[বইটির সূচীপত্র এবং সব খন্ডের লিংক একত্রে দেখুন এখানে]
ইলেক্ট্রন তো আবিষ্কার হলো। প্রমাণ হলো ইলেক্ট্রন পরমাণুর ভেতরেই থাকে। কিন্তু কীভাবে থাকে? একটা পরমাণুতে ইলেক্ট্রন থাকেইবা কতগুলো? সব মৌলের পরমাণুর সমান ভর নয়। হাইড্রোজেনের পরমাণুর ভর খুব কম। সোনার পরমাণুর ভর আবার খুব বেশি। তাহলে নিশ্চয়ই আলাদা আলাদা পরমাণুতে ইলেক্ট্রনের সংখ্যাও আলাদা!
শুধু হাইড্রোজেনের কথাই ধরা যাক। হাইড্রোজেন পরমাণুর ভর ইলেক্ট্রনের চেয়ে প্রায় দুহাজার গুণ বেশী। হাইড্রোজেনে কী বহু ইলেক্ট্রন থাকে, নাকি একটা? আরেকটা প্রশ্নও গুরুত্বপূর্ণ। ইলেক্ট্রনের চার্জ আছে অথচ মুক্ত হাইড্রোজেন পরমাণু চার্জ নিরপেক্ষ। শুধু হাইড্রোজেন পরমাণুই নয়, মুক্ত স্বাভাবিক অবস্থায় সব পরমাণুই চার্জ নিরপেক্ষ। ওদিকে ফ্যারাডে ক্যাটায়নের আর অ্যানায়নের কথা বলেছিলেন। সেই হিসেবে ধনাত্মক চার্জের অস্তিত্ব থাকা উচিৎ পরমাণুতে। আরহেনিয়াস কিন্তু সেটাই দেখিয়েছিলেন। তড়িৎ বিশ্লেষ্য লবণ-দ্রবণে ধনাত্মক চার্জবাহী পরমাণু যেমন আছে তেমনি ঋণাত্মক চার্জবাহী পরমাণুও আছে। এ ঘটনা থেকে একটা বিষয় নিশ্চিত হওয়া যায়। বিশেষ অবস্থায়ই কেবল পরমাণু চার্জিত অবস্থায় থাকে। স্বাভাবিক অবস্থায় চার্জ নিরপেক্ষ। শুধু ইলেক্ট্রন থাকলে তো আর পরমাণুর চার্জ নিরপেক্ষ হওয়া সম্ভব নয়। নিশ্চয়ই পরমাণুর ভেতর এমন কিছু আছে যেটা ধনাত্মক চার্জকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। আর সেই তেমন কিছুটা হতে পারে কোন ঋনাত্মক চার্জবাহী কণা।
আরহেনিয়াস তো দেখিয়েই দিয়েছেন, পরমাণু বিশেষ অবস্থায় ধনাত্মক চার্জবাহী কণার মতো আচরণ করে। সেটা কেন করে? ধনাত্মক চার্জবাহী কণিকা আছে বলেই। হতে পারে সেই কণিকাটা ইলেক্ট্রনেরই মত ক্ষুদ্র এবং হালকা।
‘হতে পারে’ দিয়ে বিজ্ঞান চলে না। নিশ্চিত হতে হবে। বিজ্ঞানীদের হাতে তখন ভাসা ভাসা ছবি। ধনাত্মক কণাটার খোঁজ চলছে। বিজ্ঞানে দুটো বিষয়ই হতে পারে। কখনো কোনো জিনিস আগে পাওয়া যেতে পারে। তারপর গাণিতিক ব্যাখ্যা দিয়ে সেটার তত্ত্ব দাঁড় করানো হয়।
আবার উল্টোটাও ঘটে। কখনো বস্তু বা প্রকৃতির আচরণ দেখে কিছু কিছু ব্যাপার অনুমান করে নেওয়া হয়। অযৌক্তিক অনুমান নয়। সুচিন্তিত যুক্তি-তর্কের ওপর দাঁড়িয়ে অনুমান করা হয়। তারপর গাণিতিক ছাঁচে ফেলে দাঁড় করানো হয় সেটার একটা তত্ত্ব। সবশেষে তত্ত্বের দেখানো পথে চেষ্টা করা হয় বস্তুটা খোঁজার। ধনাত্মক কণার ক্ষেত্রেও তাই করা হলো। ধরে নেওয়া হলো, পরমাণুর ভেতরে ধনাত্মক চাজচাহী কণাও আছে। সেই কণাই নিষ্ক্রিয় করে দেয় ধনাত্মক চার্জকে। এই অনুমানের ওপর ভিত্তি করে স্যার জে জে থমসন পরমাণুর একটা মডেল দাঁড় করানোর চেষ্টা করলেন। ১৯০৩ সালে। ডালটনের মডেলের সাথে এই মডেলের সম্পর্ক তেমন রইল না বললেই চলে। অবশ্য থমসনের মডেলটা একেবারেই সরল।
থমসন বললেন, পরমাণু আসলে গোলকের মতো। একথা নতুন নয়, প্রাচীন যুগের। থমসন বললেন, সেই গোলক হলো ধনাত্মক চার্জযুক্ত। এর ভেতর পাশাপাশি অবস্থান করে ইলেকট্রনগুলো। ঠিক যেভাবে জমাট পুডিংয়ের ঠেসে রাখা হয় কিসমিসগুলো। ঋণাত্মক চার্জযুক্ত ইলেকট্রন আর ধনাত্মক চার্জযুক্ত গোলক পরস্পরের চার্জকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। তাই পরমাণু চার্জ নিরপেক্ষ।
তাহলে কী পরমাণুর ভেতরটা একেবারে নিরেট? তখনই আবার আওয়াজ তুললেন ফিলিপ নেলার্ড। তিনি বললেন, নিশ্চয়ই পরমাণু নিরেট নয়। নিরেট হলে ক্যাথোড টিউবের ভেতর রাখা পাতলা ধাতব পর্দা ভেদ করে যেতে পরত না ইলেক্ট্রন। ধাবত পর্দা তো পরমাণু দিয়েই তৈরি। পাতলা ধাতব পর্দার কথা আগের কোন এক অধ্যায়েই বলেছি। থমসনের তত্ত্ব ঠিক হলে, ধাতব পর্দাও পরমাণু দিয়ে তৈরি, সেসব পরমাণুর ভেতরেও নিশ্চয়ই ইলেক্ট্রন ও অজ্ঞাত ধনাত্মক কণাগুলি ঠাসাঠাসি করে আছে। আবার পরমাণুগুলোও পদার্থের ভেতর ঠাসাঠাসি করে থাকে। তাহলে ধাতব পর্দার ভেতরে ফাঁক থাকার কথা নয়।
সেই পর্দা ভেদ করে যায় ক্যাথোড রশ্মি আকারে ইলেক্ট্রন স্রোত। পর্দার ভেতরে যদি ফাঁকই না থাকে তবে ইলেকট্রনের স্রোত তার ভেতর দিয়ে যায় কীভাবে। পরে এক্সরে ও বেটা রশ্মি বিক্ষেপন পরীক্ষার সাহায্যে থমসন নিশ্চিত হন তাঁর পরমাণু মডেল ঠিক নয়।
একই বছর লেনার্ড বললেন, পরমাণুকে পুরাপুরি নিরেট ধরলে এই হিসাব মিলবে না। তার বদলে বলা যায়, পরমাণুর ভেতর সূক্ষ্ম ফাঁক আছে। সেই ফাঁক গলে বেরিয়ে যেতে পারে ইলেক্ট্রনের স্রোত। লেনার্ড প্রস্তাব দিলেন, পরমাণু ভেতরটা আসলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণিকার মেঘে পূর্ণ থাকে। সেই মেঘ ভেদ করে বেরিয়ে যেতে পারে অন্য কণিকা।
প্রিয় পাঠক। ক্ষুদ্র কণিকাদের মেঘ সম্পর্কে একটু আলোচনা করা দরকার। এই বইয়ের পরের অধ্যায়গুলোতে বার বার ক্ষুদ্র কণিকার মেঘের কথা আসবে। বিশেষ করে ইলেক্ট্রন মেঘ। একটা সিলিং ফ্যানের কথা ভাবুন। ফ্যানে তিনটে পাখা থাকে। পাখাগুলো নিরেট একথা আমরা সবাই জানি। একটা পাখা থেকে আরেকটা পাখা বেশ দূরে দূরে। তাদের ভেতর বড়সড় ফাঁক জায়গা। এখন বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে ফ্যানটা ঘুরিয়ে দিন। ফ্যানের পাখাগুলো আর স্পষ্ট দেখা যাবে না। ঘোলাটে ভাসা ভাসা দেখায়। অনেকটা মেঘের মতো। ফ্যানের তিনটে পাখাকে একসাথে একটা বৃত্তের মতো মনে হয়। আবার ফ্যানের পেছনের সিলিং ও দেখা যায় আবছাভাবে।
এই অবস্থায় একটা ছোট রাবারের বল দিয়ে একটা পরীক্ষা করে ফেলতে পারেন। ফ্যানের নিচে বিছানা থাকলে শুয়ে পড়ুন। এবার রাবারের বলটি ছুড়ে মারুন ফ্যান সোজাসুজি সিলিং লক্ষ্য করে। খেয়াল রাখবেন বলটা যেন ফ্যানের কেন্দ্র বরাবর না যায়। ছুড়ে মারা বলটি কি সিলিং পৌঁছবে, নাকি ফ্যানের পাখায় লেগে ফিরে আসবে?
দুটোর যে কোনো একটি ঘটনাই ঘটতে পারে। বলটা ফ্যানের পাখার আঘাত এড়িয়ে পৌঁছে যেতে পারে সিলিংয়ে। অথবা পাখার আঘাতে ছিটকে অন্য দিকেও চলে যেতে পারে। বার বার যদি পরীক্ষা করেন, তাহলে দেখবেন প্রতিবার একই ঘটনা ঘটছে না। কখনো বল সিলিংয়ে গিয়ে আঘাত করছে। কখনো পাখার আঘাতে ছিটকে অন্যদিকে চলে যাচ্ছে। ফ্যানের পাখাগুলো যদি আলাদা না হয়ে এটা নিরেট চাকতির মতো হতো, তাহলে কি এমনটা হতো?
না, তা সম্ভব নয়। ফ্যানের পাখা নীরেট চাকতির মতো হলে প্রতিবারই বলটা বাধা পেত। একবারও সিলিং ছুঁতে পারত না। লেনার্ড পরমাণুর মধ্যে ক্ষুদ্র কণিকাদের এমন মেঘের কথা বললেন। সেই মেঘের ভেতর দিয়ে ইলেকট্রনের মতো কণা বলে যেতে পারে। তাহলে কী পরমাণুর ভেতরে কণিকারা স্থিতিশীল নয়? অনবরত ছোটাছুটি করে কণিকাদের মেঘ তৈরি করে?
তেমনটাই ধারণা করলেন লেনার্ড। ধরে নিলেন পরমাণুর ভেতর একটা ধনাত্মক কণিকা আর একটা ঋণাত্মক ইলেক্ট্রন পরস্পরকে কেন্দ্র করে ঘোরে। পরমাণুর ভেতরে ধনাত্মক ও ঋনাত্মক কণিকার জোড়া একাধিক থাকতে পারে।
পরমাণুর ভেতর ধনাত্মক ও ঋনাত্মক কণিকার অস্তিত্ব অনেকটাই মেনে নিলেন বিজ্ঞানীরা। তখন আরেকটা প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিল। আলোক তড়িৎ ক্রিয়ায় ধাতু থেকে ইলেক্ট্রন নির্গত হয়। কিন্তু ধনাত্মক কণা কেন নির্গত হয় না?
প্রশ্নটা গুরুত্বপূর্ণ, গুরুত্বপূর্ণ এর উত্তর খুঁজতে যাওয়াও। বায়ুশূন্য ক্যাথোড টিউবের কথাই ধরা যাক। সেখানে অ্যানোড দন্ডও থাকে। আনোডে ধনাত্মক চার্জযুক্ত কণিকা থাকার কথা। বায়ুশূন্য টিউব থেকে তাহলে ধনাত্মক কণিকাও নির্গত হাওয়া উচিত। কিন্তু হয় না। এর রহস্য কী?
বিজ্ঞান যখনই এমন সমস্যায় পড়েছেন, তখনই কেউ না কেউ হাজির হয়েছেন দেবদূতের মতো। পরমাণুর ভেতরকার গঠন প্রণালীর এই সমস্যা সমাধানে এগিয়ে এলেন একজন জাপানী বিজ্ঞানী। নাম তার হান্তারো নাগওকা। ১৯০৪ সালে তিনিই প্রথম পরমাণুকে সৌরজগতের সাথে তুলনা করলেন। তিনি প্রস্তাব করলেন, পরমাণুর ঠিক কেন্দ্রে থাকে ধানাত্মক চার্জ যুক্ত কণিকারা আর পরমাণুর বাইরের দিকে অবস্থান করে ইলেক্ট্রনগুলো।
সৌরজগতের তো এমনটাই ব্যাপার স্যাপার তাই না! সূর্যের বাস সৌরজগতের কেন্দ্রে। আর গ্রহগুলো নিজ নিজ কক্ষপথে ঘোরে সূর্য কেন্দ্র করে। পরমাণুর ব্যাপারটাও যদি এমন হয় তাহলে ইলেক্ট্রনের জন্য কক্ষপথ থাকতে হবে। ঘুরতে হবে নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে।
তবে সৌরজগতের সাথে পুরোপুরি তুলনা পরমাণুর চলে না। সৌরজগতে সূর্য আর গ্রহগুলোর মধ্যে কাজ করে মহাকর্ষীয় আকর্ষণ বল। সেই সাথে গ্রহগুলোর ঘূর্ণন গতিশক্তিও কাজ করে। পরমাণুতে মহাকর্ষ বল ক্রিয়া করার সুযোগ নেই। এখানে বরং বৈদ্যুতিক আকর্ষণ বলের ব্যাপার-স্যাপার বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তবে নাগাওয়াকা এ বিষয়ে স্পষ্ট কোনো দিক-নির্দেশনা দিয়ে যেতে পারেননি। তাছাড়া থমসন, লেনার্ড, নাগাওয়াকা প্রত্যেকেরই তত্ত্ব অনুমাননির্ভর। পরীক্ষালব্ধ প্রমাণ নয়। তবে সে সময় কিছু উদাহরণ ছিল, যেগুলো পরমাণুর ভেতরের খবর কিছু দিতে পারে।
এক্স রশ্মি ও তেজস্ক্রিয়তার ব্যাপারগুলো ততো দিনে আবিষ্কার হয়ে গেছে। তা নিয়ে অনেক গল্প করেছি আগের অধ্যায়ে। আমরা দেখেছিলাম, রাদারফোর্ড আলফা কণার ভর নির্ণয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আলফা কণা ধনাত্মক চার্জযুক্ত সেটাও তাঁর জানা ছিল। কিন্তু জানা ছিল না এই আলফা কণা আসলে কী। সে গল্প পরে হবে। এখন বরং আসল কাজের কথায় আসি।
পরমাণু গঠন সম্পর্কে একেকজন একেক ধরনের মতবাদ দিচ্ছেন। মডেল তৈরি করছেন। কিন্তু কোনোটাই ঠিক ত্রুটিমুক্ত নয়। রাদাফোর্ডের ভেতর খচখচানি একটা রয়েই গেল। তিনি পরমাণুর ভেতরের খবর পেতে চান। এর জন্য চাই একজন সংবাদবাহক। মানুষ নয়, কণা। ইলেকট্রন নিতান্তাই হালকা কণা, একে দিয়ে সংবাদবাহকের কাজ ঠিকঠাক করানো সম্ভব নয়। বেটা কণা তো ইলেকট্রনেরই স্রোত। গামার ভর নেই। চার্জও নেই। সে একেবারেই অচল। কিন্তু ভারি শক্তিশালী একটা কণা তো পাওয়া গেছে। আলফা কণা। ওকেই পাঠানো যাক না পরমাণুর ভেতরে। সে তো পরমাণুর ভেতরেই থাকে। এবার গিয়ে না হয় হাঁড়ির খবর নিয়ে আসবে।
এ জন্য করলেন একটা কালজয়ী পরীক্ষা। রাদারফোর্ডের স্বর্ণপাত পরীক্ষা নামে সেটা বিজ্ঞান ইতিহাসের স্বর্ণপাতে খোদাই হয়ে থাকবে মহাকালের বুকে। কিন্তু এ পর্বে সেটার আলোচনা করার সুযোগ নেই। তাই পাঠককে অপেক্ষা করতে হবে আগামী পর্বের জন্য।
[বইটির সূচীপত্র এবং সব খন্ডের লিংক একত্রে দেখুন এখানে]
-আব্দুল গাফফার রনি
বিজ্ঞান লেখক
[লেখকের ফেসবুক প্রোফাইল]
কোয়ান্টাম ফিজিক্স এ পদার্থের অসম আচরন সম্পর্কে জানতে চাই।