তিমাত্রাকে বলে জিইউটি শক্তিমাত্রা।
হাইয়ারার্কি প্রবলেমের ব্যাখ্যা কী?
বিজ্ঞানীরা দুটি কারণ দাঁড় করিয়েছেন এর ব্যাখ্যায়। প্রথমটিতে ভার্চ্যুয়াল কণাদের এক বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয়েছে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন ভার্চুয়াল কণাদের ওপর হিগস বোসনের প্রভাব পরস্পর বিপরীতধর্মী। ভার্চ্যুয়াল কণাদের অর্ধেক হিগস বোসনের ভর বাড়িয়ে দেয়। বাকি অর্ধেক কমিয়ে দেয় সেই ভর। সুতরাং শক্তিমাত্রা যতই বাড়ুক হিগস বোসনের ভর একই থেকে যায়। দ্বিতীয় ব্যখ্যায় বলা হচ্ছে, কোনো এক অজ্ঞাত কারণে ভার্চ্যুয়াল কণাদের সঙ্গে হিগস বোসনের মিথস্ক্রিয়া অল্প শক্তিতেই থেমে যায়। একারণে হিগস বোসনের ভর বাড়ার আর অবকাশ পায় না।
কিন্তু এতেই সন্তুষ্ট নন বিজ্ঞানীরা। তাঁরা হাইয়ারার্কি প্রবলেম সমাধানের জন্য সুপার সিমেট্রি তত্ত্বের দিকে হাত বাড়ান। সিমেট্রি নিয়ে আগেই আলোচনা করেছি। এবার সুপার সিমেট্রি কী সেটা দেখে নেওয়া যেতে পারে। যে গ্রান্ড ইউনিফাইড থিয়োরি অর্থাৎ জিউটির কথা বলেছি একটু আগে, বিজ্ঞানীরা মনে করেন এই সুপার সিমেট্রিই হতে পারে সেই জিইউটি। এই সুপার সিমেট্রির মূল ভিত্তি হলো SU(5) গেস সিমেট্রি। সুপার সিমেট্রি তত্ত্ব বলে, কণা জগতে প্রতিটা ফার্মিয়ন কণার বোসন প্রতিসমকণা আছে, আবার প্রতিটা বোসনের ফার্মিয়ন প্রতিসমকণা আছে।
প্রতিসম কণা আর প্রতিকণা কিন্তু এক নয়। ফার্মিয়নের প্রতিকণারও ফার্মিয়ন শ্রেণির কণা, তেমনি বোসনের প্রতিকণা হয় বোসন শ্রেণির কণার মধ্যেই পড়ে। মূল কণা আর প্রতিকণাদের ভর স্পিন একই থাকে কিন্তু চার্জ আলাদা হয়। প্রতিসম কণাদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। মূল কণা আর প্রতিসমকণাদের ভর আর চার্জ একই কিন্তু স্পিন আলাদা হয়। সুপার সিমেট্রি মডেলে স্ট্যান্ডার্ড মডেলের প্রতিটা কণার প্রতিসমকণাদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। কোয়ার্ক আর লেপটন প্রতিটা কণাদের প্রতিসমকণা আছেই, সঙ্গে বোসন কণাদেরও প্রতিসমকণাদের স্থান দেওয়া হয়েছে। যেমন ফোটনের প্রতিসম ফার্মিয়ন হলো ফোটিনো, গ্লুয়োনের প্রতিসম ফার্মিওন গ্লুয়িনো, জেড বোসনের প্রতিসম ফার্মিওন হলো জিনো, ডাব্লুউ বোসনের উইনো এবং হিগস বোসনের ফার্মিয়ন প্রতিসম হলো হিগসিনো।
এখন কথা হলো সুপারসিমেট্রি মডেলের বেশিরভাগ কণাদেরই এখনো হদিস পাওয়া যায়নি। তাহলে কি এগুলোর মধ্যেই লুকিয়ে আছে ডার্ক ম্যাটার কণা? এ প্রশ্নের উত্তর আমরা খুঁজব পরের অধ্যায়গুলোতে।
এই বইয়ের সব পর্ব
- গুপ্ত ভরশক্তির খোঁজে
- প্রাচীন মহাবিশ্ব
- আধুনিক মহাবিশ্ব
- মহাবিস্ফোরণ
- কী ঘটেছিল মহাবিস্ফোরণের পর?
- গ্রাভিটেশনাল লেন্সিং
- জুইকি থেকে রুবিন
- যা চেয়েছি আর যা পেয়েছি
- ছায়াপথ স্তবক
- মূল কণিকাদের গল্প
- স্ট্যান্ডার্ড মডেল
- প্রতিসাম্যতা
- ডার্ক পার্টিকেলের খোঁজে
- মিলেনিয়াম সিমুলেশনে ডার্ক ম্যাটার
- নিউট্রিনো কি ডার্ক ম্যাটার?
- স্ট্যান্ডার্ড মডেলের ত্রুটি সুপারসিমেট্রিতে সমাধান
- ডার্ক ম্যাটারের প্রার্থী কারা?
- কীভাবে শনাক্ত হবে ডার্ক পার্টিকেল?
- গামা রশ্মির সন্ধানে
- মহাবিশ্বের সম্প্রারণ ও ডার্ক এনার্জি
- সুপারনোভার জন্ম
- আদর্শ বাতির খোঁজে
- আদিম আলোয় বিশ্ব দেখা
- মহাকাশের মানচিত্রে গুপ্ত ভরশক্তি
- কুইন্টেসেন্স তত্ত্ব
- ডার্ক ফোটনের সন্ধানে
- উপসংহার