আইনস্টাইন কি তবে আলোর গতির ব্যাপারে ভুল ছিলেন?

2
630

নবজাতক মহাবিশ্বে বর্তমান সময়ের চেয়ে আলোর গতি হয়তো বেশী ছিলো। সাম্প্রতিক একটি তত্ত্ব অনুযায়ী এমন ধারনাই উঠে এসেছে যা আলোর গতি নিয়ে আইনস্টাইনের ধারনার সাথে মেলে না। আইনস্টাইন আলোর গতিকে শূন্য মাধ্যমে সর্বদা ধ্রুব মনে করতেন যার উপর ভিত্তি করে পদার্থবিদ্যার নানাবিদ তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের ম্যাগুয়েইজো এবং ক্যানাডার ওয়াটারলু বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়াযেশ আফশর্দি প্রস্তাব করেন মহাবিশ্বের জন্মলগ্নে আলোর গতি ছিলো অসীম যখন এর তাপমাত্রা ছিলো প্রলয়ঙ্কারী ১০ হাজার ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন (এক এর পর ২২ টি শূন্য) ডিগ্রি সেলসিয়াস।

১৯৯০ এর দশকের শেষ সময় হতেই ম্যাগুয়েইজো এই তত্ত্বটি প্রতিষ্ঠা করার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। তবে কেবলই কিছুদিন পূর্বে তিনি এবং আফশর্দি প্রথমবারের মতো গবেষণাপত্রে এই ধারনা উপস্থাপন করেন এবং কীভাবে এই বিতর্কিত ধারনাটি পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে সেই ব্যাপারে দিক নির্দেশনা দেন। যদি সত্যি হয়, তাহলে এই তত্ত্বটি বিগ ব্যাংএর অবশেষ থেকে প্রাপ্ত পটভৌমিক মহাজাগতিক মাইক্রোওয়েভ বিকিরণের একটা ব্যাখ্যা দান করবে যা জ্যোতির্বিদগণ স্যাটেলাইটের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করেন।

শূন্য মাধ্যমে আলোর গতিকে জগতের অন্যতম একটি মৌলিক ধ্রুবক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব হতে এই দিকনির্দেশনা পাওয়া যায় এবং এই ধ্রুবকের মান ঘন্টায় ১ বিলিয়ন কিলোমিটার সাব্যাস্ত করা হয়। যদিও আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্বটি আধুনিক পদার্থবিদ্যার অন্যতম একটি ভিত্তিস্তম্ভ, তথাপি বিজ্ঞানীরা এখন মনে করেন মহাবিশ্বের সৃষ্টি লগ্নে পদার্থবিদ্যার সূত্রগুলো এখনকার মতো কার্যকরী ছিলো না।

ম্যাগুয়েইজো এবং আফশর্দি তাঁদের যে তত্ত্ব নিয়ে হাজির হয়েছেন তার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যায় কেন বিপুল দূরত্বে মহাবিশ্বকে একই রকম দেখায়। এতটা সুষম হতে হলে আলোকরশ্মিকে মহাবিশ্বের সব প্রান্তেই পৌঁছাতে হবে, নতুবা কিছু অংশ অপেক্ষাকৃত উষ্ণ এবং কিছু অংশকে শীতল হতে হবে। কিন্তু ঘন্টায় ১ বিলিয়ন কিলোমিটারের মত বিপুল গতি নিয়েও আলোর পক্ষে বিশাল মহাবিশ্বের সকল প্রান্তে পৌঁছানো সম্ভব নয়, তাই মহাবিশ্বের সকলপ্রান্তের সুষম তাপমাত্রার ব্যাখ্যা পাওয়াও সম্ভব নয়।

এই ধাঁধার সমাধান পাওয়ার জন্য স্টিফেন হকিংসহ জ্যোতির্বিদগণ ইনফ্লেশন বা স্ফীতিতত্ত্ব নিয়ে হাজির হয়েছিলেন যার আলোকে বলা হয় উদ্গত প্রাথমিক মহাবিশ্ব খুব স্বল্প সময়ের পাল্লায় ব্যাপকতর প্রসারণের শিকার হয়। স্ফীতিতত্ত্ব অনুসারে, এই ব্যাপক স্ফীত হয়ে প্রকান্ড আকারে পৌঁছানোর পূর্বেই আলো মাহাবিশ্বের সর্বত্র পৌঁছে সুষম অবস্থা তৈরি করে। এর ফলে আলোর গতিকে শূন্যমাধ্যমে ধ্রুব ধরেই মহাবিশ্বের সুষম অবস্থার ব্যাখ্যা দেওয়া যায়। কিন্তু স্ফীতি তত্ত্বের সপক্ষে যথাযথ কোনো আলামত পাওয়া যায় নি। যদি স্ফীত তত্ত্ব সত্য হয়েই থাকে তাহলে কেনই বা মহাবিশ্ব হঠাৎ করে ব্যপকতর স্ফীতির মধ্য দিয়ে গিয়েছিল আর কেনইবা সেই স্ফীতকরণের সমাপ্তি হয়েছিলো সেধরনের কোনো ব্যাখ্যাও পাওয়া যায় নি।

আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব অনুযায়ী আলোর গতিকে ধ্রুব হিসেবে ধরা হয়।
আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব অনুযায়ী আলোর গতিকে ধ্রুব হিসেবে ধরা হয়।

ম্যাগুয়েইজো এবং আফশর্দির তত্ত্ব স্ফীতির ধারনা বাতিল করে এবং এর বদলে আলোর পরিবর্তনশীল গতি ধরে নেয়। তাঁদের গণনা অনুযায়ী, মহাবিশ্ব সৃষ্টির প্রাথমিক অবস্থায় এটি এতই উত্তপ্ত ছিলো যে আলো এবং অন্যান্য কণিকা অসীম বেগে গতিশীল হতে পেরেছে। এই অবস্থার প্রেক্ষিতে, আলো মহাবিশ্বের প্রতিটি কোনায় পৌঁছে যেতে পেরেছে এবং একে সুষম অবস্থা দান করেছে যা আমরা বর্তমানে দেখতে পাই। আফশর্দি এই প্রসঙ্গে বলেন, “আমাদের তত্ত্ব অনুযায়ী, আমরা যদি মহাবিশ্বের প্রাথমিক অবস্থায় ফিরে যাই তাহলে দেখতে পাব সেখানে এত উচ্চ তাপমাত্রা ছিলো যে সবকিছু অপেক্ষাকৃত দ্রুততর হয়েছিলো। আলোর সেই অবস্থায় অসীম বেগে গতিশীল হয়েছিলো এবং মহাকর্ষের চেয়ে বেশী বেগে ক্রিয়া করেছিলো। এই অবস্থা থেকে দশা পরিবর্তিত হয়ে মহাবিশ্ব বর্তমান অবস্থায় পৌঁছায় যেমনটি তরল পানি দশা পরিবর্তিত হয়ে বাস্পে পরিণত হয়।”

সত্যিই আলোর গতি মহাকর্ষের গতিকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলো কিনা তা বিজ্ঞানীরা খুব শিঘ্রই পরীক্ষা করে দেখতে পারবেন। এই তত্ত্ব প্রারম্ভিক মহাবিশ্বের ঘনত্বের বিভিন্নতার একটি পরিষ্কার প্যাটার্ন অনুমান করে যা স্পেক্ট্রাল ইনডেক্সের মাধ্যমে পরিমাপ করা হয়। Physical Review তে গবেষকদল যে গবেষণাটি প্রকাশ করেছেন তাতে একটি অতি সূক্ষ স্পেকট্রাল ইনডেক্স ০.৯৬৪৭৮ উল্লেখ করা হয়েছে। অপর দিকে গণনা করে এই ইনডেক্স পাওয়া গেছে ০.৯৬৮ যা তাত্ত্বিক মানের বেশ কাছাকাছি।

এটাই যথাযথ তত্ত্ব কিনা তা বিজ্ঞান কখনো পুরোপুরি প্রমাণ করতে পারবে না। তবে আফশর্দি বলেছেন, যদি আগামী পাঁচ বছরের পরিমাপে স্পেকট্রাল ইনডেক্স তাত্ত্বিকভাবে প্রত্যাশিত মানের চেয়ে অনেকটা বিচ্যুত হয়ে যায় তাহলে বোঝা যাবে নতুন তত্ত্বটি যথাযথ নয়। তিনি বলেন, “যদি আমরা ঠিক হই তাহলে স্ফীতি তত্ত্ব ভুল। কিন্তু স্ফীতি তত্ত্বের সমস্যা হলো, এটিকে পরিবর্তনের মাধ্যমে পর্যবেক্ষনের সাথে মিলিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকে।”

ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যায়লয়ের তাত্ত্বিক কসমোলজি কেন্দ্রের গবেষক ডেভিড মার্শ অবশ্য স্ফীতি তত্ত্বটিকে এখনই বাতিল করে দিতে চাইছেন না। তিনি বলেন, ” স্ফীতি তত্ত্বটি স্টিফেন হকিং এবং অন্যান্যরা মিলে ত্রিশ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং এটি বিভিন্ন জ্যোতির্বিদ্যাগত পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে খুব ভালোভাবে পরীক্ষিত। অনেক বিজ্ঞানীই স্ফীতি তত্ত্বটিকে মহাবিশ্ব এবং গ্যালাক্সি সৃষ্টির একটি সরল এবং চমৎকার ব্যাখ্যা হিসেবে দেখে আসছেন। ”

এছাড়া মার্শের মতে, যদিও অন্যান্য তত্ত্বগুলো বেশ সুন্দর দেখায় সেগুলোর সমস্যাও আছে। যেমন তিনি বলেন আফশর্দি এবং ম্যাগুয়েইজোর তত্ত্বে এমন জিনিস আছে যেগুলো বোঝা কঠিন। [দ্যা গার্ডিয়ান অবলম্বনে]

-ইমতিয়াজ আহমেদ
সম্পাদক, বিজ্ঞান পত্রিকা
[লেখকের ফেসবুক প্রোফাইল]

বিজ্ঞান পত্রিকা প্রকাশিত ভিডিওগুলো দেখতে পাবেন ইউটিউবে। লিংক:
১. টেলিভিশনঃ তখন ও এখন
২. স্পেস এক্সের মঙ্গলে মানব বসতি স্থাপনের পরিকল্পনা
3. মাইক্রোস্কোপের নিচের দুনিয়া

2 মন্তব্য

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.