ঘনিয়ে আসছে আলোর দূষণের বিপর্যয়

0
1709

হরেক রকমের দূষণের সঙ্গেই তো আমরা পরিচিত। আলোর দূষণের সঙ্গে পরিচিত কি? হয়তো ভাবছেন আলো কি সত্যিই দূষণ ছড়াতে পারে? আসুন আলোর দূষণের সঙ্গে পরিচিত হওয়া যাক।

আলোর দূষণ সম্পর্কে জানার জন্য প্রথমেই আমাদের উপলব্ধি করতে হবে বর্তমানে আমরা যে আলো ব্যবহার করি তা প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক নয়। সভ্যতার শুরুতে আমাদের কৃত্রিম আলো প্রজ্জ্বলনের সুযোগ ছিল না। প্রতিদিন খুব ভোরে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে পরিবেশ আলোকময় হয়ে উঠত আর সন্ধ্যে নাগাদ সেই আলো নিভে গিয়ে রাত্রিভাগ অন্ধকারে পর্যবসিত হতো। তবে সবদিন নিশ্চয়ই সমানভাবে যেত না। প্রবল বর্ষনে আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গিয়ে কখনো কখনো দিবাভাগে অন্ধকার নেমে আসত আর রাতের বেলায় চাঁদের ক্ষীণ আলোয় আঁধার কিছুটা ঘুচে যেত। গ্রীষ্মকালে সূর্য দীর্ঘ সময় আলো দিত আর শীতকালে অন্ধকারের পালা দীর্ঘ হতো। এর বাইরে আর ব্যাতিক্রম কিছু ছিলো না। কিন্তু সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে আমরা কৃত্রিম আলো জ্বালাতে শুরু করে দিলাম। সময়ের সাথে সাথে এই আলোর পরিমান বেড়েই চলছে। একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার করা যাক। নিচে ১৯৫০ এর দশক হতে  কৃত্রিম উপগ্রহ হতে তোলা আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের রাত্রিকালীন মানচিত্র দেখানো হলো।

২০২৫ সাল এখনো না এলেও সেই সময় নাগাদ আলোর পরিমান কী দশায় পৌঁছাবে তার একটি অনুমান করা যাচ্ছে শেষ মানচিত্রটি হতে।

১৯৫০ এর দশকের তুলনায় ১৯৯৭ সালে আলোক সম্পাতের পরিমাণ কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে যা  ২০২৫ সাল নাগাদ আরো উল্ল্যেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাবে। এই আলো নিশ্চয়ই প্রাকৃতিক নয় এবং তাই পৃথিবীর উপর এর নানাবিধ প্রভাব পড়াটাও অস্বাভাবিক নয়। গবেষকগণ ইতিমধ্যে এই আলো-আধিক্য নিয়ে গবেষণা শুরু করেছেন এবং তাঁরা দেখেছেন অতিরিক্ত আলোক সম্পাতে মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য, পরিবেশ, জ্যোতিঃগবেষণা এবং আরো বেশ কিছু বৈশ্বিক সংকট দেখা দিয়েছে। আলোর মাত্রাতিরিক্ত প্রয়োগের এই বিষয়টিকে নাম দেওয়া হয়েছে আলোর দূষণ।

গবেষকগণ আলোক দূষণের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য লিপিবদ্ধ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে,

১. কৃত্রিম আলোকে আলোকনির্ভর জীবকুলের বাসস্থান ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া,

২. উন্মুক্ত পরিবেশে প্রাকৃতিক আলোর স্বাভাবিক মাত্রা ব্যহত হওয়া,

৩. গৃহাভ্যন্তরে অতিরিক্ত আলোর ব্যবহার, যা মানুষের স্বাস্থ্যের উপর ক্ষতিকর প্রভাব তৈরি করছে,

৪. প্রত্যক্ষ্য ও পরোক্ষভাবে মানুষকর্তৃক পরিবেশে কৃত্রিম আলোর প্রভাব তৈরি করা।

আলোকদূষণের সাথে শিল্পায়নের সম্পর্ক রয়েছে। আলোর দূষণ সম্পূর্ণরূপে মানব সৃষ্ট এবং আলোর দূষণ সেখানেই ঘটে যেখানে লোকালয় রয়েছে। এর কারণে এটি একটি উদ্বেগের বিষয়। এটি বিদ্যুৎশক্তির অপচয়ের অন্যতম উৎস। এই বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদনের সাথেও পরিবেশদূষণের বিষয়টি জড়িতে কেননা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে নানাভাবে পরিবেশ দূষণ করে চলেছে। বর্তমান প্রতিযোগীতার বাজারে বিজ্ঞাপন নির্মানে,  আলোক সজ্জায়, বিপনী বিতানে মনোযোগ আকর্ষণে, খেলার মাঠে, অফিস ও কলকারখানায় চোখ ধাঁধাঁনো আলোর ব্যবহার করা হচ্ছে যা একটু সচেতন হলে বেশ খানিকটা কমিয়ে আনা সম্ভব। অতিউজ্জ্বলতার ব্যবহারে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য শুধু আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিদিন প্রায় চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ লক্ষ ব্যারেল জ্বালানী তেল অতিরিক্ত পোড়ানো হচ্ছে। বিদ্যুৎসাশ্রয়ী বাতির উন্নতি ঘটায় এবং নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে রাস্তা-ঘাটেও আগের চেয়ে অনেক তীব্র আলোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

আরো উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, আলোর দূষণের বিষয় নিয়ে আমাদের মধ্যে কোনো ধরনের সচেতনতা নেই। এটি যে একপ্রকার দূষণ সেটি আমার কেবল কিছুদিন হলো উপলব্ধি করতে শুরু করেছি। কোনো ভবনে বা অন্যত্র আলোর নকশা প্রণয়নের সময় প্রায় কখনোই দৃষ্টি বিজ্ঞানের বিষয়টি আমলে নেওয়া হয় না। শুধু প্রয়োজনের সময়ই যাতে আলো জ্বলে তার জন্য কোনো সেন্সর বা টাইমারের ব্যবস্থা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নেই। আলোর বাল্ব বাছাইয়েও দেখা দেয় অসতর্কতা, ফলে যেখানে আলোর প্রক্ষেপণ করা প্রয়োজন তার চেয়ে অনেক বেশী জায়গা জুড়ে আলোর বিস্তার ঘটে। আর যে পরিমান আলো ছড়ানো হয় তার একটি বড় অংশ সরাসরি আকাশে বিলীন হয় যা কোনো কাজেই আসে না।

আলোর দূষণ এবং এর কারণ নিয়ে অনেক কিছুই বলা হলো। এবার এর প্রভাবগুলো দেখা যাক।

প্রথমেই আসে পরিবেশের উপর প্রভাব। আন্তর্জাতিক আঁধার আকাশ এসোসিয়েশন (Internation Dark-Sky Association, IDA) এর অনুমিত মাত্রা অনুযায়ী অতিরিক্ত ও অপ্রয়োজনীয় আলোক সম্পাতের কারণে প্রতিবছর অতিরিক্ত ১.২ কোটি টন কার্বন ডাইঅক্সাইড বাতাসে উন্মুক্ত হয় যা বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য অন্যতম দায়ী। এই পরিমান কার্বন ডাই অক্সাইড প্রশমিত করতে ৭০ কোটি গাছের প্রয়োজন। এটা আলোক দূষণের পরোক্ষ প্রভাব। কিন্তু প্রত্যক্ষভাবেও আলোর দূষণে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে।  National Oceanic and Atmospheric Association এর তথ্য অনুযায়ী আলোর দূষণ রাতের বেলায় বায়ুমন্ডলে নাইট্রেট মূলক তৈরিকরণ বাধাগ্রস্ত করে। নাইট্রেট মূলক গাড়ির ও কলকারখানার ক্ষতিকর নিঃসরণের প্রভাব হ্রাসে সহায়তা করে। এই প্রক্রিয়াটি স্মোগ (smog) তৈরি হওয়া, ওজোন দূষণ এবং আরো বিভিন্ন ক্ষতিকর কণার প্রভাব প্রশমিত করে। এই প্রক্রিয়াটি কেবল রাতেই ঘটে, কেননা দিনের বেলায় সূর্যের আলোয় নাইট্রেট ভেঙ্গে যায়। কিন্তু আলোর দূষণের কারণে রাতের বেলাতেও নাইট্রেট ভেঙ্গে গিয়ে এই প্রাকৃতিক বায়ুশোধন প্রক্রিয়াটিকে ক্ষতিগ্রস্থ করছে।

রাত্রিকালীন অতিউজ্জ্বলতা যাবতীয় বন্যপ্রানীর খাদ্যাভ্যাস, ঘুম, প্রজনন এবং পরিব্রাজন চক্রে ক্ষতিকর প্রভাব তৈরি করছে। অতিরিক্ত কৃত্রিম আলোর উপস্থিতিতে বন্যপ্রানীর সময় অনুধাবনেও সমস্যা হচ্ছে যা তাদের দৈনন্দিন রুটিন ব্যহত করছে। বাদুড়, রেকুন, কয়ট, হরিন প্রভৃতি স্তন্যপায়ী প্রানীর রাত্রিকালীন খাদ্য আহরন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের প্রজনন হ্রাস পেয়েছে এবং রাত্রিকালীন দৃষ্টিশক্তি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। নিশাচর পাখিগুলোও একই সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। পরিযায়ী পাখিগুলো আলোয় বিভ্রান্ত হয়ে পথ হারিয়ে ফেলছে এবং কখনো কখনো ডুবে মরছে এবং অন্যান্য প্রানীর শিকারে পরিণত হচ্ছে। প্রতিবছর উত্তর আমেরিকায় প্রায় ১০ কোটি পাখি আলোকিত ভবন বা টাওয়ারে ধাক্কা খেয়ে মৃত্যুবরণ করে। উভচর, সরীসৃপ এবং পতঙ্গের উপরও আলোর দূষণের একই রকম নানাবিধ ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে।

জ্যোতির্বিদ্যায় আলোক দূষণের প্রভাব সরাসরি ও তীব্র। সম্ভবতঃ অন্য যেকোনো মানবগোষ্ঠীর চেয়ে জ্যোতির্বিদগণই আলোক দূষণের সবচেয়ে বড় শিকার। আলোর দূষণের কারণ রাত্রিকালীন আকাশের স্বাভাবিক দৃশ্যপট বদলে যায় এবং দূরবর্তী অতিক্ষীণ বস্তুগুলোকে সনাক্ত করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। জ্যোতির্বিদ্যার উপর আলোকদূষণের প্রভাব বুঝতে নিচের ছবিটি দেখা যেতে পারে।

উপরের ছবিদুটো ২০০৩ সালের একটি বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের আগের ও পরের ছবি। প্রথম ছবিটিতে কোনো তারাই দেখা যাচ্ছে না, অথচ দ্বিতীয় ছবিটিতে ছায়াপথ খুবই স্পষ্ট। আমরা যারা শহরে থাকি তারা জানি আজকাল আর রাতের আকাশে উজ্জ্ল দু’একটি বস্তু ছাড়া আন্য কোনো তারা দেখা যায় না। রাতের আকাশে তারা দেখা আমাদের জন্য মানসিক প্রশান্তির এবং এটি মানসিক চাপ কমাতেও সাহায্য করে। শারীরিক স্বাস্থ্যেও আলোক দূষণের প্রভাব রয়েছে। মানুষের দেহ ও মন দিবা-রাত্রির একটি চক্র অনুযায়ী নিয়ন্ত্রিত হয়। একে সার্কাডিয়ান ক্লক বলা হয়। নানাবিধ শারীরবৃত্তীয় কাজ যেমন, মস্তিষ্কের কর্মকান্ড, হরমোন নিঃসরণ, ঘুম-চক্র প্রভৃতি আলোর উপস্থিতি ও অনুপস্থিতির সাথে সাথে আবর্তিত হয়। বর্তমানে রাত্রিকালীন উজ্জ্বল আলো এই চক্রে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। এর ফলে ঘুমের ভারসাম্যহীনতা, উদ্বেগ, বিষণ্ণতা, ডায়বেটিস, ক্যান্সার (বিশেষত স্তন এবং প্রোস্টেট ক্যান্সার), হৃদরোগ, স্থুলতা প্রভৃতি স্বাস্থ্যসমস্যা প্রবলভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তীব্র উজ্জ্বল আলো দৃষ্টিশক্তির উপর প্রভাব তৈরি করছে।

আলোর দূষণের প্রভার বহুমাত্রার। এখানে একটি সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেয়া হলো কেবল। বায়ু দূষণ, শব্দদূষণ, পানি দূষণ প্রভৃতির মতো আলোর দূষণ ও প্রতিরোধ করা জরুরি। আলোর দূষণ প্রতিরোধের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে নানাবিধ সংগঠন গড়ে উঠেছে। এই আন্দোলন সংগঠনগুলো সারা পৃথিবীতে আলোর দূষণের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরির চেষ্টা করছে। আমাদের দেশেও আলোক দূষণের বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলা প্রয়োজন।

তথ্যসূত্র
১. https://en.wikipedia.org/wiki/Light_pollution
২. https://www.darksky.org/light-pollution/
৩. http://www.darkskiesawareness.org/faq-what-is-lp.php

-ইমতিয়াজ আহমেদ
সম্পাদক, বিজ্ঞান পত্রিকা
[লেখকের ফেসবুক প্রোফাইল]

বিজ্ঞান পত্রিকা প্রকাশিত ভিডিওগুলো দেখতে পাবেন ইউটিউবে। লিংক:
১. টেলিভিশনঃ তখন ও এখন
২. স্পেস এক্সের মঙ্গলে মানব বসতি স্থাপনের পরিকল্পনা
3. মাইক্রোস্কোপের নিচের দুনিয়া

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.