অধ্যায়-২: আলো
অনুচ্ছেদ-১: কণা এবং তরঙ্গ
[বইয়ের সূচীপত্র তথা প্রকাশিত সবগুলো আর্টিকেলের জন্য এখানে দেখুন]
আমরা যদি স্বীকার করে নিতে প্রস্তুত থাকি যে, এই পৃথিবীতে প্রতিটি পদার্থ পরমাণু দিয়ে গঠিত তাহলে খুব যুক্তিসংগত ভাবেই প্রশ্ন করা যায় যে, এই পৃথিবীতে এমন কিছু আছে কিনা যা পদার্থ নয় এবং একই কারণে পরমাণু দিয়ে গঠিত-ও নয়। এর উত্তর হিসেবে শুরুতেই যা মনে আসতে পারে তা হচ্ছে, আলো।
কিছু কারণে মানুষ সর্বদাই নিশ্চিতভাবে ধারণা করে এসেছে যে আলো পদার্থ নয়। কঠিন এবং তরল স্পর্শ করা যায়, তাদের ভর আছে। তাই ওজনও আছে এবং তারা জায়গা দখল করে। গ্যাসীয় পদার্থকে কঠিন এবং তরলের মত অনুভব করা না গেলেও গতিশীল অবস্থায় অনুভূত হয়। আমাদের সবারই তীব্র বায়ু প্রবাহ অনুভব করার অভিজ্ঞতা আছে এবং টর্নেডো কী-না করতে পারে তাও আমাদের জানা। এছাড়াও আমরা জানি, বায়ু স্থান দখল করে, যেমন: একটি খালি বিকারকে (আসলে বায়ুতে পূর্ণ) যদি উপুড় করে পানিতে চুবিয়ে ধরা হয়, তাহলে পানি বিকারের ভিতরে ঢুকে সেই স্থানটি দখল করতে পারে না যদি না কোনোভাবে বিকারের ভিতরের বায়ুকে বেরিয়ে যেতে না দেওয়া হয়। ১৬৪৩ সালে ইতালীয় পদার্র্থবিদ ইভানজেলিস্তা টরিচেল্লি (Evangelista Torricelli, ১৬০৮-১৬৪৭) দেখিয়েছেন যে বায়ুর ওজন আছে এবং সেই ওজন দিয়ে এটি ৭৬ সেমি উচ্চতা বিশিষ্ট পারদ-স্তম্ভকে ধরে রাখতে পারে।
অন্যদিকে, আলোর এসব কোনো ধর্ম নেই। এটি এমনকি অনুভবও করা যায় না, অবশ্য এটি যে তাপ উৎপন্ন করে তা অনুভব করা যায়। কখনোই এর ভর বা ওজন আছে বলে বোঝা যায়নি এবং এটি স্থান দখল করে বলেও জানা যায় নি। তবে এর মানে এই নয় যে, আলো অবস্তুগত বলে তাকে গুরুত্বহীন মনে করে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঈশ্বরের প্রথম বাণী যা বাইবেলে উল্লেখ করা হয়েছে, তা হচ্ছে ‘আলো আসতে দাও (let there be light.)’। এর বাইরেও এটি ছিল সেই চারটি প্রাচীন মর্ত্যীয় মৌলিক পদার্থের একটি যাদের বাকি তিনটি হচ্ছে বায়ু, পানি এবং মাটি।
সূর্যালোককে তার বিশুদ্ধ অবস্থায় সাধারণভাবে স¡াভাবিক আলো হিসেবে ধরা হতো। এটি ছিল সাদা আলো; অপরিবর্তনশীল এবং চিরস্থায়ী। যদি সূর্যালোককে রঙিন কাচের মধ্য দিয়ে পার হতে দেওয়া হয়, তাহলে তা সেই কাচের রং ধারণ করে; এটি হচ্ছে পার্থিব অবিশুদ্ধতার দৃষ্টান্ত। আবার, পৃথিবীতে যখন কোনো কিছু জ্বালানো হয় তখন তা কিছু পরিমাণ আলো নির্গত করে, সেটি হতে পারে হলুদ, কমলা অথবা লাল। আগের মতোই, এগুলো হচ্ছে পার্থিব অবিশুদ্ধতা যা রং উৎপন্ন করে।
সূর্যালোকের সাদা আলোর বিপরীতে একটি রঙিন আলো যা অন্যান্য পার্থিব বস্তু হতে পৃথক ধরনের, তা হচ্ছে রংধনু। এর বৈশিষ্ট্য ছিল মানুষের বোধগম্যতার বাইরে এবং এই কারণে এটি প্রাচীনকালে যথেষ্ট পরিমাণ উপাখ্যান এবং পৌরাণিক ঘটনারও জন্ম দিয়েছে। রংধনুকে দুনিয়া এবং স্বর্গের মাঝে সাঁকো মনে করা হত যা ব্যবহার করতেন স্বর্গীয় দূতেরা। (তাই গ্রিক দেবদূতের নাম দেওয়া হয় ইরিস (Iris), গ্রিক ভাষায় যার অর্থ রংধনু।) এটিকে একটি স¡র্গীয় নিশ্চয়তা হিসেবেও দেখা হত, যার মানে হচ্ছে পৃথিবী আবারো প্লাবনের মাধ্যমে ধ্বংস হবে না, কেননা ঈশ¡র রংধনুর মাধ্যমে ইঙ্গিত দিয়েছেন যে তিনি মানুষের কথা মনে রেখেছেন এবং বৃষ্টি থামিয়েছেন।
যা হোক, ১৬৬৫ সালে ইংরেজ বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটন (Isaac Newton, ১৬৪২-১৭২৭) তাঁর নিজের মতো করে রংধনু উৎপন্ন করেন। একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন কক্ষে তিনি সরু ছিদ্র দিয়ে একগুচ্ছ আলোকরশ্মিকে প্রবেশ করতে দেন এবং সেটিকে একটি কাচের প্রিজমের ভিতর দিয়ে চালনা করেন। আলোর বিমটি ছড়িয়ে পড়ে এবং সাদা দেয়ালে একগুচ্ছ রং উৎপন্ন করে। ক্রমানুসারে, এই রং গুলো হচ্ছে লাল, কমলা, হলুদ, সবুজ, নীল এবং বেগুনী। এই রংয়ের ক্রমটি রংধনুতে উৎপন্ন রংয়ের একই ক্রমে পাওয়া যায়। বর্তমানে আমরা জানি রংধনু তৈরি হয় বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার পরও বায়ুমণ্ডলের বিরাজমান অজস্র পানির কণার ভিতর দিয়ে সূর্যরশ্মি অতিক্রমের ফলে। এই পানির কণাগুলোর মধ্য দিয়ে সূযার্লোক গমনের ফলে একই ঘটনা ঘটে যা ঘটেছিল কাচের প্রিজমের ভিতর দিয়ে।
নিউটনের এই পরীক্ষা থেকে স্পষ্ট দৃশ্যমান হলো যে, সূযার্লোক আর যা-ই হোক ‘বিশুদ্ধ’ নয়। এর সাদা ভাব তৈরি হয় আমাদের চোখে বিভিন্ন রং-এর সংমিশ্রণে তৈরি আলোর অনুভূতির কারণে। কাচের প্রিজমে বিশ্লেষিত হওয়ার পর এদের যদি বিপরীতভাবে স্থাপিত আরেকটি প্রিজমের মধ্য দিয়ে চালনা করা হয় তাহলে পুনরায় বিভিন্ন রং-এর আলোক রশ্মিœ একীভূত হয়ে সাদা রং উৎপন্ন করে।
যেহেতু বর্ণসমূহ পুরোপুরি অবস্তুগত বিষয়, নিউটন তাই রংধনুর বর্ণগুচ্ছকে একত্রে নাম দিলেন স্পেকট্রাম (spectrum, ল্যাটিন ভাষায় যার অর্থ ভূত বা অশরীরী, বাংলায় বর্ণালী বলা হয়)। তবে নিউটনের বর্ণালীটি একটি সমস্যা তৈরি করল। রংয়ের বিশ্লেষণ যেহেতু কাচের প্রিজমের মাধ্যমে পাওয়া গেল, নিউটনের বিশ¡াস ছিল এই কাচের প্রিজমের মাধ্যমে বিভিন্ন আলো বিভিন্ন কোণে আলাদাভাবে বেঁকে গেছে। যার কারণে বর্ণালী তৈরি হচ্ছে এবং দেয়ালের গায়ে আলাদাভাবে দেখা গেছে। যদি এমনই হয় তাহলে আলো এমন কী জিনিস দিয়ে তৈরি যা তাদের এভাবে বর্ণালীতে বিশ্লিষ্ট করে ফেলে?
নিউটন একজন পরমাণুবাদী ছিলেন, তাই তিনি স্বাভাবিক ভাবেই মনে করলেন আলোও বস্তুর পরমাণুর মতো কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা দিয়ে গঠিত তবে এই ক্ষেত্রে সেসব ক্ষুদ্র কণার ভর নেই। যদিও বিভিন্ন রংয়ের আলোর মধ্যে পার্থক্য তৈরি হয় কেন এবং কেনই বা তারা প্রিজমের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন দিকে বেঁকে যায় সেই ব্যাপারে তাঁর কোনো পরিষ্কার ধারণা ছিল না। অধিকন্তু, যখন দুটি আলোর গুচ্ছ পরস্পরকে অতিক্রম করে তখন একগুচ্ছ, অপরগুচ্ছকে প্রভাবিত করে না। যদি দুটি গুচ্ছই কণা দিয়ে তৈরি হত, তাহলে তাতে তাদের পরস্পরের সাথে সংঘর্ষ হওয়ার কথা এবং ধাক্কা খেয়ে বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন দিকে চলে যাওয়ার কথা এবং যার ফলশ্রুতিতে সংঘর্ষের পর আলোকগুচ্ছ দুটির ঝাপসা এবং এলোমেলো হয়ে যাওয়ার কথা।
ডাচ পদার্র্থবিদ ক্রিস্টিয়ান হাইগেনস’র (Christiaan Huygens, ১৬২৯-১৬৯৫) একটি ভিন্ন ধরনের প্রস্তাব ছিল। তিনি ভাবলেন, আলো আসলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তরঙ্গ নিয়ে গঠিত। ১৬৭৮ সালে তিনি যুক্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন যে, সরলরেখায় চালিত দুটি রশ্মিগুচ্ছ পরস্পরের মধ্য দিয়ে কোনো রকম প্রভাব ছাড়াই চলে যেতে পারে যদি তারা তরঙ্গ দিয়ে তৈরি হয়। তরঙ্গ হিসেবে কল্পনা করার সমস্যাটি হলো, মানুষ তরঙ্গকে পানির তরঙ্গের মতো করে চিন্তা করে অভ্যস্ত, যেখানে পানিতে ঢিলের পতনে তরঙ্গ উৎপন্ন হয়, তারপরে তা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং যাত্রা পথে কোনো প্রতিবন্ধক যেমন: ভাসমান কাঠ ইত্যাদি থাকলে তা সেগুলোর পাশ কাটিয়ে যেতে পারে এবং পরে আবার মিলে যেতে পারে। আলোর তরঙ্গের ক্ষেত্রেও কী তাদের প্রতিবন্ধকের পাশ কাটিয়ে গিয়ে পরে মিলে যাওয়ার কথা না? সেই ক্ষেত্রে বস্তুর ছায়া তৈরি হওয়ার কথা নয় এবং ছায়া তৈরি হলেও তা হওয়ার কথা অত্যন্ত ঝাপসা। অথচ, এর বদলে আলোর উৎস ছোট হলে আলো কোন বস্তুর তীক্ষè ছায়া উৎপন্ন করে। এই ধরনের তীক্ষè ছায়ার ব্যাখ্যা দেওয়া যায় যদি আপনি আলোর বীমকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণার সমন¡য় ধরে নেন। এটি তরঙ্গ ধারণার বিপরীতে একটি শক্তিশালী যুক্তি।
মজার বিষয় হলো, ইতালীয় পদার্র্থবিদ ফ্রান্সেসকো মারিয়া গ্রিমাল্ডি (Francesco Maria Grimaldi, ১৬১৮-১৬৬৩) দেখতে পেয়েছিলেন যে, আলোক রশ্মিগুচ্ছকে যদি দুটি সরু চিরের (opening) মধ্য দিয়ে চালনা করা যায়, যারা একটির পেছনে আরেকটি স্থাপিত তাহলে রশ্মিœগুচ্ছ প্রশস্ত হয়ে যায় যা থেকে বোঝা যায়, চিরের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় আলোক রশ্মিœ কিছুটা বিচ্যূত হয়েছে। তাঁর এই পর্যবেক্ষণ তাঁর মৃত্যুর দুই বছর পর ১৬৬৫ সালে প্রকাশিত হয় কিন্তু কোন এক কারণে তা অন্যদের মনোযোগ আকর্ষণে ব্যর্থ হয়। (মানুষের অন্য অনেক প্রচেষ্টার মতোই বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার গুলোও অনেক সময় গুরুত্ব না দিতে পারায় কালের গর্ভে হারিয়ে যায়)।
হাইগেনস দেখালেন যে, আলো যদি তরঙ্গ দিয়ে তৈরি হয় তাহলে তাতে বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের তরঙ্গ থাকবে। আলোর যে অংশের তরঙ্গসমূহ বড় হবে সেগুলো সবচেয়ে কম বিচ্যূত হবে। তরঙ্গ ক্ষুদ্র হলে বিচ্যূতিও বেশি হবে। এই তত্ত্বের মাধ্যমে বর্ণালীকে ব্যাখ্যা করা যায়, যেখানে লাল আলোর তরঙ্গ সবচেয়ে বড় এবং তারপরে ক্রমান¡য়ে কমলা, হলুদ, সবুজ এবং নীলের দিকে যেতে যেতে তরঙ্গ ক্ষুদ্র হতে থাকে এবং এভাবে যেতে যেতে বেগুনী আলোর তরঙ্গ সবচেয়ে ছোট।
মোটের উপর হাইগেনস তুলনামূলক ভাবে ভালো যুক্তি দিয়েছিলেন, কিন্তু নিউটনের সুনাম ততোদিনে এতোটাই বেড়ে গিয়েছিল যে (সন্দেহ নেই তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী ছিলেন), তাঁর বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়াটা ছিল যথেষ্টই কঠিন। (যেহেতু বিজ্ঞানীরাও মানব সন্তান, তাই তাঁরা যেমন বড় বড় যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে আলোড়িত হন, তেমনি অনেক সময় ব্যক্তিত্বের প্রাখর্যেও আলোড়িত হন)। অষ্টাদশ শতকের পুরোটা সময়ে অধিকাংশ বিজ্ঞানীই ধরে নিয়েছিলেন যে আলো ছোট ছোট কণিকা দিয়ে গঠিত। এই বিষয়টি বস্তুর পরমাণুবাদের গ্রহণযোগ্যতাও বৃদ্ধি করেছিল এবং বিপরীতভাবে, পরমাণুবাদের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির সাথে সাথে আলোর কণা তত্ত্বও শক্তিশালী হয়েছে।
সে যাই হোক, ১৮০১ সালে ইংরেজ পদার্থবিদ থমাস ইয়ং (Thomas Young, ১৭৭৩-১৮২৯) একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা করলেন। তিনি আলোকে একটি সমতলে কাছাকাছি স্থাপিত দুটি চিরের মধ্য দিয়ে গমণ করতে দিলেন। প্রতিটি চিরের উপর আলো পড়ার পর সেগুলো আলাদাভাবে আলোর উৎস হিসেবে কাজ করল এবং আলো সেই চির থেকে ছড়িয়ে পড়ল, এবং দুই চিরের আলো তাদের সামনে রাখা একটি পর্দার উপর উপরিপাত (overlap) করল।
যদি আলো কণা দিয়ে তৈরি হতো, তাহলে উপরিপাতন স্থানে পাশ¡বর্তী স্থানের চেয়ে কণার পতন হতো বেশি, যার ফলে সেই উপরিপাতন স্থান হতো পাশ¡বর্তী স্থানের চেয়ে উজ্জ্বল কেননা, পাশ¡বর্তী স্থান কেবল একটি চির থেকেই কণা গ্রহণ করছে। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপারটি এমন ছিল না। ইয়ং যা দেখতে পেলেন তা হচ্ছে উপরিপাত স্থানটি ডোরাকাটা; পর্যায়ক্রমে উজ্জ্বল এবং অনুজ্জ্বল ডোরায় বিভক্ত।
কণা ধারণার মাধ্যমে এই ঘটনাকে কোনো ভাবেই ব্যাখ্যা করা গেল না। তবে তরঙ্গ হিসেবে চিন্তা করলে আর কোনো সমস্যাই থাকে না। যদি একটি চির থেকে আগত আলো অপর চির থেকে আগত আলোর একই দশায় থাকে এবং উভয়ে একই সময়ে একই ধাপ অতিক্রম করে তাহলে একটি চিরের তরঙ্গের উত্থান ও পতন অপর চিরের দ্বারা বিবর্ধিত হবে এবং উভয়ের মিলিত স্পন্দন একক স্পন্দনের চেয়ে শক্তিশালী হবে এবং ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধি পাবে।
১৮০১ সালে থমাস ইয়ং কাছাকাছি স্থাপিত দুটি চির বিশিষ্ট একটি পৃষ্ঠে আলো পতিত করেন। প্রতিটি চিরের মধ্য দিয়ে গমনকারী আলো একটি পর্দায় পড়ে এবং উপরিপাতিত হয়; ফলশ্রুতিতে পর্যায়ক্রমে উজ্জ্বল এবং অনুজ্জ্বল আলোর ডোরায় পাওয়া যায়। এই ঘটনাকে তখন আলোর কণা ধারণার মাধ্যমে কোনো ভাবেই ব্যাখ্যা করা যায়নি।
অপরদিকে, যদি একটি চির হতে আগত রশ্মিœ অপর চির হতে আগত রশ্মির চেয়ে ভিন্ন দশায় থাকে একই সময়ে যদি একটি চিরের তরঙ্গ উপরের দিকে থাকে এবং অপর চিরের তরঙ্গ নিচের দিকে থাকে তাহলে দুটি তরঙ্গ একে অপরকে অন্ততঃপক্ষে আংশিকভাবে বাতিল করে দেবে এবং উভয়ের মিলিত অবস্থা তাদের একক তরঙ্গের চেয়ে দুর্বলতর হবে, ফলশ্রুতিতে ঔজ্জ্বল্য কমে যাবে। ইয়ং দেখাতে সক্ষম হলেন যে, তাঁর পরীক্ষাকালীন অবস্থায় দুই গুচ্ছ তরঙ্গ কিছু এলাকায় একই দশায় এবং কিছু এলাকায় ভিন্ন দশায় থাকে এবং পর্যায়ক্রমে তা বদলাতে থাকে। তরঙ্গের ক্ষেত্রেই হুবহু এমন উজ্জ্বল ও অনুজ্জ্বল ডোরা পাওয়া যাওয়ার কথা।
যেহেতু একগুচ্ছ তরঙ্গ অন্যগুচ্ছের তরঙ্গের উপর প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে এবং বাতিল করে দেয় তাদের ডোরাগুলোকে বলা হয় ইন্টারফেরেন্স প্যাটার্ন (interference pattern)। এধরনের ইন্টারফেরেন্স প্যাটার্ন পানির তরঙ্গের ক্ষেত্রেও দেখা যায়। এই ধরনের অবস্থা শব্দ তরঙ্গের ক্ষেত্রেও পরিলক্ষিত হয় যখন দুটি শব্দ তরঙ্গ পরস্পরের সাথে একীভূত হয়। ইয়ং এর পরীক্ষা আলোর ক্ষেত্রেও তরঙ্গের মতো আচরণ উদঘাটন করে। (যদিও, যেমনটা আমরা অনুমান করতে পারছি, এর মানে এই নয় যে যারা কণা ধারণায় বিশ¡াস করে তারা খুব সহজেই নতি স¡ীকার করে নিয়েছে আসলেই তারা তা করেনি)।
এমনকি ইন্টারফেরেন্স ডোরাগুলোর প্রস্থ থেকে আলোর তরঙ্গের দৈর্ঘ্য (তরঙ্গদৈর্ঘ্য) বের করাও সম্ভব হতে পারে; এবং এভাবেই দেখা যায় যে আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য এক সেন্টিমিটারের ২০০০০ ভাগের এক ভাগের (এক ইঞ্চির পঞ্চাশহাজার ভাগের একভাগ) কাছাকাছি। লাল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য এর চেয়ে কিছুটা বেশি আর বেগুনী আলোর কিছুটা কম। এর মানে হচ্ছে, এক সেন্টিমিটার দীর্ঘ একটি আলোক রশ্মি এর দিক বরাবর কম বেশি ২০০০০ ঢেউ নিয়ে গঠিত। এটি দ্বারা আরো বোঝা যায়, প্রায় পঞ্চাশটি পরমাণু আলোর একটি তরঙ্গের দৈর্ঘ্যের মাঝে এঁটে যায়।
এখান থেকেই ব্যাখ্যা পাওয়া যায়, কেন আলো তরঙ্গ দিয়ে তৈরি হওয়া সত্ত্বেও তীক্ষœ ছায়া তৈরি করে। তরঙ্গ প্রতিবন্ধকের চারপাশে বেঁকে যায় কেবল যখন তরঙ্গের চেয়ে প্রতিবন্ধকের আকার খুব বেশি বড় না হয়। একটি তরঙ্গ তার চেয়ে অনেক বড় প্রতিবন্ধকের পাশ দিয়ে খুব বেশি বেঁকে যেতে পারবে না। শব্দ তরঙ্গ অনেক বড় তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাধা অতিক্রম করে যেতে পারে।
আমরা যেসব বস্তু সহজেই দেখতে পাই তাদের তুলনায় আলোক তরঙ্গ অনেক অনেক ছোট, তাই কার্যত আলো সেসব বস্তুর পাশ দিয়ে বেঁকে যায় না এবং এই কারণেই তারা তীক্ষœ ছায়া তৈরি করে। আলো যেহেতু তরঙ্গ তাই বেঁকে যাওয়ার ঘটনা কিছুটা ঘটে, বিশেষ করে যখন কোনো বস্তু যথেষ্ট পরিমাণ ক্ষুদ্র হয় তখন আলো তার পাশ দিয়ে যে পরিমাণ বেঁকে যায় তা সেই বস্তুর জন্য যথেষ্ট বড় বলেই মনে হয় এবং সেই ক্ষেত্রে বস্তুর ছায়ার প্রান্তভাগ কিছুটা ঝাপসা দেখায়। ইয়ং এর পরীক্ষার প্রায় ১৩০ বছর আগে গ্রিমাল্ডি এই বিষয়টিই আবিষ্কার করেছিলেন।
অবশ্য এই বিষয়টির নিষ্পত্তি তাতেও পুরোপুরি হয় নি। ইতিমধ্যে প্রকৃতিতে দুই ধরনের তরঙ্গের কথা মানুষের জানা ছিল। এক প্রকার হচ্ছে পানির তরঙ্গ, যাতে তরঙ্গ চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে, যদিও পানির কণাগুলো উপরে-নিচে উঠানামা করে যা তরঙ্গের দিকের সাথে উলম্ব। একে বলা হয় অনুপ্রস্থ তরঙ্গ। আরেক ধরনের তরঙ্গ আছে শব্দ তরঙ্গ, যেটিও চতুর্দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে কিন্তুএই ক্ষেত্রে বাতাসের অণুগুলো তরঙ্গের দিকের সাথে সমান্তরালে থাকে। এই ধরনের তরঙ্গকে বলা হয় অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ।
আলোর তরঙ্গ এই দুধরনের মধ্যে কোনটি? হাইগেনস যখন প্রথমবার তাঁর তরঙ্গ প্রকল্প ব্যাখ্যা করেছিলেন তখন সম্ভবত ভেবেছিলেন, আলো এবং শব্দ যেহেতু ইন্দ্রীয় অনুভূতি সৃষ্টি করে তাই তাদের প্রকৃতি একই হওয়ার কথা। শব্দ যেহেতু অনুদৈর্র্ঘ্য তরঙ্গ বলে জানা ছিল, তাই তিনি আলোকেও অনুদৈর্র্ঘ্য তরঙ্গ হিসেবে প্রস্তাব করেন। ইয়ং যখন তাঁর আলোর প্রকৃতির পরীক্ষা করে দেখান তখন তিনিও একই রকম ভেবেছেন।
ইতিপূর্বে, ১৬৬৯ সালে ড্যানিশ পন্ডিত ইরাসমাস বার্থোলিন (Erasmus Bartholin, ১৬২৫-১৬৯৮) আইসল্যান্ড হতে একটি স¡চ্ছ ক্রিস্টাল যোগাড় করলেন, যেগুলোকে বর্তমানে আইসল্যান্ড স্পার (Iceland spar) বলা হয়। তিনি লক্ষ্য করলেন, ক্রিস্টালের ভিতর দিয়ে কোনো বস্তুকে দুইবার করে দেখা যাচ্ছে। তিনি ধারণা করলেন, ক্রিস্টালের ভিতর দিয়ে আলো অতিক্রমের সময় দুটি ভিন্ন ভিন্ন কোণে প্রতিসরিত হচ্ছে। যে কারণে আলোর কিছু অংশ এক দিকে এবং অপর অংশ কিছুটা ভিন্ন দিকে পৌঁছাচ্ছে, যার ফলে বস্তুর দুটি প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে।
বার্থোলিন ব্যাখ্যা করতে পারেননি কেন এমনটি ঘটেছে, যেমন পারেননি নিউটন কিংবা হাইগেনস। একদিক থেকে এই ঘটনাটিকে ব্যাখ্যার অতীত বলে মনে হলো। (জ্ঞানের একটি নির্দিষ্ট স্তরে সবকিছু ব্যাখ্যা করা যায় না। তাই যৌক্তিক আচরণ হচ্ছে যেটুকু পারা যায় সেটুকুই ব্যাখ্যা করা এবং আশায় থাকা যে, একদিন জ্ঞান যখন আরো অগ্রবর্তী হবে, যখন সময় আসবে, তখন আপাত ব্যাখ্যার অতীত বিষয়গুলোও ব্যাখ্যা করা হবে)।
১৮১৭ সালে ইয়ং উপলব্ধি করলেন যে, বার্থোলিনের দ্বৈত প্রতিসরণকে সহজে ব্যাখ্যা করা যাবে না যদি আলো কণা বা অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ দিয়ে গঠিত হয়। কিন্তু আলো যদি অনুপ্রস্থ তরঙ্গ দিয়ে তৈরি হয়ে থাকে তাহলে এই ঘটনা খুব সহজে ব্যাখ্যা করা যায়।
ফরাসী পদার্র্থবিদ অগাস্তে জ্যাঁ ফ্রেনেল (Augustin Jean Fresnel, ১৭৮৮-১৮২৭) ইয়ং এর এই দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করলেন এবং অনুপ্রস্থ তরঙ্গ সম্পর্কে যতেœর সাথে তাত্ত্বিক চর্চা শুরু করলেন যা আলোর আচরণ সংক্রান্ত তৎকালীন সময়ে প্রাপ্ত সবকিছুকে ব্যাখ্যা করে দিলো। মীমাংসা হয়ে গেল! পরবর্তী আশিটি বছর পদার্র্থবিদরা আলোকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনুপ্রস্থ তরঙ্গ ধরে নিয়ে সন্তুষ্ট থাকলেন এবং এটিই ছিল তাঁদের কাছে স¡য়ংসম্পূর্ণ উত্তর।
[বইয়ের সূচীপত্র তথা প্রকাশিত সবগুলো আর্টিকেলের জন্য এখানে দেখুন। বিজ্ঞান পত্রিকায় সম্পূর্ণ বইটিই পড়া যাবে, তবে মুদ্রিত সংস্করণটি সংগ্রহ করতে চাইলে যোগাযোগ করুন: ছায়াবিথী প্রকাশনী, ফোন: ০১৭২৩৮০৭৫৩৯, এছাড়া অর্ডার দেওয়া যাবে অনলাইন বইয়ের দোকানগুলোতে।]
-ইমতিয়াজ আহমেদ
-ইমতিয়াজ আহমেদ
সম্পাদক, বিজ্ঞান পত্রিকা
[ফেসবুক প্রোফাইল]