দীর্ঘ এবং বহু যুদ্ধবিগ্রহ ইস্টার দ্বীপের প্রাচীন সভ্যতাকে ধংস করেছে তা এই দ্বীপ জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হাজারো ছোট বড়, ধারালো বর্শার মতো বস্তু সেই ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের প্রমান বহন করে এমনটাই ধারণা করা হয়ে আসছিল। কিন্তু প্রত্নতাত্বিক অনুসন্ধান থেকে নতুন করে এটাই ইঙ্গিত করে যে, ‘মাটা’ নামক ঐ বস্তুটি আসলে যুদ্ধের অস্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়নি।
ইস্টার দ্বীপ মূলত চিলির উপকূল থেকে ২,৩০০ মাইল (৩,৭০০ কি.মি.) দূরে অবস্থিত একটি ছোট দ্বীপ। দূরবর্তী এই আগ্নেয় দ্বীপটি ‘রাপা নুই’ নামেও পরিচিত যা সাংস্কৃতিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক উভয় সম্প্রদায়ের মাঝে প্রচন্ড বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে।
তের শতকে পলিনেশিয়ানরা প্রথম এ দ্বীপে আসেন। এ দ্বীপের আদি অধিবাসীরা বিরাট আকারের পাথরের মূর্তি (যাকে মোআই নামে ডাকা হয়) তৈরীর জন্য বিখ্যাত ছিলেন। এগুলো তাঁরা উপকূল ঘিরে তৈরি এবং স্থাপন করেছিলেন। নয়শ এর ও অধিক রাজকীয় মূর্তি এ দ্বীপে পাওয়া যায়। এজন্য শিক্ষিত শ্রেণীর লোকজন যুক্তি দেন যে এখানে অবশ্যই দশ হাজারের মতো বাসিন্দা ছিলো। কিন্তু তারপরও বিজ্ঞানী এবং ঐতিহাসিকগণ এই সমাজ ধ্বংস হওয়ার প্রকৃত কারণ নিয়ে একমত হতে সক্ষম হননি।
বিশাল অভ্যন্তরীণ যুদ্ধবিগ্রহের কারণে এই অধিবাসীগণের পতন হয়েছে বলে প্রচলিত আছে। সীমিত সম্পদের অতিরিক্ত ব্যবহারের পরিণামস্বরূপ এবং অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ফল এরকম ভয়ানক পরিণতি। কিন্তু প্রত্নতাত্বিকরা ভিন্ন আঙ্গিকে গবেষণা করে এই ধারণার ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছেন, যেখানে গত দশকে বা ঐ সময়ে ইউরোপীয়দের দ্বারা রোগ এবং দাসত্বের কারণে পলিনেশীয় জাতির পতন হয়ে থাকতে পারে।
সাবধানতার সাথে চার’শর ও অধিক মাটা’র ছবি সংগ্রহ করে এবং তাদের আকৃতি morphometric নামক একটি কৌশলে বিশ্লেষণ করে গবেষকগণ এই চিন্তাধারায় নতুন মাত্রা যোগ করেছেন।
নিউ ইয়র্কের বিংহ্যামটন বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ববিদ এবং গবেষণার প্রধান কার্ল লিপো বলেন, “মাটার বিভিন্ন ধরণের আকার রয়েছে, তার মাঝে কিছু গোলাকার, কিছু বর্গাকার এবং কিছু ত্রিভুজ আকৃতির। তিনি আরও বলেন, “মাটাকে খুব একটা ভাল মানের যন্ত্র দিয়ে তৈরি করা হয়নি। এগুলো ধারালো ছিলোনা এবং কোন মাটাকেই মসৃণভাবে শেষ করা হয়নি।
এ সবছিুই প্রমাণ করে, ১৭২২ সালে ইউরোপীয়রা যখন এই দ্বীপে আসে তিন হাজার জনসংখ্যার দ্বীপটিতে বড় কোন সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ ছিলনা। হুনুলুলুর বিশপ জাদুঘরের নৃবিজ্ঞানী মারা মুলরুনির মতে, “বস্তুত রাপা নুই সভ্যতা ইউরোপীয়ানদের সাথে যোগাযোগের প্রাথমিক সময় পর্যন্ত ভাল উন্নতি করেছিল।
তাছাড়া, গবেষণা অনুযায়ী দ্বীপে পদ্ধতিগত কোন যুদ্ধবিগ্রহের কিংবা অন্য কোন প্রমাণ রহস্যজনকভাবে অনুপস্থিত। উদাহরণস্বরূপ লিপু বলেন, প্রত্নতাত্ত্বিকরা ইস্টার দ্বীপে খনন করে কোন প্রকার হাড়, খুলি কিংবা গণকবরের সন্ধান পাননি। বিজ্ঞানীরা সাধারণ যুদ্ধবিগ্রহ ও আত্নরক্ষামূলক কোন দুর্গ খুঁজে পাননি যেমন ছিল ফিজি এবং নিউজিল্যান্ডে।
তিনি জানান, “কোন সন্দেহ নেই যে এই দ্বীপে কোন প্রতিযোগীতা ছিল না। এটা সসীম সম্পদের একটি দ্বীপ কিন্তু মজার ব্যাপার হল মারাত্নক কোন সহিংসতার চিহ্ন এখানে নেই।”
লিপু বলেন, রাপা নুইয়ে যে মাটা পাওয়া যায় সম্ভবত তা দিয়ে কৃষি কাজ, পাথর খোদাই, কুরবানী কিংবা উল্কি তৈরির কাজে ব্যবহৃত হতো। এই শান্তিপূর্ণ কার্যক্রম আসলে প্রত্নতাত্ত্বিক প্রেক্ষাপটে অনেক জ্ঞান বৃদ্ধি করে যেমন, এরকম একটি ছোট বিচ্ছিন্ন দ্বীপে মানুষ তাদের সমস্যার সঙ্গে মোকবিলা করতে এবং দলগত প্রতিযোগীতা নিবারণ করতে শিখতে হয়েছিল।
তিনি আরও বলেন, “আপনি কোনভাবেই হত্যা করা বৃদ্ধি করতে পারবেন না কারণ হত্যা করার ফলে আপনাকে পালিয়ে যেতে হবে আর সেটার কোন রাস্তা নেই। তাহলে যুদ্ধবিগ্রহে সবাই মারা যেত। যদি রাপা নুই সভ্যতা ঐ দূরবর্তী দ্বীপে সফল হতো তবে পরের প্রশ্নে প্রত্নতাত্ত্বিকদের উত্তর দিতে হবে কিভাবে এই মানুষগুলো একটি টেকসই সম্প্রদায় সৃষ্টি করেছিল। রহস্য আসলে এখন আরও বেশি আকর্ষক হবে কারণ এখন আমাদের কিছু শিখতে হবে এখান থেকে।”
⚫ শফিকুল ইসলাম