[বইটির সূচীপত্র এবং সব খন্ডের লিংক একত্রে দেখুন এখানে]
১৮৮৭ সালে। মাইকেলসন-মর্লির পরীক্ষাটি করেছিলেন। ব্যবহার করা হলো মাইকেলসনে ইন্টারফেরোমিটার। ইন্টারফেরেমিটারে থাকে দুটি আয়না। একটা আয়না রাখা হয় পৃথিবীর গতির অভিমুখে, অর্থাৎ পূব-পশ্চিম বরাবর। আরেকটা রাখা হয় পৃথিবীর সমোকোণে, অর্থাৎ উত্তর-দক্ষিণ বরাবর। মাইকেলসন-মর্লি একটা আলোক উৎস রাখলেন পরীক্ষা টেবিলে। আলোক উৎসের সামনে রাখা হলো অর্ধরৌপায়িত একটা আয়না। অর্ধরৌপায়িত আয়নাটি রাখা হয় আগের দুই আয়ানার সাথে ৪৫ ডিগ্রি কোণে এবং দুটো থেকেই সমান দূরত্বে।
এখন আলোক উৎস থেকে একঝাঁক আলোক রশ্মি এসে পড়বে অর্ধরৌপায়িত আয়নার ওপর। এই আয়নার একটা বিশেষ গুণ আছে। আয়নার ওপর পড়া আলোক রশ্মির অর্ধেক প্রতিফলিত হয়। আর বাকি অর্ধেক আলোক রশ্মি আয়না ভেদ করে চলে যায়।
মাইকেলসন-মর্লি আলোক উৎস থেকে রশ্মি নিক্ষেপ করলেন। সেই রশ্মি গিয়ে পড়ল অর্ধ রৌপায়িত আয়নায়। সেখানে আলোক রশ্মি দুইভাগে ভাগ হয়ে গেল। একভাগ গিয়ে আয়না ভেদ করে গিয়ে পড়ল পৃথিবীর গতির অভিমুখে রাখা আয়নায়। আরেকভাগ অর্ধরৌপায়িত আয়নায় প্রতিফলিত হয়ে সেখান থেকে সোজা গিয়ে পড়ল পৃথিবীর সমকোণে রাখা আয়নায়। তারপর দুই আয়না থেকে প্রতিফলিত হয়ে সেই রশ্মি আবার এসে পড়বে অর্ধরৌপায়িত আয়নায়। সেখান থেকে আলোক রশ্মির গন্তব্য পর্যবেক্ষণ স্থল। মাইকেলসন-মর্লি হিসাব করে দেখলেন দুটো আয়না থেকেই প্রতিফলিত আলোকরশ্মি একই সময়ে পর্যবেক্ষণ স্থলে এসে পৌঁছাছে।
কেন এমন হবে? এক্ষেত্রে ইথারের ভূমিকাই বা তা হলে কী? ইথার যদি থাকত তাহলে পৃথিবীর সমকোণে রাখা আলো ওপর ইথারের স্রোত আলোর গতির ওপর কোনো ভূমিকায় রাখতে পারত না। অন্যদিকে পৃথিবীর গতির অভিমূখে যে রশ্মিটা পাঠনো হয়েছিল সেটা ইথারের স্রোত দ্বারা প্রভাবিত হত। তার গতি শ্লথ হয়ে যেত। নদীতে চলা সেই নৌকার মতো। সুতরাং পৃথিবীর গতির অভিমূখে থাকা আয়না থেকে আলো পর্যবেক্ষণ স্থলে পৌঁছতে একটু বেশি সময় লাগত।
কিন্তু মাইকেলসন-মর্লি দেখলেন দুই আলোক রশ্মিই একই সময়ে পর্যবেক্ষণ স্থলে এসে পৌঁছচ্ছে। তা হলে কী ইথারের বাধা ছিল না? তাঁরা নিশ্চিত হলেন ইথারের বাধা আলোর ওপর কোনো প্রভাব বিস্তার করেনি। তাহলে আলো চলে কীভাবে? মাইকেলসন-মর্লি সে ব্যাখ্যা দিতে পারলেন না। পরীক্ষা হলো, প্রমাণ হলো। কিন্তু ব্যাখ্যা হলো না। তবে শেষমেষ ইথারের অস্তিত্ব ভেঙে পড়ল। এর জন্য অপেক্ষা করতে হলো বহুদিন।
মাইকেলসন-মর্লি দেখালেন ইথার বলে কিছু নেই। কিন্তু অনেক বিজ্ঞানী সেটা মানতে পারলেন না। তাঁরা উঠেপড়ে লাগলেন বিভিন্ন প্রকল্প দাঁড় করিয়ে ইথার সংক্রান্ত জটিলতা দূর করার জন্য। বিশেষ করে কিছু বিজ্ঞানী ইথারকে বাদ দিতে একেবারে নারাজ ছিলেন। তাই তাঁরা ইথারকে ধরে রাখেতে ভিন্ন পথ অবলম্বন করলেন। এর মধ্যে আইরিশ বিজ্ঞানি ফিট জেরাল্ডের প্রকল্পটা ছিল অন্যতম। তিনি বললেন গতির অভিমুখে পাঠানো আলো ফিরে আসতে বেশি সময় লাগত, কিন্তু পৃথিবীর গতির কারণে ইন্টারফেরোমিটারের দৈর্ঘ সংকুচিত হয়েছে। অর্থাৎ আলোর গতিপথ কমে গেছে। এই গতিপথ ততটুকই কমেছে যতটুকু কমলে উত্তর-দক্ষিণ বরাবর পাঠানো আলোকরশ্মি যে সময়ে ফিরে আসে সেই সময়ে ফিরতে পারে। সংকোচনের পরিমাণ কতটকু হবে তা নির্ভর করবে বস্তুর বেগের ওপর। এখানে ইন্টারেফেরোমিটার চলছে পৃথিবীর গতিতে। তিনি হিসাব করে দেখালেন, ১ মিটার দৈর্ঘের একটা বস্তু যদি আলোর বেগরে অর্ধেক গতিতে চলে তাহলে, তার দৈর্ঘ্য কমে দাঁড়াবে ০.৮৬৬ মিটারে।
তাঁর প্রকল্পের সুত্র ধরে ডাচ বিজ্ঞানী হেনড্রিক আন্টোন লরেঞ্জ আরেকটি প্রকল্প হাতে নেন। লরেঞ্জের প্রকল্পের নাম ‘লরেঞ্জ সসংকোচন প্রকল্প’। লরেঞ্জ সে সময় ক্যাথোড রশ্মি নিয়ে কাজ করছিলেন। তিনি বললেন, গতির কারণে যদি বস্তুর দৈর্ঘ্যকে সংকোচন হয় তাহলে ভরও স্বাভাবিকের চেয়ে বৃদ্ধি পাবার কথা। ফিটজেরাল্ড আর লরেঞ্জ মিলে দাঁড় করালেন ফিটজেরাল্ড-লরেঞ্জ প্রকল্প। এই প্রকল্পে তাঁরা কতগুলো সমীকরণ ব্যবহার করেন। সেই সময় গ্যালিলিও রূপান্তর সমীকরণ প্রচলিত ছিল বিজ্ঞানে। লরেঞ্জ সেই রূপান্তর সংশোধন করে নতুন একধরনের সমীকরণ চালু করলেন। ‘সেই সমীকরণগুলোকে বলে লরেন্স রূপান্তর সমীকরণ।’
ম্যাক্সওয়েলের তড়িচ্চুম্বকীয় সমীকরণগুলোকে ফিটজেরাল্ড-লরেঞ্জ প্রকল্পের মাধ্যমে দুটি ভিন্ন প্রসঙ্গ কাঠামোতে ব্যবহার করা যায়। আইনস্টাইন তাঁর আপেক্ষিক তত্ত্বে ব্যবহার করলেন এই সূত্রগুলো। কিন্তু ফিটজেরাল্ড আর লরেনৎস সমীকরণগুলো ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন ইথারকে বাঁচাতে আর আলোর বেগ ধ্রুব নয় এটা প্রমাণ করতে। আইস্টাইন ওইগুলো ব্যবহার করে আলোর বেগের ধ্রুবতা প্রমাণ করলেন। আইনস্টাইন আপেক্ষিক তত্ত্বে গ্যালিলিওর রূপান্তর সমীকরণগুলোকে লরেঞ্জ রূপান্তর সমীকরণ দ্বারা প্রতিস্থাপিত করলেন।
এখন একটু আলোর কাছ থেকে ঘুরে আসা যাক। আলোর বেগ বড্ড চমকপ্রদ বিষয়। এসকেলেটর বা চলন্ত সিঁড়ির কথাই ধরা যাক। এসকেলেটরের ওপর উঠে যদি হেঁটে ওপর দিকে ওঠা যায় তাহলে বেশ দ্রুত ওপরে ওঠা যায়। কিন্তু এসকেলটরে উঠে দাঁড়িয়ে থাকলে ওপরে উঠতে সময় অনেক বেশি লাগবে। তবে এসকেলেটর যদি আলোর বেগে চলত তাহলে কিন্তু হিসাবটা অন্যরকম হত। তখন এসকেলটরে দাঁড়িয়ে ওপরে উপরে উঠতে যে সময় লাগত, হেঁটে ওপরে উঠতেও একই সময় লাগত।
ধরুন, আপনি ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার গতিতে চলা গাড়িতে বসে আছেন। আরেকটা গাড়ি একই গতিতে বিপরীত দিকে আপনার পাশ দিয়ে চলে গেল। আপনার কাছে মনে হবে ওই গাড়িটির বেগ ঘণ্টায় ২০০ কিমি। কিন্তু গাড়িটির পরিবর্তে যদি ওটা কোনো আলোর গাড়ি হতো, তাহলে আপনি কী দেখতেন। ওই গাড়ির গতি কত হবে? ওটার গতি সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটারে সাথে এই গাড়ির গতি যোগ করলে যা হতো তাই হবে? উত্তর হবে ‘না’। আলোর ক্ষেত্রে তখন এ নিয়ম আর খাটবে না। আপনি দেখবেন আলোর গাড়ি সেকেন্ডে ৩ লক্ষ কিলোমিটার বেগেই আপনাকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে।
এবার ধরুন, আপনার গাড়ির গতিও আলোর গতির সমান। পাশ দিয়ে যে গাড়িটা চলছে তার গতিও আলো গতির সমান। তখন ওই গাড়িটা দেখে আপনার কী মনে হবে? ওটার গতি ৬ লক্ষ (৩ লক্ষ + ৩ লক্ষ) কিলোমিটার? এক্ষেত্রেও উত্তর হবে ‘না’। আপনি আলোর গাড়ির গতিবেগ তিন লক্ষ কিলোমিটারই দেখবেন।
আপনি যেমন গতির প্রসঙ্গ কাঠামোর সাপেক্ষেই আলোকে দেখেন না কেন, সবসময় এর গতি একই থাকবে। সেকেন্ডে ৩ লক্ষ কিলোমিটার। আপাত দৃষ্টিতে মনে হবে এটা অসম্ভব। মাইকেলসন-মর্লির পরীক্ষা থেকে এসব সমস্যাগুলো বেরিয়ে আসে। কিন্তু তাঁরা সমাধান করতে পারেননি। ১৯০৫ সালে এলো সমাধান। আলবার্ট আইনস্টাইনের হাত ধরে। বেরিয়ে এলো আলোর বেগের ধ্রুবতা। [এ বিষয়ে বিস্তারিত পাবেন ‘অন্বেষা’ প্রকাশিত আমার ‘থিওরি অব রিলেটিভিটি’ বইয়ে।]
[বইটির সূচীপত্র এবং সব খন্ডের লিংক একত্রে দেখুন এখানে]
-আব্দুল গাফফার রনি
বিজ্ঞান লেখক
[ফেসবুক প্রোফাইল]
‘অন্বেষা’ প্রকাশিত er online link jodi theke thake tahole dile khub valo hoto…Thank you