অধ্যায়-৫: আইসোটোপ
অনুচ্ছেদ-২: নিউক্লিয়াসের প্রকরণ
[বইয়ের সূচীপত্র তথা প্রকাশিত সবগুলো আর্টিকেলের জন্য এখানে দেখুন]
যদি তেজষ্ক্রিয়তার শক্তি নিউক্লিয়াসের হারানো ভর হতেই উৎসরিত হয়, তাহলে পরিণতিতে সেই নিউক্লিয়াসের কী হবে? এর উত্তরের সূচনা হয়েছিল যখন নিউক্লিয়াসই যে শক্তির উৎস এটি জানা গিয়েছিল তারও আগে। এমনকি যখন নিউক্লিয়াস বলতে কিছু আছে কিনা তা-ও জানা যায় নি সেই সময় থেকেই এই চিন্তাধারা প্রচলিত। (প্রায়শঃই এমন হয় যে, বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ এমন একটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়া শুরু করেছে, যার গ্রহণযোগ্য তত্ত্ব তখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এই ধরনের অগ্রীম পর্যবেক্ষণ বুঝতে পারা বেশ কষ্টকর এবং তত্ত্ব ছাড়া এই ধরনের জ্ঞান এগোয় খুব ধীরে। যখনই তত্ত্বটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় তখন পর্যবেক্ষণসমূহ খুব দ্রুতই জায়গা মতো বসে যায়। অগ্রগতি তখন খুব দ্রুত হয় যতক্ষণ না পর্যন্ত বিজ্ঞানের আরো গভীর এবং প্রশস্ত বোধগম্যতার অনুপস্থিতি আবারো তৈরি হয়।)
১৯০০ সালে ক্রুকস ইউরেনিয়াম ধাতু নিয়ে কাজ করছিলেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, যতদূর সম্ভব তিনি এটিকে বিশুদ্ধ করে যাবেন এবং এই ভাবনা থেকে একে বিভিন্ন রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিয়ে গেলেন এবং খাদসমূহ পৃথক করলেন। বিস্ময়ের সাথে তিনি লক্ষ্য করলেন, বিশুদ্ধিকৃত ইউরেনিয়াম খুব সামান্যই তেজষ্ক্রিয়, বরং খাদের অংশটুকুই বেশি তেজষ্ক্রিয়তা দেখাচ্ছে। তিনি প্রস্তাব করলেন ইউরেনিয়াম নয়, বরং অবিশুদ্ধ ইউরেনিয়ামের সাথে খাদ হিসেবে যা থাকে তা-ই হচ্ছে তেজষ্ক্রিয়তার উৎস।
বেকরেল, যিনি ইউরেনিয়ামের তেজষ্ক্রিয়তা আবিষ্কার করেছিলেন, তিনি আগের ধারণাকে এত সহজে নষ্ট হতে দিতে রাজি হলেন না। বিজ্ঞানীরা প্রায়ই তাঁদের আবিষ্কারকে সন্তান-জ্ঞান করেন এবং এটিকে নির্মূল করার যেকোনো প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে কঠোরভাবে অবস্থান নেন। এটি একটি সাধারণ মানবীয় বৈশিষ্ট্য, এমনকি কখনো তা ভুল হিসেবেও দেখা যায়। তবে এই ক্ষেত্রে বেকরেল সঠিক বলেই প্রমাণিত হয়েছিলেন। বেকরেল দেখালেন, ক্রুকস যেই পদ্ধতিতে ইউরেনিয়াম পরিশোধন করেছিলেন তাতে এর তেজষ্ক্রিয়তা হ্রাস পায় ঠিকই, কিন্তু একে কিছুটা সময় দিলে তা পুনরায় তার তেজষ্ক্রিয়তা উদ্ধার করে।
১৯০২ সালে রাদারফোর্ড এবং তাঁর সহকর্মী, ব্রিটিশ রসায়নবিদ ফ্রেডরিখ সডি (Frederick Soddy, ১৮৭৭-১৯৫৬) দেখালেন যে এই কথা থোরিয়ামের জন্যও প্রযোজ্য। যদি ধাতুটিকে বিশুদ্ধ করা হয় তাহলে এর অধিকাংশ তেজষ্ক্রিয়তা লোপ পায়, কিন্তু সময় দিলে পুনরায় তার তেজষ্ক্রিয়তা ফিরে পায়। রাদারফোর্ড এবং সডি তাই প্রস্তাব করলেন, যখন ইউরেনিয়াম পরমাণু তেজষ্ক্রিয় বিকিরণ নির্গত করে তখন এর প্রকৃতি বদলে যায় এবং এটি অন্য ধরনের পরমাণুতে পরিণত হয় যা আরো বেশি তেজষ্ক্রিয়। এই নতুন মৌলটি তেজষ্ক্রিয় হওয়ায় নিজেও পুনরায় পরিবর্তিত হয়ে যায়। ইউরেনিয়াম নিজে খুব বেশি তেজষ্ক্রিয় নয়, কিন্তু এর উত্তরসূরী মৌলগুলো আরো বেশি তেজষ্ক্রিয়। যখন ইউরেনিয়ামকে বিশুদ্ধ করা হয় তখন এর উত্তরসূরী মৌলসমূহ পৃথক হয়ে যায় যার ফলে এর তেজষ্ক্রিয়তা অনেকাংশে কম দেখা যায়। কিন্তু একে কিছুটা সময় দিলে পুনরায় এর মধ্যে থেকে নতুন মৌল তৈরি হয়। ফলে পুনরায় এই নতুন মৌলগুলো হতে আগের মতো তীব্র তেজষ্ক্রিয়তা পাওয়া যায়। দৃশ্যতঃ পরমাণুসমূহ তেজষ্ক্রিয় বিকিরণের ফলে এমন কিছু অভিজ্ঞতা লাভ করে যাকে তেজষ্ক্রিয় বিভাজন বা ভাঙন হিসেবে বর্ণনা করা যায়।
এই প্রস্তাবণাকে যথার্থ হিসেবেই পাওয়া গেল। ইউরেনিয়াম এবং থোরিয়াম উভয়েই ভেঙে অন্য মৌলে পরিণত হলো। এরা নিজেরা আবার পর্যায়ক্রমে ভেঙে শেষ পর্যন্ত একটি মৌলে পরিণত হলো। এই নতুন মৌল তেজষ্ক্রিয় নয়। এভাবে একটি তেজষ্ক্রিয় ধারা বা শ্রেণি পাওয়া যায়। বিজ্ঞানীরা ইউরেনিয়াম এবং থোরিয়ামের ভাঙনের ধারায় যেই মধ্যবর্তী মৌলগুলো উৎপন্ন হয়, সেগুলো অনুসন্ধান শুরু করলেন। এদের মধ্যে দুটি মৌল হল পোলোনিয়াম এবং রেডিয়াম। কুরি দম্পতি আগেই এগুলো আবিষ্কার করেছিলেন। পাশাপাশি এটিও আবিষ্কৃত হলো, এই ধারায় বারবার পরিবর্তিত হতে হতে শেষ পর্যন্ত যেই অতেজস্ক্রিয় মৌলটি পাওয়া যায় সেটি হচ্ছে লেড বা সীসা।
তেজষ্ক্রিয় ভাঙনের ধারণা বিজ্ঞানীদের জন্য বড় ধাক্কা হিসেবে উপস্থিত হলো। লুসিপ্পাস এবং ডেমোক্রিটাসের কাল থেকে বলা হচ্ছে, পরমাণুসমূহ অবিভাজ্য। তবে অবশ্য এটি শুধু অনুমানই ছিল। পরমাণুসমূহ অবিভাজ্য এটি নিশ্চিত হওয়ার জন্য অদ্যাবধি শুধুমাত্র রাসায়নিক পরিবর্তনকেই আমলে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তেজষ্ক্রিয়তায় রাসায়নিক পরিবর্তন হয় না। রাসায়নিক পরিবর্তনে শুধুমাত্র পরমাণুর সর্ববহিঃস্থ ইলেক্ট্রনসমূহ জড়িত। এই ক্ষেত্রে পরমাণু কোনো ইলেক্ট্রন-চার্জ গ্রহণ করতে পারে। এর ফলে অন্য পরমাণুর সাথে ফলস্বরূপ বন্ধন গঠন করতে পারে কিন্তু এর প্রকৃত পরিচিতি যা এর নিউক্লিয়াসের উপর নির্ভর করে তা অক্ষত থাকে। আর তেজষ্ক্রিয়তা নিউক্লিয়াসের সাথে জড়িত। এটি একটি নিউক্লিয় পরিবর্তন, এবং যদি নিউক্লিয়াস একটি পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায় তাহলে এমনটি হওয়ার কথা যে এক ধরনের পরমাণু পরিবর্তিত হয়ে অন্য ধরনের পরমাণুতে পরিণত হবে।
এই ধরনের একটি পরিবর্তনের প্রেক্ষাপট এমন নয় যে, যাবতীয় রসায়নের বইগুলোকে কেটেকুটে ছুঁড়ে ফেলতে হবে যেন এগুলোতে যা লেখা আছে তার সবই এখন অনর্থক। বরং এই নতুন দৃষ্টিকোণটি জ্ঞানের পরিমাণ খুব সামান্যই বাড়াল এবং সামান্যই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখা প্রদান করল। বিংশ শতাব্দীর পাঠ্যবইগুলো অবশ্যই নিউক্লিয় পরিবর্তনকে আমলে নেয়। তবে তারা চাইলে আগের মতোই রাসায়নিক পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা করে যেতে পারে এবং পরমাণুকে আগের মতোই পরিবর্তনবিহীন ধরে নিতে পারে যখন এগুলো রাসায়নিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রেই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখবে।
ইউরেনিয়াম ও লেডের মধ্যবর্তী এবং থোরিয়াম ও লেডের মধ্যবর্তী তেজষ্ক্রিয় মৌলগুলোর অনুসন্ধান কার্যক্রম বেশ সফল হয়েছিল- প্রকৃতপক্ষে মাত্রাতিরিক্ত সফল হয়েছিল। অনেক বেশি মধ্যবর্তী মৌল পাওয়া গিয়েছিল।
ইউরেনিয়ামের পারমাণবিক সংখ্যা ৯২, এবং থোরিয়ামের হলো ৯০। লেডের পারমাণবিক সংখ্যা ৮২ এবং একটি জানা মৌল বিসমাথের পারমাণবিক সংখ্যা ৮৩। তৎকালীন অনাবিষ্কৃত পর্যায় সারণির শেষের দিকের মৌলগুলোর পারমাণবিক সংখ্যা ছিল ৮৪, ৮৫, ৮৬, ৮৭, ৮৮, ৮৯ এবং ৯১। সবমিলিয়ে সাতটি। এ থেকে আরো বাদ যাবে নতুন আবিষ্কৃত পোলোনিয়াম এবং রেডিয়াম, সব মিলিয়ে বাকি থাকে পাঁচটি। এই পাঁচটি বাদে এদের মাঝে আর কোনো নতুন মৌল থাকতে পারবে না। একটিও না! ১৯১৪ সালের মোসলের গবেষণা থেকে এই বিষয়টি সুনির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
তারপরও মোসলের সময় থেকে ৩০ টিরও বেশি মধ্যবর্তী বস্তু আবিষ্কৃত হয়ে গিয়েছিল। এদের প্রত্যেকে একে অপরের চেয়ে সুস্পষ্টভাবে পৃথক, অন্তত এদের তেজষ্ক্রিয়তা বিচার করলে তেমনটিই পাওয়া যায়। কেউ কেউ আলফা কণিকা নিঃসরণ করে, এবং কেউ নিঃসরণ করে বিটা কণিকা। এমনকি যখন মধ্যবর্তী দুটি বস্তু আলফা কণিকা নিঃসরণ করে তখন একটি হয়তো যে শক্তিতে আলফা কণিকা নির্গত করে, অপরটি করে তার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিতে।
সডি এই সমস্যা মোকাবেলা করলেন। ১৯১২ এবং ১৯১৩ সালের মধ্যে, যখনও পারমাণবিক সংখ্যা গবেষণা করে বের করা হয়নি, সডি দেখলেন যে, মধ্যবর্তী বস্তুগুলোর কয়েকটির মধ্যে রাসায়নিক ধর্ম একই রকম। যদি এদেরকে মিশ্রিত করা হয়, তাহলে সাধারণ রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় এদেরকে আলাদা করা যায় না। এরা একই মৌল ছিল এবং তার মানে হলো এদের ইলেক্ট্রন বিন্যাস একই এবং তাই এদের নিউক্লিয়াসের ধনাত্মক চার্জও একই। যেহেতু এদের তেজষ্ক্রিয়তার মধ্যে পার্থক্য ছিল তার মানে চার্জের বাইরে, এদের নিউক্লিয়াসে অন্য কিছুর মধ্যে পার্থক্য ছিল।
পর্যায় সারণিটি ছিল মৌলের রাসায়নিক ধর্মের ভিত্তিতে নির্মিত। যদি দুটি ভিন্ন ধরনের পরমাণুর রাসায়নিক ধর্ম একই হয় এবং শুধুমাত্র তেজষ্ক্রিয়তার ক্ষেত্রে ভিন্নতা দেখায় তাহলে (রাসায়নিকভাবে) তারা একই মৌল এবং অবশ্যই পর্যায় সারণিতে একই জায়গায় স্থান দিতে হবে।
সডি তাঁর অনুসন্ধানলব্ধ বিষয় ১৯১৩ সালে ঘোষণা করলেন। তিনি বিভিন্ন ধরনের পরমাণুর নামকরণ করলেন আইসোটোপ (গ্রিক শব্দ হতে, যার অর্থ হলো একই স্থান) যারা পর্যায় সারণিতে একই স্থানের অন্তর্ভুক্ত। তিনি তাঁর কাজের জন্য ১৯২১ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করলেন।
এই ঘটনাটি পরমাণুর দীর্ঘদিনের ধারণার প্রতি আরেকটি আঘাত। লুসিপ্পাস, ডেমোক্রিটাস এবং ডাল্টন, এদের সকলেই ধরে নিয়েছিলেন, একটি নির্দিষ্ট মৌলের সকল পরমাণু একই রকম। তখন পর্যন্ত এমন বিরোধি কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। বিজ্ঞানীরা মধ্যবর্তী তেজষ্ক্রিয় বস্তুগুলো নিয়ে কাজ করছিলেন। প্রতিটি মৌলের জন্য পাঁচ/ছয়টি করে প্রকরণ পাওয়া গিয়েছিল। তাদের প্রতিটির তেজষ্ক্রিয়তা ভিন্ন ধরনের।
১৯১৪ সালে, যখন পারমাণবিক সংখ্যার ধারণাটি স্পষ্ট হয়ে গেল তখন কিভাবে এক পরমাণু অপর পরমাণুতে পরিণত হয় তার বিস্তারিত খুঁজে দেখার সুযোগ তৈরি হলো। এভাবে, ইউরেনিয়াম পরমাণুর নিউক্লিয়াসের পারমাণবিক ভর ২৩৮ এবং পারমাণবিক সংখ্যা ৯২। আমরা এটিকে বলি U-২৩৮। তেজষ্ক্রিয় বিকিরণের ফলে আলফা কণিকা নির্গত হলে, এর নিউক্লিয়াস থেকে আলফা কণিকার পারমাণবিক ভর ৪ এবং পারমাণবিক সংখ্যা ২ বাদ দিতে হবে। যা বাকি থাকবে, তাহলো পারমাণবিক ভর ২৩৪ এবং পারমাণবিক সংখ্যা ৯০ বিশিষ্ট একটি নিউক্লিয়াস। একটি আলফা কণিকা যখন নির্গত হয় তখন সর্বদাই নিঃসরণকারী নিউক্লিয়াসের পারমাণবিক ভর ৪ করে এবং পারমাণবিক সংখ্যা ২ করে হ্রাস পায়।
ক্রুকস যখন ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াসের এই বিয়োজন আবিষ্কার করেছিলেন, তখন তিনি উৎপন্ন বস্তুকে নাম দিয়েছিলেন ইউরেনিয়াম এক্স। অজানা কিছুর নামকরণে এটি এক ধরনের পদ্ধতি, কেননা, কী ঘটেছে সেই সম্বন্ধে তাঁর বিন্দুমাত্র কোনো ধারণা ছিল না। এখন এই সব নতুন আবিষ্কারের ফলে জানা গেল নতুন পরমাণুটি হচ্ছে থোরিয়াম, যেহেতু এর প্রতিটি পরমাণুরই পারমাণবিক সংখ্যা হচ্ছে ৯০।
সাধারণভাবে, সুবিদিত থোরিয়ামের পারমাণবিক ভর ছিল ২৩২ এবং তাই এটি হচ্ছে Th-২৩২। ইউরেনিয়ামের বিয়োজনে উৎপন্ন বস্তুর পারমাণবিক ভর ছিল ২৩৪ এবং তাই এটি হলো Th-২৩৪। এখানে আমরা দুটি আইসোটোপের একটি উদাহরণ পাচ্ছি। উভয়েই ৯০ পারমাণবিক সংখ্যা বিশিষ্ট এবং তাই এদের নিউক্লিয়াসের চার্জ +৯০। যদিও এদের ভরের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য আছে। Th-২৩৪, Th-২৩২ এর চেয়ে দুই একক বেশি ভারী।
এটি কি আসলেই উল্লেখযোগ্য কোনো পার্থক্য? রাসায়নিক দৃষ্টিকোণ থেকে উত্তর হচ্ছে, না। Th-২৩৪ এবং Th-২৩২ উভয়েরই যেহেতু নিউক্লিয়াসের চার্জ +৯০, তাই এদের ইলেক্ট্রনও আছে ৯০ টি করে, যা প্রতিটি ক্ষেত্রে একইভাবে বিন্যাস্ত এবং তাই উভয়েরই সব রাসায়নিক ধর্ম একইরকম। কিন্তু তেজষ্ক্রিয়তার দৃষ্টিকোণ থেকে এই পার্থক্যটুকু উল্লেখযোগ্য। সাধারণ থোরিয়াম হলো Th-২৩২ যা খনিতে পাওয়া যায় এবং তা আলফা কণিকা নির্গত করে। কিন্তু ইউরেনিয়ামের বিয়োজনের ফলে যেই থোরিয়াম উৎপন্ন হয় তা হলো Th-২৩৪ এবং তা বিটা কণিকা নির্গত করে। শুধু তা-ই নয়, থোরিয়াম-২৩৪ এর পরমাণুগুলো থোরিয়াম-২৩২ এর পরমাণুর চেয়ে ২০০ বিলিয়নগুণ বেশি দ্রুত বিয়োজিত হয়। এটি নিশ্চয়ই বিশাল পার্থক্য।
থোরিয়ামের অন্যান্য আইসোটোপও আছে যাদের একই তেজষ্ক্রিয় ধারা কিংবা ভিন্ন তেজষ্ক্রিয় ধারা হতে পাওয়া যায়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে Th-২২৭, Th-২২৮, Th -২২৯, Th-২৩০ এবং Th-২৩১। এদের প্রত্যেকেই ভিন্ন ভিন্নভাবে বিয়োজিত হয় এবং তাদের ভাঙনের হারও বিভিন্ন, এবং এদের প্রত্যেকেই Th -২৩২ এর চেয়ে অনেক দ্রুত ভেঙে যায়। তবে, আগে চলুন থোরিয়াম-২৩৪ এর কাছে ফিরে যাই, যেটি বিটা কণিকা নিঃসরণ করে। এই নিঃসরণের ফলাফলস্বরূপ, এটি কি কোনো পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়?
বিটা কণিকা মূলত একটি ইলেক্ট্রন। এর চার্জ হচ্ছে-১, তাই বলা যায় এর পারমাণবিক সংখ্যা হচ্ছে-১। এটির ভর হাইড্রোজেন পরমাণুর ১৮৩৭ ভাগের ১ ভাগ বা ০.০০০৫৪। এই পরিমাণটি এতোই অল্প যে আমরা যদি একে ০ ধরে নিই তাহলেও খুব বেশি ভুল হবে না। তার মানে হলো, কোনো নিউক্লিয়াস থেকে যদি বিটা কণিকা নির্গত হয়, তাহলে তার নিউক্লিয়াস থেকে তেমন কিছু বিয়োগ করতে হবে না এবং এটি প্রায় অপরিবর্তিত থাকবে। তবে আমাদেরকে অবশ্যই পারমাণবিক সংখ্যা থেকে -১ বিয়োগ করতে হবে। কোনো কিছু থেকে -১ বিয়োগ করা আর তার সাথে +১ যোগ করা একই কথা, যার ফলে পারমাণবিক সংখ্যা ১ বৃদ্ধি পাবে। তাই Th-২৩৪ যার পারমাণবিক সংখ্যা ৯০। পারমাণবিক ভর ২৩৪। একটি বিটা কণিকা নির্গত করার পর পারমাণবিক সংখ্যা হয় ৯১ এবং পারমাণবিক ভর হয় ২৩৪। পারমাণবিক সংখ্যা ৯১ বিশিষ্ট মৌলটি হলো প্রোট্যাক্টিনিয়াম, যেটিকে ১৯১৭ সালে প্রথমবারের মতো সনাক্ত করেছিলেন জার্মান রসায়নবিদ ওটো হান (Otto Hahn, ১৮৭৯-১৯৬৮) এবং তাঁর সহকর্মী, অস্ট্রিয়ান রসায়নবিদ লিজে মিটনার (Lise Meitner, ১৮৭৮-১৯৬৮)। অর্থাৎ আমরা যা পেলাম তা হলো, Th-২৩৪ রূপান্তরিত হয়ে Pa-২৩৪ এর পরিণত হলো।
গামা রশ্মির নিঃসরণে একটি পরমাণুর নিউক্লিয়াসের কোনো পরিবর্তন হয় না। গামা রশ্মির পারমাণবিক সংখ্যা ০, কেননা এতে কোনো চার্জ নেই। এর পারমাণবিক ভরও ০। কারণ এর কোনো ভরও নেই। গামা রশ্মি নিঃসরণকারী একটি নিউক্লিয়াস শুধুমাত্র শক্তিই হারায়।
যেই-না বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করলেন, কীভাবে প্রত্যেক ধরনের তেজষ্ক্রিয় বিকিরণ একটি পারমাণবিক নিউক্লিয়াসের পরিবর্তন ঘটায়। তাঁরা একটি তেজষ্ক্রিয় ধারার প্রতিটি মধ্যবর্তী পরমাণুর যথাযথ পরিচিতি নির্ণয় করতে সক্ষম হলেন।
আইসোটোপের ধারণা পর্যায় সারণিটিকে অক্ষত রাখল। এর প্রতিটি স্থানে শুধু মাত্র এক ধরনেরই পরমাণুই থাকবে যদি আমরা শুধুমাত্র পারমাণবিক সংখ্যার কথা চিন্তা করি। আইসোটোপের পারমাণবিক সংখ্যার বিভিন্নতায় কিছু এসে যায় না, রাসয়নিক বৈশিষ্ট্যগুলোই গুরুত্বপূর্ণ। তবে নিউক্লিয়াসের কাঠামোর সাথে এর সম্পর্ক ও ধর্মের বিষয়ে আমরা পরবর্তীতে ফিরে আসব।
[বইয়ের সূচীপত্র তথা প্রকাশিত সবগুলো আর্টিকেলের জন্য এখানে দেখুন। বিজ্ঞান পত্রিকায় সম্পূর্ণ বইটিই পড়া যাবে, তবে মুদ্রিত সংস্করণটি সংগ্রহ করতে চাইলে যোগাযোগ করুন: ছায়াবিথী প্রকাশনী, ফোন: ০১৯১৫৯৩৯৬৬৮]
-ইমতিয়াজ আহমেদ
সম্পাদক, বিজ্ঞান পত্রিকা
[লেখকের ফেসবুক প্রোফাইল]