পরমাণুর গহীন নিসর্গে | ৫: আইসোটোপ | ৫.৩: অর্ধায়ু

0
456

অধ্যায়-৫: আইসোটোপ
অনুচ্ছেদ-৩: অর্ধায়ু
[বইয়ের সূচীপত্র তথা প্রকাশিত সবগুলো আর্টিকেলের জন্য এখানে দেখুন]

একটি তেজষ্ক্রিয় ধারার বিভিন্ন মধ্যবর্তী বস্তুগুলো খুব দ্রুত ভেঙে যায়। যদি নির্দিষ্ট পরিমাণ কোনো একটি মধ্যবর্তী বস্তুকে পর্যবেক্ষণ করা হয়, তাহলে দেখা যায় যে সময়ের সাথে এর ভাঙনের পরিমাণ কমতে থাকে। কারণটি স্পষ্ট। যেহেতু পরমাণু ভাঙতে থাকে তাই মূল প্রকরণটি ক্রমশঃ কমতে কমতে নিঃশেষ হতে থাকে এবং ভাঙনের জন্য আগের চেয়ে আরো কম পরমাণু পাওয়া যায়।

যে হারে এই ভাঙনের হ্রাস ঘটে তার সাথে এর আগে বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়ার হারের ক্রম-হ্রাসের ঘটনার মিল খুঁজে পেলেন বিজ্ঞানীরা। এই ধরনের ক্রমহ্রাসমান হারের বিক্রিয়াকে বলা হয় প্রথম-ক্রম বিক্রিয়া। এর মানে হলো একটি নির্দিষ্ট প্রকরণের প্রতিটি পরমাণুর বিয়োজনের একটি নির্দিষ্ট সম্ভাবনা থাকে। সময়ের সাথে সেই সম্ভাবনা পরিবর্তিত হয় না। এদের কোন নির্দিষ্ট একটি দিনে দুয়ের মধ্যে একটির হয়তো ভাঙার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু যদি ১০০ দিন পার হয়ে যায় এবং একটিও না ভাঙে তারপরও ১০১ তম দিনে দুয়ের মধ্যে একটিরই ভাঙার সম্ভাবনা থাকবে। মুদ্রা নিক্ষেপের মাধ্যমে টস করার সাথে এর সাদৃশ্য আছে। টসে হেড ওঠার সম্ভাবনা থাকে দুইবারের মধ্যে একবার। কিন্তু আপনি যদি ১০০ বার টস করেন এবং প্রতিবারই টেইল পান তারপরেও ১০১তম বারে হেড ওঠার সম্ভাবনা থাকবে অর্ধেক মাত্র! তবে এখানে ধরে নেওয়া হচ্ছে মুদ্রাটির মধ্যে কোনো ত্রুটি নেই। প্রায়ই এই ভুল করা হয় যে, একটি মুদ্রাকে বারবার নিক্ষেপ করলে যত বেশি টেইল উঠবে পরবর্তীতে হেড ওঠার সম্ভাবনা ততই বেড়ে যাবে।

আপনি এটি বলতে পারবেন না কখন একটি নির্দিষ্ট পরমাণু বিয়োজিত হবে। কিন্তু আপনি যদি বিপুল পরিমাণ পরমাণু নিয়ে কাজ করেন, তাহলে আপনি গণনা করে বের করতে পারবেন দিন শেষে মোট কতগুলো পরমাণু বিয়োজিত হবে। কিংবা মিনিটেই বা কয়টি তাও বের করা যাবে। আপনি বলতে পারবেন না ঠিক কোন পরমাণুটি ভাঙবে। কিন্তু মোট কতটি পরমাণু ভাঙবে তা বলতে পারবেন। এটি অনেকটা একই রকম, যখন পরিসংখ্যানবিদগণ অনুমান করেন সাপ্তাহিক ছুটির দিনে কয়জন মানুষ গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যাবেন, যদিও তাঁরা তেমন সহজে বলতে পারবেন না ঠিক কোন ব্যাক্তিটি মারা যাবেন।

এর মানে হলো আপনি গণনা করতে পারবেন উপস্থিত বস্তুর অন্তর্গত অর্ধেক পরমাণু ভেঙে যেতে কত সময় লাগবে। প্রথম-ক্রম বিক্রিয়ার ক্ষেত্রেও বিষয়টি একই রকম, কোনো বস্তুর অর্ধেক পরিমাণ বিক্রিয়া করতে সবসময় একই সময় লাগে। এভাবেই, আপনি যদি কোনো নির্দিষ্ট পরমাণুর ১২০ গ্রাম নিয়ে শুরু করেন এবং যদি এর অর্ধেকটা বিয়োজিত হতে ১ বছর সময় লাগে, তাহলে এর অবশিষ্ট অর্ধেকের মধ্যে আরো অর্ধেকটা বিয়োজিত হতে আরো ১ বছর সময় লাগবে।

অন্যভাবে বিষয়টি দেখুন, ১২০ গ্রাম নিয়ে শুরু করে এক বছর শেষে আপনার কাছে ৬০ গ্রাম থাকবে। দুই বছর শেষে ৩০ গ্রাম থাকবে। তৃতীয় বছর শেষে ১৫ গ্রাম থাকবে। চতুর্থ বছর শেষে ৫.৫ গ্রাম থাকবে এবং এভাবেই চলতে থাকবে। তাত্ত্বিকভাবে আপনি কখনোই শূন্যে পৌঁছাবেন না, কিন্তু পর্যায়ক্রমে একসময় আপনার কাছে একটি মাত্র পরমাণু থাকবে এবং কিছু অনুমানের অযোগ্য সময় পরে এটিও ভেঙে যাবে। আপনার তেজষ্ক্রিয় আইসোটোপটি পুরোপুরি নিঃশেষ হয়ে যাবে।

অনেক ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা একক সময়ে নিঃসৃত আলফা বা বিটা কণিকার প্রকৃত সংখ্যা গণনা করে ফেলতে পারেন। এই সংখ্যাটি কী হারে হ্রাস পায় তা থেকে তাঁরা একটি আইসোটোপের অর্ধেকে পরিণত হওয়ার সময় বের করে ফেলতে পারেন। বিজ্ঞানীরা আলফা ও বিটা কণিকার সংখ্যা নির্ণয়ের অনেকগুলো পদ্ধতি বের করেছেন, কিন্তু আমি কেবলমাত্র বাধ্য হলেই সেগুলো নিয়ে আলোচনা করব। আমি যেই বিষয়ে জোর দিচ্ছি তা হচ্ছে ধারণা ও চিন্তাধারা।

এভাবেই জানা যায়, প্রোট্যাকটিনিয়াম আইসোটোপ চধ-২৩৪ যা ইউরেনিয়ামের বিয়োজন থেকে পাওয়া যায় তার অর্ধেক পরমাণু প্রায় ৭০ সেকেন্ডে হারিয়ে ফেলে। এই সময়টিই এর “অর্ধায়ু” (একটি পরিভাষা যা আর্নেষ্ট রাদারফোর্ড চালু করেছিলেন ১৯০৪ সালে)।

প্রাকৃতিকভাবে প্রোট্যাক্টিনিয়াম-২৩৪ সম্পূর্ণ নিঃশেষ হতে খুব বেশি সময় লাগবে না, এমনি যদি বিশাল পরিমাণেও নিয়ে শুরু করা হয়। যদি সমগ্র পৃথিবীটিই শুধুমাত্র প্রোট্যাক্টিনিয়াম-২৩৪ দিয়ে গঠিত হত, এবং যদি ধরে নেওয়া হয় পরমাণু সাড়া-শব্দ ছাড়া বিয়োজিত হয়, এই বিপুল পরিমাণ পরমাণু মাত্র তিন ঘণ্টার মধ্যে শেষ হয়ে যেত। বাস্তবে এতো বেশি শক্তি উৎপন্ন হতো যে পৃথিবী একটি প্রকান্ড বোমার মতো বিস্ফোরিত হতো।

এবং তারপরেও প্রোট্যাক্টিনিয়ামকে পৃথিবীর মাটিতে পাওয়া যায় এবং খুব সামান্য পরিমাণে পৃথক করা যায়। কেন এটি পুরোপুরি নিঃশেষ হয়ে যায় নি? এর উত্তর হলো পৃথিবীর উদ্ভবের সময় এধরনের যদি কোনো পরমাণুর অস্তিত্ব থেকে থাকে তাহলে তারা কয়েক মিনিটের মধ্যেই নিঃশেষ হয়ে গেছে, তবে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে সবসময়ই এটি ইউরেনিয়াম থেকে উৎপন্ন হচ্ছে।

অন্য আইসোটোপগুলোর অর্ধায়ু আরো দীর্ঘ। রেডিয়াম-২২৬ আলফা কণিকা নিঃসরণ করে। এর অর্ধায়ু বেশ দীর্ঘ, তাই অল্প সময়ের মধ্যে এর বিয়োজন হারের পার্থক্য হিসেব করার মত যথেষ্ট নয়। যদি কেউ দীর্ঘ সময় অপেক্ষায় থাকে তাহলে এই ক্রমহ্রাসমান হার পরিমাপ করা যেতে পরে এবং এভাবেই জানা যায় এর অর্ধায়ুটি হচ্ছে ১৬২০ বছর। তারপরেও এই অর্ধায়ু পৃথিবীর উদ্ভবকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত টিকে থাকার জন্য যথেষ্ট নয়। রেডিয়ামের অস্তিত্ব আছে। কেননা এটি প্রতিনিয়ত ইউরেনিয়াম থেকে উৎপন্ন হচ্ছে।

যেহেতু ইউরেনিয়ামের বিয়োজনের হার খুব ধীর, তাই রেডিয়াম গঠিত হয় খুব ধীরে। রেডিয়াম যদিও উৎপন্ন হওয়ার সাথে সাথেই বিয়োজিত হতে থাকে কিন্তু শুরুতে এই হার থাকে কম কেননা শুরুতে এর পরিমাণ থাকে খুব অল্প। যতই এটি ক্রমান্বয়ে বেশি পরিমাণে জড়ো হতে থাকে ততোই এর বিয়োজন দ্রুত থেকে দ্রুততর হতে থাকে। এটি প্রথম-ক্রম বিক্রিয়ার বৈশিষ্ট্য পর্যায়ক্রমে এটি এমন অবস্থায় পৌঁছায় যে যতগুলো পরমাণু নতুন করে নির্দিষ্ট সময়ে তৈরি হয়, ততগুলোই একই সময়ে ভেঙে যায়, এতে একটি তেজষ্ক্রিয় সাম্যাবস্থা তৈরি হয়।

যে বস্তুটিতে ইউরেনিয়ামের উপস্থিতি আছে তাতেই রেডিয়ামের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। তবে রেডিয়ামের পরিমাণ ইউরেনিয়ামের চেয়ে অনেক কম থাকে কেননা এর অর্ধায়ু তুলনামূলক ভাবে অনেক কম। এমনকি যদি ইউরেনিয়াম সরাসরি রেডিয়াম উৎপন্ন না-ও করে বরং অন্যান্য মধ্যবর্তী ধাপ পেরিয়ে যদি রেডিয়াম উৎপন্ন হয় তাহলেও তুলনাটি একই রকম থাকে।

এই ঘটনার কারণেই, ইউরেনিয়ামের আকরিকের মধ্যে ইউরেনিয়ামের ঘনত্ব রেডিয়ামের চেয়ে ২,৭৮০,০০০ গুণ বেশি। কারণ ইউরেনিয়াম-২৩৮ এর অর্ধায়ু রেডিয়াম-২২৬ এর চেয়ে ২,৭৮০,০০০ গুণ বেশি দীর্ঘ। এর অর্থ হলো ইউরেনিয়ামের অর্ধায়ু প্রায় ৪.৫১ বিলিয়ন বছর।

এই কারণেই আদিম পৃথিবীর ইউরেনিয়ামের অস্তিত¦ এখনো বিদ্যমান। পৃথিবী প্রথম গঠিত হয়েছিল ৪.৬১ বিলিয়ন বছর আগে এর গঠনে একটি সুনির্দিষ্ট পরিমাণ ইউরেনিয়াম অন্তর্ভুক্ত করেছে। এই সুদীর্ঘ পথ চলায় এর আদিম ইউরেনিয়ামের কেবলমাত্র অর্ধেকের কাছাকাছি পরিমাণ বিয়োজিত হয়েছে। বাকি অর্ধেকটা এখনো রয়ে গেছে। যেটুকু রয়ে গেছে তার অর্ধেকটা ভেঙে যেতে আরো ৪.৫১ বিলিয়ন বছর লেগে যাবে। যেহেতু ইউরেনিয়াম এই সম্পূর্ণ সময়টিতে আমাদের আশেপাশেই ছিল তাই এর মধ্যবর্তী বস্তুগুলোও বিদ্যমান আছে, তবে অবশ্যই অনেক সামান্য পরিমাণে।

থোরিয়াম-২৩২ এর অর্ধায়ু এমনকি ইউরেনিয়ামের চেয়ে দীর্ঘ-১৩.৯ বিলিয়ন বছর। পৃথিবীর প্রাথমিক বরাদ্দের কেবলমাত্র ১/৫ ভাগ থোরিয়ামই কেবল অদ্যাবধি বিয়োজিত হতে পেরেছে।

ইউরেনিয়ামের অন্য আইসোটোপ, ইউরেনিয়াম-২৩৫ এর উপস্থিতি আছে যা ১৯৩৫ সালে কানাডিয়ান-আমেরিকান পদার্থবিদ আর্থার জেফরি ডেম্পস্টার (Aurther Jeffrey Dempster, ১৮৮৬-১৯৫০) আবিষ্কার করেন। এটি ইউরেনিয়াম-২৩৮ বা থোরিয়াম-২৩২ এর মতো এতো দীর্ঘায়ু নয়। ইউরেনিয়াম-২৩৫ এর অর্ধায়ু কেবল ৭১০ মিলিয়ন বছর। তবে তারপরও এই সময়টি বেশ লম্বা, যদিও পৃথিবী গঠনের সময়কার প্রাথমিক পরিমাণের মাত্র ১/৭০ ভাগ বর্তমানে অবশিষ্ট আছে।

[বইয়ের সূচীপত্র তথা প্রকাশিত সবগুলো আর্টিকেলের জন্য এখানে দেখুন। বিজ্ঞান পত্রিকায় সম্পূর্ণ বইটিই পড়া যাবে, তবে মুদ্রিত সংস্করণটি সংগ্রহ করতে চাইলে যোগাযোগ করুন: ছায়াবিথী প্রকাশনী, ফোন: ০১৯১৫৯৩৯৬৬৮]

-ইমতিয়াজ আহমেদ
সম্পাদক, বিজ্ঞান পত্রিকা
[লেখকের ফেসবুক প্রোফাইল]

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.