অধ্যায়-১: পরমাণু
অনুচ্ছেদ-৩: পরমাণুবাদের বিজয়
[বইয়ের সূচীপত্র তথা প্রকাশিত সবগুলো আর্টিকেলের জন্য এখানে দেখুন]
যেসব বস্তু পৃথিবীতে উৎপন্ন হয় তাদের অধিকাংশই মৌলিক নয় তবে সেগুলোকে একাধিক মৌলিক পদার্থে বিশ্লেষণ করা যায়। যেসব বস্তু একাধিক মৌলিক পদার্থের সমন্বয় হিসেবে পাওয়া যায় সেগুলোকে যৌগিক পদার্থ বা যৌগ বলা হয় (ইংরেজিতে কম্পাউন্ড (compound), যা একটি ল্যাটিন শব্দ হতে এসেছে যার অর্থ একসাথে স্থাপন)।
রসায়নবিদগণ ক্রমশ কোন বস্তু কী পরিমাণ বিভিন্ন মৌলিক পদার্থ নিয়ে গঠিত তা সনাক্ত করতে প্রবল উৎসাহী হয়ে উঠলেন। এর শুরু হয় ফরাসী রসায়নবিদ যোসেফ লুই প্রাউস্ট (Joseph Louis Proust, ১৭৫৪-১৮২৬) এর হাত ধরে যিনি এই সমস্যা নিয়ে কাজ শুরু করেন এবং একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার করে ফেলেন। তাঁর সময়ে একটি যৌগ ছিল যাকে আমরা বর্তমানে কপার কার্বনেট নামে ডাকি। প্রাউস্ট এই বিশুদ্ধ যৌগটিকে নিয়ে কাজ শুরু করেন এবং একে ভেঙে তিনটি মৌল সংগ্রহ করেন; কপার (তামা), কার্বন এবং অক্সিজেন। ১৭৯৯ সালে তিনি দেখলেন যে, এই যৌগের প্রতিটি নমুনা যে পদ্ধতিতেই প্রস্তুত করা হোক না কেন, সর্বদাই ভর হিসেবে পাঁচভাগ তামা, চার ভাগ অক্সিজেন এবং একভাগ কার্বনকে একসাথে যুক্ত করে তৈরি হচ্ছে। তিনি যদি কোন একটি উপাদান, যেমন, কপার যদি অতিরিক্ত পরিমাণে মিশ্রণে যুক্ত করেন তাহলে অতিরিক্ত পরিমাণটুকু অবশিষ্ট থেকে যাচ্ছে। তিনি যদি কপার পরিমাণে কিছুটা কম নেন, তাহলে কেবল মাত্র নির্দিষ্ট অনুপাতে বাকি অতিরিক্ত মৌলগুলো তামার সাথে যুক্ত হচ্ছে এবং তাদের কার্বন ও অক্সিজেনের অংশ অপরিবর্তিত থেকে যাচ্ছে।
প্রাউস্ট দেখালেন যে, এই একই ঘটনা অন্য আরো অনেক যৌগের জন্যই সত্য। সেসব যৌগ যেসব মৌল দিয়ে গঠিত তারা সবসময়ই কেবল একটি নির্দিষ্ট অনুপাতেই যৌগের মধ্যে বিদ্যমান থাকছে। এই সূত্রটির নাম দেওয়া হয় স্থিরানুপাত সূত্র। স্থিরানুপাত সূত্রটি পরমাণুবাদকে বড় ধরনের সমর্থন দিল। মনে করি, কপার কার্বনেট যৌগটি কয়েকটি ক্ষুদ্র পরমাণুগুচ্ছ (ইংরেজিতে মলিক্যুল (molecule), ল্যাটিন ভাষায় যার অর্থ একটি ক্ষুদ্র ভর, বাংলায় অণু নামে ডাকা হয়) নিয়ে গঠিত যার প্রতিটি গুচ্ছে আছে একটি তামার পরমাণু, একটি কার্বন পরমাণু এবং তিনটি অক্সিজেন পরমাণু। আরো মনে করি, তিনটি অক্সিজেন পরমাণু একত্রে কার্বন পরমাণুর চেয়ে চারগুণ ভারী এবং তামার পরমাণুটি এই তিনটি পরমাণুর চেয়ে পাঁচগুণ ভারী। যদি এই যৌগের প্রতিটি অণু এই অনুপাতে বিন্যাস্ত থাকে তাহলে কপার কার্বনেট যৌগটি সর্বদাই ভর হিসেবে পাঁচভাগ কপার, চারভাগ অক্সিজেন এবং একভাগ কার্বন নিয়ে গঠিত হবে।
যদি প্রতিটি অণু, ধরি ১ ১/২ পরিমাণ কপার পরমাণু, ৩ ১/৩ টি অক্সিজেন পরমাণু এবং ৫/৬ টি কার্বন পরমাণু দ্বারা গঠন করা যেত, তাহলে আমরা হয়তো কপার কার্বনেটের বিভিন্ন নমুনায় বিভিন্ন অনুপাতে এই তিনটি মৌল পেতাম। কিন্তু আমরা বিভিন্ন অনুপাতে যৌগটি পাই না। এই পর্যবেক্ষণ শুধু পরমাণুর ধারণাকেই প্রতিষ্ঠা করে না, বরং সেই সাথে এটাও বলে যে, পরমাণুসমূহ অবিভাজ্য, ডেমোক্রিটাস অনেক অনেক কাল আগে যা ধারণা করেছিলেন। এটি হয় অখণ্ড অবস্থায় থাকে, নতুবা মোটেও উপস্থিত থাকে না।
ডেমোক্রিটাস এবং প্রাউস্টের কর্মপদ্ধতির মধ্যে পার্থক্য হলো ডেমোক্রিটাসের শুধুমাত্র একটি প্রস্তাবনা ছিল কিন্তু প্রাউস্টের ছিল সাক্ষ্যপ্রমাণ। (এর মানে এই নয় যে প্রাউস্ট ডেমোক্রিটাসের চেয়ে জ্ঞানী বা উপযুক্ত ব্যক্তি ছিলেন। প্রাউস্টের হাতে ডেমোক্রিটাসের চেয়ে ২১টি শতাব্দীর চিন্তাভাবনা ও কর্মকাণ্ড জমা ছিল যা তিনি কাজে লাগাতে পেরেছেন। আপনি বরং এভাবে ভাবতে পারেন, ডেমোক্রিটাসের কাজ অধিক স্মরণীয় কেননা তিনি এত আগে সত্য উপলব্ধি করতে পেরেছেন।) এমনকি সাক্ষ্যপ্রমাণ থাকা সত্ত্বেও প্রাউস্ট হয়তো সঠিক না-ও হতে পারতেন। সর্বোপরি, এটাও সম্ভব ছিল যে প্রাউস্টের পর্যবেক্ষণ ভুল এবং তিনি তাঁর ধারণা প্রমাণে এতই অধীর ছিলেন যে, তিনি অবচেতন মনে তাঁর পর্যবেক্ষণ নিজের মতো করে পাওয়ার চেষ্টা করেছেন। (বিজ্ঞানীরা মানবীয় সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে নন, এবং এই ধরনের ঘটনা ঘটাও অস্বাভাবিক নয়)।
অপর একজন ফরাসী রসায়নবিদ ক্লদ লুই বার্থোলেট (Claude Louise Berthollet, ১৭৪৮-১৮২২) সেই সময় পদে পদে প্রাউস্টের বিরুদ্ধাচরণ করেছেন। তিনি বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, প্রাউস্টের বিশ্লেষণ অনুযায়ী একই ধরনের মৌলের ভিন্ন ভিন্ন অনুপাতের মিশ্রণে যৌগ উৎপন্ন হওয়ার কথা। অবশ্য ১৮০৪ সালে সুইডিশ রসায়নবিদ জন জ্যাকব বার্জেলিয়াস (১৭৭৯-১৮৪৮) পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রাউস্টের ধারণার ভিত্তি মজবুত করেন এবং প্রমাণ করেন যে, স্থিরানুপাত সূত্র সম্পূর্ণ সঠিক।
এই সময়ে ইংলিশ রসায়নবিদ জন ডাল্টনও (John Dalton, ১৭৬৬-১৮৪৪) একই সমস্যা নিয়ে কাজ করছিলেন। তিনি দেখলেন যে, একই ধরনের পরমাণুর বিভিন্ন অনুপাতের মিশ্রণে উৎপন্ন যৌগিক পদার্থও পাওয়া সম্ভব। এভাবে, কার্বন এবং অক্সিজেন গঠিত একটি গ্যাসে পাওয়া গেল তিনভাগ কার্বনের সাথে চারভাগ অক্সিজেন। আর অপর একটি গ্যাস যেটিও গঠিত হয়েছে কার্বন ও অক্সিজেন দিয়ে, তাতে পাওয়া গেল তিনভাগ কার্বনের সাথে আট ভাগ অক্সিজেন। এই দুটি নমুনাই ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি গ্যাস যাদের ধর্ম ভিন্ন ভিন্ন এবং তাদের প্রতিটির জন্য স্থিরানুপাত সূত্র পৃথক পৃথক ভাবে কাজ করে।
ডাল্টন প্রস্তাব করলেন, এই দুই ধরনের গ্যাসের একটিতে একটি কার্বন পরমাণু একটি অক্সিজেন পরমাণুর সাথে এবং অপর গ্যাসে একটি কার্বন পরমাণু দুটি অক্সিজেন পরমাণুর সাথে যুক্ত। পরবর্তীতে তার ধারণা সত্যি বলে প্রমাণিত হলো এবং এই দুটি গ্যাসের প্রথমটি কার্বন মনোক্সাইড এবং দ্বিতীয়টি কার্বন ডাই অক্সাইড বলে পরিচিত হলো। (উপসর্গ “মনো-“ গ্রিক থেকে আগত যার মানে এক এবং “ডাই” গ্রিক দুই বোঝাতে ব্যবহৃত হয়)।
ডাল্টন দেখতে পেলেন এই ব্যাপারটি অন্য গ্যাসগুলোর জন্যও প্রযোজ্য এবং ১৮০৩ সালে তিনি এই বিষয়টিকে গুণানুপাত সূত্র হিসেবে ঘোষণা করলেন। তিনি দেখালেন যে, এই সূত্রটিও পরমাণুর ধারণার সাথে যায় এবং তিনি সুচিন্তিতভাবে ডেমোক্রিটাসের প্রতি সম্মান প্রদর্শনপূর্বক তাঁর প্রবর্তিত atomos নামটি থেকে atom শব্দটিকে প্রচলিত করলেন।
ডাল্টন বলেন যে, পরমাণুর অনুপাতের বিষয়ে যা পাওয়া গেল তাতে এটা ধরে নিতে হয় প্রতিটি মৌল বেশ কিছু পরমাণু দিয়ে গঠিত যাদের প্রতিটির ভর একই ও নির্দিষ্ট এবং বিভিন্ন ধরনের মৌলের পরমাণুর ভর ভিন্ন ভিন্ন এবং অণুসমূহ তৈরি হয় সুনির্দিষ্ট এবং স্বল্প সংখ্যক ভিন্ন ভিন্ন কাছাকাছি অবস্থিত পরমাণু দিয়ে।
১৮০৮ সালে ডাল্টন New System of Chemical Philosophy (রাসায়নিক দর্শনের নতুন ব্যবস্থা) নামে একটি বই প্রকাশ করেন যেখানে তিনি পরমাণুবাদকে প্রতিষ্ঠা করে এমন যাবতীয় সাক্ষ্য-প্রমাণ একত্রিত করেন এবং দেখান যে কীভাবে এই সব সাক্ষ্য-প্রমাণ পরস্পরের সাথে সম্পর্কযুক্ত। এই বইটির মাধ্যমে ডাল্টন আধুনিক পরমাণু তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত করেন। আধুনিক বলার তাৎপর্য হচ্ছে এই যে, এটা গ্রিকদের তত্ত্বের তুলনায় সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। অবশ্য তত্ত্ব শব্দটি সাধারণ মানুষের কাছে যথাযথাভাবে বোধগম্য ছিল না, যারা এই শব্দটি দ্বারা বুঝতেন অনুমান। এমনকি বিজ্ঞানীরা এই শব্দটি দ্বারা যা বোঝাতেন, অভিধানেও এই শব্দটি তেমনভাবে ব্যাখ্যা করা ছিল না।
যথাযথ ভাবে বললে বলতে হয়, তত্ত্ব হচ্ছে একগুচ্ছ ভিত্তিমূলক সূত্র যা যথেষ্ট পরিমাণ পর্যবেক্ষণ দ্বারা স্বীকৃত ও সুনিশ্চিত এবং যা সাধারণভাবে পরস্পরের সাথে সম্পর্কহীন বলে মনে হয় এমন অনেকগুলো সত্যকে বোধগম্য করে তোলে। ব্যাপারটি হচ্ছে এমন যে, একটি কাগজে একগুচ্ছ বিন্দু দিয়ে বিভিন্ন শহর, রেখা দিয়ে দেশ এবং রাষ্ট্রীয় সীমানা বোঝানো হলো যেগুলো আপাতদৃষ্টিতে কাগজে আঁকা দেখলে এলোমেলো ও অর্থহীন বলে মনে হয়। তত্ত্ব হচ্ছে একটি মানচিত্র যা এই শহরগুলোকে রাষ্ট্রের ভিতরে যথাস্থানে বসায় এবং তাদের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করে ও অর্থবহ করে তোলে।
একটি তত্ত্বকে সবদিক থেকে পুরোপুরি সঠিক হতে হবে এমন কোনো কথা নেই, তবে তাদেরকে সেই পরিমাণ সঠিক হতে হবে যেন বিজ্ঞানীরা তত্ত্ব থেকে পুরো বিষয়টি সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট ধারণা পান এবং সেই তত্ত্বটিকে আরো নিখুঁত করার জন্য প্রয়োজনীয় কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করতে পারেন। ডাল্টনের তত্ত্বের প্রতিটি সূত্র পুরোপুরি সঠিক ছিল না। পর্যায়ক্রমে বোঝা গিয়েছিল যে, একই পদার্থের ভিন্ন ভর বিশিষ্ট পরমাণু থাকা সম্ভব কিংবা ভিন্ন ভিন্ন পদার্থের ও একই ভর বিশিষ্ট পরমাণু থাকা সম্ভব। তারপরেও, ডাল্টনের তত্ত্ব যথার্থতার যথেষ্ট কাছাকাছিই ছিল, যতটা যথার্থ হলে রসায়নবিদদের জন্য তা কাজে লাগে এবং ভবিষ্যৎ গবেষণার প্রতি দিক নির্দেশনা পাওয়া যায় এবং তত্ত্বটিকে আরো নিখুঁত করে তোলার সুযোগ তৈরি হয়।
কোনো বৈজ্ঞানিক তত্ত্বই রাতারাতি বিজ্ঞানীমহলে স্বীকৃত হয়নি। ইতিহাসে সর্বদাই এমন কিছু বিজ্ঞানী ছিলেন যাঁরা যেকোনো নতুন কিছুর প্রতি সন্দেহ পোষণ করেন। প্রকৃতপক্ষে এটি একটি ভালো দিক। কোন তত্ত্বই খুব সহজে গৃহীত হওয়া উচিৎ নয়; প্রতিটি তত্ত্বকেই কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া উচিৎ যেন তার ফাঁক-ফোঁকরগুলো সহজে চোখে পড়ে এবং সেগুলোকে শুধরে নেওয়া যায়।
বলাই বাহুল্য, ডাল্টনের নতুন তত্ত্বটিকে তৎকালীন সবচেয়ে প্রসিদ্ধ বেশকিছু রসায়নবিদ সন্দেহের দৃষ্টিতে নিলেন, কিন্তু ধীরে ধীরে তত্ত্বটি বৈজ্ঞানিকমহলের সমাদর কেড়ে নিল এবং পর্যায়ক্রমে সমগ্র বৈজ্ঞানিক সমাজ এর সমর্থকের কাতারে চলে এলো এবং পরমাণুবাদী হয়ে উঠল।
[বইয়ের সূচীপত্র তথা প্রকাশিত সবগুলো আর্টিকেলের জন্য এখানে দেখুন। বিজ্ঞান পত্রিকায় সম্পূর্ণ বইটিই পড়া যাবে, তবে মুদ্রিত সংস্করণটি সংগ্রহ করতে চাইলে যোগাযোগ করুন: ছায়াবিথী প্রকাশনী, ফোন: ০১৭২৩৮০৭৫৩৯, এছাড়া অর্ডার দেওয়া যাবে অনলাইন বইয়ের দোকানগুলোতে।]
-ইমতিয়াজ আহমেদ
সম্পাদক, বিজ্ঞান পত্রিকা
[ফেসবুক প্রোফাইল]