১৯০০ সালের দিকে ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী লর্ড কেলভিন বলেছিলেন “পদার্থবিজ্ঞানে নতুন করে আবিষ্কার করার মতো আর কিছুই নেই। যা করার আছে তা হলো বার বার পরীক্ষা ও পরিমাপের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত হওয়া আবিষ্কারকে আরো সূক্ষ্মাতিসূক্ষ করা।” তখনকার সময়ের পদার্থবিজ্ঞানের অগ্রগতি এমনকি পদার্থবিজ্ঞানীদেরকেও ভাবিয়ে তুলেছিল নতুন করে আর কিছু আবিষ্কার করার আছে কিনা। তাঁরা ভেবেছিলেন পদার্থবিজ্ঞান এতোই এগিয়ে গেছে যে সমস্ত আবিষ্কারই ইতিমধ্যে হয়ে গেছে। কিন্তু আজকে একশো বছর পর পর আমরা দেখি আজকের পদার্থবিজ্ঞানের তুলনায় ১৯০০ সালের পদার্থবিজ্ঞান কিছুই না। ‘স্বয়ংসম্পূর্ণ পদার্থবিজ্ঞানে’র উপর প্রথম ধাক্কাটি দিয়েছিলেন ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক তার কোয়ান্টাম তত্ত্বের মাধ্যমে। এই প্ল্যাঙ্ককেই কিন্তু বলা হয়েছিল পদার্থবিজ্ঞান না নিয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করতে, কারণ পদার্থবিজ্ঞানে নতুনভাবে করার মতো কিছুই নাকি বাকি ছিল না! প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম বিপ্লবের পর একে একে বিপ্লবাত্মক অনেক কিছু ঘটে গিয়েছে পদার্থবিজ্ঞানে।
আলোর গতি, আপেক্ষিকতা, কোয়ান্টাম মেকানিক্স, পরমাণু তত্ত্ব সহ অনেক কিছু, যাদের ছাড়া আজকের দিনে পদার্থবিজ্ঞানকে অচল বলে মনে হবে। যত দিন যাচ্ছে একটার পর একটা করে বিপ্লব হচ্ছে। যতই বিপ্লব হচ্ছে ততই একটার পর একটা করে রহস্য তৈরি হচ্ছে আর বলছে- পদার্থবিজ্ঞান তোমাকে আরো অনেক দূর যেতে হবে। একেকটা আবিষ্কারের সাথে সাথে একটা করে প্যানডোরার বাক্স খুলে যাচ্ছে। প্রতিটা বাক্স থেকে আরো বড় আকারের সমস্যার জন্ম হচ্ছে হচ্ছে। একের পর এর সমস্যা বের হবার ব্যাপারটা এখন পদার্থবিজ্ঞানের সৌন্দর্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। একেকটা বাক্স মানে গবেষণার একেকটা নতুন ক্ষেত্র। এখনকার কোনো পদার্থবিজ্ঞানী ভুলেও ভাববে না, পদার্থবিজ্ঞান স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে কিংবা স্বয়ংসম্পূর্ণ হবার কাছাকাছি পর্যায়ে চলে এসেছে। অমীমাংসিত থাকা রহস্যগুলো তালিকা করলে বিশাল একটা ফর্দ হবে। তার মাঝে উল্লেখযোগ্য কিছু অমীমাংসিত রহস্য হচ্ছে-
- ডার্ক ম্যাটার
- ডার্ক এনার্জি
- কণা তরঙ্গ দ্বৈততা
- সময়ের বহমানতা (সময় কেন শুধু সামনের দিকেই চলে?)
- প্রতি-পদার্থ (প্রতি-পদার্থের চেয়ে পদার্থের পরিমাণ কেন বেশি?)
- স্ট্রিং থিওরি (সঠিক না ভুল?)
- মহাবিশ্বের চূড়ান্ত ভবিষ্যৎ কী?
- প্যারালাল ইউনিভার্সের অস্তিত্ব আছে কি?
- আলোর গতি (কেন সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটারের বেশি হতে পারে না?)
- প্রকৃতির ক্যাওসে কোনো শৃঙ্খলা আছে কি?
- চতুর্থ মাত্রা (সহ অন্যান্য উচ্চ মাত্রা) কেন অনুধাবন করতে পারি না?
- আমরা কি হলোগ্রাম সদৃশ কোনো মহাবিশ্বে বাস করছি?
- কোয়ান্টাম ওয়েভ ফাংশনে কীভাবে পরিমাপের সাধারণ নিয়মগুলো ভেঙে পড়ে?
- থিওরি অব এভরিথিং (সার্বিক তত্ত্ব)
- কোয়ান্টাম অভিকর্ষ (২০১৬ সালে এর কিছুটা সমাধান হয়েছে, অনেকটা বাকি রয়েছে)
- ব্ল্যাক হোল
- অতিপ্রতিসাম্যতা (সুপারসিমেট্রি)
- নিউট্রিনোর ভর
- প্রোটনের ব্যাসার্ধ সমস্যা
- ব্লা ব্লা ব্লা… (রহস্যের বিস্তারিত তালিকা দেখুন উইকিপিডিয়ায়)
শত শত বছর ধরেই পদার্থবিজ্ঞানে অমীমাংসিত সমস্যা ছিল। কোনোটা ছিল বড় কোনোটা ছিল ছোট। একটা সময় ছিল যখন আমরা পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরে কিনা। একসময় এটা জানতে পারলাম। যখন এটা জানতে পারলাম তখন আবার রহস্য হয়ে দাঁড়াল, পৃথিবী কীভাবে ও কেন সূর্যের চারপাশে ঘুরছে? কেপলারের মাধ্যমে আমরা ‘কীভাবে’ এর উত্তর পেলাম। কিন্তু ‘কেন’টা তখনো রহস্যই রয়ে গিয়েছিল। এরপর রঙ্গমঞ্চে আসলেন নিউটন। নিউটন তাঁর অভিকর্ষ তত্ত্বের মাধ্যমে ব্যাখ্যা দিলেন কেন ঘুরছে পৃথিবী কিংবা কেন ঘুরছে চাঁদ। আরো পরে আইনস্টাইন এসে তার আপেক্ষিকতা তত্ত্বের মাধ্যমে অভিকর্ষের পুরো সংজ্ঞাটাই পালটে দিলেন। আজকের যুগে দেখতে পাই অভিকর্ষ নিয়েও অনেক রহস্য হচ্ছে। এই রহস্যগুলোর কোনো কোনোটা সমাধানও হচ্ছে।
সমস্যা ও রহস্য থাকবেই। ধীরে ধীরে এগুলোর সমাধানও হবে। সমস্যা ও সমাধানের এই খেলার মাঝেই পদার্থবিজ্ঞানের সৌন্দর্য। বিজ্ঞানীরা তাদের মেধা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে রহস্যের সমাধান করবেন এবং বৈজ্ঞানিক বিপ্লবকে ব্যবহার করে মানব কল্যাণে নতুন নতুন প্রযুক্তি তৈরি করবেন।
সময় এসেছে এই বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার। বিজ্ঞান পত্রিকায় ধীরে ধীরে এগুলোর বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। বিজ্ঞান পত্রিকার সাথেই থাকুন।
-সিরাজাম মুনির শ্রাবণ
বিজ্ঞান পত্রিকা প্রকাশিত ভিডিওগুলো দেখতে পাবেন ইউটিউবে। লিংক:
১. টেলিভিশনঃ তখন ও এখন
২. স্পেস এক্সের মঙ্গলে মানব বসতি স্থাপনের পরিকল্পনা
3. মাইক্রোস্কোপের নিচের দুনিয়া