মাত্র পাঁচ বছর বয়সে পিতৃবিয়োগে এতিম বালক, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, ডাচ ছাড়া অন্য ভাষা নাজানার কারণে উচ্চশিক্ষাও কপালে জোটেনি ! ষোল বছর বয়সে অ্যামস্টারডামের একটি কাপড়ের দোকানে কাজ নেন, এর প্রায় বছর পাঁচেক পর নিজেই শুরু করেন কাপড়ের ব্যবসা ৷ অল্পকয়েক বছরেই তিনি এলাকায় একজন প্রতিষ্ঠিত ও প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিতি পান ৷ লেখার শুরু দেখে ভাবতে পারেন আমি কোনো একজন সফল ব্যবসায়ীর জীবনবৃত্তান্ত বলছি, না, এটি একজন জগদ্বিখ্যাত বিজ্ঞানীর জীবনের শুরুর গল্প ৷ কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়ায় যিনি একজন মহান বিজ্ঞানীর স্বীকৃতি পান, তিনি এনথনি ভন লিউয়েনহুক (Anthoni Von Leewuenhoek)। জীববিজ্ঞান বা চিকিৎসা বিজ্ঞানের এমন ছাত্র-শিক্ষক বা গবেষক নেই যিনি বিজ্ঞানী লিউয়েনহুক সম্বন্ধে বইপুস্তকে পড়েনি ৷ সারা দুনিয়াতে তিনি পরিচিত অণুজীববিজ্ঞানের জনক হিসেবে। ১৬৩২ সালের ২৪শে অক্টোবর তৎকালীন ডাচ রিপাবলিকের (বর্তমান নেদারল্যান্ড) ডেল্ফট শহরে জন্ম গ্রহণ করেন ৷
আজ থেকে মাত্র তিনশ বছর আগেও মানুষের অজানা ছিল যে সাধারণ দৃষ্টিসীমার বাইরে অতিক্ষুদ্র জীবাণুদের আরেকটি জগৎ আছে ৷ জীবজগতের এ সত্যটি উৎঘাটন করেন ডাচ কাপড় বিক্রেতা এনথনি ভন লিউয়েনহুক, একজন স্বশিক্ষিত বিজ্ঞানী ৷ তিনি পৃথিবীর প্রথম স্বীকৃত অণুজীব বিজ্ঞানী, প্রথম অণুবীক্ষণ যন্ত্রের আবিষ্কারক, অণুজীববিজ্ঞানের জনক ৷ কাপড়ের সুক্ষ ফাইবার পরীক্ষা করার জন্য বিভিন্ন লেন্সের সমন্বয়ে অণুবীক্ষণ যন্ত্র উদ্ভাবন করেন তিনি ৷ পরবর্তীতে আরো উন্নত কৌশলে অন্তত ৫০০ টি অণুবীক্ষণ যন্ত্র তৈরি করেন ৷ নিজের উদ্ভাবিত যন্ত্র কাজে লাগিয়ে তিনি আবিষ্কার করেছিলেন ব্যাকটেরিয়া, প্রটোজোয়া, স্পার্মাটোজোয়া ইত্যাদি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণ ৷ প্রতিটি আবিস্কারের খবর সারাবিশ্বকে জানানোর জন্য তিনি প্রায় ১৯০ টি চিঠি লিখেছিলেন লন্ডনে রয়্যাল সোসাইটি বরাবর ।
একজন অণুজীববিজ্ঞানের ছাত্র, শিক্ষক বা গবেষকের ভাবনা চিন্তার অধিকাংশ সময়জুড়ে থাকে অণুজীব, তাই এরকম অনুজীববিজ্ঞানীর জীবনী বা কর্ম জানার আগ্রহ থাকে অপরিসীম । আমার স্ত্রী ডাঃ শাহানা আহমেদ ও আমি দুজনেই ডেনমার্কের কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে অণুজীববিজ্ঞানে ডক্টরেট করছি, তাই বর্তমানে ইউরোপে বসবাসের সুবাদে এবছর ইস্টার হলিডেতে আমরা দুজনেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম বিজ্ঞানী এনথনি ভন লিউয়েনহুক এর জন্মস্থান ও কর্মস্থল পরিদর্শন করবো ৷
তাঁর জীবনের আদি নিদর্শন দেখতে ১২ই এপ্রিল ২০১৭ ডেনমার্ক থেকে যাত্রা শুরু করি ৷ ভ্রমনের অনেক আগেই বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস ও লুক্সেমবুর্গ (বেনেলাক্স) এই তিন দেশের জন্য চারদিনের ইন্টার-রেইল ট্রেইন পাস কিনেছিলাম যাতে ট্রেইন টিকেট নিয়ে ঝামেলা করতে নাহয়। প্রথমে বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলস ও পার্শ্ববর্তী দেশ লুক্সেমবুর্গ ভ্রমণের পর ১৬ই এপ্রিল ব্রাসেলস কেন্দ্রীয় ট্রেন স্টেশন থেকে রওনা দিলাম নেদারল্যান্ডের ডেল্ফট শহরের উদ্দেশ্যে ৷ দৃষ্টিনন্দন লাল-কমলা-বেগুনী টিউলিপের চাদরে আবৃত বিস্তীর্ণ মাঠ পেড়িয়ে চলছে ট্রেন ৷ ঘন্টা তিনেক পর দুপুর বারোটা নাগাদ আমরা পৌঁছলাম ডেল্ফট কেন্দ্রীয় ট্রেন স্টেশনে ৷ স্টেশন তথ্যকেন্দ্র থেকে শহরের একটি ম্যাপ নিয়ে হেটে রওনা দিলাম প্রথম গন্তব্যস্থল লিউয়েনহুকের শৈশবের বাড়ি ৷ অসম্ভব সুন্দর একটি শহর, সারাশহর জালের মতো বিস্তৃত স্বচ্ছ পানির ক্যানেল, প্রতিটি ক্যানেলের পাশদিয়ে সবুজ গাছ বেষ্টিত হাঁটার রাস্তা, টুংটাং বাইসাইকেলের বেল, সবমিলিয়ে মনে হচ্ছিলো অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সুবিধা সম্বলিত একটি গ্রামের রাস্তায় হাটছি ৷ লিউয়েনহুকের জীবন নিয়ে লেখা বই ও বিভিন্ন ব্লগের বর্ণনা অনুযায়ী ক্যানেলের পাশধরে ২০ মিনিট হাঁটার পর ম্যাপ এ নির্দেশিত সেই স্থান পেলাম ৷ তার আসল বাড়িটি এখানে আর নেই, সেই জায়গায় একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুল করেছে সিটিকর্পোরেশন ৷
এখান থেকে পানির ক্যানেলের পাশ ধরে হাঁটতে থাকলাম তার শৈশব পরবর্তী বাসস্থান বরাবর ৷ মিনিটপাঁচেক হাঁটার পরেই ম্যাপের অবস্থান অনুযায়ী রাস্তার কোনায় সেই বাড়ির অবস্থান নিশ্চিত হল ৷ পুরানো বিল্ডিং, নিচতলায় দোকানঘর, বোঝার মতো কোনো চিহ্নই নেই যে এটি সেই মহান বিজ্ঞানীর বাসস্থান ৷ অনেকক্ষন পর চোখে পড়লো দেয়ালে একটি ছোট পিতলের প্লেটে লিখা তার পরিচয় ৷
“HIER STOND HET HUIS
HET GOUDEN HOOFD
WAAR 91 JAAR OUD
OP AUGUSTUS 1723
OVERLEED
ANTHONI VON LEEWUENHOEK
DE ONTDEKKER
DER MIKROBEN”
(“এখানেই সেই বাড়ি, সেই স্বর্ণালী নিদর্শন যেখানে ৯১ বছর বয়সে ১৭২৩ সালের আগস্টে মৃত্যুবরণ করেন অণুজীবের আবিস্কারক এনথনি ভন লিউয়েনহুক”)
পিতলের প্লেটটি বেশকিছুক্ষন ধরেই দেখছি আর ছবি তুলছি, পাশদিয়ে হেঁটেযাওয়া মানুষজন অবাক হয়ে দেখছে দেয়ালে কিসের প্রতি এত মনোযোগ আমাদের ! যেকোনো অণুজীববিজ্ঞানীর কাছে এটি এক বিশেষ মুহূর্ত, এই সেই জায়গা যেখানে বিজ্ঞানের এক নতুন যুগের সূচনা হয়, এই বাড়িতে তিনশত বছর আগে আবিস্কার হয় পৃথিবীর প্রথম অণুবীক্ষণ যন্ত্র, এখানেই আবিষ্কার হয় ব্যাকটেরিয়া, প্রটোজোয়া, লোহিত রক্ত কণিকা, শুক্রাণু আরো অনেক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণ ৷ এখানে দাড়িয়ে অনুভব করতে পারছি এই রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন হাঁটতেন এনথনি ভন লিউয়েনহুক, দরজার সামনের এই ক্যানেলের পানিই পরীক্ষা করতেন নতুন জীবনের সন্ধানে ৷
বাড়ির ঠিক ১০০ মিটার দূরেই তার কর্মস্থল ‘ডেল্ফট সিটি হল’, সামনের রাস্তা ধরে কিছুক্ষণ হাঁটার পরই দেখতে পেলাম, এটি ছিল লিউয়েনহুকের প্রায় চার যুগের কর্মস্থল ৷ নিজের কাপড়ের ব্যবসার পাশাপাশি এখানে তিনি শহরের শেরিফের কউন্সিল চ্যাম্বারে ‘চ্যাম্বারলিন’ পদে কাজ করতেন ৷ সিটি হলের সামনেই বিশাল ফাঁকা মাঠের অপরপাশে অপূর্ব নির্মাণশৈলীর সুউচ্চ গির্জা নাম ‘নতুন গির্জা’, এই গির্জাতে ১৬৩২ সালে লিউয়েনহুক খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত হন এবং এখানেই ১৬৫৪ সালে বারবারা দি মেইজের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন ৷
এখান থেকে মানচিত্রে দেখানো নির্দেশনা অনুযায়ী হাঁটতে থাকলাম লিউয়েনহুকের সমাধিস্থল ‘পুরাতন গির্জার’ উদ্দেশ্যে। পাঁচ ইউরো দিয়ে প্রবেশ টিকেট নিয়ে ঢুকলাম গির্জার ভিতরে। অসংখ্য পুরাতন কবরের মাঝে প্রায় আধাঘণ্টা খোঁজার পর পেলাম লিউয়েনহুকের সমাধি। মৃত্যুর প্রায় সপ্তাখানেক পরে তাঁকে এখানে কবর দেয়া হয়। ১৭৩৯ সালে কবরের পাশে পাথরের ছোট একটি সৃতি ফলক তৈরি করেন তাঁর মেয়ে, এর পাশেই একটি ছোট প্রদর্শনীতে তার পরিচয় ও পুরাতন কিছু ছবি রাখা। প্রায় ৩০ মিনিট পর গির্জা থেকে বের হয়ে কয়েক মিটার সামনেই একটি প্রাচীরের গায়ে বিজ্ঞানী লিউয়েনহুকের পরিচয় সম্বলিত আরেকটি ধাতব ফলক চোখে পড়ল, এটিই আমাদের দেখা এশহরে লিউয়েনহুকের শেষ স্মৃতিচিহ্ন ।
ক্ষুদ্র প্রাণের সন্ধানদাতা এ মহান বিজ্ঞানীর জীবনের কিছু নিদর্শন বাস্তবে দেখতে পারা যেকোনো শিক্ষানবিশ অণুজীব বিজ্ঞানীর জীবনের একটি স্মরণীয় দিন।
-ডাঃ মোঃ জহুরুল ইসলাম
পি এইচ ডি ফেলো, কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়, ডেনমার্ক।
সহকারী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ।