স্থান-কালের হিল্লোলে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ সনাক্তকরণ

3
1302

আপেক্ষিকতা তত্ত্বের জনক কে? এই প্রশ্নের উত্তরে আমরা চোখ মুখ বন্ধ করে বলে দিতে পারি আলবার্ট আইনস্টাইন। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে আপেক্ষিকতার সূচনা হয়েছিলো গ্যালিলিও গ্যালিলির হাত ধরে। গ্যালিলিও বলেছিলেন একটি সুষম গতিতে চলমান জাহাজের কেবিনে বসে আমরা স্থির আছি নাকি চলছি তা বোঝার কোনো সাধ্য নেই। অনেকে হয়তো ভাবতে পারেন কেবিনে আবদ্ধ অবস্থায় আমরা যদি কোনো বস্তুকে মেঝেতে ছেড়ে দিই তাহলে সেটি পেছনে পড়ে গেলে বোঝা যাবে জাহাজ চলমান। কিন্তু এটিও ঠিক নয়, সুষম গতিতে চলমান অবস্থায় কেবিনে অবস্থানরত কোনো ব্যক্তি যদি উপর থেকে একটি বস্তুকে মেঝেতে ছেড়ে দেয় তবু এটি স্থির অবস্থায় যেখানে পড়ার কথা সেখানেই পড়বে, কেননা এই বস্তুটিও জাহাজের সাথে সাথে চলমান। গ্যালিলীয় তাঁর আপেক্ষিকতাকে এভাবেই সংজ্ঞায়িত করেছেন: কোনো ব্যক্তি যদি তার পরিপার্শ্বের সাথে একই বেগে সুষমভাবে গতিশীল থাকেন তাহলে ব্যক্তির পক্ষে বোঝা সম্ভব নয় তিনি স্থির নাকি গতিশীল আছেন। এই কারণেই পৃথিবী সূর্যের চারপাশে সেকেন্ডে ৩০ কিলোমিটার বেগে অতিক্রম করা সত্ত্বেও আমরা বুঝতে পারি না যে আমরা গতিশীল আছি। কিন্তু এ-তো আবদ্ধ কেবিনের জন্য। কেমন হয় আমরা যদি জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই? আমরা যদি দেখি যে বাইরের দৃশ্যপট সরে সরে যাচ্ছে তাহলেই তো বুঝতে পারব আমরা গতিশীল আছি। কিন্তু না, এই ক্ষেত্রে প্রশ্ন আসবে আমরা গতিশীল, নাকি বাইরের দৃশ্যপট? নাকি উভয়েই আংশিকভাবে গতিশীল? আমাদের পক্ষে বোঝার উপায় নেই। আমরা কেবল বলতে পারব আমাদের উভয়ের মধ্যে গতির পার্থক্য কত বা কতটা ‘আপেক্ষিক গতিতে’ আমরা পরস্পরকে অতিক্রম করছি। আইনস্টাইন গ্যালিলিওর আপেক্ষিকতা নিয়েই চিন্তার সূচনা করেছিলেন এবং পরবর্তীতে তাঁর আপেক্ষিকতা তত্ত্বগুলো ‘ভেবে ভেবে’ আবিষ্কার করেছিলেন।

নিউটনের আপেল পতনের বিষয়টিকে সত্য ধরে নিয়েই চিন্তা করা যাক। নিউটন বলেছিলেন আপেল মাটিতে পতিত হয় কারণ এর উপর পৃথিবীর অভিকর্ষ (মাধ্যাকর্ষণ বল) প্রযুক্ত হয়। একটি বস্তুর উপর যদি কোনো বল প্রযুক্ত হয় তাহলে সেই বল বস্তুর ত্বরণের (বেগের পরিবর্তন) সৃষ্টি করে। কোনো বস্তু যদি সুষম বেগে চলতে থাকে তাহলে তার ত্বরণ থাকে না কিন্তু যদি তার বেগের পরিবর্তন ঘটে তাহলে আমরা বলতে পারি সেটি ত্বরিত হচ্ছে। যে কোনো বস্তুর উপর একটি নির্দিষ্ট স্থানে অভিকর্ষ বলের কারণে সুনির্দিষ্ট ত্বরণ ঘটে। পৃথিবী পৃষ্ঠে এই ত্বরণকে g দিয়ে সূচিত করা হয়। স্থুলভাবে এই মান ৯.৮ মিটার^২/সেকেন্ড। অর্থাৎ পৃথিবীতে পতনোন্মুখ কোনো বস্তুর বেগ প্রতি সেকেন্ডে ৯.৮ মিটার করে বৃদ্ধি পেতে থাকবে ভূপৃষ্ঠে পতিত হওয়ার আগ পর্যন্ত।
কিন্তু আইনস্টাইন বললেন, না এই ধরণের কোনো অভিকর্ষ বলের অস্তিত্ব নেই! মানে, অস্তিত্ব থাকতে পারে কিন্তু আমরা এই ধরণের কোনো বলের অস্থিত্ব ছাড়াই, বিকল্প পদ্ধতিতে আপেলের পতনকে ব্যাখ্যা করতে পারি। আমরা বলতে পারি আপেলটি স্থির আছে আর পৃথিবী নিজেই তার যাবতীয় জিনিসপত্র নিয়ে আপেলের দিকে ত্বরিত হচ্ছে। আমাদের পক্ষে কেবল আপেল আর পৃথিবী পর্যবেক্ষণ করে বলা শক্ত কে কার দিকে ধাবিত হচ্ছে। আইনস্টাইনের ভাবনা এই পরিস্থিতিতে কিঞ্চিৎ হাস্যকর শোনাতে পারে কিন্তু তাঁর বিবৃতিতে যথাযথ যুক্তি ছিলো এবং এইভাবে ভাবতে ভাবতেই তিনি পরবর্তীতে সাধারণ আপেক্ষিকতা প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। সেটি কিভাবে, তা দেখা যাক।

মনে করি ভূ-পৃষ্ঠের উপর দিয়ে একটি ট্রেন ত্বরিত হচ্ছে, অর্থাৎ সময়ের সাথে এর গতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। মনে করি ট্রেনের ভিতরে একজন মানুষ বসে আছেন। ট্রেনটি যদি ত্বরিত না হয়ে সুষম বেগে গতিশীল থাকত তাহলে সেই ব্যক্তি অনুভব করতেন না তিনি স্থির আছেন না গতিশীল, কিন্তু যেহেতু এটি ত্বরিত হচ্ছে সেই ব্যক্তি ট্রেনের পেছন দিকে একধরনের টান অনুভব করবেন। শুধু তিনিই নন তাঁর সাথে ট্রেনের ভেতরে যা কিছু অবস্থান করবে সবাই এই টান অনুভব করবে। এখন এই টানের সাথে অভিকর্ষের টানের পার্থক্য কোথায়? তেমন কোনো পার্থক্যই নেই বলা যায়, পার্থক্য শুধু দুটি বল দুই ভিন্ন দিকে অনুভূত হচ্ছে। কিন্তু উভয় ধরনের টানের প্রভাব বা ফলাফল একই ধরনের অনুভূত হবে। এখান থেকে আমরা বুঝতে পারি, ট্রেনটি সামনের দিকে ত্বরিত হচ্ছে এটি বলা যেই কথা, এটি আমাদেরকে পেছন দিকে টানছে এটা বলাও একই কথা। এই কথাটিই আইনস্টাইন পৃথিবীর ক্ষেত্রেও বলতে চেয়েছেন। এখন পৃথিবী পৃষ্ঠে একটি ত্বরিত ট্রেনের ভেতরে আমরা দুই ধরনের টান অনুভব করব। একটি টান ট্রেনের জন্য ট্রেনের পেছন দিকে, আরেকটি টান পৃথিবীর জন্য নীচের দিকে। এই দুই টানের সম্মিলিত প্রভাবে ট্রেনের ভেতরে আমরা কোণাকুনি বরাবর একটি সার্বিক টান অনুভব করব (নিচের চিত্র দ্রষ্টব্য)। এই টানটি ট্রেনে অবস্থিত প্রত্যেকটি বস্তুই অনুভব করবে। ফলে আমরা ট্রেনের ত্বরণ, পৃথিবীর অভিকর্ষ ইত্যাদি আলাদা আলাদা উল্লেখ না করে যদি বলি আমরা স্থির অবস্থায় আছি এবং একটি গ্রহ কোণাকুনি ভাবে আমাদের টানছে বা আমরা কোনো একটি গ্রহের পাহাড়ের ঢাল বরাবর স্থির অবস্থায় আছি তাহলেও পুরো বিষয়টি একই থাকবে। আমরা ট্রেন ভিতর থেকে বুঝতেই পারব না যে আসলে কী ঘটছে কিন্তু আমরা এভাবে ধরে নিলেও বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে কোনো অসুবিধা হয় না। আমরা উল্লম্ব (vertical) বলতে যা বুঝি, নতুন অবস্থায় সেই কোণাকুনি দিকটিকে উলম্ব হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা যাবে বা উলম্ব দিকের মতোই আচরণ করবে।

আনুভুমিক ও উলম্ব দুই বলের প্রভাবে সৃষ্ট লব্ধি বল হবে কোণাকুণি বরাবর।

কাজেই আপেক্ষিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে বা ফলাফলের দিক থেকে আইনস্টাইন সঠিক বলেই মনে হয়। যদিও নিউটনীয় পদার্থবিদ্যার আলোক এটি শুধুই একটি গণনার অজুহাত এবং ভ্রান্তি। নিউটনের আলোকে বা আমাদের বোধগম্যতা অনুযায়ী সত্যি ঘটনা হচ্ছে ট্রেনটি ত্বরিত হচ্ছে এবং পৃথিবী নিচের দিকে টানছে। কিন্তু আইনস্টাইন বললেন, দাঁড়াও, পৃথিবীর অভিকর্ষও যে একটা ভ্রান্তি নয় এবং পৃথিবী যে বস্তুটির দিকে ত্বরিত হচ্ছে না এটি আমরা নিশ্চিত হচ্ছি কিভাবে? নিউটনীয় পদার্থবিদ্যার আলোকে একটি বস্তু ত্বরিত হচ্ছে কিনা তা নির্ণয় করার উপায় হচ্ছে একটি জড় প্রসঙ্গ কাঠামো (inertial reference frame, যা ত্বরিত হচ্ছে না) ঠিক করা এবং তার সপেক্ষে কোনো কিছুর ত্বরণ নির্ণয় করা। কিন্তু এধরনের প্রসঙ্গ কাঠামো আমরা পৃথিবীতে কিভাবে পেতে পারি? আইনস্টাইন বললেন, ধরা যাক আমরা একটি প্রসঙ্গ কাঠামো চিন্তা করলাম যা মুক্তভাবে পৃথিবী পৃষ্ঠে পতিত হচ্ছে (g ত্বরণে)। এই প্রসঙ্গ কাঠামোর মধ্যে একটি বাক্স কল্পনা করা হলো যা একইভাবে মুক্তভাবে পড়ছে। বাক্সের ভিতরে যদি একজন ব্যক্তি অবস্থান করে এবং পুরো সিস্টেমটিকে মুক্তভাবে পড়তে দেওয়া হয় তাহলে ওই ব্যক্তির সাপেক্ষে বাক্সটি এবং বাক্সের ভিতরে অন্যান্য বস্তু রাখা হলে সবাই পরস্পরের সাপেক্ষে স্থিতি অবস্থায় থাকবে। এই অবস্থায় বাক্সের মুক্তভাবে পতনে যদিও ত্বরণ ঘটছে কিন্তু এই পরিস্থিতিকে মহাশূন্যে সকল বলের প্রভাবমুক্ত অবস্থায় একটি সুষমগতির প্রসঙ্গকাঠামো ব্যবস্থার সাথেই চিন্তা করা যায়। অর্থাৎ অভিকর্ষ বলহীন কোনো স্থানে একটি প্রসঙ্গ কাঠামো ব্যবস্থায় (স্থির বা সুষম গতির) যেমন অনুভূতি হবে পৃথিবীর নিকটে মুক্তভাবে পড়ন্ত ত্বরিত প্রসঙ্গকাঠামো ব্যবস্থাতেও একই অনুভূতি হবে এবং একটিকে আরেকটি হতে আলাদা করা যাবে না। বিষয়টিকে ঘুরিয়ে এভাবেও বলা যায়, বাক্সটি যদি মহাশূন্যের আকর্ষনবিহীণ স্থানের মধ্য দিয়ে g ত্বরণে উপরের দিকে উঠতে থাকে তাহলে ভিতরের বস্তুগুলো যেমন অনুভব করবে, পৃথিবীপৃষ্ঠে স্থির অবস্থায় রাখলেও একই রকম অনুভব করবে। আইনস্টাইন এই উদাহরণের মাধ্যমে উপসংহার টানলেন “কাজেই আমরা পৃথিবীর অভিকর্ষ বলকে একটি বিভ্রম হিসেবে সহজেই ধরে নিতে পারি।“ এই দুটি প্রসঙ্গকাঠামো ব্যবস্থার সমতুল্যতার একটি নাম ও তিনি দিলেন, The equivalence Principal।

বাক্সটি যদি মহাশূন্যের আকর্ষনবিহীণ স্থানের মধ্য দিয়ে g ত্বরণে উপরের দিকে উঠতে থাকে তাহলে ভিতরের বস্তুগুলো যেমন অনুভব করবে, পৃথিবীপৃষ্ঠে স্থির অবস্থায় রাখলেও একই রকম অনুভব করবে।

আইনস্টাইনের কথা হলো, যেহেতু অভিকর্ষ বলকে আমরা একটি বল হিসেবে না ধরে পৃথিবী নামক একটি বস্তুর g ত্বরণে উপরের দিকে ছুটে চলার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করতে পারছি তবে শুধু শুধু কেন এখানে অভিকর্ষজ বল নামের একটি বল ধরে নেওয়া? কিন্তু এই ক্ষেত্রে একটি সমস্যা আছে। পৃথিবী যেহেতু গোল কাজেই পৃথিবীতে ভিন্ন স্থানে মুক্তভাবে পড়ন্ত দুটি বস্তুর গতিপথ সমান্তরাল হবে না, বরং এদের গতিপথ পৃথিবীর কেন্দ্র বরাবর একীভূত হতে থাকবে। আইনস্টাইনের g ত্বরণে পৃথিবীকে উপরের দিকে গতিশীল রাখতে হলে এই দুটি বস্তুর দূরত্বতো পরস্পরের সাপেক্ষে একই থাকার কথা। কিন্তু এরা যেহেতু পৃথিবীর কেন্দ্রের অভিমূখে গমন করছে তার মানে বাক্সের ভিতরকার বিভিন্ন বস্তুর মধ্যে পড়ন্ত অবস্থায় দূরত্ব হ্রাস পাচ্ছে, অথচ আইনস্টাইনের কথা অনুযায়ী এখানে কোনো বল কাজ করার কথা নয়, তাই বস্তুগুলোর কাছাকাছি আসাও কথা নয়। নিচের চিত্র দ্রষ্টব্য।

পৃথিবীতে পড়ন্ত বস্তুগুলো পড়তে পড়তে পরস্পরের কাছাকাছি আসতে থাকবে।

আরেকটি সমস্যা হলো উপগ্রহের কক্ষপথ। উপগ্রহের কক্ষপথ পড়ন্ত বস্তুর এই ধারনার মাধ্যমে ব্যাখ্যা দেওয়া যাচ্ছে না। আইনস্টাইন এ দুটি বিষয় ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য তখন এক অদ্ভূত ধারনার অবতারণা করলেন। তিনি স্থান-কালকে বাঁকিয়ে দিলেন! তিনি বললেন সমতল স্থান-কালের ক্ষেত্রে দুটি বস্তু সমান দূরত্বে থেকেই পতিত হওয়ার কথা কিংবা উপগ্রহের মতো কক্ষপথ না পাওয়ারই কথা, কিন্তু যদি স্থান-কাল (spacetime) নিজেরাই বেঁকে কাছে চলে আসতে চায় তাহলে সেই বাঁকা স্থান-কালে দুটি বস্তুর কাছাকাছি চলে আসতে বা একটি উপগ্রহের পক্ষে কক্ষপথে আবর্তনরত থাকাতে কোনো সমস্যা নেই। এই স্থান-কালের বক্রতার আইডিয়াটি আইনস্টাইনের মাথায় আসতে সাত বছর লেগেছে। কিন্তু যখন তাঁর মাথায় এলো তখন দেখা গেলো মহাকর্ষীয় বলের অবতারণা না করেই, তথা স্থান-কালকে একটি ভারী বস্তুর চারপাশে বক্র চিন্তা করে নিয়েই মহাবিশ্বের গতিশীল বস্তুগুলোর গতি ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে এবং এভাবেই আপেক্ষিকতার সাধারণত তত্ত্ব (general theory of relativity) প্রতিষ্ঠিত হয়। এই তত্ত্ব আইনস্টাইন আজ হতে ঠিক ১০০ বছর পূর্বে প্রকাশ করেন। এই ধরনের একটি বক্র স্থান-কালের গ্রাফ দেখানো যায় নিচের চিত্রের মতো।

স্থান কালের বক্রতার গ্রাফ। ভারী বস্তুগুলো না থাকলে এই গ্রাফ সমতল হতো।

মহাকর্ষ বলের মতোই স্থান-কালের বক্রতার পরিমাণ নির্ভর করবে ভরের উপর। কোনো বস্তুর ভর যত বেশী হবে তার চারপাশের স্থানকালের বক্রতাও তত বেশী হবে। এভাবে স্থান কালের বক্রতা থেকে একটি ভারী বস্তুর চারপাশে অপেক্ষাকৃত হালকা বস্তুর প্রদক্ষিণও ব্যাখ্যা দেওয়া যায়। একজন পরিদর্শকের কাছে বস্তুটির গতি বৃত্তাকার মনে হতে পারে কিন্তু ওই স্থান-কালের ভিতরে সেই গতিটি সরলরৈখিক। স্থান-কাল নিজেই বৃত্তাকারে বেঁকে গেছে বলে বাহ্যিকভাবে গতিপথটিকে বৃত্তাকার বা বক্র মনে হয়।
নিচের ভিডিওর মাধ্যমে কিভাবে একটি বক্র স্থানকালের মধ্যে একটি বস্তু গতিপ্রাপ্ত হয় তা খুব স্থুল একটি তুলনার মাধ্যমে কিছুটা বোঝা যেতে পারে।

তবে এখানে স্থানকালের গ্রাফের বিষয়ে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। আমরা ছবিতে দেখানোর সময় স্থান-কালের যেই বক্রতা দেখাই সেটি ঠিক এভাবে বর্তমান থাকে না বা দৃষ্টিগোচর হয় না। এটি শুধুমাত্র একটি গ্রাফ। এর একটি অক্ষ বরাবর স্থান, এবং অপর অক্ষ বরাবর কাল বা সময় চিন্তা করে এই গ্রাফটি তৈরি করা হয়েছে। এই গ্রাফটি নিয়ে বিশদ ব্যাখ্যা দিতে গেলে এই লেখাটি শেষ করা কঠিন হয়ে যাবে তাই আপাততঃ বেশি কিছু বলছি না। সাধারণ পাঠক আপাততঃ স্থানকালের গ্রাফটিকে একটি কাপড়ের সাথে তুলনা করতে পারেন উপরের ভিডিওটির মতো যাতে কোনো ভারী বস্তু রাখা হলে তা খানিকটা ডেবে যায় এবং তাতে কাপড়ে বক্রতা তৈরি হয়। কাপড়ের মাঝখানে যত ভারী বস্তু রাখা হবে সেটি তত বেশী ডেবে যাবে। এবং কোনো গতিশীল বস্তু এই ডেবে যাওয়া অংশের প্রভাবে একটা বাঁকা পথে পরিভ্রমন করবে।

এখন প্রশ্ন হলো, কেন নিউটনের মহাকর্ষীয় বলের তত্ত্ব ত্যাগ করে আমাদের এই অপেক্ষা জটিল ‘ধরে নেওয়া’ এবং ভেবে ভেবে বের করা তত্ত্ব গ্রহণ করতে হবে। এর কারণ আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব মহাকর্ষ ছাড়াও আরো অনেক কিছু ব্যাখ্যা করে যা নিউটনীয় তত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে পারে না। এর মধ্যে রয়েছে কোন ভরযুক্ত বস্তুর পাশ দিয়ে আলোক রশ্মির বেঁকে যাওয়া তথা গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং (gravitational lensing), ভরযুক্ত বস্তুর কাছে সময়ের ধীর হয়ে যাওয়া বা কাল দীর্ঘায়ন (time dilation), র্ঘূণায়মান ভরের দিকে স্থান-কালের টান ইত্যাদি। আইনস্টাইন এই ঘটনাগুলো ভেবে ভেবেই বের করেছেন যদিও কিন্তু পরবর্তীতে বাস্তবিক ক্ষেত্রে এর সবগুলো পরীক্ষা-নীরিক্ষার মাধ্যমে প্রমাণীত হয়েছে। কাজেই কোনো ভাবেই আইনস্টাইনের আপাত বিদঘুটে তত্ত্বটিকে অবহেলা করার সুযোগ নেই। এই তত্ত্বটিতে তাঁর অনুমিত প্রায় সবকিছুই যথাযথ হিসেবে পাওয়া গিয়েছে। শুধু তাঁর অনুমিত একটি বিষয়ই দীর্ঘদিন ঝুলে ছিলো। সেটিই হচ্ছে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ বা গ্রাভিটেশনাল ওয়েভ (gravitational wave বা G wave)।

মহাকর্ষীয় তরঙ্গের ধারনা কিভাবে তৈরি হয়? আমরা স্থান-কালকে একটি কাপড়ের সাথে তুলনা করে নিয়েছি এবং দেখেছি যে একটি কাপড়ের উপর একটি ভারী বস্তুকে রাখা হলে তার আচরণ অনেকটা বাস্তব ক্ষেত্রে কোনো ভরযুক্ত বস্তুর আশাপাশে স্থান-কালের গ্রাফের আচরণের মতোই। আর কাপড়টি যেহেতু নমনীয় তাই এটিকে ভরের মাধ্যমে আন্দোলিত করা সম্ভব। যেমন: পুকুরে ঢিল ছুঁড়লে এর পৃষ্ঠে আন্দোলন বা হিল্লোল তৈরি হয়। সেই আন্দোলন তরঙ্গাকারে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। শুধু তাই না পানির উপর দিয়ে কোনো কিছু টেনে নিয়ে গেলেও সেটি তরঙ্গ তৈরি করতে করতে যায়। যেমন: একটি নৌকা যদি পানির উপর দিয়ে চলমান থাকে তাহলে দেখতে পাব সেটি পানিতে তরঙ্গ তৈরি করছে এবং তা ছড়িয়ে পড়ছে। নিচের চিত্রটি দেখুন:

নৌকার চলনে পানির পৃষ্ঠে উৎপন্ন হিল্লোল।

এখন একটি বস্তু যখন স্থানকালের কাপড়ের মধ্যে বিশেষ ভাবে ত্বরিত থাকে তখন তার প্রভাবেও সেই স্থান-কালে সংকোচন-প্রসারণ তৈরি হতে পারে যা তৈরি করবে স্থান-কালের হিল্লোল বা ripple। তবে ঠিক সব বস্তু থেকে এই ধরনের হিল্লোল তৈরি হবে না। এই কাজের জন্য কোন এলাকার ভর বিন্যাসের কোয়াড্রুপল মোমেন্ট পরিবর্তন করতে হবে। এই কাঠখোট্টা টার্ম মনে রাখার বা বোঝার প্রয়োজন নেই্। আপাততঃ একটি অসমভাবে বিন্যাস্ত ভরের চিন্তা করুন। একটি সুষম গোলক বা সিলিন্ডারের ভর সুষম। কিন্তু যদি কোন এলাকায় ভর এভাবে সুযমভাবে বিন্যাস্ত না থাকে বরং এক পাশে কম একপাশে বেশী থাকে অর্থাৎ প্রতিসম না হয় তাহলে এধরনের হিল্লোল তৈরি হতে পারে (কাপড়ের ক্ষেত্রেও চিন্তা করে দেখুন না একটি অতি মসৃণ গোলক কাপড়ে সহজে ঢেউ বা ভাঁজ তৈরি করতে পারবে না।) কিন্তু যদি দুটি ভিন্ন ভরের বস্তু একে অপরের চারপাশে ঘুরতে থাকে বা যদি কোথাও ক্যাওটিক (chaotic) বিস্ফোরণ ঘটে তাহলে এই ধরনের মোমেন্টে পার্থক্য তৈরি হবে এবং স্থান-কালের হিল্লোল তৈরি হবে। আমাদের সূর্য আর পৃথিবী মিলেও এভাবে তরঙ্গ তৈরি করতে পারে, কিন্তু এই যুগলের উৎপন্ন তরঙ্গ এতোই দুর্বল হবে যা সনাক্তকরণ অচিন্ত্যনীয়।

এই যে তরঙ্গ তৈরি হলো এর গতি কেমন হবে? পানির ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই এই তরঙ্গ খুব ধীরে ধীরে প্রবাহিত হয়। তরঙ্গের গতি নির্ভর করে পৃষ্ঠ কতটা নমনীয় তার উপর। কাপড় যদি নমনীয় হয় তাহলে গতি ধীর হবে যাবে আর যদি দৃঢ় হতে থাকে তাহলে গতি ক্রমশঃ বাড়তে থাকবে। স্থান-কালের নমনীয়তা কেমন? যতটা হলে এর মধ্য দিয়ে গমনকারী তরঙ্গের গতি হয় আলোর গতির সমান! ঠিকই ধরেছেন। স্থান কালের মধ্য দিয়ে এই হিল্লোল তথা G-wave আলোর গতিতেই এগিয়ে যাবে। আলোর গতি কেন? বা অন্য ভাবে বললে কেন আলোই বা স্থানকালের মধ্য দিয়ে এই গতিতে চলে? আসলে স্থুলভাবে উত্তরটি দিয়েই দিয়েছি। স্থান কালের নমনীয়তা এর মধ্য দিয়ে কোন বস্তুর গমনের সর্বোচ্চ এই গতি নির্ধারণ করে দেয়। এটা আসলে বস্তুর গতি নয়, এটি হলো ঘটনার গতি বা কার্যকারণের (causality) গতি, এটি স্থান-কালের মধ্য দিয়ে কোনো কিছুর ফল প্রযুক্ত হওয়ার সর্বোচ্চ গতি। এই গতিতে স্থানকাল পরস্পরের সাথে কথা বলতে পারে বা যোগাযোগ রাখতে পারে। আর স্থান-কালের মধ্য দিয়ে কোনো কিছুর গতিকে চেপে ধরে ভর। এটি হচ্ছে অনেকটা ভীড়ের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাওয়ার মতো। ভরকে তুলনা করতে পারি জনপ্রিয়তার সাথে। আপনি যদি ভীড়ের মধ্য দিয়ে হেঁটে যান তাহলে আপনি জনপ্রিয় হলে আপনার চারপাশে লোকজনের ভিড় পড়ে যাবে আর আপনার গতি বাধাপ্রাপ্ত হবে। যতবেশী জনপ্রিয় হবেন ততোই ভিড় বেশী হবে আর আপনার চলাচলেও বাধা পড়বে বেশী। কিন্তু আপনি অজনপ্রিয় হলে বা আপনার অস্তিত্ব সম্বন্ধে দুনিয়াদারী ওয়াকিবহাল না হলে ভীড় বাঁচিয়ে আপনার স্বাভাবিক গতিতে হেঁটে চলে যেতে পারবেন। আলোর গতিই হচ্ছে শূন্য নিশ্চল ভর বিশিষ্ট যেকোনো কণিকা বা তরঙ্গের এই স্বাভাবিক তথা সর্বোচ্চ গতি যা সে স্থান-কালের মধ্য দিয়ে অর্জন করতে পারে। এই কারণেই আলোর চেয়ে বেশী গতিতে কোনো কিছু/ঘটনা/কার্যকারণ চলতে পারে না। মহাকর্ষীয় এই হিল্লোলের বা তরঙ্গও তাই আলোর গতিতেই তরঙ্গায়িত হবে।

কিন্তু এই মহাকর্ষীয় তরঙ্গ দেখতে কেমন? দেখতে বলতে বোঝাচ্ছি এর গঠন কেমন? আমরা দু’ধরনের তরঙ্গের বিষয়ে পড়ে এসেছি, অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ আর অনুপ্রস্থ তরঙ্গ। অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গের ক্ষেত্রে তরঙ্গ মাধ্যমের কণাগুলোর স্পন্দনের দিকের সাথে একই দিকে অগ্রসর হয়, আর অনুপ্রস্থ তরঙ্গ মাধ্যমের কণাগুলোর স্পন্দন দিকের সাথে সমকোণে অগ্রসর হয়। নিচের চিত্র দ্রষ্টব্য।

অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ: মাধ্যমের কণার স্পন্দনের দিকে এবং তরঙ্গ নিঃসরণের দিক সমান্তরাল
অনুপ্রস্থ তরঙ্গ: মাধ্যমের কণাগুলো তরঙ্গ নিঃসরণের দিকের সাথে সমকোণে স্পন্দিত থাকে।

শব্দ তরঙ্গ অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ আর আলো বা পুকুরের পানিতে ঢিল ছোঁড়ার ফলে উৎপন্ন তরঙ্গ হলো অনুপ্রস্থ তরঙ্গ। কিন্তু মহাকর্ষীয় তরঙ্গ এমন নয়। এই তরঙ্গ হল কোয়াড্রুপল তরঙ্গ। এই তরঙ্গের প্রস্থচ্ছেদ করলে তা দেখতে হবে নিচের চিত্রের মতো। এরা স্থানের পর্যায়ক্রমিক আনুভূমিক ও উলম্ব সংকোচন ও প্রসারণের মাধ্যমে এগিয়ে চলে।

আর সার্বিকভাবে চিন্তা করলে দেখাবে নিচের চিত্রের মতো।
এই মহাকর্ষীয় তরঙ্গ আপনার শরীরের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করলে আপনার শরীরও প্রথম চিত্রটির মতো একবার লম্বা হবে আবার চওড়া হবে, এভাবে কম্পাঙ্ক অনুযায়ী লম্বা-চওড়া হতে থাকবে যতক্ষণ অবধি সম্পূর্ণ তরঙ্গটি আপনার শরীর অতিক্রম করে যায়। কিন্তু এই লম্বা-চওড়া হওয়ার পরিমান কেমন হবে? আপনার শরীরের মধ্য দিয়ে যদি এধরনের তরঙ্গ বয়ে যায় তাহলে পাশ দিয়ে অতিক্রম করা একজন পথচারী কি দেখে বুঝতে পারবেন যে আপনি একবার লম্বা হচ্ছেন, আবার চওড়া হচ্ছেন? উত্তর হচ্ছে না। মহাকর্ষীয় তরঙ্গ এত এত এত দূর্বল যে এগুলো সনাক্ত করা অতিমাত্রায় কঠিন আর এই কারণেই আইনস্টাইনের বর্ণনা করার পরে ১০০ বছর লেগেছে এগুলো সনাক্ত করতে। এবং এই সনাক্তকরণের জন্য প্রচুর কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে, প্রচুর সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়েছে। বিপুল কর্মযজ্ঞ চালাতে হয়েছে। আগেই বলেছি আমাদের সূর্য আর পৃথিবীর জোড়ও পরস্পর আবর্তিত হতে হতে (হ্যাঁ, পৃথিবী যেমন সূর্যের চারদিকে ঘোরে, সূর্যও পৃথিবীর প্রভাবে খুব সামান্য আন্দোলিত হয়, শুধু পৃথিবীর জন্যই নয় সব গ্রহই সুর্যকে সামান্য পরিমান আন্দোলিত করে থাকে) মহাকর্ষীয় তরঙ্গ বিকিরণ করে। প্রতিনিয়ত স্থানের মধ্য দিয়ে নানাবিধ মহাকর্ষীয় হিল্লোল অতিক্রান্ত হয়ে চলে যাচ্ছে আমরা সেগুলো টের পাই না। কাজেই যত সহজে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ বর্ণনা করা গেল তত সহজে এগুলো সনাক্ত করা যাবে না। এর জন্য আমাদের ভাল উৎসের দিকে নজর দিতে হবে।

দ্বৈত নক্ষত্র ব্যাবস্থায় পরস্পরকে আবর্তনরত অবস্থায় উৎপন্ন ও ছড়িয়ে পড়া মহাকর্ষীয় তরঙ্গ।

ভালো উৎসের সন্ধান কিভাবে পাওয়া যেতে পারে? পুকুরে যদি ছোটখাট নুড়ি ছুঁড়ে দেওয়া হয় তাহলে তরঙ্গ তৈরি হবে দূর্বল, আর ভারী কোনো বস্তু ফেললে তরঙ্গও তৈরি হবে শক্তিশালী। একই কথা প্রয়োজ্য মহাকর্ষীয় তরঙ্গের ক্ষেত্রে। একটি মহাকর্ষীয় ঘটনা যত বেশী বিধ্বংসী হবে, যতো বেশী ভর এতে যুক্ত হবে, যত প্রলয়ঙ্কারী হবে ততোই শক্তিশালী হবে তার নিঃসৃত তরঙ্গ। এই ধরনে সবচেয়ে প্রবল তরঙ্গগুলো উৎপন্ন হতে পারে যখন দুটি নিউট্রন স্টার বা দুটি ব্ল্যাক হোল পরস্পরের মাঝে বিলীন হওয়ার পূর্বে বিপদজনক গতিতে পরস্পরের চারদিকে আবর্তিত হতে থাকে, কিংবা যখন কোনো বিপুল ভরের তারকায় সুপারনোভা বিস্ফোরণ হয় তখন। এমনকি এধরনের সবচেয়ে তীব্র উৎসগুলো থেকেও যেই তরঙ্গগুলো উৎপন্ন হয় সেগুলো স্থানের সংকোচন-প্রসারণ ঘটায় কেবল ১০^-২১ ভাগ। বিষয়টিকে কিভাবে অনুধাবণ করা যায়?

এধরণের একটি শক্তিশালী মহাকর্ষ যদি পৃথবীর মধ্য দিয়ে চলে যায় তাহলে পৃথিবীর ব্যাসের পরিবর্তন ঘটবে (সংকোচন-প্রসারণজনিত কারণে) এক ন্যানোমিটারের লক্ষ ভাগের একভাগ মাত্র, যা একটি পরমাণুর নিউক্লিয়াসের ব্যাসের সমান! বুঝতেই পারছেন পৃথিবীর ব্যাস এতো সামান্য পরিমান বাড়ে যেই তরঙ্গ থেকে তা সনাক্ত করা কত মুস্কিল হতে পারে। তবু বিজ্ঞানীরা এই তরঙ্গ সনাক্ত করেছেন খুব চমৎকার উপায়ে। সেটি এখন আলোচনা করব। কিন্তু এই সবচেয়ে শক্তিশালী তথাপি অত্যন্ত দুর্বল মহাকর্ষীয় তরঙ্গ উৎসরণের ঘটনাও সচরাচর ঘটে না। কোনো একটি গ্যালাক্সিতে এধরনের একেকটি ঘটনা ঘটার জন্য কয়েক হাজার বছর অপেক্ষা করে থাকতে হতে পারে। তাই বিভিন্ন দূরবর্তী গ্যালাক্সি থেকে আগত মহাকর্ষীয় তরঙ্গগুলোর দিকেও নজর রাখতে হবে।

তবে ১৯৯৩ সালে পরোক্ষভাবে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ আবিষ্কৃত হয়েছিলো এবং তার জন্য নোবেলও দেওয়া হয়েছে। যেহেতু তরঙ্গ শক্তি স্থানান্তর করে তাই একটি দ্বৈত নক্ষত্র ব্যবস্থায় এভাবে শক্তি বিকিরণ করতে করতে নক্ষত্রদুটি ক্রমাগত একে অপরের কাছাকাছি চলে আসে এবং তাদের পরিধি ছোট হতে হতে শেষ পর্যন্ত একে অপরের মাঝে বিলীন হয়। যে হারে শক্তি বিকিরণ ঘটে তা হুবহু আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্বে অনুমিত মহাকর্ষীয় তরঙ্গের শক্তি বিকিরণ হারের সমান, তাই বলা যেতে পারে এই ক্ষেত্রে মহাকর্ষীয় তরঙ্গই উৎসরিত হয়েছে। যদিও এই পদ্ধতিতে তরঙ্গ সনাক্ত হয় না কিন্তু এই ঘটনা মহাকর্ষ তরঙ্গ উৎক্ষেপনের একটি সূচক। অবশ্য এই ফলাফল নিয়ে সন্তুষ্ট হওয়ার অবকাশ নেই। আমরা যদি সরাসরি মহাকর্ষীয় তরঙ্গ শনাক্ত করতে পারি তাহলে তা নানাবিধ গবেষনা এগিয়ে নিয়ে যাবে। এর মাধ্যমে ব্ল্যাকহোল, নিউট্রন তারকা এমনকি মহাবিশ্বের আদি অবস্থার বিষয়েও অনেক অজানা কাহিনী জানা যাবে।

কিন্তু একটি বস্তুর বিলিয়ন বিলিয়ন বিলিয়ন ভাগের একভাগের কাছাকাছি দৈর্ঘ্যের প্রসারণ বা সংকোচন মাপা খুব সহজ কাজ নয় তাই মহাকর্ষীয় তরঙ্গ সনাক্তকরণ অধরা থেকে গেছে দীর্ঘদিন। তবে কিভাবে এই তরঙ্গ সনাক্ত করা যেতে পারে সেই বিষয়ে বিজ্ঞানীদের ধারনা ছিলো বেশ কয়েক বছর ধরেই। এবং এই আইডিয়া থেকেই স্থাপন করা হয়েছে Laser Interferometer Gravitational-Wave Observatory (LIGO)। নাম থেকেই কিছুটা অনুমান করা যায় কিভাবে এখানে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ সনাক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রথমতঃ এখানে একটি মাইকেলসন ইনটারফেরোমিটার ব্যবহার করা হয়েছে এবং আলোর উৎস হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে লেজার।

LIGO পরীক্ষায় প্রায় সহস্রাধিক বিজ্ঞানী কাজ করেছেন এবং এতে ১ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। স্থানের সংকোচন-প্রসারণ সনাক্তকরার জন্য এই প্রকল্পে দুটি ডিটেক্টর ব্যবহার করা হয়েছে, যার একটি ওয়াশিংটনে এবং অপরটি লুইজিয়ানায় স্থাপিত। প্রতিটি ডিটেক্টর দেখতে L আকৃতির যার একেকটি বাহু চার কিলোমিটার লম্বা। এই দুটি বাহুর সংযোগস্থলে একটি অর্ধভেদ্য দর্পন রাখা হয় যা লেজার বিমকে দুই ভাগে ভাগ করে দুই বাহু বরাবর প্রেরণ করে। চিত্র দ্রষ্টব্য।

L আকৃতির ডিটেক্টর

প্রতিটি বাহুর প্রান্তে নিক্ষিপ্ত লেজার প্রতিফলিত হয় এবং অত্যন্ত অণুপুঙ্খ পারমাণবিক ঘড়ির মাধ্যমে লেজারের পথ পাড়ি দেওয়ার সময় নির্ধারণ করা হয়। যদি কোনো শক্তিশালী মহাকর্ষ তরঙ্গ এর মধ্য দিয়ে যায় তাহলে L এর দুই বাহুর মধ্যে দৈর্ঘ্যের তারতম্য ঘটতে অতিঅতি অতি সামান্য এবং দুই বাহুর লেজারের আগমনের সময়ে সেকেন্ডের ক্ষুদ্রাংশ তারতম্য ঘটবে। তবে এই তারতম্য এতোই সূক্ষ হবে যে এই ডিটেক্টরকে তাই প্রায় অসম্ভব রকমের সূক্ষতা পরিমাপে সক্ষম হতে হবে। এই তারতম্য হবে একটি প্রোটনের ব্যসের লক্ষ্যভাগের একভাগ। যদি আমরা বাহুর দৈর্ঘ্যকে ছায়াপথ গ্যালাক্সির ব্যসের সাথে তুলনা করি তাহলে দৈর্ঘ্য সংকোচন-প্রসারণের পরিমান হবে একটি ফুটবল মাঠের ব্যসের সমান। তার উপর এই ধরনের সেনসেটিভ স্থাপনায় বাইরে থেকে নয়েজ ঢুকে যেতে পারে খুব সহজে। যেমন: নিয়ন্ত্রন কক্ষে বসে কেউ একটি তালি দিলেও তা যন্ত্রের সিগন্যালে একটি বিক্ষেপ তৈরি করে ফেলতে পারে। এই ক্ষেত্রে দুটি সম্পূর্ণ পৃথক স্থানে স্থাপিত দু’টি ডিটেক্টর এই সমস্যার সমাধান করবে। ঠিক একই নয়েজ একই সময়ে দুটি ডিটেক্টরে তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। একই সময়ে দুটি ডিটেক্টরেরই নিয়ন্ত্রন কক্ষে তালি দেওয়ার সম্ভাবনা বেশ কমই বলা চলে!

দৈর্ঘ্য বিচ্যুতি নির্ণয়ের পদ্ধতিটিও বেশ চমৎকার। বাহুর মধ্যে লেজারের বীমের দৈর্ঘ্য এমনভাবে নির্ধারণ করা হয় যেন স্বাভাবিক অবস্থায় প্রতিফলনের পরে আলোক তরঙ্গগুলো একে অপরের বিপরীত দশায় মিলিত হয়। আমরা জানি বিপরীত দশায় মিলিত দুটি তরঙ্গ একে অপরকে নাকচ করে দেয়। ফলে সার্বিকভাবে ডিটেক্টরে কোন সংকেত পাওয়া যায় না (নিচের চিত্র দেখুন)। কিন্তু যদি বিমের দৈর্ঘ্যে খুব সামান্য বিচ্যুতি ঘটে তাহলে দর্পনে প্রতিফলনের পরে এরা আর পুরোপুরি একটি বিপরীত দশায় মিলিত হবে না। ফলে একে অপরকে নাকচ করতে পারবে না বরং মিলত তরঙ্গের কোনো কোনো স্থানে সংকেতের তীব্রতা তৈরি হবে।

যন্ত্রের কার্যপ্রনালী তাহলে স্পষ্ট হয়ে গেল: স্বাভাবিক অবস্থায় কোনো সংকেত পাওয়া যাবে না, এবং দৈর্ঘ্য বিচ্যুতি ঘটলে সংকেত পাওয়া যাবে। এই পদ্ধতিতে একটি প্রোটনের ব্যসের ১ সহস্রাংশ দৈর্ঘ্য পার্থক্য পরিমাপ করা সম্ভব। তবে আগেই যেমন বলা হয়েছে বাইরে থেকে খুব সামান্য নয়েজ এই যন্ত্রে বিশাল প্রভাব পড়তে পারে। কিন্তু মহাকর্ষীয় তরঙ্গ সনাক্তকরণের ক্ষেত্রে একটা সুবিধা আছে। আমরা এর প্রস্থচ্ছেদ থেকে জানি এটি যখন একদিকে সংকোচন ঘটাবে তখন তার ৯০ ডিগ্রি কোণে প্রসারণ ঘটাবে। ফলে যখন আমরা একটি বাহুতে সংকোচন পাব অপর বাহুতে প্রসারণ পাব সুনির্দিষ্ট ভাবে। বাইরের গোলমাল এইরকম যথাযথ সংকেত তৈরি করতে পারবে না। তারউপর আগেই বলা হয়েছে দুটি ভিন্ন স্থানে দুটি ডিটেক্টর বসানোয় উভয়ের গোলমাল একই হবে না ফলে কোনগুলো গোলমাল আর কোনগুলো আসল সংকেত তা সহজেই পৃথক করা যাবে। এর বাইরেও ইতালীর ভার্গোতে আরেকটি স্থাপনা রয়েছে যা প্রকৃত মহাকর্ষীয় সংকেত সনাক্তকরণ আরো সহজতর করবে।

এই ধরনের ব্যবস্থাপনা নিয়ে ২০০১ সালে LIGO প্রকল্প যাত্রা শুরু করে। কিন্তু ২০১০ সাল পর্যন্ত এটি একটি মহকর্ষীয় তরঙ্গও শনাক্ত করতে পারে নি। কারণ এত ব্যবস্থা আর সেনসেটিভিটি সত্ত্বেও মহাকর্ষীয় তরঙ্গ সনাক্ত করার জন্য যে পরিমান সেনসিটিভি প্রয়োজন এর তা ছিলো না। তার উপর এই ধরনের তরঙ্গ উৎসরিত হওয়ার সম্ভাবনাও প্রতিকূল। মহাজাগতিক গবেষণা হতে দেখা যায় এ ধরনের তরঙ্গ উৎসরিত হওয়ার সম্ভাবনা সর্বাধিক বছরে ১ টি, আর সর্বনিন্ম ১০,০০০ বছরে ১ টি! বোঝাই যাচ্ছে খুবই অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে হচ্ছে। ২০১০ সালের মধ্যে কিছু সনাক্ত না হওয়ায় এই প্রকল্প বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং ২০৫ মিলিয়ন ডলার খরচ করে এর যন্ত্রপাতি আপগ্রেড করে সেনসিটিভিটি ১০ গুন বাড়ানো হয়। এর অর্থ হলো এটি এখন মহাবিশ্বের ১০০০ গুণ বেশী আয়তনের সংকেত গ্রহণ করতে পারবে। তার মানে হলো রাতারাতি সংকেত পাওয়ার সম্ভাবনা ১০০০ গুণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সব ঠিকঠাক করে এটিকে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে পুনরায় চালু করা হয়। এবং বিভিন্ন সময় এতে সিগন্যাল গ্রহণ করা হয়!

লুইসিয়ানায় অবস্থিত L-সদৃশ ডিটেক্টর

কিন্তু এখানে মজার বিষয় আছে। পুনরায় চালু করার পর প্রকল্পে মাঝে মাঝে কৃত্রিমভাবে সংকেত প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয়। এর দুটি উদ্দেশ্য। প্রথমতঃ প্রকল্পের কর্মীরা সবাই যেন সতর্ক থাকে সংকেতের বিষয়ে এবং সতর্কতা চর্চা করে, আর দ্বিতীয়ত, কোনটি আসল সংকেত সেটি যেন সবাই বুঝে ফেলতে না পারে। কেবলমাত্র তিনজন ব্যক্তি জানেন একটি সংকেত আসল নাকি নকল। এর কারণ হলো, প্রকৃত সংকেত পাওয়া গেলেও প্রকল্পের কর্তাব্যক্তিদের ইচ্ছে ছিলো না নতুন বছরের আগে তা প্রকাশ করা। এর কারণ সংকেত সনাক্তকরণে ভুল-ভ্রান্তিও থাকতে পারে। এই ভুল-ভ্রান্তি তদারকি করতে মাসাধিক কাল লেগে যেতে পারে তাই সবদিক নিশ্চিত না হয়ে ফলাফল প্রকাশ করে দেওয়া ঝুঁকিপূর্ণ। তবে এতকিছুর পরেও সেপ্টেম্বরেই গুজব ছড়িয়ে যায় যে LIGO সত্যিকারের মহাকর্ষীয় তরঙ্গ শনাক্ত করেছে। সেই গুজব যে সত্যি ছিলো তা অবশেষে প্রমানীত হলো।

-ইমতিয়াজ আহমেদ
সম্পাদক, বিজ্ঞানপত্রিকা
[ফেসবুক প্রোফাইল]

বিজ্ঞান পত্রিকা প্রকাশিত ভিডিওগুলো দেখতে পাবেন ইউটিউবে। লিংক:
১. স্পেস এক্সের মঙ্গলে মানব বসতি স্থাপনের পরিকল্পনা
২. মাইক্রোস্কোপের নিচের দুনিয়া

3 মন্তব্য

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.