কাচ একটি স্বচ্ছ বস্তু। মূলতঃ সিলিকন-ডাই-অক্সাইড বা সিলিকা দিয়ে তৈরি। তার মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান আলো আপাতঃদৃষ্টিতে খুব সহজেই ভ্রমণ করতে পারে। অর্থাৎ সেই আলো কাচের পরমাণুদ্বারা শোষিত হয়ে যায় না। কিন্তু সাধারন কাচের প্রতিসরণাঙ্ক ১.৫, অর্থাৎ কাচের ভেতর আলোর গতি শূন্য মাধ্যমে আলোর গতির চাইতে প্রায় ৫০% কম, কাচে আলোর গতি সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটারের বদলে দুই লক্ষ কিলোমিটার। কেন আলো কাচের মধ্যে শ্লথ হয়ে যাবে?
অনেকে বলবেন কাচের পরমাণু আপতিত আলোকে শোষণ করে আবার বিকিরিত করে। এবং এইভাবে স্তরে স্তরে শোষিত ও বিকিরিত হতে হতে আলো কাচের মধ্যে দিয়ে ভ্রমণ করে। এই শোষণ ও বিকিরণেরর জন্য সময় লাগে, তাই কাচে আলোর গতিবেগ কম। কিন্তু কোন পরমাণু (আসলে পরমাণুর ইলেকট্রন) আলো বা ফোটনকে শুষে নিলে সেটি যখন বিকিরিত হবে সেটা যে কোন দিকে হতে পারে তাই এই প্রক্রিয়ায় আলো বিচ্ছুরিত (scattered) হয়ে যাবে এবং কাচ স্বচ্ছ বস্তু থাকবে না।
আলো হচ্ছে তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ। তড়িৎ-চুম্বকীয় বিকিরণের দুটি মূল অংশ- একটি হল তড়িৎ E ক্ষেত্র (electric field), অপরটি হল চৌম্বক B ক্ষেত্র (magnetic field)। এই দুটি ক্ষেত্র একে অপরের সাথে লম্বভাবে অবস্থান করে।
ওপরের ছবিটি থেকে এই ব্যাপারটা স্পষ্ট হবে। E ক্ষেত্রটি ওঠানামা করছে, সাথে সাথে B ক্ষেত্রটি ওঠানামা করছে, আর তড়িৎ-চুম্বকীয় বা EM তরঙ্গটি বাঁ থেকে ডান দিকে যাচ্ছে। ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ অনুযায়ী B ক্ষেত্র সৃষ্টি হয় পরিবর্তনশীল E ক্ষেত্র দিয়ে আর E ক্ষেত্র সৃষ্টি হয় পরিবর্তনশীল B ক্ষেত্র দিয়ে । তাই বলা যায় শূন্যস্থানে E এবং B একে অপরকে সৃষ্টি বা রক্ষা করতে করতে ভ্রমণ করে।
এই EM তরঙ্গ যখন একটি পরমাণুর ওপর আপতিত হয় তখন পরমাণুর ইলেকট্রন সেই তরঙ্গের E ক্ষেত্রকে অনুভব করে। বলা যায় আপতিত E ক্ষেত্র ইলেকট্রনের ওপর একটি বল সৃষ্টি করে।এই বলের পরিমাণ হল = (ইলেকট্রনের বৈদ্যুতিক আধান বা charge পূরণ E ক্ষেত্র । মূল EM তরঙ্গে E ক্ষেত্র যে কম্পাঙ্কে ওঠা-নামা করছিল ইলেকট্রনও সেভাবে ওঠানামা করতে চাইবে। তবে যেহেতু ইলেকট্রনের আধান ঋণাত্মক (নেগাটিভ), ইলেকট্রনের ওপর বলের দিক E ক্ষেত্রের বিপরীত দিকে হবে, অর্থাৎ E ক্ষেত্রের দিক ওপরের দিকে হলে ইলেকট্রন নিচের দিকে যাবে।
এখানে একটা মডেল কল্পনা করে নেয়া যেতে পারে যে ইলেকট্রনগুলো স্প্রিং দিয়ে নিউক্লিয়াসের সাথে বাঁধা। এবং এই E ক্ষেত্রের জন্য স্প্রিংয়ের দোলনে ইলেকট্রনগুলো সরল দোলগতির (বা simple harmonic motion SHM) মধ্যে আছে।
আলো বা EM তরঙ্গ যখন কাচের পরমাণুর ওপর আপতিত হয় তখন তার ইলেকট্রনরা আপতিত তঙ্গের E ক্ষেত্র অনুভব করে কম্পিত হয়, oscillate করে। যেহেতু তারা কম্পিত হয়, তারা ত্বরান্বিত হয়। কিন্তু তারা পরমাণু ছেড়ে দূরে চলে যায় না, বরং বলা চলে তারা ভারী ও স্থির ধনাত্মক নিউক্লিয়াসের দু-দিকে দোলনের মধ্যে থাকে বা যাওয়া-আসা করতে থাকে।
মূল আপতিত তরঙ্গ কিন্তু এই ইলেকট্রন দ্বারা শোষিত হয়ে যায় না। বরং সেই কাচের মধ্য দিয়ে ভ্রমণ করতে থাকে। এবং সেই ভ্রমণ পথে যত পরমাণু আছে তাদের ইলেকট্রনদের আন্দোলিত করতে থাকে। সেই ইলেকট্রনগুলো এখন EM তরঙ্গ বিকিরণ করবে কারণ তারা ত্বরান্বিত হচ্ছে। যে কোন তড়িৎ আধানযুক্ত কণা ত্বরান্বিত (বা accelerated) হলে সেটির থেকে EM বিকিরণ নির্গত হবে। এই ব্যাপারটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এই আলোচনাটি আর এক দিনের জন্য তুলে রাখা হল। আমরা এই EM তরঙ্গদের দ্বিতীয় পর্যায়ের EM তরঙ্গ বলব।
তাহলে কাচের মধ্যে আমরা দুটি পর্যায়ের তরঙ্গ পাচ্ছি। একটি হল মূল আপতিত বা প্রথম পর্যায়ের তরঙ্গ ও অপরটি হল দ্বিতীয় পর্যায়ের কাচের ইলেকট্রন থেকে নির্গত তরঙ্গ। প্রতিটি পরমাণুর স্তর থেকে দ্বিতীয় পর্যায়ের তরঙ্গ নির্গত হয়। এই তরঙ্গ প্রতিটি পরমাণু থেকে একটি গোলকের মত চতুর্দিকে বিস্তৃত হতে থাকে। এটা দেখানো সম্ভব যে দ্বিতীয় পর্যায়ের এই তরঙ্গগুলো শেষাবধি শুধুমাত্র সম্মুখে বিস্তার লাভ করে। পাশে ও পেছনে বিস্তৃত দ্বিতীয় পর্যায়ের তরঙ্গ অন্য পরমাণু থেকে নির্গত দ্বিতীয় পর্যায়ের তরঙ্গ দ্বারা বিলুপ্ত হয়ে যায়।
কেন বিলুপ্ত হবে সেই আলোচনাটা এখানে এখন করছি না। যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হল আমরা একটা প্রাথমিক তরঙ্গ পাচ্ছি আর একটা দ্বিতীয় পর্যায়ের তরঙ্গ পাচ্ছি। এই দুটি তরঙ্গই কাচের অপর পাশ দিয়ে বেরিয়ে আসবে। পৃথকভাবে দুটি তরঙ্গই আলোর গতিতে ভ্রমণ করবে। রিচার্ড ফাইনমানের বিখ্যাত তিন খণ্ডের পদার্থবিদ্যার পাঠ্যপুস্তকের প্রথম খণ্ডের ৩১ নম্বর পরিচ্ছেদে এই নিয়ে একটি আলোচনা আছে। ফাইনমান এই দুটি তরঙ্গের ধারনাটি নিচের ছবির মাধ্যমে দেখিয়েছেন।
এখানে দেখা যাচ্ছে যে কাচ পেরিয়ে যে transmitted wave সেটি মূল উৎসের তরঙ্গ Es ও কাচের পরমাণু থেকে সৃষ্ট Ea তরঙ্গের সমষ্টি।
কিন্তু আমরা জানি কাচের ভেতর আলোর গতি শূন্যস্থানে তার গতির তুলনায় প্রায় ৩৩% কম। সেটা কেমন করে সম্ভব?
এইখানে ব্যতিচারের (interference) ধারনাটি আনা প্রয়োজন। দ্বিতীয় পর্যায়ের তরঙ্গটির phase বা দশা প্রাথমিক তরঙ্গটির মত নয়, অর্থাৎ সেটির উঁচু-নিচু তরঙ্গ প্রাথমিক তরঙ্গের একটু পেছনে থাকে। নিচের চিত্রটি থেকে এই জিনিসটা পরিষ্কার হবে। এখানে x অক্ষ হচ্ছে সময় ও y অক্ষ হচ্ছে E ক্ষেত্রের মান।
এখানে প্রাথমিক তরঙ্গকে উঁচু বিস্তার (বা amplitude) দিয়ে দেখানো হয়েছে, দ্বিতীয় পর্যায়ের চূড়া প্রাথমিক চূড়া থেকে একটু পেছনে কারণ ইলেকট্রনকে আন্দোলিত করে দ্বিতীয় তরঙ্গ সৃষ্টি করতে একটু সময় লাগে। যে তরঙ্গটি কাচের অন্যপ্রান্তে বের হয়ে আসে সেটি হল প্রাথমিক ও দ্বিতীয় তরঙ্গের ব্যতিচার বা সমষ্টির ফলাফল। এই ফলাফলকে চূড়ান্ত তরঙ্গ হিসাবে ড্যাশ (- – -) দিয়ে দেখানো হয়েছে। দেখা যাচ্ছে চূড়ান্ত তরঙ্গের দশা বা অবস্থান সময়ের অক্ষে মূল প্রাথমিক তরঙ্গের একটু পেছনে। ব্যতিচারের ফলে কাচের অপর পাশে শুধুমাত্র চূড়ান্ত তরঙ্গটিই দেখা যাবে এবং সেটি মূল তরঙ্গ যখন বের হবার কথা ছিল তার পরে বের হবে। (এই চিত্রে সময় ডান দিকে বাড়ছে, অর্থাৎ চূড়ান্ত ড্যাশ রেখাটি মূল তরঙ্গের একটু ডানদিকে, অর্থাৎ সময় অনুযায়ী একটু বিলম্বে আছে)।
চূড়ান্ত তরঙ্গের (বা দশার) গতিবেগ সাধারণতঃ আলোর গতিবেগের চাইতে কম হয়, কিন্তু কোন কোন ক্ষেত্রে কম্পাঙ্কের ওপর নির্ভর করে আলোর গতিবেগের চাইতে বেশী হতে পারে, কিন্তু তা কেন আপেক্ষিকতা তত্ত্বের বিরোধী নয় সেটা নিয়েও আর এক দিন আলোচনা করা যাবে।
মূল কথা হল কাচের ভেতর দৃশ্যমান আলোর তরঙ্গের কোন শোষণ হয় না, এবং কাচের ভেতর একটি মূল আপতিত তরঙ্গ ও কাচের ইলেকট্রন থেকে উদ্ভূত তরঙ্গ একসাথে ভ্রমণ করে যদিও তাদের দশা বা phase এক নয়। এই দুটি তরঙ্গের সমষ্টি বা ব্যতিচারের দশার গতিবেগ আলোর গতিবেগের চাইতে কম যদিও একক ভাবে দুটি তরঙ্গই আলোর গতিতে ভ্রমণ করে।
[২ এবং ৪ নম্বর চিত্রদুটি Eugene Hecht’s Optics বই থেকে নেয়া।]
-দীপেন ভট্টাচার্য
বিজ্ঞানী ও গল্পকার