যখন কনসেটা এন্টিকো কোন পাতার দিকে দৃষ্টি দেন তখন তিনি সবুজ ছাড়াও আরো কিছু দেখেন। “প্রান্তের কাছাকাছি কমলা, লাল কিংবা রক্তবর্ণ দেখতে পারি। আপনি হয়তো গাঢ় সবুজ দেখে থাকবেন কিন্তু আমি বেগুনী, নীল ফিরোজা দেখতে পারি। ঠিক যেন একটি রং এর মোজাইক সদৃশ।” এমনটিই বলছিলেন তিনি।
এন্টিকো শুধু রং উপলব্ধিই করতে পারেন না তিনি একজন শিল্পী যিনি প্রতিচ্ছায়াবাদি ধারায় ছবি আকতে পারেন। তাঁর মাঝে টেট্রাক্রোমেসির (Tetrachromacy) উপস্থিতি থাকার জন্যে তিনি চোখ দিয়ে অধিক রং শুষে নিতে পারেন। পার্থক্যটি রয়েছে মূলত এন্টিকোর চোখের কোনকোষ এবং গঠনের মাঝে যা আলো তরঙ্গরশ্মির দৈর্ঘ্য পরিমাপ করে মস্তিষ্কে প্রেরণ করতে পারে। প্রতিটি মানুষের সাধারণতঃ তিন ধারনের রঞ্জক বিশিষ্ট কোণ কোষ থাকে যা তাকে প্রায় ১ মিলিয়ন রং দেখতে সক্ষম করে তোলে। কিন্তু এন্টিকোর রয়েছে চারটি কোণ যার মাধ্যমে তিনি রং-এর ১০০ মিলিয়ন গুন বেশি মাত্রা ও এর বিস্তার উপলব্ধি করতে সক্ষম হন।, যেটা সচরাচর মানুষ উপলব্ধি করতে পারেনা। এন্টিকো বলেন, “আমার খুব খারাপ লাগে ভেবে যে মানুষ কত অল্প রং দেখতে পারে।”
একটি অনন্য জেনেটিক পরিবর্তন এবং অসাধারণ পরিণত মস্তিষ্ক যা কনসেটা এন্টিকোকে বিশ্বের অন্য সকল চিত্র শিল্পী থেকে আলাদা করেছে।
যদিও টেট্রাক্রোমেটসদের (যাদের চার ধরনের কোণ) চোখে অধিক রিসেপ্টর কোষ রয়েছে তবুও সাধারণ দৃষ্টিসম্পন্ন লোকদের মতোই তাদের মস্তিষ্কের গঠন। তাহলে কিভাবে এন্টিকোর মস্তিষ্ক এতো রং দেখার জন্য পরিবর্তিত হয়?
বছরের পর বছর ধরে গবেষকরা নিশ্চিত ছিল যে টেট্রাক্রোমেসির অস্তিত্ব নেই। যদি এটা হতো তাহলে দুটো এক্স-ক্রোমোযোমের মানেুষের মাঝেই এর উপস্থিতি থাকতো। রং অনুধাবনের পেছনের কারণ হচ্ছে জিনের উপস্থিতি। সাধারণ দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষের তিনটি কোণ রয়েছে যার মাধ্যমে সে লাল, সবুজ ও নীল রংএর তরঙ্গদৈর্ঘ্য দেখতে পারে। আর এগুলো এক্স-ক্রোমোজোমের সংযুক্ত যা সব মানুষের মাঝেই রয়েছে একটি কিন্তু নারীদের ক্ষেত্রেই দুটো এক্স ক্রোমোজোম থাকে। এক্স-ক্রোমোজোমের পরিব্যপ্তির জন্যই একজন ব্যক্তি রং কম বেশি দেখে থাকে, যার কারণে পুরুষরা জন্মগতভাবেই নারীদের অপেক্ষা বেশি বর্ণান্ধ হয়ে থাকে(যদি তাদের একটি এক্স-ক্রোমোজোম পরিব্যপ্তি হয়ে থাকে)। কিন্তু তত্ত্ব বলছে যদি একজন ব্যক্তির এক্স-ক্রোমোজোম রূপান্তরিত হয় তবে তার স্বাভাবিক তিনটি কোণের পরিবর্তে চারটি কোণ থাকবে ।
এন্টিকোর এই ঘটনাটিকে গবেষকরা ২০১২ সালে টেট্রাক্রোমেটিক হিসেবে নিশ্চিত করেন। বিশ্বের এক শতাংশ মানুষকে টেট্রাক্রোমেটিক হিসেবে বিবেচনা করা হয় কিন্তু এটা প্রয়োগিক অর্থে প্রদশন করা সহজ নয়। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবহারিক বিজ্ঞানী মিবার্লি জেমসন এর মতে, “একজন টেট্রাক্রোমেট এবং একজন স্বাভাবিক দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যাক্তির মাঝের পার্থক্য একজন বর্ণান্ধ ও স্বাভাবিক দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তির মধ্যে যে বিস্তর পার্থক্য সেরকমটা নেই।” তিনি এবং তাঁর সহকর্মি এলিসা উইংকলার নেভাডা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত এক বছর যাবৎ এন্টিকোকে নিয়ে গবেষণা করছেন টেট্রাক্রোমেসি ভালোভাবে বোঝার জন্য। রং উপলব্ধির পার্থক্য শনাক্ত করা অনেকটাই কঠিন কারণ এগুলো খুবই ক্ষুদ্র। জেমসন বলেন বর্তমানে যে পরীক্ষা চালানো হচ্ছে তা লাল, সবুজ ও নীল এই তিনটি রংয়ের বেশি রঞ্জকের জন্য করা যায়না।
এন্টিকোর জিনের উপর ভিত্তি করে জেমসন এটা নির্ধারণ করেন যে, “এন্টিকোর চতুর্থ কোণটি লালচে, হলুদ এবং কমলা রং শোষণ করতে পারে কিন্তু এন্টিকোর চোখে এখন কি কি রং আসছে তা নির্ধারণ অনিশ্চিত।” যেহেতু পরীক্ষার মাধ্যমে তরঙ্গদৈর্ঘ্য পরিমাপ করা যাচ্ছে না সেহেতু গবেষণামূলক ভাবে কোন তথ্য এই মুহূর্তে প্রদর্শন করা সত্যিই কঠিন।
টেট্রাক্রোমেটসদের মস্তিষ্ক কিভাবে কাজ করে তা জানার জন্য জেমসন এবং উইংকলার আরও টেট্রাক্রোমেটস খুঁজছেন। জেমসন বলেন, “যদি আপনার অক্ষিপটে অতিরিক্ত একটি কোণের উপস্থিতি থেকে থাকে তবে বাইরে থেকে কোন সংকেত অক্ষিপটে পাঠানো হলে তা কি আকার ধারণ করে। এই কর্মপদ্ধতিটিই আমরা জানতে চাচ্ছি।” এটা সম্ভবত মস্তিষ্কের গঠন পদ্ধতিই নিজস্বভাবে কাজ করে থাকে যখন প্রয়শই নির্দিষ্ট কিছু সংকেত আসতে থাকে। এই ধারণাকে নিউরোপ্লাষ্টিসিটি বলা হয়। কিছু মানুষ ও প্রাণির উপর এই নিউরোপ্লাষ্টিসিটি নিয়ে গবেষণা পরিচালনা করা হয়েছে।
যদিও পৃথিবীতে আরো অনেক টেট্রাক্রোমেটসদের উপস্থিতি বিদ্যমাণ রয়েছে কিন্তু তারা ভিন্ন রং উপলব্ধি করতে পারেন না কারণ তাদের মস্তিষ্ক এ বিষয়ে প্রশিক্ষিত নাও থাকতে পারে। এন্টিকোর ক্ষেত্রে এই বিষয়ের উপস্থিতি অনেকটা বিরল। এন্টিকো বলেন, “আমি পাঁচ বছর বয়সী অন্য সাধারণ শিশুদের থেকে আলাদা ছিলাম, সাত বছর বয়সে আমি ছবি আঁকা শুরু করি। রং আমাকে খুব মুগ্ধ করতো।”
-শফিকুল ইসলাম