কোয়ান্টাম ফিজিক্স-২৮ : দ্য ব্রগলির বস্তু তরঙ্গ

1
1114

[বইটির সূচীপত্র এবং সবগুলো খন্ডের লিংক একত্রে দেখুন এখানে]

১৮৯২ সালে ফ্রান্সের এক রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম লুই দ্য ব্রগলির। বিজ্ঞাানীদের নয়, হোমরা-চোমরা রাজনৈকিত লোকেদের নাম গল্প শুনতে শুনতে বেড়ে উঠেছেন। বাবার হয়তো ইচ্ছে ছিল ছেলে নামী রাজনীতিক হবে একদিন। সে গুড়ে বালি ঢেলে দেন তাঁর জৈষ্ঠ পূত্র মরিস দ্য ব্রগলি। মরিস একসময় চাকরি করতেন। পরে চাকরি-বাকরি ছেড়ে দিয়ে পিএইচডি করেন বিখ্যাত বিজ্ঞানী পল ল্যাভেঞ্জার অধীনে। তারপর নিজ উদ্যোগে একটা ল্যাবরেটরি গড়ে তোলেন। বাবার মৃত্যুর পর থেকে তিনিই পরিবারের প্রধান । ১৪ বছরের ছোট ভাই লুই দ্যা ব্রগলিকে স্কুলে পাঠান। মাত্র ১৭ বছর বয়সেই পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক। তারপর  নেভিতে যোগ দেন লুই। তখন ফ্রান্স-জার্মানির যুদ্ধ চলছিল। সেই যুদ্ধে অংশ নিতে হয় লুইকে। ১৯১৯ সালে ফিরে আসেন। ভাইয়ের ল্যাবরেটরিতেই শুরু করেন গবেষণা। তাঁদের ল্যাবরেটরির প্রধান গবেষণার বিষয় ছিল  এক্স-রে।

মরিস দ্য ব্রগলি
আর্থার কম্পটন

দুই ভাই এক সাথে গবেষণা করতেন। গবেষণার ফলাফল নিয়ে আলোচনা করতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তারপর হয়তো সমাধানে পৌঁছাতেন। তখন রঞ্জন রশ্মি ও কেলাস তত্ত্বের ওপর প্রচুর কাজ হচ্ছিল বিশ্বজুড়ে। ব্রগলি ভাইয়েরা তাঁদের ল্যাবরেটরিতে ওই বিষয়ে জোর গবেষণা শুরু করেন।
রঞ্জন রশ্মি আর কেলাস নিয়ে পরীক্ষা-নীরিক্ষা করতে গিয়ে তাঁর মাথায় আসে বেশ কিছু সম্যসা। সেসব সমস্যার সমাধান করতে গিয়েই ব্রগলি জন্ম দিলেন তরঙ্গ-কণার দ্বৈত ধর্মের। অর্থাৎ বস্তু তরঙ্গের জন্ম হলো। এই বস্তু তরঙ্গই বসিয়ে দিল কোয়ান্টাম বলবিদ্যার প্রথম ভিত।

দুই
আলোর কণা তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করেছি একেবারে প্রথম অধ্যায়ে। তারপর দেখলাম হাইগেনস তরঙ্গ তত্ত্ব সামনে নিয়ে এলেন। পরে থমাস ইয়াং দুই ছিদ্রের পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ দিলেন তরঙ্গ তত্ত্বের। পরে ম্যাক্সওয়েল এলেন, আলোর তরঙ্গ তত্ত্ব আরো জনপ্রিয় হলো এবং প্রবল বিক্রমে রাজত্ব করল কয়েক দশক। ১৯০০ সালে আলোর কোয়ন্টাম ধারণা প্রতিষ্ঠা করলেন ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক। আইনস্টাইন সেটাকে এগিয়ে নিলেন আরেক ধাপ। জন্ম দিলেন আলোক ফোটন তত্ত্বের। ফোটন তত্ত্বের মূল কথাই ছিল আলো আসলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ফোটন কণার সমষ্টি। সেটা প্রমাণ করতে তিনি ব্যবহার করলেন প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টা তত্ত্ব। আলোর কণা তত্ত্ব আবার ফিরে এলো পদার্থবিদ্যায়।

এসব ইতিহাস একটা যুদ্ধের ইঙ্গিত দেয়। কণা তত্ত্বের সাথে তরঙ্গ তত্ত্বের যুদ্ধ। এই যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত কেউই জয়ী হতে পারেনি। কখনো কণা তত্ত্ব ছড়ি ঘুরিয়েছে, কখনো বা তরঙ্গ তত্ত্বের জয়জয়কার। একই সাথে দুটো চরিত্র ব্যাখ্যা করতে পারেননি কেউ।

১৯১৯ সালে এসে আইনস্টাইন করলেন প্রথম চেষ্টা। তাপীয় বিকিরণের শক্তিবন্টনের করতে গিয়ে তিনি ফোটনের কণা তত্ত্ব ও তরঙ্গ তত্ত্বের মেলবন্ধন ঘটান। একটা সমীকরণে। সেই সমীকরণের একটা অংশ আলোর কণা বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে, আরেকটা অংশ দেখায় আলোর তরঙ্গ বৈশিষ্ট্য।  ১৯২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পদার্থবিদ আর্থার কম্পটন ফোটনের কণা-তরঙ্গ দ্বৈত ধর্মের পরীক্ষামূলক প্রমান দেন। সেই বিষয়ে আলোচনা এখানে করব না। আমরা বরং দ্য ব্রগলির কাছে ফিরে যাই। তিনি একটু উল্টোভাবে ভাবলেন। ভাবলেন, যদি আলোক তরঙ্গের কণা বৈশিষ্ট্য থাকে, তাহলে কি সম্ভব নয়, কণাদেরও তরঙ্গ বৈশিষ্ট্য থাকবে? আলোর ফোটন কণার যেহেতু তরঙ্গ বৈশিষ্ট থাকে, তবে অন্য কণাদেরও তরঙ্গ বৈশিষ্ট্য থাকলে ক্ষতি কী।

দ্য ব্রগলি সেই পথেই হাঁটলেন। তাঁর চিন্তাটাই ছিল একেবারে মৌলিক। অন্য কেউ যা কল্পনাতেও কোনোদিন ভাবেননি, দ্য ব্রগলি সেই অকল্পিত বিষয়ই ভাবতে বাধ্য করলেন অন্য বিজ্ঞানীদের। এই ভাবনার পেছনেও অবশ্য কারণ ছিল।

লুই দ্য ব্রগলি

তিন
আমরা বোর মডেলের বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা দেখেছিলাম। সেগুলোর কিছু কিছুর সমাধান করেছিলেন সোমারফেল্ড। কিন্তু সব প্রশ্নের উত্তর বোর-সোমারফেল্ড কেউই দিতে পারেননি। বোরের পরমাণু মডেলে বলা হয়েছিল ইলেকট্রন একটা নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘোরার সময় কোনো তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ বিকিরণ করে না। কিন্তু কেন করে না, তার ব্যাখ্যা বোরের তত্ত্বে ছিল না। সেই ব্যাখ্যা সোমারফেল্ডও দিতে পারেননি।

বোর বলেছিলেন, সেইসব কক্ষপথেই ইলেকট্রন থাকতে পারে যাদের ব্যাসার্ধ ħ (=h/২π)-এর সরল অখ- গুণিতক। ħ-এর সরল গুণিতক না হলে সেই কক্ষপথে ইলেকট্রন কেন থাকতে পারবে না, সে বিষয়েই জোরাল কোনো ব্যাখ্যা ছিল না বোর-সোমারফেল্ড মডেলে। দ্য ব্রগলি এই প্রশ্নগুলোরই উত্তর খুঁজছিলেন। সেটা তাঁর পিএইচডিকালীন সময়েই। অবশ্য আলোর কোয়ান্টাম ধর্ম নিয়ে ১৯২২ সালে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন তিনি। তবে সে প্রবন্ধটা খুব বেশি বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি কাড়তে পারেনি।

এরপর তিনি বস্তু তরঙ্গ নিয়ে গবেষণা করেন। বিশেষ করে ইলেকট্রন কীভাবে তরঙ্গের মতো আচরণ করে তাই ছিল গবেষণার বিষয়। সাজিয়ে-গুছিয়ে একটা প্রবন্ধ লিখলেন। সেটা তাঁর পিএইচডির থিসিস। তারপর সেটা জমা দিলেন শিক্ষকদের কাছে। সরবন বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯২৪ সালে। সে বছরই নভেম্বর মাসে ডাক পড়ল তাঁর। থিসিসের বিষয়বস্তু ব্যাখ্যা করার জন্য শিক্ষকদের মুখোমুখি হতে হয় তাঁকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষক ছিলেন। আর বাইরে থেকে এসেছিলেন পল ল্যাভেঞ্জা। তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কোয়ান্টাম তত্ত্বে বিশেষজ্ঞ গোছের ছিলেন না। তবে পল ল্যাভেঞ্জা কোয়ান্টাম বিশারদ। ব্রগলির থিসিস পেপার তাঁর মনে ধরল। তিনি পেপারটির অতিরিক্ত একটা কপি চাইলেন। আইনস্টাইনের কাছে পাঠাতে চান সেই অতিরিক্ত কপিটি। ব্রগলি অতিরিক্ত একটা কপি দিলেন ল্যাভেঞ্জাকে। সত্যি সত্যিই ল্যাভেঞ্জা সেটা আইনস্টাইনের কাছে পাঠান।
আইনস্টাইনের কাছে দ্য ব্রগলি একেবারেই অপরিচিত নাম। তবুও তিনি জবাব পাঠাতে দেরি করেননি। দ্রুতই ব্রগলির পেপারটি পড়েন। এবং ল্যাভেঞ্জাকে চিঠি লিখে জানান, ব্রগলির কাজটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এই কাজ তাঁকে আকর্ষণ করেছে। এই জায়গাতেই আইনস্টাইন ছিলেন অন্যরকম। শত ব্যস্ততার মাঝেও জুনিয়রদের লেখা পড়ার সময় ঠিক বের করে নিতেন। থমসন কিংবা রাদারফোর্ডের মতো তরুণ বিজ্ঞানীদের পেপার দিনের পর দিন না পড়ে ফেলে রাখতেন না। আমরা দেখেছি সত্যেন বোসের পেপার তিনি কত আগ্রহভরে পড়েছিলেন এবং অনুবাদ করেছিলেন।

আইনস্টাইনের প্রসংশা ব্রগলির কোয়ন্টাম যাত্রা সহজ করে দিল। ল্যাভেজ্ঞা ব্রগলিকে অভিনন্দন জানালেন। জানালেন আইনস্টাইনের মতও। সেই সাথে ব্রগলি পেয়ে গেলেন ডক্টরেট ডিগ্রিও।

চার
দেখে নেওয়া যাক, ব্রগলির বস্তু তরঙ্গের ধারণা কেমন ছিল। ব্রগলি বললেন, প্রতিটা জড় বস্তুর সাথেই তরঙ্গ জড়িত থাকে। কিন্তু ষেই তরঙ্গ বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায় বস্তু যখন গতিশীলি থাকে তখন। একটা টেনিস বল এক খেলোয়াড়ের কোট থেকে আরেক খেলোয়াড়ের কোটে যখন যায়, তখন একই সাথে একই সাথে কণা ও তরঙ্গ উভয়ের ধর্ম নিয়েই ছোটে। অর্থাৎ বস্তুর জড় গতির সাথে জড়িয়ে থাকে তরঙ্গ গতিও। সেটা শুধু টেনিস কিংবা কিক্রেট বলের ক্ষেত্রেই নয়। দ্রুত গতিতে ধেয়ে চলা বাস, ট্রাক কিংবা ট্রেনের গতির সাথেও তরঙ্গ গতি জড়িয়ে থাকে। গতিশীল বস্ত মানেই তার ভরবেগ থাকবে। গতিশীল বস্তুর ভরবেগ p হলে তার তরঙ্গ দৈর্ঘ্য \lambda । তাহলে তরঙ্গ সমীকরণটা হলো-
\lambda =\frac { h }{ mv } =\frac { h }{ p } ……..(১)
তবে বস্তুর ভর যত বেশি হয়, তার তরঙ্গ বৈশিষ্ট্য অনুধাবন করা তত কঠিন  হয়। কেন কঠিন তাও ব্রগলি অঙ্ক কষে দেখিয়ে দেন। আমরা জানি বস্তুর রৈখিক ভরবেগ p = mv h হলো প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবক। এর মান \lambda =\frac { h }{ mv } =\frac { h }{ p } । প্ল্যাঙ্ক ধ্রুবকের মান এমনিতেই খুব ক্ষুদ্র। গতিশীল বস্তুর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য হবে (১) নং সমীকরণ অনুযায়ী প্ল্যাঙ্ক ধ্রুবকের চেয়ে ছোট। বস্তুর ভর বেশি হলে তার আকারও বেশি। তাহলে বৃহৎ বস্তুর আকার এত বড় তার তরঙ্গ দৈর্ঘ্য প্ল্যাঙ্ক ধ্রুবকের মতো ছোট হওয়া কঠিন। তবুও তরঙ্গ থাকবে। কিন্তু অত ক্ষুদ্র তরঙ্গ বুঝতে পারা আমাদের জন্য অসম্ভব। তাই বস্তুর আকার ও ভর এমন হওয়া উচিত যাতে বস্তুটি কম্পনের একটা পর্যায় সম্পন্ন করতে হবে প্ল্যাঙ্ক ধ্রুকের চেয়েও ছোট কোনো জায়াগার মধ্যে। সেটা ইলেকট্রনের মতো ক্ষুদ্র বস্তুর পক্ষেই সম্ভব।

তাহলে কি আলোর ফোটন কণার তরঙ্গ থাকা সম্ভব দ্য ব্রগলির সমীকরণ অনুসারে? আলোর ফোটন কণা ভরহীন, এটা আমরা সবাই জানি। তাহলে ভর শূন্য হলে তরঙ্গ দৈর্ঘ্য অসীম হয়ে পড়ে। দ্য ব্রগলির সমীকরণ তাই তো বলে।

তাহলে?
ফোটনের স্থির ভর শূন্য। কিন্তু গতিশীল অবস্থায় আলোর ভরবেগ থাকে। ফোটনের আপেক্ষিক ভরবেগ তাই শুন্য হয় না। তাই দ্য ব্রগলির সমীকরণ মানতে আলোর ফোটন কণার কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

ভর কম হলে তরঙ্গ দৈর্ঘ কেমন হবে?
এই জায়গাতেই ব্রগলির আসল কারিশমা। তিনি বললেন বস্তুটি খুব ক্ষুদ্র হলে, ভর খুব কম হলে তার তরঙ্গ বৈশিষ্ট্য সহজেই ধরা দেয়। ইলেকট্রনের কথাই ধরা যাক। সেকালে ইলেকট্রনই ছিল সবচেয়ে হালকা ও সবচেয়ে ক্ষুদ্র কণিকা। ইলেকট্রনের ভর ও আয়তন দুটোই খুব ক্ষুদ্র। তার জন্য দ্য ব্রগলির সমীকরণ থেকে যে তরঙ্গ দৈর্ঘ্য পাওয়া যাবে, সেই দৈর্ঘের ভেতর ইলেকট্রন অনায়াসে তার তরঙ্গের পর্যায় সম্পন্ন করতে পারবে। সূতরাং ইলেকট্রনের তরঙ্গ বৈশিষ্ট্য বোঝা কঠিন কিছু নয়।

তাই যদি হয়, তাহলে পরমাণুর ভেতরে কক্ষপথগুলোতে যে ইলেকট্রন আছে তারাও নিশ্চয়ই তরঙ্গ ধর্ম দেখাতে পারে?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই দ্য ব্রগলি বোর পরমাণু মডেলের ত্রুটি বিচ্যূতি সব ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে সক্ষম হলেন।

পাঁচ
দ্য ব্রগলির পরমাণুর ভেতরে ইলেকট্রনের জন্য যে তরঙ্গ বের করেছিলেন সেটি আসলে স্থির তরঙ্গ। স্থির তরঙ্গ কি তা নবম শ্রেণির বইয়েই পাওয়া যায়। তবু আমরা বিষয়টা ঝালিয়ে নিতে পারি।
ধরা যাক, একটা লম্বা তার। তারের দুটো মাথা দুটো খুটিতে বাঁধা। তারটিকে মাঝখান থেকে টেনে ছেড়ে দিলে তারটি কাঁপতে শুরু করবে। কম্পনের ফলে তৈরি হবে তরঙ্গ। দুই খুঁটির যে বিন্দু তারের দুই প্রান্ত বাঁধা সেই বিন্দুকে বলে নিস্পন্দ বিন্দু। এধরনের বদ্ধ ব্যবস্থায় যে তরঙ্গ তৈরি হয় তাকে স্থির তরঙ্গ বলে।

খুটিতে বাঁধা তারে স্থির তরঙ্গ তৈরি হয়

ধরা যাক, প্রথমবার খুব মৃদু একটা টোকা দেওয়া হলো তারটিতে। তার ফলে একবার বেঁকে সোজা হয়ে গেল তারটি। এখানে একটাই মাত্র অর্ধ তরঙ্গ তৈরি হলো, সেটা তারের দৈর্ঘ্যরে সমান। কিন্তু একটা তরঙ্গ একটা পূর্ণ চক্র সম্পন্ন করতে যেটুকু সোজাপথ পাড়ি দেয়, সেটাই ওই তরঙ্গের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য। মৃদু টোকার ফলে একটা তারে অর্ধেক তরঙ্গ তৈরি হয়েছে। তাই তরঙ্গটির তরঙ্গ দৈর্ঘ্য হবে তারের দ্বিগুন। নিচের ছবির একদম ওপরের ছবিতে লক্ষ করুন।

দ্বিতীয়বার আরেকটু জোরে টোকা দেওয়া হলো। এবার  তারটি ভাগ হয়ে গেল দুভাগে। প্রতিভাগে একটা করে অর্ধেক তরঙ্গ তৈরি হয়েছে। দুটো অর্ধ তরঙ্গের জন্ম হয়েছে, কিন্তু তারের দৈর্ঘ্যতো বাড়েনি। তাই দুটি তারকে সমান দুটি ভাগে ভাগ করে নেবে দুটি অর্ধ তরঙ্গ। তারের অর্ধেক অংশে থাকবে একটা অর্ধ তরঙ্গ, অন্য অর্ধেক অংশে আরেকটা অর্ধ তরঙ্গ। তখন তরঙ্গের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য হবে তারের দৈর্ঘ্যরে সমান।

ধরা যাক, প্রতিবার একটু বেশি জোরো টোকা দিয়ে, একটা করে অর্ধ তরঙ্গ বাড়ানো হয়। তাহলে দেখা যাবে তৃতীয় বারে তরঙ্গ দৈর্ঘ্য হবে তারের দৈর্ঘ্যরে দুই তৃতীয়াংশের সমান। চতুর্থবার তরঙ্গ দৈর্ঘ্য হবে তারের দৈর্ঘ্যের অর্ধেক। প্রতিবার একটা করে তরঙ্গ বাড়ছে আর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য কমছে একটা নির্দিষ্ট হারে।


ব্রগলি একটু অন্যভাবে ভাবলেন, যদি তারটি খুটিতে না বেঁধে এর দুই খোলা প্রান্ত পরস্পরের সাথে জুড়ে দিয়ে একটা বৃত্তাকার লুপ তৈরি কার হয় তবে কেমন হবে?

সেই বৃত্তাকার লুপে যে তরঙ্গের সৃষ্টি হবে সেই তরঙ্গও হবে স্থির তরঙ্গ। নিস্পন্দ বিন্দু এখানে নেই। তবে তারটি আবদ্ধ, তাই এর তরঙ্গ আলোর তরঙ্গের মতো ক্রমাগত সামনে এগিয়ে যেতে পারে না। তাই এতে যে তরঙ্গ তৈরি হবে সেটা স্থির তরঙ্গই হবে।

ব্রগলি এই ধারণাটা ব্যবহার করলেন ইলেকট্রনের কক্ষপথে। ধরাযাক, বৃত্তাকার বা উপবৃত্তাকার কক্ষপথে ইলেকট্রন আবর্তন করছে। ইলেকট্রনের গতিশক্তি আছে এই কক্ষপথে। তাই তার একটা কৌণিক ভরবেগও আছে। আছে রৈখিক ভরবেগও। ভর আর বেগ আলাদা আলাদাভাবে জানা থাকলে রৈখিক ভরবেগ বের করা সম্ভব। রৈখিক ভরবেগে থেকে কৌণিক ভরবেগের হিসাবও বের করা যায়। আর ভরবেগ যেহেতু আছে, ১ নং সমীকরণ থেকে খুব সহজেই ইলেকট্রনের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বের করা সম্ভব।

তার আগে আমরা বরং দেখি ইলেকট্রনের কক্ষপথগুলোতে তরঙ্গের বিন্যাসটা কেমন হবে। ধরা যাক, একটা কক্ষপথে একটা মাত্র পূর্ণ তরঙ্গ জড়িত আছে। উপরের দ্বিতীয় ছবিটার মতো। তরঙ্গটার খোলা মুখ দুটি যদি ধীরে ধীরে বন্ধ করা যায় তাহলে নিচের চিত্রটির মতো একটা ছবি পাব।

একটা পূর্ণ তরঙ্গ বেঁকে ধীরে ধীরে গোলাকার বৃত্তে পরিণত হচ্ছে।

শেষমেষ যে বৃত্তকার তরঙ্গ পথ পাচ্ছি এটাকেই আমরা ইলেকট্রনের কক্ষপথ হিসেবে বিবেচনা করতে পারি। উপরের চিত্রে ইলেকট্রনের কক্ষপথের সাথে দ্য ব্রগলির তরঙ্গ কীভাবে জড়িয়ে আছে সেটা দেখানো হয়েছে। এখানে একটা পূর্ণ বৃত্তে একটাই মাত্র পুর্ণ কম্পন জড়িয়ে আছে। তাই বৃত্তটির পরিধি একটা মাত্র তরঙ্গ দৈর্ঘ্য নির্দেশ করবে।

পরিধির সাথে তরঙ্গ দৈর্ঘের সম্পর্কটা কিন্তু আমরা বের করে ফেলতে পারি। আমরা জানি, বৃত্তের পরিধি 2\pi r <span class="st"> এবং তরঙ্গ দের্ঘ্য \lambda <span class="st">। পরিধি আর তরঙ্গ দৈর্ঘ্যরে সম্পর্কটা আমরা বের করে ফেলতে পারি-
2\pi r = \lambda ……(২)
p হলো ধ্রুব সংখ্যা। তাই r-এর মান অর্থাৎ বৃত্তাপথের ব্যাসার্ধ পরিবর্তন হলেই কেবল তরঙ্গ দৈর্ঘ্য \lambda <span class="st">-এর মান পরিবর্তন হবে।
এখন যদি, একটা বৃত্তের সাথে যদি দুটি পূর্ণ তরঙ্গ যুক্ত থাকে তাহলে (২) সমীকরণ অনুসরণ করে পরিধি আর তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের সম্পর্ক হবে-
2\pi r = 2\lambda
এভাবে একটা বৃত্তের সাথে যদি ৩টি পূর্ণ তরঙ্গ যুক্ত থাকে তাহলে সমীকরণটা দাঁড়াবেÑ
2\pi r = 3\lambda
এভাবে যেকোনো সংখ্যক পূর্ণ তরঙ্গের জন্য একটা সাধারণ সমীখরণ পাবো। সেটা হলোÑ
2\pi r = n\lambda …….(৩)
n হলো পূর্ণ সংখ্যা। এখন এই সমীকরণে n-এর বিভিন্ন মান বসালে পর্যায়ক্রমে কক্ষপথ আর তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের যেসব ছবি পাব সেগুলো নিচের চিত্র থেকে দেখে নিতে পারি।


এখন (১) নং থেকে \lambda =\frac { h }{ p } -এর মান (৩) নং এ বসিয়ে পাই,
2\pi r = n\frac { h }{ p }
rp=\frac { nh }{ 2\pi  }
rmv=\frac { nh }{ 2\pi  } …….(৪)
আবার আমরা জানি, রৈখিক ভরবেগের সাথে ব্যসার্ধ্য গুণ করলে কৌণিক ভরবেগ পাওয়া যাবে। সুতরাং কৌণিক ভরবেগ L=rmv । তাহলে (৪) নং সমীকরণকে লেখা যায়-
Lrp=\frac { nh }{ 2\pi  }=n\hslash ………..(৫)
এখানে n পূর্ণসংখ্যা। সূতরাং কৌণিক ভরবেগ h/2π বা ħ-এর অখ- গুণিতক। অবশ্য এখানে n পূর্ণ তরঙ্গের সংখ্যা প্রকাশ করছে।

আমরা কিন্তু বোরের শর্তানুযায়ী কক্ষপথের সমীকরণ পেয়ে গেছি। দ্য ব্রগলি শর্ত থেকে বোরের সমীকরণ প্রতিপাদন করলাম। তাই বোরের পরমাণু মডেলে দ্য ব্রগলির তরঙ্গ তত্ত্বের প্রবেশে বাধা রইল না আর। সুতরাং এখন নিশ্চিতভাবেই বলা যায় ইলেকট্রন শুধু বস্তু নয় একই সাথে সে তরঙ্গ।

ছয়
দ্য ব্রগলির শুধু এটাই সাফল্য নয়। এই সমীকরণের জন্ম হয়েছিল যেসব সমস্যার ওপর দাঁড়িয়ে সেগুলোই দূর করা যায় দ্য ব্রগলির তত্ত্ব দিয়ে।

প্রথম সমস্যার দিকে চোখ ফেরানো যাক। একটা বৃত্তাপথে ঘূর্ণণশীল চার্জিত কণা তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ বিকিরণ করার কথা। কিন্তু বোর দেখিয়েছেন নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘোরা কোনো কোনো ইলেকট্রন তুড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ বিকিরণ করে না। আসলে ম্যাক্সওয়েলের তরঙ্গ সীমকরণের হিসাব মতে কোনো বস্তু ত্বরিত হলে সেটা শক্তি বিকিরণ করে। বৃত্তাপথে ঘোরা চার্জিত বস্তুর বেগ সুষম। কিন্তু বেগের শুধু দিক পরিবর্তন হলেও এর মানের পরিবর্তন হয়। আর মান পরিবর্তন মানেই সেটা ত্বরিত বা মন্দিত হয়। বৃত্তপথে ঘুর্ণনশীল বস্তুও ত্বরিত হচ্ছে। আর ত্বরণশীল চার্জিত কণা তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ বিকিরণ করে। বিকিরত সেই তড়িচ্চুম্বকীয় শক্তির যোগান দেয় বস্তুর কৌণিক গতিশক্তি। সুতরাং শক্তি বিকিরণের ফলে ক্রমাগত ছোট হতে থাকে বৃত্তাপথের দৈর্ঘ্য। তাই কমতে থাকে চার্জিত কণা বা ইলেকট্রনের কক্ষপথের ব্যসার্ধ। সেকারণেই ইলেকট্রন সর্পিল গতিতে গিয়ে নিউক্লিয়াসে হুমড়ি খেয়ে পড়ার কথা। কিন্তু সেটা হয় না, তা আমরা আগেই দেখেছি।

কেন হয় না, সেটার ব্যাখ্য দিলেন দ্য ব্রগলি। ব্রগলির তত্ত্বমতে ইলেক্ট্রন যখন কোনো স্থায়ী কক্ষপথে ঘোরে তখন এর ত্বরণ থাকে না। ত্বরণ থাকবে না কেন তার ব্যখ্যাও দিলেন ব্রগলি। খুব সহজ ব্যাখ্যা। তরঙ্গের কোনো ত্বরণ থাকে না। সে আলোক তরঙ্গই হোক আর শব্দ তরঙ্গই হোক। মাধ্যমের তারতম্যের কারণে গতির হেরফের হতে পারে। কিন্তু ত্বরণ বা মন্দন হয় না তরঙ্গের। দ্য ব্রগলি বললেন, ইলেকট্রন তার কক্ষপথে ঘোরে তরঙ্গাকারে। তাই ইলেকট্রন বৃত্তাপথে ঘুরলেও তার কোনো ত্বরণ থাকে না। ত্বরণ থাকে না বলেই সে তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ বিকিরণ করে না।

খুব সহজ সমাধান। কিন্তু আমরা দেখলাম এই সমস্যাটাই কীভাবে বোর, সোমারফেল্ড এমনকী সে সময় কণা পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে যত বিজ্ঞানী কাজ করেছেন সবাই হন্যে হয়ে ছুটেছেন এই সমস্যার পেছনে। সবার ঘামের গন্ধ তো আর ইতিহাসের পাতায় লেগে থাকে না। অত বড় একটা সমস্যার সমাধান দ্য বগ্রলির ছোট্ট এবং সহজ সমীকরণের ভেতর লুকিয়ে ছিল!

যেসব কক্ষপথে তরঙ্গ ভঙ্গুর অবস্থায় থাকে
সেসব কক্ষপথে ইলেকট্রন থাকতে পারে না

সমস্যা আরো দুটো রয়ে গেল। কেন নির্দিষ্ট কক্ষপথেই ইলেকট্রন ঘুরবে। দুটি অনুমোদিত কক্ষপথের মাঝখানে আরো অনুমোদিত কক্ষপথ থাকে। যেগুলোতে ইলেকট্রনের কৌণিক ভরবেগ p -এর অখ- গুণিতক। কিন্তু বোর প্রথমে বলেছিলেন যেসব কক্ষপথের শক্তি প্ল্যাঙ্ক ধ্রুবকের সরল n-এর অখন্ড গুণিতক, শুধু সেসব কক্ষপথের কৌণিক ভরবেগ p -এর অখ- গুণিতক। কিন্তু সেই শক্তিস্তরগুলোতে শক্তির মান প্ল্যাঙ্ক ধ্রুবকের অখ- গুণিতক কেন, তার ব্যাখ্যা বোর মডেলে ছিল না। সোমারফেল্ডও ব্যাখ্যা করতে পারেননি। কিন্তু দ্য ব্রগলি পারলেন। ব্রগলি বললেন, ওইসব কক্ষপথের পূর্ণ সংখ্যার পূর্ণতরঙ্গ থাকে। অর্থাৎ যেসব বৃত্তাকর পথে ইলেকট্রন পূর্ণ সংখ্যার তরঙ্গ সেসব কক্ষপথে শুধু ইলেকট্রন থাকতে পারবে। যেসব কক্ষপথে ভগ্নদশার তরঙ্গ জড়িত সেসব কক্ষপথে ইলেকট্রন থাকতে পারে না। উপরের চিত্রের দিকে লক্ষ রাখুন। আসলে এ ধরনের কক্ষপথের অস্তিত্বই নেই পরমাণুতে।

কোন কক্ষপথে কয়টি পূর্ণ দৈর্ঘ্যরে তরঙ্গ থাকবে, তা আমরা বুঝব কী করে। এখানে এসে ব্রগলি বোরের তত্ত্বের সাথে তার তত্ত্বের সমন্বয় ঘটালেন। ৫ নং সমীকরণটা আরেকবার দেখে নেওয়া যাক-
\frac { nh }{ 2\pi  } ………..(৫)
এখানে n দিয়ে ব্রগলি পূর্ণ তরঙ্গের সংখ্যা প্রকাশ করেছিলেন। আবার বোর একই সমীকরণে n দিয়ে প্রধান কোয়ান্টাম সংখ্যা প্রকাশ করেছিলেন। সেই কোয়ান্টাম সংখ্যা দিয়েই নির্ধারণ করা হত নিউক্লিয়াস থেকে কক্ষপথটি কতদূরে। n=১ মানে সেটা নিউক্লিয়াসের সবচেয়ে কাছের অনুমোদিত কক্ষপথ। n=২ মানে, প্রথম কক্ষপথের পরে দ্বিতীয় পর্যায়ে যে অনুমোদিত কক্ষপথ আছে, সেটা। এভাবে n-এর মান যত বেশি নিউক্লিয়াস থেকে তার দূরত্বও তত বেশি।
ব্রগলির হিসাবটাও কি তেমন?

হাইড্রোজেন পরমাণুতে ইলেকট্রনের তরঙ্গায়ীত কক্ষপথ

এভাবে হ-এর মান এক এক করে যত বাড়বে, তত নিউক্লিয়াস থেকে বাইরের দিকের কক্ষপথ নির্দেশ করবে। সূতারাং বোরের প্রধান কোয়ান্টাম সংখ্যাকেই দ্য ব্রগলির পূর্ণ তরঙ্গের সংখ্যার সাথে মিলিয়ে ফেলা যায় সহজেই। দুই ক্ষেত্রে হ দুটি আলাদা বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করলেও শেষ গন্তব্য এক। তাই বোর মডেলে পরিপূর্ণভাবে দ্য ব্রগলির তত্ত্বের প্রয়োগ ঘটানো যায়।

সাত
দ্য ব্রগলির সমীকরণ বোর মডেলের ত্রুটিগুলো দূর করল। পাশাপাশি বোর মডেলের যেসব বৈশিষ্ট্য বোর আর সোমারফেল্ড প্রমাণ করেছিলেন, সেগুলোও বোর ব্যাখ্যা করতে সমর্থ হলেন। অর্থাৎ বস্তু বা ইলেকট্রনের তরঙ্গ ধর্ম তাত্ত্বিক ও গাণিতিকভাবে প্রমাণিত হলো। বাকি থাকল কেবল পরীক্ষামূলক প্রমাণ।

দ্য ব্রগলির তরঙ্গের পরীক্ষামূলক প্রমাণটা হবে কীভাবে? ইলেকট্রনের তরঙ্গ ধর্শের প্রমাণ দিতে হবে। সেটা কীভাবে? দ্য ব্রগলিই বাতলে দিলেন সমাধানের পথ। আলোর মতো ইলেকট্রনের অপর্তন ধর্ম থাকার কথা। পরীক্ষাগারে যদি সেটা প্রমাণ করা যায়, তাহলে দ্য প্রমfণ হবে ইলেকট্রনের তরঙ্গ র্ধম। কিন্তু এই পরীক্ষা দ্য ব্রগলির পক্ষে করা সম্ভব ছিল না। তিনি তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে যতটা পটু ছিলেন, ততটা দক্ষ ছিলেন না পরীক্ষা-নীরিক্ষামূলক পদার্থবিজ্ঞানে। তিনি বড় বড় এক্সপেরিমেন্টাল বিজ্ঞানীদের অনুরোধ করলেন, ইলেকট্রনের তরঙ্গ ধর্ম প্রমাণের পরীক্ষাটি করার জন্য। কীভাবে পরীক্ষাটি করা সম্ভব সেটাও ব্রগলির জানা ছিল না।

জার্মানির গটিংগন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ওয়াল্টার এসলার উপায় বাতলে দিলেন। বললেন যদি ইলেকট্রনের তরঙ্গ ধর্ম থাকে, তাহলে একটা পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে। সাধারণ কৃস্টালের ভেতর দিয়ে পাঠাতে হবে ইলেকট্রন। কৃস্টালের অণুগলোর মধ্যে দূরত্ব খুবই কম। অণুগুলোর সজ্জার মধ্যে ক্ষুদ্র ফাঁকগুলো খুব সূক্ষ। সেই ফাঁকগুলোই সূক্ষ্ম ছিদ্রের মতো কাজ করবে। তার ভেতর দিয়ে ইলেকট্রন প্রবহিত করলে তা অপবর্তিত হতে পারে, যদি ইলেকট্রন সত্যিই তরঙ্গ প্রকৃতির হয়। এই পরীক্ষা অনেকটা ইয়াংয়ের ডাবলস্লিটের পরীক্ষার মতো। এলসারের এই প্রস্তাব আইনস্টাইনের বেশ মনে ধরে। তিনি তাঁকে উৎসাহিত করেন পরীক্ষাটি করতে। কিন্তু এলসার পরীক্ষাটি করতে একটু বেশি সময় নিয়ে ফেলেন। বিজ্ঞানীদের একজনের দেরি আরেকজনের পোয়াবারো হতে পারে। এলসারের ক্ষেত্রেও তাই হলো।

ক্লিনটন ডেভিসন ও লেস্টার গার্মার
জি পি থমসন

১৯২৫ সাল। যুক্তরাষ্ট্রের বেল ল্যাবরেটির গবেষক ক্লিনটন ডেভিসন অনাকাঙ্খিত এক ঘটনার মধ্য দিয়ে ইলেকট্রনের অপবর্তন প্রমাণ করে ফেলেন। ইলেকট্রন নিয়েই ছিল তাঁর যত কাজ। তিনি বিভিন্ন ধাতব বস্তুকে লক্ষ বানিয়ে ইলেকট্রন ছুঁড়ে তাতে আঘাত করতেন। একদিন তাঁর একটা তরল বায়ু ভরা বোতল ফেটে যায়। বোতলের গায়ে নিকেলের প্রলেপ দেওয়া ছিল। নিকেলের গায়ে মরিচা পড়ে নষ্ট হয়ে যায়। সেকারণেই ভেঙে যায় বোতলটি। বোতলের গা থেকে নিকেল সরিয়ে নিতে চাইলেন। এজন্য নিকেলকে উত্তপ্ত করতে হলো। সেই উত্তপ্ত নিকেল প্রলেপ পরে অন্য একটি পরীক্ষায় কাজে লাগালেন। কিন্তু পরীক্ষার একটু ভিন্ন রকম ফল এলো। কেন এলো সেটা তিনি বোঝেননি। তবে পরীক্ষার ফলাফলটা তিনি টুকে নিলেন। পরে ফলাফলাটি প্রকাশ করেন কোনো এক জার্নালে। পরে কয়েকজন বিজ্ঞানী এই ফলের ব্য্যাপাটা নিয়ে পত্রিকায় লিখলেন। তারা জানালেন ডেভিসনের পরীক্ষাটি দ্য ব্রগলির সমীকরণের সাথে মিলে যায়। কিন্তু ডেভিসন তখনও দ্য ব্রগলির নামই শোনেননি, তাঁর তত্ত্ব দূরে থাক।

ডেভিসন তখন দ্য ব্রগলি আর তাঁর কাজ সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিলেন। তারপর সত্যি সত্যি পরীক্ষাটি সাজিয়ে গুছিয়ে আরেকবার করা সিদ্ধন্ত নিলেন। এবার তাঁর সঙ্গী হলেন সহকর্মী লেস্টার গারমার। সেটা ১৯২৭ সালে। সেই পরীক্ষার ফল দ্য ব্রগলির তত্ত্বকে সম্পূর্ণ সমর্থন করল। ইলেকট্রন অপবর্তিত হলো, প্রমাণ হলো ইলেকট্রনের তরঙ্গ ধর্ম।


একই ধরনের পরীক্ষায় পাওয়া ইলেকট্রনের (বাঁয়ে) এবং আলোক রশ্মির অপবর্তন প্যাটার্ন

জর্জ পেজেট থমসন। জে জে থমসনের পূত্য। ইলেকট্রনের আবিষ্কারক তিনি। ইলেকট্রন নিয়ে বহু গবেষণা তিনি করেছেন। সেইসব গবেষণা আকৃষ্ট করে তাঁর পূত্রকেও। জি পে থমসনও বাবার ল্যাবরেটরিতে ইলেকট্রনের প্রকৃতি নিয়ে নানা গবেষণা করতেন। তিনিও উৎসাহিত হলেন ইলেকট্রনের অপবর্তনের পরীক্ষাটা তিনি নিজের মতো করে করতে চাইলেন। পরক্ষিা থেকে তিনি ইলেকট্রনের অপবর্তন ধর্ম যেমন বের করতে সক্ষম হলেন, বের করলেন ইলেকট্রনের তরঙ্গ ধর্মও। সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হলো ইলেকট্রনের তরঙ্গ ধর্ম।

ইলেকট্রনের তরঙ্গ তত্ত্ব আবিষ্কারের জন্য দ্য ব্রগলি নোবেল পুরস্কার দেওয়া হলো ১৯২৯ সালে। আর ১৯৩৭ সালে ইলেকট্রন অপবর্তন পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণের জন্য যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হলো ডেভিসন ও জিপি থমসনকে।

[বইটির সূচীপত্র এবং সবগুলো খন্ডের লিংক একত্রে দেখুন এখানে]
বিজ্ঞান পত্রিকায় সম্পূর্ণ বইটি পড়া যাবে। তবে কেউ সংগ্রহে রাখতে চাইলে অনলাইনে কেনা যাবে ০১৫৫ ৭৭৭ ৯৩২৩ নম্বরে ফোন করে।

-আব্দুল গাফফার রনি
বিজ্ঞান লেখক
[লেখকের ফেসবুক প্রোফাইল]

1 মন্তব্য

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.