কোয়ান্টাম ফিজিক্স-১৮ : এক্স-রে ও তেজস্ক্রিয়তা

0
486

[বইটির সূচীপত্র এবং সব খন্ডের লিংক একত্রে দেখুন এখানে]

প্লাকার টিউব ও ক্যাথোড রশ্মি নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। তবে একজনের কথা বলা হয়নি। তিনিও এক জার্মান বিজ্ঞানী। পদার্থবিজ্ঞানের গন্ডি ছাড়িয়ে তাঁর অবদান সবচেয়ে বেশি জোরেশোরে উচ্চারিত হয় চিকিৎসাশাস্ত্রে। তাঁর আবিষ্কার এক্সরে বা রন্টজেন রশ্মি আজও চিকিৎসাশাস্ত্রে অপরিহার্য উপাদান। তিনি উইলহেম কোনার্ড রন্টজেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে তিনিও ক্যাথোড রশ্মি নিয়ে গবেষণা করছিলেন।

১৮৯৫ সাল। তখনও নিশ্চিত হয়নি ক্যাথোড রশ্মিই ইলেক্ট্রনের স্রোত। ৮ নভেম্বর। ল্যাবরেটির কাজকর্ম শেষ করে ঘরে ফেরার প্রস্ততি নিচ্ছিলেন রন্টজেন। টেবিলের ওপর ক্যাথোড টিউব ছিল। সেটাকে একটা কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে দিলেন। তারপর নিভিয়ে দিলেন ঘরের বাতি। এখানে একটা কথা বলে রাখা জরুরি। ক্যাথোড টিউবের আশপাশে বেরিয়াম প্লটিনোসায়াইডের প্রলেপ দেওয়া কাগজ রাখা ছিল। রন্টজেন ঘরের লাইট নিভিয়ে দিলেন, কিন্তু ক্যাথোড টিউবে সাথে সংযুক্ত বিদ্যুৎ প্রবাহমাত্র বন্ধ করেননি। হয়তো সুইচ বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিলেন।

ঘরের বাতি নেভানোর সাথে সাথে একটা আলোর ঝলক দেখতে পেলেন রন্টজেন। ঝলকটি দেখলেন বেরিয়াম প্লাটিনোসায়ানাইডের প্রলেপ দেওয়া কাগজের ওপর। থেমে গেলেন রন্টজেন। চমকেও উঠলেন। আবার ঘুরে এলেন। বারবার ক্যাথোড টিউবের সুইচ বন্ধ ও চালু করে দেখলেন। একই ঘটনা ঘটছে বারবার। এ ঘটনার ব্যাখ্যা কী?

রন্টজেন নিশ্চিত জানেন, আলোর ঝলক ক্যাথোড টিউবের ভেতর থেকে আসছে না। টিউবের ওপর রাখা ক্যাথোড রশ্মির ক্ষমতা নেই কালো কাপড় ভেদ করে বেরিয়ে এসে বেরিয়াম প্লাটিনোসায়ানাইডের পর্দায় ঝলক তোলার। তাহলে এই নতুন ঝলক নিশ্চয়ই অন্য কিছু। এবং সেটা আসছে ক্যাথোড নলের ভেতর থেকেই।

অনেক পরীক্ষা করে দেখলেন রন্টজেন। খুব বেশি কিছু জানতে পারলেন না সেই আলোক রশ্মি সম্পর্কে। শুধু জানতে পারলেন, বিদ্যুৎ প্রবাহমাত্রা বাড়ালেই সেই রশ্মির ভেদনক্ষমতা বাড়ে। এমনকী পুরু দেয়াল পর্যন্ত ভেদ করে যেতে পারে।

উইলহেম রন্টজেন
উইলহেম রন্টজেন

ঘটনার পরই বৈজ্ঞানিক মহলে হইচই ফেললেন না রন্টজেন। কেউই হয়তো বিশ্বাসই করতে চাইবে না।  তারপর নানাভাবে পরীক্ষা-নীরিক্ষা চালালেন। ফল সেই একই। সিদ্ধান্ত নিলেন ব্যাপারটা স্ত্রীকে জানানোর। সেটাও নাটকীয়ভাবে। একদিন ল্যাবে ডেকে নিলেন স্ত্রী বার্থাকে। ততদিনে এক্স-রে ব্যবহার করে ছবি তোলার প্রক্রিয়া শিখে গেছেন। নিজের মতো করে বানিয়ে নিয়েছেন ফটোগ্রাফিক প্লেট। বার্থাকে বললেন হাতটা ফটোগ্রাফিক প্লেটের ওপর রাখতে। তারপর এক্স-রে নিক্ষেপ করলেন প্লেটের ওপর। ফটোগ্রাফিক প্লেটটা ডেভেলপ করে নিয়ে এলেন রন্টজেন। ধরলেন বার্থার চোখের সামনে। চমকে উঠলেন বার্থা, ভয় পেলেন এবং চিৎকার করে উঠলেন। সেটাই স্বাভাবিক। রন্টজেন বার্থার সুস্থ-সবল হাতের ছবি তুলেছিলেন; কিন্তু ছবিতে তো হাতের কঙ্কাল দেখা যাচ্ছে। প্রতিটা হাঁড়, হাঁড়ের জোড়া চেনা যাচ্ছে স্পষ্ট করে। বার্থার হাতে একটা আংটি ছিল। সেটাও ছবিতে খুব ভালোভাবে বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু হাতের মাংস, চামড়ার ছবি বেশ হালকা।

পৃথিবীর প্রথম এক্স-রে ফটোগ্রাফ। রন্টজেনের তোলা বার্থার হাতের সেই ছবি
পৃথিবীর প্রথম এক্স-রে ফটোগ্রাফ। রন্টজেনের তোলা বার্থার হাতের সেই ছবি

বার্থাার হাতের সেই ছবি, সেটাই পৃথিবীর প্রথম এক-রে ফটোগ্রাফ। এরপর রন্টজেন সাজিয়ে-গুছিয়ে লেখা শুরু করলেন। এক্স-রে নিয়ে বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ। সেই প্রবন্ধে জুড়ে দিলেন বার্থার হাতের এক্স-রে ছবি। ৮ নভেম্বর প্রথম এই বিকিরণের খোঁজ পান রন্টজেন। কিন্তু সে খবর বিজ্ঞান দুনিয়াকে জানালেন ২৮ ডিসেম্বর। অবশ্য প্রবন্ধটা ছাপা হয় আরও পরে। রন্টজেন এই বিকিরণের নাম দিলেন ীÑরে। কারণ তিনি তখনো এই রশ্মি সম্পর্কে কিছুই জানতে পানেননি। প্রবন্ধটা ছাপা হবার পর রাতারাতি বিখ্যাত বনে গেলেন রন্টজেন। সারা পৃথিবীতে তুমুল আলোড়ন তুলল এক্স-রশ্মি।

এই আবিষ্কারের জন্য ১৯০১ সালের রন্টজেন পদার্থবিদ্যার নোবেল প্রাইজ পেলেন। তিনিই নোবেল বিজয়ী প্রথম পদার্থবিদ। ১৯০১ সালেই তো নোবেল প্রদান শুরু হয়।

রঞ্জন রশ্মি নিয়েও শুরু হয় জল্পনা-কল্পনা। যেমনটা হয়েছিল ক্যাথোড রশ্মি নিয়ে। রন্টজেন রশ্মি কী? তরঙ্গ না কণা? কেউ কেউ মনে করেছিলেন এটা হয়তো আলোই নয়। শব্দের মতো অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ।

১৮৯৬ সালের ২৩ জানুয়ারি রন্টজেনের প্রবন্ধ প্রকাশ হয়। সেটা দৃষ্টি আকর্ষণ করে জে জে থমসনের। তিনিও এক্স-রশ্মির কথা জানতেন বলে শোনা যায়। অজানা কারণে এটা নিয়ে তিনি হইচই করেননি। তবে তাঁর ছাত্রকে লাগিয়ে দিলেন এক্স-রশ্মির পেছনে। সেই ছাত্রই পরে প্রমাণ করেন এক্স-রশ্মি আসলে তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ। সেই ছাত্রটি হলেন বিখ্যাত বিজ্ঞানী আর্নেস্ট রাদারফোর্ড। রাদারফোর্ড তাঁর কাজ চালিয়ে যােচ্ছন। অন্যরাও কিন্তু বসে নেই। বিশেষ করে ফরাসী বিজ্ঞানী হেনরি বেকরেলের নাম না বললেই নয়। তিনিও রন্টজেন রশ্মি নিয়ে কাজ করছিলেনে।

হেনরি বেকরেল
হেনরি বেকরেল

ফেব্রুয়ারি, ১৮৯৬। হেনরি বেকরেলও নেমে পড়েছেন এক্স-রশ্মি নিয়ে গবেষণায়। তখনকার যুগে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আলোকরশ্মি নিঃসরণ করে এমন কিছু যৌগের কথা জানা ছিল বিজ্ঞানীদের। এসব যৌগগুলোকে ফসফরোসেন্ট পদার্থ বলতেন বিজ্ঞানীরা। এই পদার্থগুলো আলো বা তাপ শক্তি শোষণ করে ধীরে ধীরে আলো বিকিরণ করে। শক্তির যোগান বন্ধ হওয়ার পরও বহুক্ষণ ধরে চলে আলো বিকিরণ প্রক্রিয়া। আরেক ধরনের পদার্থ আছে। ফ্লোরোসেন্ট। শক্তির যোগান বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে এদের বিকিরণও বন্ধ হয়ে যায়।

বেকরেল এক ফসফরোসেন্ট পদার্থ নিয়ে কাজ করছিলেন। পদার্থটা হলো পটশিয়াম ইরোনাইল সালফেটের একটি ক্রিস্টাল। এটা শক্তি শোষণ করে আলোক রশ্মি বিকিরণ করতে পারে। বেকরলের মনে ছিল অন্য চিন্তা। তিনি দেখতে চেয়েছিলেন এই ক্রিস্টালটি যখন আলোকরশ্মি বিকিরণ করে তখন অন্য আলোর পাশাপাশি এক্স রশ্মিইও বিকিরণ করে কি-না।

বেকরেল একটা ফটোগ্রাফিক প্লেটকে কালো কাগজ দিয়ে মোড়ালেন। তারপর সেটাকে রাখলেন সূর্যের আলোতে। সূর্যের আলোক রশ্মি সেই কালো কাগজ ভেদ করে প্লেটের ওপর পড়বে না। বেকরেল কালো কাগজটির ওপর রাখলেন পটাশিয়াম ইউরোনাইল ফসফেটের সেই ক্রিস্টাল। সূর্যের সাধারণ আলো কালো কাগজ ভেদ করে ঢুকতে পারবে না ফটোগ্রাফিক প্লেটে। ঢুকতে পারবে না ক্রিস্টাল যেসব দৃশ্যমান আলোক রশ্মি বিকিরণ করে সেগুলোও। কিন্তু ক্রিস্টালটা যদি এক্স-রশ্মি বিকিরণ করে তাহলে সেটা ঢুকে পড়বে কালো কাগজ ভেদ করে। ফটোগ্রাফিক প্লেটে সেই রশ্মির ছাপ পড়বে। কয়েক ঘণ্টা রোদে রেখে দিলেন সেগুলো। পরে বেকরেল সবগুলো জিনিস তুলে নিয়ে গেলেন ল্যাবরেটরিতে। কালো কাগজ সরিয়ে ফটোগ্রাফিক প্লেটটাকে ডেভেলপ করলেন। দেখলেন, তাঁর অনুমানাই ঠিক। ফসফরোসেন্ট ক্রিস্টালটি সত্যি সত্যিই এক্স-রে বিকিরণ করেছে। সেই বিকিরণের ছাপ দেখা গেছে প্লেটটিতে।

অনুমান তো ঠিক হলো। এটা তো অন্যদেরও জানাতে হবে। তার আগে শতভাগ নিশ্চিত হওয়া চাই। এজন্য বেকরেল আরেকবার করতে চইলেন পরীক্ষাটি। সবকিছু আগের মতো করে প্রস্তুত করলেন। কিন্তু তাঁর কপাল মন্দ। হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল আবহাওয়া । মেঘের আড়ালে মুখ লুকিয়ে ফেলল সূর্য। সুতরাং আর এগুবে না পরীক্ষা। যতদিন আবহাওয়া ভালো নয়, ততদিন অপেক্ষা করা ছাড়া গতি নেই। কালো কাগজ মোড়ানো প্লেট আর ক্রিস্টালটাকে তুলে নিয়ে এলেন। তারপর সেগুলো ঢুকিয়ে রাখলেন ল্যাবরেটরির ড্রয়ারে। বেশ কয়েকদিন আবহাওয়া খারাপ হয়ে ছিল। তর সইছিল না বেকরেলের। কিছু একটা করতে হবে। তাই ড্রয়ারে রাখা কালো কাগজ মোড়া প্লেট, কিস্টাল বের করলেন সব।প্যাকেট খুলে প্লেটটা ডেভেলপ করলেন। কেন?

সেকথা আজও কেউ জানে না। প্লেট ডেভেলপ করার কোনো কারণ ছিল না। অকারণে করা সেই পরীক্ষায় অনেক অজনা তথ্য জানিয়ে দিল বিজ্ঞানকে।

ডেভেলপ করা প্লেটের দিকে তাকিয়ে অবাক হলেন বেকরেল। প্লেটের ওপর ঝাপসা আলোর রেখা। এটা এলো কোথা থেকে? আশপাশে চালু অবস্থায় কোনো এক্স-রে উৎসও নেই। তারমানে কোনো রকম শক্তি শোষণ না করেই ফসফরোসেন্ট কিস্টালটি এক্স-রে বিকিরণ করেছে! একেবারে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। এটা বিজ্ঞান ইতিহাসের আরেকটি যুগন্তকারী ঘটনা।

curies
গবেষণায় ব্যস্ত মেরি কুরি ও পিয়েরে কুরি

এর ব্যাখ্যা খুঁজতে লাগলেন বেকরেল। তারপর আবিষ্কার করলেন, এই ঘটনাটির জন্য পুরো ক্রিস্টালটি দায়ি নয়। পটাশিয়াম ইউরেনিয়াল সালফেট ক্রিস্টালের প্রতিটা অণুতে একটা করে ইউরেনিয়াম পরমাণু থাকে। সেই পরমাণুই আসলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এক্স-রে বিকিরণ করেছে। বেকরেল ইউরেনিয়ামযুক্ত আরও কিছু যৌগ নিয়েও পরীক্ষা করেছিলেন। সবগুলোতেই একই ফল পাওয়া গেছে। তারমানে ইউরেনিয়াম পরমাণুর বিশেষ ক্ষমতা আছে রশ্মি বিকিরণ করার। তবে বেকরেল কিন্তু পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলেন না বিকিরিত এই রশ্মিগুলো এক্স-রে কিনা। তাই তিনি সেই বিকিরণের নাম দিলেন ইউরেনাইল রশ্মি। পরে ফরাসী বিজ্ঞানী মেরি কুরি এ ধরনের সকল রশ্মির নাম দিলেন তেজস্ক্রিয় রশ্মি। যেসব মৌল তেজস্ক্রিয় রশ্মি বিকরণ করে তাদের নাম দেওয়া হলো তেজস্ক্রিয় পদার্থ।

বেকরেলের পর তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন ফরাসী দম্পত্তি মেরি কুরি ও পিয়েরে কুরি। তাঁরা ইউরেনিয়ামসমৃদ্ধ যৌগের পিচব্লেন্ড নিয়ে কাজ করছিলেন। পিচব্লেন্ড থেকে গবেষণার উপযোগী ইউরেনিয়াম খুঁজছিলেন তাঁরা। কিন্তু পিচব্লেন্ডের আচরণ ছিল অদ্ভুত। যে পরিমাণ তেজস্ক্রিয় রশ্মি বিকিরণ করার কথা তারচেয়েও অনেক বেশি পরিমাণ রশ্মি বিকিরণ করছিল পিচব্লেন্ড। কুরি দম্পত্তি নিশ্চিত হলেন, পিচব্লেন্ডে ইউরেনিয়াম ছাড়াও অন্য কোনো তেজস্ক্রিয় মৌল আছে। সেই মৌলের রশ্মি বিকিরণ ক্ষমতা ইউরেনিয়ামের থেকে অনেক বেশি। কিন্তু সহজে ধরা দিল না সেই অজ্ঞাত মৌল। প্রায় দুই বছরের কঠিন পরিশ্রমের পর অবশেষে পাওয়া গেল নতুন তেজস্ক্রিয় মৌল। তাও আবার দু-দুখানা। একটার নাম রাখা হলো পোলিয়াম। মেরি কুরির পৈত্রিক দেশ পোল্যান্ডের নামানুসারে। আরেকটি মৌল হলো বিখ্যাত রেডিয়াম।

[বইটির সূচীপত্র এবং সব খন্ডের লিংক একত্রে দেখুন এখানে]

-আব্দুল গাফফার রনি
বিজ্ঞান লেখক
[লেখকের ফেসবুক প্রোফাইল]

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.