পুরুষ সঙ্গী ছাড়াই তিন সন্তানের এক জননীর গল্প

0
285

অস্ট্রেলিয়ার বিলুপ্তপ্রায় “জেব্রা শার্ক” (বৈজ্ঞানিক নাম Stegostoma fasciatum)  প্রজাতির এক মেয়ে হাঙ্গর  কুইন্সল্যান্ডের একটি একুরিয়ামে তিনটি সন্তানের জন্ম দিয়েছে। মা হাঙ্গর মাছটির নাম “লিওনি” ও তার তিন কন্যা সন্তানের নাম রাখা হয়েছে যথাক্রমে ক্লিও,সিসি ও জেমিনি। বিষয়টি খুব সাধারণ মনে হলেও প্রাণীবিজ্ঞানীদের কাছে তা খুবই রহস্যময়। কারণ ২০১২ সালের পরে লিওনির সাথে কোন পুরুষ হাঙ্গরের সাক্ষাতই যে হয়নি!

২০১২ সাল পর্যন্ত লিওনির সাথে একটি পুরুষ হাঙ্গর থাকত। তার নাম ছিল লিও। সেই সময় লিওনি যৌন প্রজননের মাধ্যমে  ২০টি বাচ্চা প্রসব করে। ২০১৩ সালে লিওকে একুরিয়ামের অপর একটি ট্যাঙ্কে স্থানান্তরিত করা হয়। ফলে লিওনি তখন থেকে একা হয়ে যায়। ২০১৬ সাল পর্যন্ত তার ট্যাঙ্কে নতুন কোন পুরুষ সঙ্গী প্রবেশ করেনি। কিন্তু এরপরেও তার সন্তান জন্মদানের বিষয়টি আশ্চর্যজনক। বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল, লিওনি হয়ত আগে থেকেই শুক্রানু সংগ্রহ করে রেখেছিল। কিন্তু তার সন্তানদের ডিএনএ পরীক্ষায় দেখা যায় তাদের দেহকোষে শুধুমাত্র লিওনির ডিএনএ বিদ্যমান রয়েছে।

হাঙ্গরের এই অযৌনপ্রজনন প্রক্রিয়া বিরল হলেও তা একেবারে অসম্ভব নয়। কারণ বেশ কিছু প্রজাতির প্রানি যৌন প্রজননের পরিবর্তে অযৌন প্রক্রিয়ায় বংশবৃদ্ধি করে থাকে। ব্যাতিক্রমী এই পদ্ধতিকে জীববিজ্ঞানের ভাষায় “পার্থেনোজেনেসিস” বলা হয়। এই প্রক্রিয়াতে  শুক্রাণুর অনুপস্থিতিতে  ভ্রুন যৌনপ্রজননের মতই মাতৃগর্ভে বড় হতে থাকে। পার্থেনোজেনেসিস প্রধানত উদ্ভিদ ও অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের ক্ষেত্রে দেখা যায়। তবে মেরুদণ্ডী প্রাণী যেমনঃ টিকটিকি এমনকি হাঙ্গরও এই প্রক্রিয়াতে প্রজনন ঘটিয়েছে বলে তথ্য রয়েছে।

তাই লিওনির এই ঘটনাটি আবারো সাদামাটা মনে হলেও এর মাঝে আরও রোমাঞ্চ বাকি রয়েছে। কারণ যে সমস্ত হাঙ্গর পার্থেনোজেনেসিস প্রক্রিয়ায় সন্তান জন্ম দেয়, তারা প্রাপ্তবয়স্ক হবার পর থেকে এই পদ্ধতিতেই প্রজনন ঘটায়। তারা সাধারণত যৌন প্রজনন ঘটাতে পারে না। এইখানেই আসলে লিওনি অনন্য। কারণ সে যৌন ও অযৌন উভয় প্রক্রিয়াতেই গর্ভবতী হয়েছে এবং সন্তান প্রসবও করেছে। এর আগে আর কোন হাঙ্গরের ক্ষেত্রে প্রাণীবিজ্ঞানীরা এই আশ্চর্যজনক ঘটনা লক্ষ্য করেননি। তবে যৌন অভিজ্ঞতার পর অযৌন প্রক্রিয়াতে সন্তান জন্মদানের ঘটনা  এর আগেওঁ বিজ্ঞানীরা আরও ২ ধরনের প্রাণীর (এক প্রজাতির ঈগল ও এক ধরনের অজগর) মাঝে দেখতে পান। তারা বন্দি অবস্থায় প্রজননের জন্য এই পদ্ধতি বেছে নিয়েছিল। লিওনিও তাদেরকেই অনুসরণ করেছে বলে ধারনা করা হচ্ছে।

লিও ও লিওনির যৌন প্রজনন হার ছিল অনেক বেশি। যার কারণে তাদের বাচ্চা উৎপাদন ক্ষমতা ছিল মাত্রাতিরিক্ত। ফলে তাদের অধিক সংখ্যক সন্তানকে সামাল দিতে হিমশিম খাওয়ায় একুরিয়ামের কর্মচারীরা লিওকে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু তার পরেও লিওনি সন্তান জন্ম দেয়ায় প্রানিবিজ্ঞানিরা নড়েচড়ে বসেন। তারা বলছেন, লিওনি তার বর্তমান পরিস্থিতির সাথে নিজেকে পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছে এবং পুরুষ সঙ্গীকে হারানোতে সে অযৌন প্রজননের পথ বেছে নিয়েছে।

জীববিজ্ঞানীরা একক প্রচেষ্টায় সন্তান জন্মদানের এই প্রক্রিয়াটি উপযুক্ত সঙ্গী ছাড়াই প্রাণীদের টিকে থাকার একটি উত্তম পন্থা হিসেবে বিবেচনা করছেন। তবে সেক্ষেত্রে জন্ম নেয়া বাচ্চাদের বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। কারণ তাদের দেহে শুধুমাত্র মায়ের জিন থাকে। ফলে তাদের মাঝে জীনগত বৈচিত্র্য খুঁজে পাওয়া দুস্কর হবে।

বিজ্ঞানীরা  ক্লিও,সিসি ও জেমিনির প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করার পরিকল্পনা করেছেন।  তারা মূলত দেখতে চান,সেই সময়ে কোন পুরুষ সঙ্গীর সাথে মিলনের ফলে তারা সন্তান জন্ম দিতে পারে কিনা। যদি তারা যৌন প্রক্রিয়ায় বাচ্চা প্রসব করতে পারে,তবে সেটা নির্দেশ করবে, জেব্রা শার্ক প্রতিকুল পরিবেশে টিকে থাকার এক অভিনব কৌশল আয়ত্ত করে ফেলেছে। বিপন্ন প্রাণীকূল পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণে তা এক নতুন দিগন্তের সূচনা করবে বলেই আশা করা হচ্ছে। [Sciencealert অবলম্বনে]

– নাসরুল্লাহ মাসুদ

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.