পৃথিবীকে মানুষ একাই বদলাচ্ছে বলে আমরা ভাবতে পারি। কিন্তু সরলতর প্রাণ বহু আগে থেকেই এ গ্রহকে রূপান্তরিত করে আসছে।
১.
প্রাণের সাথে পাথরের কোন সংস্রব নেই – কেউ এমনটা ভাবলে তাকে অবহেলে মার্জনা করা যায়। উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞান সিলেবাস থেকে শুরু করে উইকিপিডিয়ার নিবন্ধসহ সবখানে জীববিজ্ঞানের সাথে ভূবিদ্যার প্রাতিষ্ঠানিক বিচ্ছিন্নতা দৃঢ়-প্রতিষ্ঠিত। এ বিচ্ছিন্নতা উদ্ভিদ, প্রাণি ও খনিজের ভিন্নতার সাথে তুলনীয়। এই তিন ভাগের মধ্যে প্রভেদ করেছিলেন আঠারশ’ শতকের সুইডিশ উদ্ভিদবিদ কার্ল লিনিয়াস। কারণ সুগন্ধী গোলাপ এক টুকরো শীতল গ্রানাইটের চাইতে আলাদা আর কিই বা হতে পারে?
খনিজ আকরিক বলতে সাধারণত প্রকৃতিতে পাওয়া যায় এমন অজৈব পদার্থ বোঝানো হয়। এদের বৈশিষ্ট্য হলো এরা সংমিশ্রিত হয়ে বিভিন্ন পাথর তৈরি করে। এই কিছুদিন আগেও অনেক ভূবিজ্ঞানী ভাবতেন যে চারপাশের অধিকাংশ পাথর পৃথিবীর শুরু থেকেই আছে। ভাবতেন, প্রাণের উদ্ভবের অনেক আগ থেকেই পাথরগুলো বিদ্যমান। এমনকি বিভিন্ন প্রাণীর খোল, দাঁত ও হাড় তৈরির জন্য জীবদেহ থেকে নিঃসৃত পদার্থে তৈরি ক্যালসাইট ও অ্যাপাটাইটের মতো জৈবখনিজগুলোও আসলে অতিপ্রাচীন ও সুলভপ্রাপ্য অজৈব পদার্থের উদাহরণ। তাই যখন আমি আমার পিএইচডি উপদেষ্টাকে প্রশ্ন করলাম স্নাতক-শিক্ষাকে সুদৃঢ় করার জন্য জীববিজ্ঞানের কোন কোর্স নেয়া উচিত কিনা, বিস্ময় ছাড়াই বোধগম্য হয় কেন তাঁর উত্তর ছিলো: “কেন? তুমি একজন খনিজবিদ। তোমার কোন দিনও জীববিজ্ঞান লাগবে না!”।
পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার হ্যামার্সলে রেঞ্জে লৌহখনিজের রঙিন স্তর। ছবি তুলেছেন ফ্যান্স ল্যান্টিং।
বিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে আমি কর্মজীবন পার করেছি অণুজীব ও খোলকী মলাস্কা, দাঁত ও হাড় সম্পর্কে অজ্ঞতার সাথে বসবাস করে। তবে ১৯৯৬ সালে যখন প্রাণের উৎপত্তি নিয়ে গবেষণা শুরু করলাম, তখন থেকে এ বিষয়ে আমার উপলদ্ধি বদলাতে শুরু করে। চার দশক আগে যুক্তরাষ্ট্রের রসায়নবিদ স্ট্যানলি মিলার ও হ্যারল্ড ইউরি তাঁদের বিখ্যাত পরীক্ষায় পৃথিবীর প্রাথমিক বছরগুলোর পরিবেশ গবেষণাগারে নকল করেন। উদ্দেশ্য ছিলো পরীক্ষাগারে পানি (সাগর), বাষ্প (বায়ুমন্ডল) ও ক্ষুদ্র স্ফুলিঙ্গ (বিজলী চমক) মিশিয়ে জীবনের প্রাথমিক অণুগুলো তৈরি করা। মিলার-ইউরি পরীক্ষায় খনিজ পদার্থ ছিলো না। এ পরীক্ষায় কোন ঝামেলা না হয়ে সফলভাবে এমিনো এসিড ও শর্করা অণু গঠিত হয়। তবে এর পরে দশকের পর দশক বয়ে গেলেও এসব সরল অণু থেকে ডিএনএ ও প্রোটিনের মতো জটিলতর অণুর যৌগিক সমাবেশ দুঃসাধ্য বলে প্রমাণিত হলো। তাই তাত্ত্বিকরা প্রাণ-উৎপত্তির ব্যাখ্যায় কোয়ার্টজ-সমৃদ্ধ বালি, লোহার চকচকে পাইরাইট আর সূক্ষ্ম-কণার কাদামাটির কথা আনতে লাগলেন। তাঁরা বললেন যে এসব খনিজরা নির্বাচন, ঘনীভবন ও জোড়া দেয়ার মাধ্যমে প্রাথমিক জৈবঅণু থেকে আরো জটিল ও বড় অণু গঠনে সাহায্য করেছে। পাশাপাশি এ খনিজগুলো তৎকালীন পৃথিবীর প্রতিকূল পরিবেশ থেকে এসব পলকা জৈব-অণুকে রক্ষা করেছে। বর্তমানে বিজ্ঞানের এই বিভাগে প্রায় সবাই মানেন যে নানা রকম খনিজ পদার্থ জীবনের উৎপত্তির জন্য অপরিহার্য ছিলো। অর্থাৎ খুব শুরু থেকেই প্রাণ ও পাথর এক সাথে মিলেমিশে আছে।
মনে করা হয়, এখন থেকে ৪০০ কোটি বছর আগে ভূতাত্ত্বিক আর্কিয়ন-কালে পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব হয়েছে। তখন পৃথিবী আবৃত ছিলো অস্বাস্থ্যকর কমলা-বর্ণের হাইড্রোকার্বন-কুয়াশার পুরু বায়ুমন্ডলে। মহাদেশ আর মহাসাগরগুলো তখন ছিলো নিষ্প্রাণ। জীবনের কাঁচামাল হিসেবে কাজ করা পানি, বায়ু ও প্রস্তর তখন অতিবেগুণী রশ্মির মারাত্মক বিকিরণে ধৌত হচ্ছিলো। অগ্ন্যুৎপাতের ভীষণ প্রলয়ে, গ্রহাণুর বোমাবর্ষণে, বরফপূর্ণ ধূমকেতুর সংঘর্ষে প্রতিনিয়ত বিকৃত হয়ে যাচ্ছিলো এ গ্রহের পৃষ্ঠদেশ। এ রকম অস্বাভাবিক, অগ্নুৎপাতী, ধূমকেতু-ক্ষত ভূগোলক কিভাবে জীবন্ত-অণু তৈরি করলো? বয়ানটা হলো এরকম যে কোয়ার্টজ, পাইরাইট, কর্দমকণা ইত্যাদি খনিজ পদার্থ প্রাণ উদ্ভবের জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করেছে। তবে এ তত্ত্ব ঠিক হতে হলে ওই সব জীবন-সঞ্চারী খনিজ অবশ্যই প্রাণের উদ্ভবের আগে থেকেই উপস্থিত থাকতে হবে। সাম্প্রতিক আবিষ্কার বলছে পৃথিবীর খনিজ আকরিকসমূহও বিবর্তিত হয়েছে। অর্থাৎ শুরু থেকে পৃথিবীর খনিজ সম্ভার একই রকমের ছিলো না। আরো জানা যাচ্ছে যে কিছু কিছু খনিজ আবির্ভূত হতে একশ কোটি বছর বা তার চেয়েও বেশি সময় নিয়েছে। তাহলে কিভাবে আমরা বলতে পারি যে, ঐসব জরুরী খনিজ পৃথিবীতে প্রাণের সূচনালগ্নে উপস্থিত ছিলো?
২.
পৃথিবী নিকট-পৃষ্ঠীয় খনিজ-বৈচিত্র ও বিন্যাসে গত সাড়ে চারশ কোটি বছরে আমূল পরিবর্তন এসেছে। এখন আমরা জানি এইসব পরিবর্তনের পেছনে কি কাজ করেছে: মৌলিক রসায়ন, পদার্থবিদ্যা এবং বিস্ময়কর মনে হলেও, জীববিজ্ঞান। আমরা আরো জানি এই সর্বজনীন নীতিগুলো সারা বিশ্বব্রক্ষ্মান্ডের শত শত কোটি গ্রহ ও উপগ্রহেও খাটবে। এ নতুন বিবর্তনীয় প্রেক্ষিতটি যথেষ্ট বিস্তারিত। তাই যখন মহাবিশ্বের প্রথম খনিজগুলো তৈরি হচ্ছিলো, বহু আগের তখনকার সময়টিও আমরা অনুমান করতে পারি। আমরা জানি যে বিগ ব্যাঙের ঠিক পরেই কোন খনিজ তৈরি সম্ভব নয়। কারণ মহাবিশ্ব তখন অত্যন্ত উত্তপ্ত ছিলো। তাছাড়া খনিজ গঠনের জন্য যথেষ্ট মৌলিক কণাও উপস্থিত ছিলো না। হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম গ্যাস ছাড়া বলতে গেলে অন্য কিছুই তখন বিদ্যমান ছিলো না। প্রথমদিকের নক্ষত্রের কেন্দ্রে কোন ধাতুও ছিলো না। সে নক্ষত্রগুলোর অতিরিক্ত উত্তাপ ছিলো নিরেট কেলাস গঠনের প্রতিকূলে।
তবে মহাবিশ্বের জন্মের লক্ষ লক্ষ বছর পর প্রথম প্রজন্মের নক্ষত্রগুলো বিষ্ফোরিত হতে থাকে। তাদের ছিটকে পরা দেহাবশেষ ঠান্ডা হয়ে অন্তঃস্থিত কার্বন অণুসমূহ ঘণীভূত হয় আর গঠন করে হীরা। এছাড়া কিছু ভিন্নধর্মী কেলাসও ঘনীভূত হয়, যাদের একত্রে বলা হয় উর-খনিজ। উর-খনিজ পরিমাণে অনেক কম ছিলো। সম্ভবত ডজনখানেকের মতো খনিজ-প্রজাতি তৈরি হয়। এদের মাঝে আছে গ্রাফাইট (এক ধরণের বিশুদ্ধ কার্বন যা পেন্সিলের লেড তৈরিতে ব্যবহৃত হয়), কোরান্ড্রাম (রঙিন রুবি ও নীলকান্তমণি হিসেবে অধিক পরিচিত), এবং ময়সনাইট (সিলিকন ও কার্বন দিয়ে গঠিত অনমনীয় যৌগ যা হীরক-রত্নের সস্তা বিকল্প হিসেবে প্রায়ই ব্যবহৃত হয়)। কেলাসের এসব আদিম প্রজাতি এখনো পৃথিবীপৃষ্ঠে আণুবীক্ষণিক ধূলিকণা হিসেবে পতিত হয়। এরা অত্যন্ত প্রাচীন – সাড়ে চারশ কোটি বছরের বহু আগে যে মহা-নীহারিকা থেকে এই সৌরজগত তৈরি হয়েছিলো তারই ভগ্নাবশেষ।
খনিজ-বিবর্তনের পেছনে মূল প্রশ্নটি হচ্ছে নীহারীকা হতে এই ডজনখানেক উর-খনিজে তৈরি বিশাল পরিমাণের ধূলিকণা কিভাবে প্রক্রিয়াজাত হয়ে আনকোরা নতুন, হাজার হাজার ভিন্ন বৈচিত্র্যের খনিজে পরিণত হলো। পৃথিবীর সকল রাসায়নিক ঐশ্বর্য এক সময় ঐ আদিম ধূলিকণার মাঝে খুব সামান্য পরিমাণে লুকিয়ে ছিলো। এখন আমরা এসব খনিজ ঐশ্বর্য আইফোন, স্কেটবোর্ড, গাড়ি, সমতল-পর্দার টেলিভিশন এবং অগণিত অন্য খেলনা তৈরিতে ব্যবহার করি। কিন্তু এগুলো কিভাবে প্রাথমিক খনিজ যৌগ থেকে উদ্ভূত হলো? ডজনখানেক মৌলের কথা বাদ দিলে পৃথিবী গঠনকারী বাকি ৮০টির মতো রাসায়নিক মৌল ছড়ানো ছিলো অসম্ভব পাতলা ঘনত্বে, কয়েক লক্ষ বা কয়েকশ কোটি পরমাণুর মধ্যে অল্প কয়েকটি – এই অনুপাতে। অত্যন্ত দক্ষ কোন ঘনীকরণ প্রক্রিয়া ছাড়া সেসব দূর্লভ রাসায়নিক মৌল একে-অপরে তালগোল পাকিয়ে, পরস্পর বিভিন্ন সংখ্যক যোজনীতে যুক্ত হয়ে হাজার হাজার খনিজ প্রজাতী গঠন করবে – এরকম সম্ভাবনা খুবই কম। আজকে আমরা যে খনিজ বৈচিত্র্য উপভোগ করি তা সম্ভব হতে হলে পৃথিবী-নির্মাণকারী আদিম প্রস্তরকে অবশ্যই অনেকগুলো প্রক্রিয়াজাতকরণের মধ্য দিয়ে যেতে হবে।
পৃথিবীর প্রথম অর্ধশত কোটি বছরে খনিজের বিবর্তনে প্রাণ কোন ভূমিকা রাখে নি। তখন পৃথিবীর এই রূঢ় ঊষর ভূমিতে কোন জীবন্ত কোষ ছিলো না। নতুন ধরনের খনিজ পদার্থে তৈরি জোয়ার বওয়া শুরু করে গ্রহ সৃষ্টিরও আগে, যখন আদিম সূর্য জ্বলে উঠতে শুরু করলো, বিশোধক-শিখার স্তবক ছড়াতে লাগলো এর চারপাশে ঘুরতে থাকা ধূলি-গ্যাসে তৈরি নীহারীকা-চাকতিতে। প্রথম দিকের ডজনখানেক উর-খনিজ উত্তাপে গলে, পরস্পর মিশ খেয়ে তৈরি করে ৬০টির মতো নতুন খনিজ। তারপর অভিকর্ষের টানে জমাটবদ্ধ ধূলি ও গ্যাস যখন তৈরি করছিলো খুদে গ্রহাণু, তখন আরো ১০০টি খনিজ-প্রজাতি তৈরি হয়। তাপ, চাপ ও পানি আদিম কেলাসদের রূপান্তরিত করছিলো নতুন ছাঁচে। এছাড়া প্রস্তরদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কির অভিঘাত (impact shock) আরো নতুন খনিজ বৈচিত্র্য নিয়ে আসে।
পৃথিবী বড় হতে থাকলে লৌহ-নিকেলের মতো সান্দ্র ধাতুগুলো পাথুরে-আবরণ ভেদ করে ডুবতে থাকে, তৈরি করে ভূকেন্দ্রের মজ্জা। সেই বিশাল স্তুপের বাইরের আবরণ মূলত আগ্নেয়গিরিজাত কালো রঙের ব্যসাল্ট পাথরে তৈরি ছিলো। পৃথিবী অনেকটা পেঁয়াজের মতো পরতে পরতে স্তরীভূত করে নিকট-পৃষ্ঠে কয়েক ডজন দূর্লভ মৌল দিয়ে একটি পরিমণ্ডল তৈরি করে। হাইড্রোজেন, লিথিয়াম, বেরিলিয়াম ও বোরনের মতো খনিজ-গঠনকারী হালকা মৌলগুলো সুনির্দিষ্ট অনুপাত ছাড়াই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যায় সেই বহিঃস্থ পরিমণ্ডলে। তামা, জিঙ্ক, রূপা ও সোনার ধাতব আকরিক; ইউরেনিয়াম, থোরিয়াম, রেডিয়ামের মতো তেজষ্ক্রিয় মৌল; ফসফরাস, সালফার, নাইট্রোজেন ও কার্বনের মতো প্রাণের অত্যাবশ্যকীয় মৌলসমূহ – সবাই পৃথিবীর নব্য-ভূত্বকে লক্ষণীয় পরিমাণে সংযুক্ত হয়।
এরকম অবস্থায় শিশু-পৃথিবী খনিজ উৎপাদনের একটি ইঞ্জিনে পরিণত হয়। এজন্য ধন্যবাদ দেয়া উচিত ভূপৃষ্ঠের তরল পানিকে, গভীর শিলাস্তরের তাপশক্তিকে, আর শিলা-পুনঃর্ব্যবহারকারী টেকটনিক প্লেটকে। অন্যান্য ভৌত ও রাসায়নিক প্রক্রিয়ার সাথে সাথে এগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে তৈরি হয় ১,৫০০টি ভিন্ন ভিন্ন খনিজ যৌগ। এই পরিমাণটি উল্লেখযোগ্য অবশ্যই। কিন্তু বর্তমানে আমরা অন্তত ৫,০০০ খনিজ প্রজাতির কথা জানি। বাকি ৩,৫০০ খনিজকে কে তৈরি করলো? নতুন এসব খনিজের সংখ্যা পূর্বের ১,৫০০ খনিজ প্রজাতির চাইতে দ্বিগুণেরও বেশি। অধিকাংশ খনিজ যৌগের (তিনের মধ্যে দুইটির) উৎপত্তি হয়েছে জৈবিক-প্রক্রিয়ার ফল হিসেবে – এটিই হলো খনিজবিদ-সম্প্রদায়ের ভিত্তিমূলকে নাড়িয়ে দেয়া উপসংহার।
প্রাণ ও পাথরের মাঝে সহবিবর্তনের গল্প শুরু হয় আনুমানিক ৪০০ কোটি বছর আগে। তখন এ গ্রহে কাজটা শুরু করার জন্য শুধু পাথর, বাতাস ও সাগর উপস্থিত ছিলো। মিলার ও ইউরিকে অনুসরণকারী প্রাণ-উদ্ভবের গবেষকরা খুব দ্রুত বুঝতে পারলেন যে আকাশ যতোই বিদ্যুৎচমকে চমকিত হোক না কেন, প্রাণ তৈরির জন্য বায়ু ও সাগর যথেষ্ট নয়। কিছু নির্বাচিত খনিজই পারে সরল ও নির্জীব জৈবযৌগের ঘনত্ব বাড়িয়ে এমনভাবে সাজাতে যাতে সেই সম্মেলন জীবনের দরকারি সব জটিল কর্মসাধন করতে পারে। প্রথমদিককার অণুজীবরা ছিলো কেমোলিথোঅটোট্রফ, বাংলা বলা যেতে পারে রাসায়নিক-শৈল-ভক্ষক। যেসব এককোষী জীবেরা একেবারে শূণ্য থেকে নিজেদের গাঠনিক জৈবযৌগ বানানোর জন্য দরকারী রাসায়নিক শক্তি খনিজ পদার্থ থেকে সংগ্রহ করে তাদেরকে রাসায়নিক-শৈল-ভক্ষকের আলঙ্কারিক উপাধিতে ডাকা হয়। এই প্রক্রিয়ায় অণুজীবেরা লোহা, সালফার ও কার্বনের ভারসাম্যহীন রাসায়নিক যৌগের ভাঙনের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে জৈববিক্রিয়ার মাধ্যমে, আর উপজাত হিসেবে উপার্জন করে সামান্য শক্তি।
পাথর-খেকো অণুজীবেরা পৃথিবী-পৃষ্ঠকে বদলে দেয়। তবে সেটা পৃথিবীর খনিজ বিবর্তনের ইতিহাসে সবচেয়ে নাটকীয় ঘটনা মহা-জারণ-সংঘটনের (Great Oxidation Event বা GOE) সাথে তুলনীয় নয়। শিলাসমূহের রাসায়নিক ও ভৌত পরিবর্তনের সাক্ষ্য থেকে জানা যায় প্রায় ২৪০ কোটি বছর আগে এই মহা-জারণ-ঘটনা শুরু হয়েছিলো। সময়টা ঠিক তখনই যখন সূর্যের শক্তি ব্যবহার করে অক্সিজেন-উপজাত তৈরি করা সালোকসংশ্লেষণক্ষম অণুজীবেরা ক্ষয়প্রাপ্ত-খনিজ-পুষ্টি-সমৃদ্ধ সমূদ্র-উপকূলে বাড়তে শুরু করেছে। অক্সিজেন একটি বিপজ্জনক জারক গ্যাস, বেশিরভাগ শিলা ও খনিজপদার্থের উপর রাসায়নিক আক্রমণ চালিয়ে বদলে দেয় মরিচার মতো নতুন ‘জারিত’ রূপে। ওই প্রাচীন বায়ুমণ্ডলে বেশি অক্সিজেন মানে বেশি ক্ষয়, যা তৈরি করে আরো পুষ্টি, ফলাফলে অক্সিজেন-নির্মাতা শৈবাল বেড়ে যায়। ভূমণ্ডলের নিকট-পৃষ্ঠীয় পরিবেশে এই প্রতিক্রিয়া চক্র চলে আসছে ২০০ কোটি বছরেরও বেশি সময় ধরে, তৈরি করে চলেছে আরো অধিক সংখ্যার খনিজ-বৈচিত্র্য।
উদাহরণ হিসেবে তামার কথা ধরা যাক। মহা-জারণ-সংঘটনের আগে পৃথিবীতে হাতে গোনা কয়েকটির বেশি তাম্রযৌগ পাওয়া যেত না। বর্তমানে আমরা ছয়শো’রও বেশি ভিন্ন ভিন্ন তাম্রযৌগ তালিকাভূক্ত করেছি। এদের মধ্যে আছে অ্যাজুরাইট, ম্যালাকাইট ও টার্কোয়েজের মতো সব নীল ও সবুজ রঙের রত্নপাথর। সালোকসংশ্লেষণের বিবর্তন না হলে তামা, অক্সিজেন ও অন্যান্য মৌল যুক্ত হয়ে শত শত খনিজ তৈরি হতে পারতো না। একইভাবে দুইশতাধিক ইউরোনিয়াম খনিজের নব্বুই শতাংশেরও অধিক যৌগ গঠনের জন্য প্রাণ দায়ী। এছাড়াও রয়েছে নিকেল, কোবাল্ট, মলিবডেনাম, সীসা, আর্সেনিক, কার্বন, সালফার ও অন্যান্য মৌলসমূহ যারা অক্সিজেনের সাথে নির্দ্বিধায় বিক্রিয়া করে। শুধুমাত্র একটি জীবন্ত গ্রহের পক্ষেই সম্ভব এমন খনিজ উর্বরতা দেখানো।
জীবনের উদ্ভব হয়েছে খনিজ থেকে, তারপর খনিজের উদ্ভব হলো জীবন থেকে। ভূমণ্ডল ও জীবমণ্ডল পরস্পর অজস্র প্রতিক্রিয়া চক্রের মাধ্যমে অগণিত প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া পরিচালনা করার জন্য এমন জটিলভাবে জড়িয়ে গেছে যে বিষয়টি এর আগে আমাদের মনোযোগে আসে নি। সালোকসংশ্লেষণকারী অণুজীবেরা ইউরেনিয়াম ও কপারের খনিজ তৈরি করেছে অভিনব পদ্ধতিতে। আর সেসব ইউরোনিয়াম ও তাম্র খনিজ নতুন পরিবেশ সরবরাহ করে ভিন্ন একদল অণুজীবদের জন্য, যেখানে তারা অন্য আকরিক জমানোর জন্য দরকারী কাজ করে। বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেনের বৃদ্ধির সমান্তরালে কমেছে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ, ফলাফলে কমেছে সাগরের অম্লতা, যা সযত্নে লালন করেছে চুনাপাথরের প্রবাল-প্রাচীর, যে প্রাচীর সরবরাহ করেছে অধিক সালোকসংশ্লেষণের জন্য টেকসই পরিবেশ। সালোকসংশ্লেষণক্ষম অণুজীব কর্তৃক প্রস্তুত অক্সিজেন আরও তৈরি করেছে উচ্চ-বায়ুমণ্ডলের ওজনস্তর, যা রুদ্ধ করেছে সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুণী রশ্মি বিকিরণ, তৈরি হয়েছে অগভীর-উপকূলে প্রাণের বসতিপূর্ণ হওয়ার মতো অবস্থা।
দুইশ কোটি বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রাণ ও পাথরের ঘনিষ্ঠ মিথষ্ক্রিয়া দেখা গেছে পৃথিবীর প্রায় সব নিকট-পৃষ্ঠ পরিবেশে। এখন প্রাণ-পাথরের প্রেমের রহস্যগল্পে নতুনতর সূত্রের খোঁজে ভূবিজ্ঞানীরা পরস্পর পাল্লা দেন। এমনকি পৃথিবী প্লেট টেকটনিকস প্রভাবিত হতে পারে প্রাণ দ্বারা। প্লেট টেকটনিকসের মাধ্যমে মহাদেশগুলো সরে যায় আর ভূমিকম্প ও আগ্নেয়গিরি বদলে দেয় ভূদৃশ্য। প্লেট টেকটনিকসের উপর প্রাণের প্রভাবের বক্তব্যটা এরকম – অণুজীবীয় ক্ষয় প্রক্রিয়ায় কর্দম-খনিজ উৎপাদন বেড়ে যায় বহুগুণে, আর এই পিচ্ছিল কর্দমের বর্ধিত উৎপাদন নিম্নগামী প্লেটের সঞ্চালনকে মসৃণ করে দেয়, ফলাফল ত্বরিত টেকটনিক সঞ্চারণ। অনেক বিজ্ঞানীই মনে করেন এই ভাবনা পাগলাটে। কারণ প্লেট টেকটনিক ও অণুজীববিহীন-কর্দম উৎপাদন অন্তত একশ কোটি বছর আগে থেকেই ছিলো। তবে এধরণের অনুকল্প দেখিয়ে দেয় যে সহবিবর্তনীয় দৃষ্টিভঙ্গি কিভাবে আজকের ভূবিজ্ঞানীদের নতুনভাবে চিন্তাভাবনা করতে উৎসাহিত করছে।
৩.
আগ্নেয়গিরিময় ভগ্নদশাগ্রস্থ অবস্থা থেকে পৃথিবী রূপান্তরিত হয়েছে নীল পানির বিশ্বে; তারপরে বিবর্ণ, লালচে স্থলের অক্সিজেন-সমৃদ্ধ ভূগোলকে। তবু কোন রূপান্তরই ৬৫ কোটি বছর আগে পৃথিবীর সবুজ হয়ে ওঠা এবং জৈবমণ্ডল উত্থানের মতো নাটকীয় নয়। তখন বরফ যুগ শেষ হয়ে আসার সাথে সাথে সালোকসংশ্লেষণক্ষম শৈবালের বিষ্ফোরিত বিকাশ বায়ুমণ্ডলের অক্সিজেনের পরিমাণ ১% থেকে বাড়িয়ে দেয় ২০% পর্যন্ত। অধিক অক্সিজেন মানে ওজোন স্তরের চাঙ্গা হয়ে ওঠা। ওজোন স্তর তখনকার ঊষর মহাদেশগুলোকে অতিবেগুণী রশ্মির দহনের বিরুদ্ধে রক্ষা করে। ফলে বিরান স্থল জীবনের জন্য নিরাপদ হয়ে ওঠে।
ভূমির প্রথম উদ্ভিদের শেকড় ছিলো ক্ষুদ্রকায়। এসব শেকড় সে সময়ে তাদের আবাসের অগভীর মাটির জন্য যথেষ্ট ছিলো। এসব ক্ষুদ্র শেকড় কঠিন-শিলা ভাঙার গতি বাড়িয়ে দিলো, তৈরি হলো গভীর মাটি, যেখানে নতুন উচ্চতর উদ্ভিদেরা পারলো উপনিবেশ স্থাপন করতে, সাথে নিয়ে অনধিকার-প্রবেশক্ষম দীর্ঘতর শেকড়। মাত্র চল্লিশ কোটি বছরের মধ্যে স্থলের উদ্ভিদকূল বিবর্তিত হলো ৫০ ফুট উঁচু উদ্ভিদে আর গাছের মতো দৈত্যাকার ছত্রাকে, যারা মাটির ২০ ফুট গভীরে শেকড় ছড়িয়ে দেয়। তারপর সেই গাছেরা মেঘ-গঠনের বীজ বপন করতে থাকলো বায়ুমণ্ডলে, বাড়িয়ে দিলো বৃষ্টিপাত, বদলে দিলো ক্ষয়ের ধরণ, যোগান দিলো উদ্ভিদ বিস্তারের নতুন বাস্তুস্থান। পরিপুষ্ট খাদ্য-জালের জন্য ভিত্তি সৃষ্টি করলো সেই বৃক্ষরা। সে খাদ্যজাল দ্রুত ছড়িয়ে পড়লো কীট-পতঙ্গ, উভচর, ডাইনোসর, এবং অবশেষে আমরা মানুষ পর্যন্ত।
পৃথিবীর চলমান খনিজ বিবর্তন সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহ থেকে আমাদের এই নীলাভ বাসভূমির ভিন্ন রকমের স্বাতন্ত্র্য উন্মোচন করে। সৌরতাপের সেঁক-খাওয়া বুধ আর আমাদের শুকনো চাঁদের খনিজ-ভিন্নতা সামান্য, ৩০০-র চাইতে কম খনিজ-প্রজাতি নিয়ে গঠিত। এর চাইতে সামান্য এগিয়ে মঙ্গল – তবে তার ভাণ্ডার কয়েক’শো খনিজ-প্রজাতির বেশি নয়। আর অন্যদিকে পৃথিবীর সংগ্রহশালা অনন্য কারণ সেখানে আছে ৫০০০ খনিজ-প্রজাতি। এ সংগ্রহ সাক্ষ্য দেয় ভূমণ্ডল ও জীবমণ্ডল সহবিবর্তিত হওয়ার কারণে উন্মোচিত অজস্র সম্ভাবনার কথা।
আমরা যখন পৃথিবীর সাড়ে চারশো কোটি বছর পুরনো ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকাই, তখন একটা অবাকবোধ জেগে ওঠে যে আমরা এই সহবিবর্তন-গল্পের নববিপ্লবের যুগে বেঁচে আছি। বর্তমানে খনিজ ও জীবনের মধ্যকার মিথস্ক্রিয়া ত্বরান্বিত করেছে একটি প্রাণী, হোমো স্যাপিয়েন্স। এ যুগে মানুষের সাথে খনিজ ও জীবনের সম্পর্কটি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে চিহ্নিত করা যায়। বিগত দশ হাজার বছরে মানুষের কর্মকান্ড পৃথিবীর নিকট-পৃষ্ঠের ভূরাসায়নিক চক্র বদলাতে শুরু করেছে – খনি থেকে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে আকরিক সংগ্রহ, কৃষি ও সারের ব্যবহার, বন উজাড়, শহর ও রাস্তা নির্মাণ, সমুদ্র-উপকূলে বাঁধ দেয়া, নদী আটকিয়ে ড্যাম তৈরি করা, অজস্র নতুন রাসায়নিকের উৎপাদন, আর বর্ধিত হারে জীবাষ্ম-জ্বালানী পোড়ানো ইত্যাদির মাধ্যমে।
লক্ষ বছর ধরে দীর্ঘ ভৌগলিক সময়ে ঘটে যাওয়া প্রাকৃতিক পরিবর্তনের চেয়েও বৈপ্লবিক এসব পরিবর্তন। হয়তো এসব মানবসৃষ্ট ‘বিপ্লব’-এর পরিণাম কি হবে তা আমরা বুঝতে পারছি না। তবুও আমাদের বোঝার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া উচিত। কারণ মানব-প্রজাতি বেঁচে থাকুক বা না থাকুক, পৃথিবী একটি গতিশীল জীবন্ত-জগৎ হিসেবে বিবর্তিত হতে থাকবে। তবে নিজেদের বাঁচাতে হলে পাথর ও প্রাণের মধ্যকার এই উদ্ভট সম্পর্কের গভীরতর উপলদ্ধির প্রয়োজন। আমাদের জানামতে এই জটিল সম্পর্ক কেবল একটি মাত্র বাসস্থানেই বজায় আছে।
[অনলাইন ম্যাগাজিন Aeon এ প্রকাশিত Mineral fodder-এর ভাষান্তর। মূল লেখক রবার্ট হ্যাজেন কার্নেগি ইন্সটিটিউট অফ ওয়াশিংটন-এর জিওফিজিক্যাল গবেষণাগারে বিজ্ঞানী, আর জর্জ ম্যাসন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূবিজ্ঞানের প্রফেসর। তাঁর সাম্প্রতিক বই হলো ‘দ্যা স্টোরি অফ আর্থ’ (২০১২)।]
⚫ আরাফাত রহমান
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীববিজ্ঞান বিভাগে প্রভাষক।