কোয়ান্টাম মেকানিক্সের নিয়মগুলোকে শুধু অদ্ভুত বললে আসলে কমই বলা হয়ে যায়। এই নিয়মগুলো রীতিমতো ভুতুড়ে। কিন্তু তাই বলে ভাববেন না যেন, কোয়ান্টাম মেকানিক্সের এই অদ্ভুত নিয়মের বুঝি কোন সীমা আছে। আসলে কোয়ান্টাম মেকানিক্স নিয়ে বিজ্ঞানীরা যত গভীরে প্রবেশ করছেন, ততই বেশি অদ্ভুত বিষয় লক্ষ্য করছেন। সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা পদার্থের সম্পূর্ণ নতুন একটি অবস্থা আবিস্কার করেছেন, যার সাথে আমাদের চেনাজানা কোন কিছুরই মিল নেই। তবে পদার্থের এই নতুন অবস্থা এতটাই অদ্ভুত যে দু-এক জনের চোখ কপালেও উঠে যেতে পারে!
পদার্থের এই বিশেষ অবস্থাটির নাম, “কোয়ান্টাম স্পিন লিকুইড”। নাম শুনে মনে হতে পারে এটি বুঝি কোন এক ধরনের তরল। কিন্তু নাম লিকুইড হলেও এটি আসলে আমাদের চেনা জানা কোন বস্তু না। পদার্থ এই বিশেষ অবস্থাটি বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি আবিস্কার করলেও, পদার্থ যে এমন অবস্থায় থাকতে পারে সেটা কিন্তু আজ থেকে প্রায় ৪০ বছর আগেই ভবিষ্যৎবানী করা হয়েছিল। এই গবেষণার ফলাফল, Nature Materials জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণাপত্রটির একজন সহলেখক, ক্যামব্রিজ ক্যাভেন্ডিস ল্যাবোরেটরির বিজ্ঞানী ড. জোহানেস নোলে জানিয়েছেন, “ এটি পদার্থের নতুন একটি কোয়ান্টাম অবস্থা, যা আগে ভবিষ্যৎবানী করা হলেও বাস্তব পরীক্ষাতে ইতিপুর্বে দেখা যায়নি।”
মৌলিক কনিকার পদার্থবিজ্ঞানে ইলেকট্রনকে সাধারনত অবিভাজ্য মৌলিক কনিকা হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু কোয়ান্টাম মেকানিক্সে একটি কনা বা একটি তরঙ্গকে সম্পুর্ন গানিতিকভাবেও ব্যাখ্যা করা যায়। গানিতিকভাবে ব্যাখ্যা করালে ইলেকট্রনকে দুটি “কোয়াসি পার্টিক্যাল” দিয়ে তৈরি একটি কনা হিসেবেও ব্যাখ্যা করা যায়। এই কোয়াসি পার্টিক্যাল দুটি হল- চার্জ ও স্পিন। কি শুনতে অদ্ভুত শোনাচ্ছে ? আসলে গতানুগতিক পদার্থবিজ্ঞানে কনিকা বলতে যা বোঝানো হয় কোয়ান্টাম মেকানিক্স তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। সে যাই হোক, এখন জানা দরকার এই “কোয়াসি পার্টিক্যাল” বলতে আসলে কি বোঝায় ? কোয়াসি পার্টিক্যালকে বাংলায় “আপাত কনিকা” বলা যেতে পারে। এসব কনিকাদের আপাত বলার কারন হলো, এরা কনিকার মত আচরন করলেও সব ক্ষেত্রে বাস্তব কনিকার মত আচরন করতে পারে না। একটি উদাহরন দিলেই বিষয়টি আরও ভালমত বোঝা যাবে। যেমন- ইলেকট্রনের মত বাস্তব কনিকারা স্থানের(স্পেস) মধ্যে মুক্তভাবে চলাচল করতে পারে , কিন্তু এই আপাত কনিকারা তা পারে না। এরা শুধুমাত্র একত্র অবস্থান করতে পারে। ইলেকট্রনের ক্ষেত্রে যেমন “স্পিন” ও “চার্জ” একত্রে “ইলেকট্রন” গঠন করে আছে, তেমনি।
সাধারন অবস্থায় কোয়াসি পার্টিক্যালগুলো মুক্তভাবে চলাচল করতে না পারলেও , “কোয়ান্টাম স্পিন লিকুইড” –এর ক্ষেত্রে বিষয়টি সম্পুর্ন আলাদা। এক্ষেত্রে ইলেকট্রনের, “স্পিন কোয়াসি পার্টিক্যাল” এবং “চার্জ কোয়াসি পার্টিক্যাল” মুক্তভাবে চলাচল করতে পারে। ফলে ইলেকট্রন ভেঙ্গে যায়। অর্থাৎ স্পিনগুলো একটি আরেকটির থেকে আলাদাভাবে ঘোরাফেরা করতে পারে। একটি তরলের মধ্যে পানির অণুগুলো যেমন মুক্তভাবে চলাচল করতে পারে, এক্ষেত্রে স্পিনগুলোর এই মুক্ত গতিকেও তরলের অনুর সাথে তুলনা করা যায়। আর একারনেই পদার্থের এই অবস্থার নামকরন করা হয়েছে, “ কোয়ান্টাম স্পিন লিকুইড”।
এই মুক্ত স্পিনগুলো এক্ষেত্রে বাস্তব কনিকার মতই আচরন করছে। ফলে একটি বাস্তব কনিকার মত তারও একটি এন্টিপার্টিক্যাল থাকার কথা। কিন্তু এগুলো আসলে, “মেজোরানা ফার্মিওন” কনিকার মত আচরন করে। আর আমরা জানি যে শুধুমাত্র ডিরাক ফার্মিওনেরই এ্যান্টি-পার্টিক্যাল থাকে। মেজোরানা ফার্মিওনের এন্টি-পার্টিক্যাল এরা নিজেরাই। ফলে এদের কোন এ্যান্টি-পার্টিক্যাল নেই।
গবেষণাপত্রটির একজন সহলেখক ড. দিমিত্রি কোভরিজহিন বলেছেন, এই পরীক্ষণটি বাস্তবে করে দেখার আগের সময়গুলোতে আমরা এটাও জানতাম না যে, কোয়ান্টাম স্পিন লিকুইডের প্রমানের জন্য যদি কোন পরীক্ষা করা হয় তার আলামতগুলো দেখতে কেমন হবে! তিনি আরও জানিয়েছেন- কোয়ান্টাম স্পিন লিকুইডের মত পদার্থের কোন অবস্থা যদি থেকে থাকে, তবে তা দেখতে কেমন হবে তা জানার জন্য এই পরীক্ষাটি করার আগে তারা কিছু গবেষণাও করেছিলেন। ফলে বোঝাই যাচ্ছে বিষয়টি বিজ্ঞানীদের কাছেও সম্পূর্ণ নতুন।
কোয়ান্টাম স্পিন লিকুইড নিজেই একটি উত্তেজনাকর আগ্রহের বিষয়। তবে তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, কোয়ান্টাম স্পিন লিকুইড সম্পর্কে ভালমতো জানা গেলে কক্ষতাপমাত্রার সুপারকন্ডাক্টর ও কোয়ান্টাম কম্পিউটারের ক্ষেত্রে কাজে লাগানো যাবে। যদি সঠিকভাবে এই দুটি প্রযুক্তি ব্যাবহার করা যায় তবে প্রযুক্তিক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। বদলে যাবে জীবনযাপনের সংজ্ঞা।
⚫ হিমাংশু কর