এপিজেনেটিক্স: কিছু সংক্ষিপ্ত ধারনা

0
623

ধরা যাক আপনার জন্ম মোটেই স্বাভাবিক জন্ম নয়। আপনার জন্ম হয়েছে কোন এক গোপন ল্যাবরেটরিতে, আপনার এবং আপনার ক্লোনের একসাথে। তারপর এক্সপেরিমেন্টের উদ্দেশ্যে আপনাকে পাঠিয়ে দেয়া হল নানান সমস্যায় জর্জরিত এই বাংলাদেশে, অপরদিকে আপনার ক্লোনকে কোন উন্নত দেশে। আপনি এখানে খাচ্ছেন বিষাক্ত সবজি, ফরমালিন দেয়া মাছ, পানি মেশানো দুধ। অপরদিকে আপনার ক্লোন খাচ্ছে শুধুই অর্গানিক খাবার। আপনি স্কুলে বেত্রাঘাত সহ্য করে বড় হয়েছেন, অপরদিকে আপনার ক্লোন পেয়েছে বিশ্বমানের শিক্ষা। এই অবস্থায় আজ থেকে ১০ বছর পরে দেখা যাবে আপনি কোন এক দেশীয় প্রতিষ্ঠানে ৯টা-৫টা অফিস করেন, খুবই কষ্টদায়ক কাজ। প্রায়ই বাইরে বাইরে থাকতে হয়, নিজের জন্য সময় নেই বললেই চলে। অন্যদিকে আপনার ক্লোন হয়তো গুগল বা ফেসবুকে বসে মানুষের সময় কিভাবে হাইজ্যাক করা যায় সেই ফন্দি আটছেন। আপনাদের দুজনকেই তখন একসাথে করা হল, দেখা যাবে আপনাদের দুজনের মধ্যে মিল নেই বললেই চলে। আপনার ক্লোন হয়তো আপনার চেয়ে কিছুটা লম্বা, এবং স্বাস্থ্যবান। ত্বকের রং আপনার কালো হলে তিনি হয়তো উজ্জ্বল শ্যামলা, এমনকি আপনার চেয়ে তার মাথায় চুলের ঘনত্বও বেশী। অর্থাৎ, এমন নয় যে আপনারা শুধু দেখতে আলাদা, প্রকৃত পক্ষে আপনা দুজনেই সম্পুর্ন আলাদা মানুষ হয়ে গেছেন।

এখন আমি একজন জেনেটিক্সের ছাত্র যদি আপনাদের দুজনকেই ধরে আমার ল্যাবে নিয়ে যাই, এবং ডিএনএ-তে মাইক্রোস্কোপ রেখে দেখি, তাহলে দেখব আপনাদের ডিএনএ একই! একই জিনোমের কপি আপনারা আপনাদের প্রতিটি কোষে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে এতদিন, অথচ আপনাদের মাঝে কত অমিল। তাহলে এতদিন যে জানতাম আমাদের জিনগুলোই সকল বৈশিষ্ট্যের ভিত্তি, সেটা কোথায় গেল? এটা তো দেখি ব্যাখ্যার অতীত তথা ব্যাখ্যাতীত বিষয়!

এখন বলা যায়, আপনাদের জিনোম হচ্ছে একটা প্যারাগ্রাফ, যেখানে শব্দগুলো একই ক্রমে থাকে। কিন্তু যদি দাড়ি, কমা, এই চিহ্নগুলোর অবস্থান পরিবর্তন করে দেয়া হয়, তাহলে প্যারাগ্রাফটি যেই কথাগুলো ধারন করে- সেটাই বদলে যায়। যে শাস্ত্রে এই রকম জেনেটিক যতিচিহ্ন নিয়ে আলোচনা করা হয় তাকেই বলা হয় ‘জেনেটিক্সের অতীত’ বা এপিজেনেটিক্স।

এপিজিনোম আপনার জিনোম বা ডিএনএ কে পরিবর্তন করেনা, কিন্তু এটা নির্দিষ্ট করে কোন কোন জিন আপনার জীবদ্দশায় তার বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করবে এবং এই বৈশিষ্ট্য কি আপনার সন্তানদের মধ্যে এমনকি আপনার নাতি-নাতনী উত্তরাধিকার সূত্রে পাবে কিনা।

আমাদের দেহের লক্ষ লক্ষ কোষ আছে, আর কোষে আছে ডিএনএ। প্রতিটি কোষে ঠিক একই রকম ডিএনএ রয়েছে। আর ডিএনএ থাকলেই তো হয়না- আরো কিছু লাগে, এই যেমন এক প্রকার কার্বন যৌগ ‘মিথাইল গ্রুপ’। তো এরা কিভাবে জিনোম নিয়ন্ত্রন করে? মিথাইল গ্রুপ একটা জিনের সাথে যুক্ত হয়, যুক্ত হয়ে ওই জিনের বহন করা বৈশিষ্ট্য প্রকাশে বাধা দেয়। এইভাবে মিথাইলগ্রুপগুলো বিভিন্ন জিনের সাথে যুক্ত হয় এবং চোখের কোষ, জিহবার কোষ, ত্বকের কোষের জিনোমের মধ্যে একটা পার্থক্য তৈরি করে।
Forschungsbericht_Epicombing_Zillner_figure1

মিথাইল গ্রুপের সাথে সাথে এপিজেনেটিক্স আরেকটা জিনিস দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়। যার নাম হিস্টোন। এটা এক ধরনের প্রোটিন যার মধ্যে ডিএনএ প্যাচানো অবস্থায় থাকে ঠিক নাটাইয়ে যেভাবে সুতা প্যাচানো থাকে সেরকম। তবে নাটাইয়ের সাথে এর একটা পার্থক্য হল, হিস্টোন এর সাথে জড়ানো ডিএনএ আঁটোসাটোভাবে জড়ানো নাকি ঢিলেঢালা ভাবে জড়ানো সেটা নিয়ন্ত্রন করতে পারে। যদি ডিএনএ আঁটোসাটোভাবে জড়ানো থাকে, তাহলে কম সংখ্যক জিন তার বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করবে। যদি ঢিলেঢালাভাবে থাকে, তখন বেশি সংখ্যক জিন তার বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করতে পারবে।
histones_small

অর্থাৎ, সহজ ভাষায় চিন্তা করলে ব্যাপারটা এমন হয়। মিথাইল গ্রুপ কাজ করে সুইচের মত। অন্যদিকে হিস্টোন কাজ করে টিউনিং নবের মত। দেহের প্রতিটা কোষের আলাদা মিথাইলেশন এবং হিস্টোন প্যাটার্ন রয়েছে। এই মিথাইলেশন এবং হিস্টোন প্যাটার্নই একটা পেশীর কোষকে পেশী কোষ, একটা ত্বকের কোষকে ত্বকের কোষ হিসেবে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য বহন করে থাকে। তার মানে, জিনোমকে বলা যায় একটা কোষের হার্ডওয়ার অপরদিকে এপিজিনোমকে বলা যায় সফটওয়ার। সফটওয়ার শুধু হার্ডওয়ারকে বলে দেয় কি করতে হবে, বাকীটা হার্ডওয়ার নিজেই করে নেয়।

সাম্প্রতিক কালে আরেকটা উপায়ে জানা যায়, সেটা হচ্ছে মাইক্রো আরএনএ। মাইক্রো আরএনএ নিউক্লিয়াসে তৈরি হয়; এরা কোন প্রোটিন কোড করেনা কিন্তু সাধারন বার্তাবাহক আরএনএ-র সাথে যুক্ত হয়, তখন রাইবোজম ওই বার্তাবাহক আরএনএ-র সাথে আর কাজ করতে পারেনা। ফলে ওই বর্তাবাহক আরএনএ তার প্রোটিনকে কোড করতে পারেনা।
mr

তাহলে ডিএনএ বা হার্ডওয়ার সারা জীবন একই থাকলেও সফটওয়ারে কিন্তু পরিবর্তন হয়। কখনো আপগ্রেড হয়, কখনো ভাইরাস আক্রমন করে…নানান কিছু। তেমনি এপিজেনেটিক প্যাটার্নও পরিবর্তন হয়। এরাই বলে দেয় কোন জিনের প্রকাশ হবে কোনটার হবেনা।

সুতরাং, এপিজেনেটিক ইনফর্মেশন স্থায়ী নয়। এটা সারা জীবনই কোন না কোন পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যায়, বংশগতির মাধ্যমে ছড়ায় এবং কিছু কিছু সময় যেমন বয়ঃসন্ধিকালে অবশ্যই পরিবর্তন হয়। বয়ঃসন্ধিকালে বিশেষ কিছু অঙ্গের কোষে এপিজিনোম পরিবর্তন হয়, যায় ফলে সেখানে চুল গজানো শুরু হয়। আবার কিছু কিছু অংগের কোষের এপিজিনোমে পরিবর্তনের কারনে দেখা যায় হঠাৎ ব্রন গজানো শুরু হয়। আবার একজন গর্ভবতী অবস্থায়, সংশ্লিষ্ট অংগের এপিজিনোম পরিবর্তন হয় এবং একটি ভ্রুনকে পরিচর্যা করে মানবশিশুতে পরিনত করার জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ সৃষ্ট হয়।

এরকম বিশেষ সময়গুলো ছাড়াও নানান কারনে এপিজেনেটিক ইনফরমেশন পরিবর্তন হয়। আমরা কোন পরিবেশে থাকছি, কি খাচ্ছি, কি গন্ধ নিচ্ছি, প্রতিদিন কিরকম পরিশ্রম করছি এসবের প্রভাবেও এপিজিনোম পরিবর্তন হয়। বিজ্ঞানীরা সাম্প্রতিক কালে বলছেন, বাজে খাদ্যাভ্যাস মিথাইল গ্রুপকে ভূল জিনের সাথে যুক্ত হবার পথে পরিচালিত করে। ফলে কোষ ভূল তথ্য পায়, কোষের কাজ হয়ে পড়ে অস্বাভাবিক সবশেষে দেখা দেয় রোগ এমনকি ক্যান্সার হতে পারে।

এপিজেনেটিক্স একটি অপেক্ষাকৃত নতুন বিজ্ঞান। যদিও এই শব্দটির সাথে আমরা ১৯৭০ সাল থেকেই পরিচিত। গত ২০ বছর ধরে জিনোমের যে পরিবর্তন বা এপিজেনেটিক ট্যাগ গুলো সৃষ্টি হয় এর প্রভাব নিয়েই কাজ করা হচ্ছে। এক সময় ধারন করা হত সন্তানদের মধ্যে যাওয়ার আগে জিনোম থেকে এপিজেনেটিক ট্যাগ গুলো খসে পড়ে এবং সন্তানের দেহে নতুন ট্যাগের সৃষ্টি হয়। তার মানে আপনার হাজারটা বদ অভ্যাস, ক্রমাগত অপুষ্টি, খারাপ ধরনের কোন রোগ থাকলেও এর ফলে আপনার অনাগত সন্তানের কোন ক্ষতিই হচ্ছেনা। কিন্তু এই ধরনের ধারনা গুলো পরিবর্তন হচ্ছে। যদিও, অনেকগুলো বা বেশিরভাগ ট্যাগই খসে পড়ে। কিন্তু, কিছু কিছু ট্যাগ ঠিকই জিনোম কামড়ে পড়ে থাকে এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বিস্তার লাভ করে।

এই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে তথ্য পরিবহনের নতুন একটি ধারনা দিচ্ছে এপিজেনেটিক্স। সাম্প্রতিক কালে যে সব রোগ প্রায় মহামারীর মত দেখা যাচ্ছে- ডায়বেটিস, অটোইম্যুন ডিসর্ডার, ক্যান্সার। এগুলো কিন্ত, পূর্বসূরীদের মধ্যে ছিলোনা বললেই চলে। তাহলে ধারনা করা হচ্ছে আমাদের বাবা-মার থেকে এরকম পাওয়া এপিজেনেটিক তথ্যের কারনেই এমনটা হচ্ছে।

তাহলে কি দাড়ালো? আপনারা যদি সুস্থ্য সন্তান, নাতী-নাতনী চান তাহলে আপনাকেও সুস্থ্য থাকার চেষ্টা করতে হবে। যেকোন ধরনের বদভ্যাস থেকে দূরে থাকতে হবে। ভালো খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। তবে, যা দিনকাল পড়েছে। জিনোমে ট্যাগ লাগতে লাগতে হয়তো আমাদের জিনের চেয়ে ট্যাগের সংখ্যাই বেশি হয়ে গেছে।

হ্যা আমরা তাহলে অনেক কথা জানলাম। কিন্তু এখানে নতুন কি আছে? বাপ-দাদার পাপের ফল যে সন্তানদেরও ভোগ করা লাগে সেটাতো বাংলা সিনেমাতেও বলে। খারাপ খাদ্যাভ্যাস, বাজে পরিবেশ নিজের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। এই প্রভাব পরবর্তী প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়তেই পারে। এটাতো কমন সেন্সের ব্যাপার। তাহলে এটাকে আলাদা করে সায়েন্স বলার কি আছে?

আপনি যদি টুকটাক গণিত ভালোবাসেন, তাহলে হয়তো জানবেন ছোটখাটো সজ্জার একটা পাল্লার মধ্যে সবগুলো প্রাইম নাম্বার বের করা। এগুলো কমন সেন্স দিয়েই করা সম্ভব। এই ধারনাগুলো দিয়ে যখন কম্পিউটার প্রোগ্রাম লিখবেন তখন কিন্তু এটা বিজ্ঞানের অংশ। এই ধারনা গুলো ব্যাবহার করেই আরো অনেক উন্নত এলগরিদম তৈরি হয়েছে। তেমনি এপিজেনেটিক্সের ধারনা ব্যাবহার করে বিজ্ঞানীরা জানতে পারছেন কিছু কিছু ক্যান্সারের কারন এই এপিজেনেটিক ট্যাগগুলোর ভুল অবস্থান। তাই তারা এমন ড্রাগ ডিজাইন করছেন যার ফলে খারাপ জিন গুলো আগে থেকেই চুপ করানো, এবং ভূল এপিজেনেটিক ট্যাগ গুলো মেরামত করা সম্ভব হবে।

তাহলে ব্যাপারটা এই দাড়ালো, জিনোম আমাদের চারিত্রিক এবং বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যের নীল নকশা সেটা ঠিক। তবে, একটা মানুষ যদি বোকা অথবা স্বাস্থ্যহীন হয়। তাহলে কিন্তু এমন না যে সে খারাপ জিন বহন করছে। হাজারটা সামাজিক এবং পরিবেশগত ফ্যাক্টর জিনের এক্সপ্রেশনে প্রভাব রাখে। একজনের জিনোমে তার পূর্বপুরুষদের নেয়া কোন কোন সিদ্ধান্তের প্রভাবও বিদ্যমান। তার মানে, আপনি এই মুহুর্তে যে সিদ্ধান্তগুলো নিচ্ছেন, যেভাবে জীবন যাপন করছেন,  আপনি মারা যাওয়ার পরে যে জীবিত থাকবে তার মধ্যে সেই প্রভাব থাকবে। [ইতিপূর্বে বিজ্ঞান ব্লগে প্রকাশিত]

-রুহশান আহমেদ
জিন প্রকৌশল ও জৈবপ্রযুক্তির শিক্ষার্থী,
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
[লেখকের ফেসবুক প্রোফাইল]

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.