ক্যান্সার চিকিৎসায় অগ্রগতি: বেছে বেছে ক্যান্সারাক্রান্ত কোষ ধ্বংস করবে আলট্রাসাউন্ড

0
426

ক্যান্সারের চিকিৎসায় আলট্রাসাউন্ড ওয়েভ বা অতিসূক্ষ্ম শব্দ তরঙ্গ ব্যবহার হয়ে আসছে আগে থেকেই। তবে এই পদ্ধতির মাধ্যমে প্রয়োগকৃত সূক্ষ্ম শব্দ তরঙ্গ ক্যান্সার আক্রান্ত কোষের সাথে সাথে সুস্থ কোষদেরও ধ্বংস করে ফেলে। এর ফলে রোগীর শরীরে বিভিন্ন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। এর বিকল্প পন্থা হিসেবে বিজ্ঞানী এবং প্রকৌশলীরা চেষ্টা করে যাচ্ছেন কিভাবে আরো নির্দিষ্ট করে এই শব্দ তরঙ্গ প্রয়োগ করা যায়। এমনই এক বিকল্প পদ্ধতির একটি হচ্ছে Low-Intensity Pulsed Ultrasound (LIPUS) যার মাধ্যমে পূর্বের চেয়েও আরও নির্দিষ্ট ভাবে ক্যান্সার আক্রান্ত কোষ ধ্বংস করা সম্ভব হবে।

LIPUS এর মাধ্যমে সুস্থ্য কোষের কোন ক্ষতি সাধন না করেই ক্যান্সার আক্রান্ত কোষ ধ্বংস করা সম্ভব হয়েছে। ৭ জানুয়ারি এপ্লাইড ফিজিক্স লেটারস –এ প্রকাশিত এক মডেলে এই নতুন কৌশলের কার্যকরিতার বিষয়টি বর্ণনা করা হয়।

তবে গবেষকগণ বলেছেন এটি শুধুমাত্র জীবিত প্রাণীদেহের উপরেই প্রয়োগ করা সম্ভব হয়েছে, মানুষের ক্ষেত্রে প্রয়োগের জন্য আমাদের আরো অপেক্ষার প্রয়োজন। কিন্তু এই পদ্ধতি প্রয়োগের ফলাফল খুবই আশাব্যঞ্জক।

পাঁচ বছর আগে শুরু হওয়া এই গবেষণায় ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলোজি (Caltech)-র মাইকেল অরটিজ, ফ্রাংক এবং এরোনোটিক্স এন্ড মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর অধ্যাপক ওরা লি মারবেল ক্যান্সার আক্রান্ত কোষ এবং স্বাস্থ্যকর কোষের আকার, কোষ প্রাচীরের পুরুত্ব এবং এদের শারীরিক পার্থক্য দেখে নিজেদের মধ্যে চিন্তা ভাবনা শুরু করেন যখন শব্দ তরঙ্গগুলি দুটি ভিন্ন কোষকে ভিন্নভাবে প্রভাবিত করে এবং শব্দতরঙ্গে শুধুমাত্র ক্যান্সার কোষই মারা যায়। এদিকে অরটিজ এই বিষয়টির একটি গাণিতিক মডেলেও তৈরী করেছেন; শব্দ তরঙ্গের কম্পন ভিন্নতায় কোষ গুলো কিভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায় তা দেখার জন্য।

২০১৬ সালে অরটিজ এবং গ্রাজুয়েট ছাত্র স্টেফনি হেইডেন মিলিত ভাবে জার্নাল অফ দ্যা মেকানিক্স এন্ড ফিজিক্স অফ সলিড-এ একটি গবেষণা পত্র প্রকাশ করেন যেখানে দেখানো হয় যে, ক্যান্সার কোষ এবং স্বাস্থ্যকর কোষের দৈহিক বৃদ্ধির হারের মাঝে পার্থক্য রয়েছে। তাত্ত্বিকভাবে এই পার্থ্যক্যটির অর্থ হচ্ছে একটি সতর্কতার সাথে প্রয়োগকৃত শব্দ তরঙ্গ ক্যান্সার আক্রান্ত কোষের ঝিল্লীকে এমন এক বিন্দুতে স্পন্দিত করে যার ফলে স্বাস্থ্যকর কোষের কোন ক্ষতিই করেনা। অরটিজ এই প্রক্রিয়াকে “অনকোট্রিপসি” নাম দিয়েছেন যা গ্রীক শব্দ অ্যানকোস (টিউমারের জন্য) এবং ট্রিপসি (ভাংগার জন্য) থেকে নেয়া হয়েছে।

এসব ফলাফলের উপর ভিত্তি করে অরটিজ গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার জন্য Caltech’s Rothenberg Innovation Initiative (RI2) এর  মাধ্যমে নতুন করে অর্থায়নের আবেদন করেন এবং তহবিল সংগ্রহ করেন।

প্রকল্পটি পরিচালনার জন্য Caltech’s এর কেমিক্যাল ইঞ্জিরিয়ারিং এর অধ্যাপক ও আলট্রাসাউন্ড বিশেষজ্ঞ মিখাইল শ্যাপিরোকে নিয়োগ দেয়া হয়। সম্প্রতি শ্যাপিরো একটি পদ্ধতির উন্নতি সাধন করেছেন যা আলট্রাসাউন্ডকে শরীরে জীনের অভিব্যাক্তি প্রকাশে সাহায্য করে এবং সেইসাথে একপ্রকার ব্যাকটেরিয়ার নকশাও তৈরী করেছেন যাতে আল্ট্রাসাউন্ডের মাধ্যমে প্রেরিত শব্দ তরঙ্গ প্রতিফলিত হয়ে সমগ্র শরীরে এদের উপর নজরদারি করা যায়। শ্যাপিরো গবেষণাগারে হেপাটোসেলুলার কার্সিনোমা নামে পরিচিত একটি ক্যান্সারের উপর বিভিন্ন মাত্রার শব্দতরঙ্গ প্রয়োগ করছেন এবং এর ফলাফল পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছেন।

একজন চিকিৎসক ও বিজ্ঞানী হিসেবে ওরা লি রোগীদের নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি দিতে বেশ আগ্রাহী। লি জানান, “আমি যখনি এ সম্পর্কে জানতে পেরেছি, আমি ভেবেছিলাম এটা খুবই আশাব্যাঞ্জক। যদি এই পদ্ধতি কার্যকর হয় তবে ক্যান্সারের চিকিৎসায় একটি যুগান্তকারী পন্থা হতে পারে।“ অন্যান্য শহরের গবেষকগণও এই প্রকল্পটিতে তাঁদের সমর্থন প্রদান করেছেন।

লি আরও বলেন, আমরা আশাবাদী যে, আল্ট্রাসাউন্ড একটি নির্দিষ্ট উপায়ে ক্যান্সার কোষকে মেরে ফেলবে যেখানে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও জড়িত থাকবে এবং চিকিৎসার পরে অবশিষ্ট কোন ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করতে সহায়তা করবে। প্রতিটি ক্যান্সার কোষকে মেরে ফেলতে পারে এমন জায়গায় আল্ট্রাসাউন্ড স্থাপন করা অনেকটাই অসম্ভব। যার ফলে এদের মাঝে কিছু বেঁচে যাওয়া কোষ থাকবে যা পুনরায় টিউমার তৈরীতে সহায়তা করবে।

আমাদের দেহে প্রতিদিন ৫ কোটিরও বেশি কোষ মারা যায়, আর এই মৃত্যুর বেশিরভাগই ঘটে যখন কোষগুলো বৃদ্ধ হয়ে যায়। এপোপটোসিস নামক এক প্রকার প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে এরা মারা যায়। সংক্রমণ ঘটলে বা আঘাতের কারণে সময়ের আগেই কোষ মারা যেতে পারে। একটি স্বাস্থ্যকর রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা  এপোপটোসিস এবং আঘাতের পার্থক্য বলে দিতে পারে।

যদি আল্ট্রাসাউন্ডকে এমনভাবে কোষের মৃত্যুর কারণ হিসাবে ব্যবহার করা যায় যাতে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাটি এপোপটোসিসের পরিবর্তে আঘাত হিসাবে স্বীকৃতি দেয় তবে এটি শ্বেত রক্ত কোষকে টিউমার বৃদ্ধি পাওয়া অঞ্চলে বয়ে নিয়ে যেতে পারে যা ক্যান্সারের অবশিষ্ট কোষগুলোকে আক্রান্ত করতে পারে। এখন পর্যন্ত সকল পরীক্ষাই গবেষণাগারে উৎপাদিত কোষের উপর প্রয়োগ করা হয়েছে। তবে Caltech–City of Hope গবেষক দলটি এবার টিউমারের উপর পরীক্ষা চালানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে এটা জীবন্ত প্রাণীর উপর প্রয়োগ করা হবে। [phys.com অবলম্বনে]

-শফিকুল ইসলাম

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.