কোয়ান্টাম ফিজিক্স-১ : আলোর কণাতত্ত্ব ও এর ত্রুটি

4
2355

[বইটির সূচীপত্র এবং সবগুলো খন্ডের লিংক একত্রে দেখুন এখানে]

আলো বিজ্ঞানের অদ্ভুত এক চরিত্র। অন্যদের থেকে সতর্কভাবে নিজেকে আলাদা করে রেখেছে। তাই যুগে যুগে আলো বিজ্ঞানীদের কাছে রহস্যময় চরিত্রই তুলে ধরেছে। সেই রহস্য ভেদ করতে নাভিশ্বাঃস উঠে গেছে বিজ্ঞানীদের। এখন মোক্ষম প্রশ্নটা হলো, আলো কী? পদার্থ না শক্তি?
এ প্রশ্ন বহুদিনের। আলোর পদার্থ-বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া মুশকিল।

যে বস্তুকে ধরা-ছোঁয়া যায় সে বস্তু পদার্থ। পদার্থ বল প্রয়োগে বাঁধা দেয়। কঠিন, তরল ও বায়বীয় অবস্থায় পদার্থ থাকে।
কঠিন পদার্থ ধরা-ছোঁয়া যায়। এর নির্দিষ্ট আকার ও আয়তন আছে। তাপ দিলে কঠিন পদার্থ এক সময় বাধ্য হয়ে তরলে পরিণত হয়। চাপ প্রয়োগ করলেও তরলে পরিণত হয়। একসাথে চাপ-তাপ বাড়ালে তো কথাই নেই।

তবে কঠিনের চেয়ে কিছুটা সহজ সরল হলো তরল পদার্থ। এদের তরল রাখতে জোরাজুরি করা লাগে না। তাপ-চাপ প্রয়োগেরও দরকার হয় না। স্বাভাবিক চাপ ও তাপমাত্রায় তরল। যেমন পানি। তরলকে ছোঁয়া যায়। বল প্রয়োগে বাধাও দেয়। ।

তরলের নির্দিষ্ট আকার নেই। যখন যে পাত্রে রাখা হয় তখন সে পাত্রের আকার ধারণ করে। তবে তরলের নির্দিষ্ট আয়তন আছে। তাপ প্রয়োগ করে তরলকে গ্যাসীয় পদার্থে পরিণত করা যায়।

পদার্থের মধ্যে কেবল বায়বীয় বা গ্যাসীয় পদার্থই নিজের চেহারা দেখাতে ভালোবাসে না। অবশ্য জলীয় বাষ্প নিজের ভূতুড়ে চেহারাটা মাঝে মাঝে দেখিয়ে থাকে। গ্যাসীয় পদার্থের নির্দিষ্ট আকার-আয়তন কোনোটাই নেই। কিছু কিছু গ্যাসকে অবশ্য স্পর্শ করা যায়। যেমন-বাতাস। কিছু গ্যাস আবার স্পর্শানুভূতির বাইরে। গ্যাসের নির্দিষ্ট আকার ও আয়তন নেই। যখন পাত্রে রাখা হয় গ্যাস সে পাত্রের সবটুকু আকার ও আয়তন দখল করে নেয়। আসলে গ্যাসের অণুদের ভেতর তেমন ভাব-ভালোবাসা নেই। যতটা সম্ভব একে অপরের কাছ থেকে দূরে থাকা সম্ভব, সে চেষ্টাই করে।

তবে বল প্রয়োগে বাধা দেবার ক্ষমতা গ্যাসের আছে। ধরা যাক, একটা বেলুন। তার ভেতর গ্যাস ঢোকানো হচ্ছে। ধীরে ধীরে বেলুনটা ফুলতে থাকবে। এক সময় বেলুনের ভেতর আর গ্যাস ধরবে না। তখন আরও গ্যাস ঢোকালে গ্যাস বেলুনের গায়ে প্রচণ্ড চাপ তৈরি করবে। এক সময় বেলুন সেই চাপ আর সহ্য করতে পারবে না। ফটাস! ফেটে যাবে বেলুন। এই যে চাপ তৈরির ক্ষমতা আছে গ্যাসের, কেন? সে পদার্থ বলেই চাপটা তৈরি করতে পারছে। দুষ্টু একটা ছেলের সামনে একটা গ্যাসে ভরা বেলুন রাখা যাক। ছেলেটার হাতে ধরিয়ে দেওয়া যাক একটা ছোট্ট হালকা ঢিল। দুষ্টুটাকে বলতে হবে না কী করতে হবে। দুম করে গ্যাসভর্তি বেলুনের গায়ে বসিয়ে দেবে ঢিলখানা। বেলুনটি হয়তো সামান্য সরে যাবে। অথবা ঢিলটা বেলুনের ওপর বাউন্স করে অন্য দিকে চলে যাবে। বেলুন কিন্তু চুপসে যাবে না। এর মানে, ঢিলটা যে বল বেলুনের ওপর প্রয়োগ করছে, বেলুনও সেই বলটা ভেতরের গ্যাসের ওপর প্রয়োগ করছে। গ্যাসও সেই বল ফিরিয়ে দিচ্ছে বেলুনকে। বেলুন আবার সেই বল ফিরিয়ে দিচ্ছে ঢিলকে। পুরো ঘটনার পেছনের রয়েছে নিউটনের গতির তৃতীয় সূত্র।

গ্যাস পদার্থ বলেই সেটা তার ওপর প্রযুক্ত বলে ফিরিয়ে দিতে পারছে। তবে ঢিলের আকার যথেষ্ট বড় ও ভারি যদি হয়, দুষ্টু বালকের হাতের জোরও যদি বেশি হয়, তখন কিন্তু বেলুন ফেটে যাবে। সেক্ষেত্রেও গ্যাসের ভূমিকা আছে।

কঠিন, তরল, বায়বীয় কোনো পদার্থের বৈশিষ্ট্যই নেই আলোর মধ্যে। তাই আলোকে পদার্থের মর্যাদা দেওয়া যায় না।
তা হলে আলো কী?
অনেকে বলেন শুধুই শক্তি।

যেকোনো গতিশীল পদার্থকে বাধা দিয়ে থামানো যায়। আলোকে থামানো যায় না। এলেম আছে বেটার! চলার পথে বাধা এলে সে দিক পরিবর্তন করে অন্য দিকে চলে যায়। এক্কেবারে শিয়ালে-বুদ্ধি! তাই পদার্থের বৈশিষ্ট্য আলোর নেই। আলোর শক্তি আছে। আলো তাপ উৎপন্ন করতে পারে। শক্তি আছে বলেই পারে। আলোর গতি আছে। শক্তি না থাকলে গতি থাকার কথা নয়। সুতরাং আলো নিশ্চয়ই শক্তি বহন করে। কিন্তু প্রাচীন যুগে এটা প্রমাণ করার খুব বেশি উপকরণ ছিল না।

আলো নিয়ে সত্যিকার অর্থে গবেষণা শুরু করেন স্যার আইজ্যাক নিউটন। প্রচণ্ড রাগি, বদমেজাজি, অহঙ্কারী এই মহামানব না জন্মালে আমরা কোথায় পড়ে থাকতাম ভাবাই যায় না। আগে মানুষের ধারণা ছিল সূর্য বা নক্ষত্রের আলোর রং একটাই। সেটা হলো সাদা। অর্থাৎ সাদা আলোকে মৌলিক আলো বলেই জানত সবাই। তখন তা আর নিউটন জন্মাননি!

কিন্তু নিউটনের মনে এলো অন্য ভাবনা। রংধনুতে সাতটি রং কেন? রংধনুর আল্পনায় তো সাত রঙের বাহার। কিন্তু সে নিজে তো কোনো আলোক উৎস নয়। বাতাস ও মেঘ সূর্যের আলো ধার করে রংধনু বানায়। তাহলে রংধনু সাতটি রং পেল কোথায়। এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই নিউটনের মনে হলো সূর্যের সাদা আলো মৌলিক নয়। সাদা আলো হয়তো অনেকগুলো রঙের মিশ্রণ। কোনও একটা উপায়ে যদি একে ভাঙা যায়…।

নিউটন ছিলেন গ্যালিওর যোগ্য উত্তসুরি। গ্যালিলিও পরীক্ষা-নিরীক্ষামূলক বিজ্ঞানের প্রবাদ পুরুষ। তিনি দূর আকাশের গ্রহ-নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করার জন্য নিজের মতো করে দূরবীক্ষণ যন্ত্র বানিয়ে নিয়েছিলেন। বানিয়েছেনে সরল দোলকসহ নানা যন্ত্র। নিউটনও গ্যালিলিওর দেখানো পথে হেঁটেছিলেন। তিনি পরীক্ষার প্রয়োজনে নানা যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করেছিলেন। নিউটনের আবিষ্কৃত যন্ত্রপাতিগুলোর মধ্যে অন্যতম সেরা যন্ত্র ছিল প্রিজম। প্রিজম হলো পাঁচ তল বিশিষ্ট একটা কাচের পিরামিড। অবশ্য খুব ছোট। প্রিজম ব্যবহার করেই নিউটন সাদা আলোকে ভাঙতে সক্ষম হলেন। এজন্য তাঁকে একটা পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হয়েছিল।

১৬৬৫ সাল। নিউটন একটা বদ্ধ অন্ধকার ঘর বেছে নিলেন পরীক্ষাটির জন্য। ঘরের একপাশের দেয়ালে ছোট্ট একটা ছিদ্র রাখলেন। সেই ছিদ্র দিয়ে ঘরে ঢুকল সূর্যের সাদা আলোর লম্বা রশ্মি। সেই রশ্মির অভিমুখে নিউটন প্রিজম ধরলেন। তখন প্রিজমের ভেতর দিয়ে যেতে হলো রশ্মিকে। উল্টো দিকে রেখেছিলেন একটা পর্দা। নিউটন লক্ষ্য করলেন, প্রিজমের ভেতর দিয়ে আসা সাদা আলোক রশ্মি পর্দায় পড়েছে সাত রঙে ভাগ হয়ে। নিউটন যেমনটা অনুমান করেছিলেন ঠিক সেই ভাবেই ভেঙেছে আলো। রংধনুতে যেভাবে সাতটি রং পরপর সাজানো থাকে সেই ক্রমেই পর্দার ওপর সাত রঙের পট্টি তৈরি হয়েছে। রঙগুলোর সংজ্জাটাও রংধনুর মতো। প্রথমে বেগুনি। তারপর নীল। এরপর একে একে আসমানী, সবুজ, হলুদ, কমলা ও লাল রঙ পরপর বসেছে।
Picture2

রংধনুতে ধনুকের ভেতরের দিকে থাকে বেগুনি রঙের পট্টি। সবার ওপরে থাকে লাল।
নিউটন ভাবলেন, সাদা আলো কেন এভাবে ভাঙল। তাহলে আলো কি কোনো কণা?
নিউটন নিশ্চিত করে বললেন, আলোক রশ্মি শুধু রশ্মি নয়। কণার সমষ্টি। আলো যে কণা এর পক্ষে বড় প্রমাণ আলো সোজা পথে চলে। আলোর কণাতত্ত্বের পক্ষে আরেকটা বড় প্রমাণ হলো আলো প্রতিফলন।
আলো কোনো বস্তুর ওপর পড়ে বলেই আমরা সেটাকে দেখতে পাই।

কিন্তু কেন দেখি?
আলো প্রতিফলিত হয় বলে। আলোক রশ্মি যখন কোনো বস্তুর ওপর পড়ে সেখান থেকে কিছু আলো প্রতিফলিত হয়ে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিফলিত হয়ে ছড়িয়ে পড়া সেই আলোক রশ্মি এসে আমাদের চোখের রেটিনায় আঘাত করে। মস্তিষ্কের এক বিশেষ পর্দায় সে বস্তু থেকে আলো প্রতিফলিত হচ্ছে সে বস্তুর একটা প্রতিবিম্ব তৈরি হয়। তখন আমরা বস্তুটাকে দেখি।
অবশ্য প্রাচীন গ্রীসে আলোকে পদার্থই মনে করা হত। অ্যারিস্টোটলের আগেই গ্রীসের পণ্ডিতরা মনে করতেন, পৃথিবীসহ গোটা মহাবিশ্ব তৈরি হয়ে চারটি মাত্র মৌলিক পদার্থ দিয়ে। মাটি, পানি, বাতাস আর আগুন বা আলো দিয়ে।

নিউটন সাত রঙের এই আলোক পট্টির নাম দিলেন স্পেকট্রাম। ল্যাটিন ভাষায় শব্দ। এর অর্থ ভূত। বাংলায় স্কেপট্রামের নামকরণ করা হলো বর্ণালী।

এখন প্রশ্ন হলো প্রিজমের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় আলোগুলো ভাঙল কেন?
নিউটন নিজের মত করে হিসেব করে নিলেন। তাঁর ধারণা প্রিজমের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় সাতটা আলো বিভিন্ন কোণে বেঁকে যায়। তাই প্রিজম থেকে বেরিয়ে এরা আলাদা আলাদা রঙের বর্ণালী গঠন করে।

কণাবাদের ওপর নিউটনের অগাধ আস্থা। তিনি ধরে নিলেন যেহেতু সাদা আলোকে ভাঙা যায়, তাহলে নিশ্চয় আলো কণাধর্মী। কনাধর্ম না থাকলে আলোকে ভাঙা সম্ভব হত না। কণা মানেই ভর থাকা উচিৎ। আজকের অত্যাধুনিক যুগে ভরহীন কণার কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু সেই মধ্যযুগে একথা কেউ ভাবতেই পারত না। নিউটন ভাবলেন। শুধু ভাবেননি, তিনি বললেন, আলো আসলে ভরহীন কণা।

কিন্তু আলোকে কণা হিসেবে বিবেচনা করলে বেশ কিছু সমস্যাও থেকে যায়। সেই সমস্যা সম্পর্কে জানার আগে আমরা একটু আলোর গতি নিয়ে আলোচনা করতে পারি।

নিউটন আলোর কণা ধর্ম প্রতিষ্ঠা করলেন ঠিকই, কিন্তু তিনিও জানতেন না আলোর গতি কত। আদিকাল থেকেই মানুষ মনে করত আলোর গতি অসীম। ১৬৭৫ সালে ভুলটা ভাঙালেন ডাচ পদার্থবিদ ওলে ক্রিস্টেনসন রোমার। তিনি তখন কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। রোমার বৃহঃস্পতি গ্রহের উপগ্রহের গ্রহণকাল পর্যবেক্ষণ করেছিলেন।

আমরা সূর্যগ্রহণ দেখতে পাই, দেখতে পাই চন্দ্রগ্রহণ। শুধু আমাদের চাঁদেই গ্রহণ লাগে না। সৌরজগতের অন্যান্য উপগ্রহগুলোতেও গ্রহণ লাগে। সে নিয়মের ব্যতিক্রম হয় না বৃহঃস্পতির উপগ্রহগুলোও।

বহু আগে থেকেই জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বৃহঃস্পতির উপগ্রহগুলোর ভবিষদ্বাণী করতে জানতেন। কিন্তু সে বছর রোমার এক আশ্চর্য ব্যাপার লক্ষ করলেন। সূর্যের চারদিকে একবার ঘুরে আসতে বৃহস্পতির সময় লাগে ১১.৮৬ বছর। আর পৃথিবীর সময় লাগে ১ বছর। তাই বছরে একটা নির্দিষ্ট সময়ে আর বৃহঃস্পতি ও পৃথিবীর মধ্যে দূরত্ব সবচেয়ে বেশি হয়। আবার একই বছরে একটা সময় দূরত্ব সবচেয়ে কম হয়। অর্থাৎ পৃথিবী আর বৃহঃস্পতির মধ্যে দূরত্ব সবসময় এক থাকে না।

রোমার লক্ষ করলেন বৃহঃস্পতি যখন পৃথিবীর খুব কাছে থাকে তখন বৃহঃস্পতির উপগ্রহগুলোর গ্রহণ ভবিষদ্বাণী ঠিকঠাক মানে না। পূর্বানুমানের কয়েক মিনিট আগেই গ্রহণ লেগে যায়। আবার বৃহঃস্পতি যখন সবচেয়ে দূরে থাকে তখন পূর্বানুমানের কয়েক মিনিট পরে উপগ্রহগুলোর মধ্যে গ্রহণ লাগে।

এটা কেন হলো?
আলোর গতি যদি অসীম হয় মানে আলো যদি তাৎক্ষণিক ঘটনা হয়, তাহলে এক বস্তু থেকে আরেক বস্তুতে যেতে আলোর সময় লাগার কথা নয়। কিন্তু বৃহঃস্পতির উপগ্রহগুলোর গ্রহণ বলছে ভিন্ন কথা। আলো যদি তাৎক্ষণিক হতো তাহলে বৃহঃস্পতি যেখানেই থাক উপগ্রহগুলোর গ্রহণ ভবিষ্যদ্বাণী মেনে চলত। তার মানে, দূরত্ব আলাদা বলে সেখানকার দুই স্থান থেকে আলো পৃথিবীতে আসতে দুরকম সময় লাগছে। আলোর গতি অসীম হলে তো তা হবার কথা নয়। রোমার নিশ্চিত হলেন, আলোর গতি অসীম নয়। হয়তো খুব বেশি।

সেটি কত?
রোমার হিসাব করে দেখলেন আলোর বেগ সেকেন্ডে ১, ৯১, ৭৬৭ মাইল। রোমারের হিসাব নিখুঁত ছিল না। সূক্ষ্মভাবে সময় মাপতে পারে এমন ঘড়িও তখন ছিল না। তাছাড়া পৃথিবীর কক্ষপথ গোলাকার ধরে হিসাব কষেছিলেন রোমার। আসলে তা উপবৃত্তকার। পৃথিবীর কক্ষপথের ব্যাসও নির্ভুল ভাবে জানতেন না তিনি। তবুও রোমার যা করলেন তা বিজ্ঞানের ইতিহাসে বিপ্লব ঘটিয়ে দিল।

এরপরে ১৮৪৯ সালে ফিজো আলোর গতি মাপেন সেকেন্ডে ৩.১৩ লক্ষ কিলোমিটার। ১৮৬২ সালে ফুকো মাপেন ২ লক্ষ ৯৮ হাজার কিলোমিটার। সবচেয়ে নির্ভুল হিসেবটা আসে অ্যামেরিকান পদার্থবিদ আলবার্ট মাইকেলসনের হিসাব থেকে। তিনি আলোর গতি মাপেন ২.৯৯৭৯ লক্ষ কিলোমিটার। রোমারের বড় কৃতিত্বটা হলো, তিনি আলোর গতি মেপেছিলেন নিউটনের প্রিন্সিপিয়া অব ম্যাথমেটিকা প্রকাশের অনেক আগেই। এই বই প্রকাশের আগে গ্রহের গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে অনেক কিছুই জানতেন না বিজ্ঞানীরা।

আলোর গতির একটা নির্দিষ্ট মান যখন বেরোল, নিউটনের কণাতত্ত্ব আরও জোরালো হলো। যুক্তি দেখানো গেল, আলো কণা বলেই তার গতি নির্দিষ্ট। আর নির্দিষ্ট গতি মানেই তা নিউটনের গতিতত্ত্ব মানতে বাধ্য। আর এই জায়গায়ই হলো মস্ত ভুল।
কণাতত্ত্বের সাহায্যে আলোর প্রতিফলন, প্রতিসরণ ব্যাখ্যা করা যায়। আলো কোনো স্বচ্ছ মাধ্যমে আপতিত হলে তিনটি ঘটনা ঘটে। স্বচ্ছ মাধ্যম হিসেবে আমরা স্বচ্ছ কাচের কথা ভাবতে পারি। স্বচ্ছ কাচের ওপর আলো পড়লে এর কিছু অংশ প্রতিফলিত হয়ে ফিরে আসে। একেই আলোর প্রতিফলন বলে। তবে আলোর সবচেয়ে ভালো প্রতিফলক হলো আয়না।

দ্বিতীয়টা হলো, কিছু আলো এই স্বচ্ছ কাচ শোষণ করে নেয়। তৃতীয় ঘটনা হলো, স্বচ্ছ কাচের ভেতর দিয়ে আলোক রশ্মির বাকি অংশ কাচের ভেতর দিয়ে চলে যায়। একে আলোর প্রতিসরণ বলে।

আলোর প্রতিফলন, প্রতিসরণ ঘটনাগুলো কণাতত্ত্ব দ্বারা ভালোভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। কিন্তু আলোর ব্যাতিচার, অপবর্তন, সমবর্তন, বিচ্ছুরণ ইত্যাদি বিষয়গুলো কণাতত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। আলো কাচের ওপর পড়লে প্রতিফলিত হয় কেন?
এর জবাবে বলা হয়েছে আলোর যে তা হলে প্রতিফলিত হয় সেখানে আলোর কণাগুলোর ওপর এক ধরনের বিকর্ষণ বল কাজ করে। কিন্তু আলোর কণিকাদের ওপর এই আকর্ষণ ও বিকর্ষণ কীভাবে ক্রিয়া করে এবং এর উৎসই বা কী, তা আলোর কণাতত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে পারে না।

কোনো উৎস থেকে অবিরামভাবে আলোর কণা নিঃসৃত হলে ওই উৎসের ভর কমে যাওয়ার কথা। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে উৎসের ভর কখনও কমে না। তাহলে কি আলোর কণা ভর শূন্য। নিউটন সেটাই মনে করতেন। কিন্তু নিউটনের সময় ভরহীন কণার কথা বিজ্ঞানীরা কল্পনাও করতে পারতেন না।

নিউটন কিন্তু একটা বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। আলো শূন্য মাধ্যমে চলে কীভাবে? নিউটন ভাবলেন আমরা যেটা শূন্যস্থান ভাবি, আদৌ সেটা শূন্যস্থান নয়। তিনি ফিরিয়ে নিয়ে এলেন ইথার তত্ত্ব। ইথার বিষয়ে পরে আরও আলোচনা করা হবে।

[বইটির সূচীপত্র এবং সবগুলো খন্ডের লিংক একত্রে দেখুন এখানে]

-আব্দুল গাফফার রনি
বিজ্ঞান লেখক
[লেখকের ফেসবুক প্রোফাইল]

বিজ্ঞান পত্রিকা প্রকাশিত ভিডিওগুলো দেখতে পাবেন ইউটিউবে। লিংক:
১. টেলিভিশনঃ তখন ও এখন
২. স্পেস এক্সের মঙ্গলে মানব বসতি স্থাপনের পরিকল্পনা

4 মন্তব্য

  1. বিজ্ঞান পত্রিকার সম্পাদক এর কাছে অনুরোধ এই যে, প্রকাশিত সব আর্টিকেল অনলাইন পত্রিকার পাশাপাশি যদি পি.ডি.এফ আকারে ডাউনলোড করার সুবিধা থাকে তবে জ্ঞান আহোরন এবং ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য বড় বেশি সুবিধা হয়!

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.