যে সেপ্টেম্বরে দিন ছিলো ১৯ টি

0
1170

প্রায় সাড়ে ছয় লাখ ব্রিটিশ নাগরিক ১৭৫২ সালের ২ সেপ্টেম্বরের রাতে ঘুমাতে গেলেন আর ঘুম থেকে উঠে দেখলেন সেপ্টেম্বরের ১৪ তারিখ! এমনটি ঘটল কেমন করে? আজ তা নিয়েই আলোচনা থাকবে।

আরো অনেককাল আগে, ১৫৮২ সালে পোপ ছিলেন ত্রয়োদশ গ্রেগরি।  ক্যাথলিক গীর্জায় ১০ বছর ধরে তিনি নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। এই অবস্থায় ইস্টারের তারিখ নিয়ে তিনি সমস্যায় পড়লেন। সেই সময় দীর্ঘদিন পূর্বের জুলিয়াস সিজার প্রনীত জুলিয়ান ক্যালেন্ডার প্রচলিত ছিলো এবং এটি তখন সারা দুনিয়ায় সর্ববহুল প্রচলিত। এই ক্যালেন্ডারে একেকটি বছরের দৈর্ঘ্য ছিলো ৩৬৫ দিন ৬ ঘন্টা।

বছরের এই মাত্রা মোটামুটি যথাযথ হলেও মোটামুটি শব্দটি নিয়ে কিঞ্চিৎ ঝামেলা হলো। এই শব্দটি তুলে দিতে হলে একেকটি বছরের গড় দৈর্ঘ্য হতে হয় ৩৬৫ দিন ৫ ঘন্টা ৪৯ মিনিট। অতিরিক্ত যে ১১ মিনিট হিসেব করা হচ্ছে তা দুই-এক বছরের জন্য সামান্য হলেও ক্যালেন্ডার প্রণয়নের সময় হতে ১৩০০ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর জমে গিয়ে কয়েক দিনে পরিণত হলো। তাই ১৫৮২-র ফেব্রুয়ারির ২৪ তারিখে পোপ এক ডিক্রি জারি করলেন। তিনি ঘোষনা করলেন তাঁর অধীনে যত গীর্জা আছে সেসবের অনুসারীদের ক্যালেন্ডার হতে বেশ কিছু দিন বাদ দিয়ে দিতে হবে। ভবিষ্যতে যেন এই সমস্যা তৈরি না হয় সেই জন্য এতে আরো কিছু সংশোধনী যোগ করা হলো। স্পেন, ইতালির বৃহদাংশ, নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স, পর্তুগাল, লুক্সেমবার্গ, পোল্যান্ড এর সবাই গ্রেগরির এই সংশোধিত ক্যালেন্ডার গ্রহণ করলেন। পরিমার্জিত এই ক্যালেন্ডারের নাম হলো গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার।

পরবর্তী ৫০ বছরে অস্ট্রেলিয়া, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, হাঙ্গেরি এবং প্রসিয়া একে একে এই ক্যালেন্ডারের ছায়াতলে চলে এলো। ফলে ইউরোপের অধিকাংশ স্থানেই এই ক্যালেন্ডারের প্রচলন ঘটে গেল।

তবে ব্রিটেনে ঘটে নি। ব্রিটেনের সাম্রাজ্য অনেক বিশাল, এখানে সুর্যাস্ত যায় না। অহমিকায় এটি ক্যাথোলিকদের প্রণীত একটি ক্যালেন্ডার গ্রহণ করে নিতে খুব স্বস্তি বোধ করলো না। তবে ব্রিটেনের নাগরিকদের মধ্যে বিভাজন ছিলো। অনেকেই ক্যাথোলিক গীর্জার অধীনস্ত ছিলেন। ফলে দেখা গেল নাগরিকবৃন্দ একই দিনের জন্য দুটি ভিন্ন তারিখ ব্যবহার করছেন আর তাতে বাঁধছে গোলমাল। তাছাড়া অন্যান্য দেশের সাথে ব্যাবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও নানাবিধ অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে।

শেষমেষ ব্রিটেন হাল ছেড়ে দিয়ে ১৭৫০ সালে নতুন আইনের মাধ্যমে ক্যালেন্ডার সংস্কারের উদ্যোগ নিলো। এই পরিকল্পনায় ব্রিটেন গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে রীতি-নীতি গ্রহণ করা হলো এবং অতিরিক্ত দিনগুলো বাতিল করার জন্য ১৭৫২ সালের সেপ্টেম্বরের ৩ হতে ১৩ তারিখ পর্যন্ত ১১ দিন ক্যালেন্ডার হতে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। সেপ্টেম্বর মাস হলো ১৯ দিনের। মাস ১৯ দিনের হলেও সবাই ৩০ দিনেরই বেতন পেয়েছেন এবং এই সময় হতে বেতনসহ ছুটির প্রচলন ঘটে। ব্রিটেনের অধীনস্থ সবগুলো উপনিবেশে এই আইন কার্যকর হলো। ধারনা করা হয়েছিলো এই আইনের কারণে আম-জনতার মধ্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে এবং নানা বিভ্রাট আর জটিলতার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। কিন্তু তেমন কিছুই হয়নি। নাগরিকবৃন্দ সহজভাবেই নতুন ক্যালেন্ডার গ্রহণ করলেন।

ব্রিটেনে ক্যালেন্ডার সংশোধনের পরও বিশ্বের অনেক জায়গায় পুরোনো ক্যালেন্ডারের চল রয়ে গিয়েছিলো। অনেক রাষ্ট্রের অহমিকার বাঁধ সহজে ভেঙ্গে পড়ল না। রাশিয়া ১৯১৮ সালের আগে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার গ্রহণ করে নি। গ্রিস করেছে আরো পরে, ১৯২৩ সালে। ইতিমধ্যে পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে। আগের গণনা ব্যবস্থায় আরো ২ দিন বেশী ত্রুটি হয়ে গেছে। ফলে এই দেশগুলোতে ১১ দিনের পরিবর্তে ১৩ দিন করে উপেক্ষা করতে হয়েছে।

-ইমতিয়াজ আহমেদ
সম্পাদক, বিজ্ঞান পত্রিকা
[লেখকের ফেসবুক প্রোফাইল]

বিজ্ঞান পত্রিকা প্রকাশিত ভিডিওগুলো দেখতে পাবেন ইউটিউবে। লিংক:
১. টেলিভিশনঃ তখন ও এখন
২. স্পেস এক্সের মঙ্গলে মানব বসতি স্থাপনের পরিকল্পনা
3. মাইক্রোস্কোপের নিচের দুনিয়া

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.