[বইটির সূচীপত্র এবং সবগুলো খন্ডের লিংক একত্রে দেখুন এখানে]
বিজ্ঞান চলে যুক্তি ও প্রমাণের কাঁধে চেপে। ঘড়ির কাঁটা মেপে, গণিতের হিসাব মিলিয়ে। হিসাবের হেরফের হলে, যুক্তিতে ফাঁকফোঁকর থাকলে প্রমাণ মিলবে না। আর কে না জানে প্রমাণ ছাড়া বিজ্ঞানের কানাকড়িও মূল্য নেই। কিন্তু বিজ্ঞানের ইতিহাসের দিকে পেছন ফিরে তাকালে হিসাবটা অনেক ক্ষেত্রে পাই টু পাই মেলে না। অনেক তত্ত্ব সময়ের আগেই জন্ম নেয়, আবার অনেক তত্ত্ব জন্মের পরেও পড়ে থাকে লোকচক্ষুর অন্তরালে। কখন কোন বিজ্ঞান-রাজ্যের রাজকুমার এসে তাকে ‘অপ্রমাণিত’ নামের রাক্ষসের শৃংখল থেকে মুক্ত করবে সেই আশাই দিনের পর দিন বছরের পর বছর পড়ে থাকে ধুলো-জঞ্জালের স্তূপে। আবার অনেক তত্ত্ব যুক্তি-তর্ক প্রমাণের দায় মিটিয়েও পড়ে থাকে ইতিহাসের কানা গলিতে। উদাহরণ চান? ভুরি ভুরি মিলবে। ইতিহাস তার হিসাব মেলাতে অক্ষম। নইলে নিউটন তার বিখ্যাত সমীকরণগুলো আবিষ্কারের পরেও কেন ত্রিশ বছর লোকচোক্ষুর আড়াল করে রাখবেন? কেন এডিংটন মানতে পারেননি বলে চন্দ্রশেখর লিমিট ৫০ বছর ঘুমিয়ে কাটাবে? অ্যারিস্টটলের নির্বোধ বিরোধিতার কারণে কেন ১৫০০ বছর সূর্যকে পৃথিবীর চারপাশে ঘুরতে হবে? ইতিহাস কি পারবে এসবের হিসাব মেলাতে?
সম্প্রতি বিজ্ঞানের এক বড় আবিষ্কারের পর আবার মাথাচড়া দিয়ে উঠেছে হিসাবের গড়মিলের ব্যাপারটা।
এলএইচসির সাইক্লোট্রনে বছর চারেক আগে হিগস বোসনের সন্ধান মিলেছে- আশা করি এ তথ্য কারও অজনা নয়। এই সাফল্যের পর দুনিয়াব্যাপী উচ্ছ্বাস ও আবেগের স্ফুরণ ঘটেছে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই উচ্ছ্বাসের তোড়েই ভেসে যেতে বসেছে অনেক আসল ইতিহাস, অনেক হিসাব-নিকাশ। এই আবিষ্কারের পথ ধরে যদি পেছনে ফিরে দেখা যায় তো বেরিয়ে আসবে কালের গর্ভে গুমরে মরা অনেক অচেনা সত্য।
এই রহস্যের পিছু ধাওয়া করতে হলে আপনাকে প্রথমেই যেতে হবে বিংশ শতাব্দীর তিরিশের দশকের শুরর দিকে। তখন বিজ্ঞানের জগত মোটামুটি নিশ্চিত নিউট্রন ও প্রোটন কণার সমন্বয়েই পরমণুর নিউক্লিয়াস গড়ে উঠেছে। কিন্তু শুধু এটুকু কথায় চিড়ে ভেজেনি। পরামণুর অন্দরমহলের যে মাইক্রোস্কোপিক জগত, তার আমাদের চেনা জগতের জ্ঞান বুদ্ধি দিয়ে পুরোপুরি উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। তাই বোর, হাইজেনবার্গ, শ্রোডিংগার, বর্ন, ডিরাক, ডি-ব্রগলিদের মতে সুক্ষ্মচিন্তাবিদেরা গড়ে তুললেন কোয়ান্টাম মেকানিক্স নামের এক আশ্চর্য জগত। এর আগ পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল, মহাবিশ্ব দাঁড়িয়ে আছে দু’ধরনের বলের খুঁটিতে ভর দিয়ে। একটা হলো মহাকর্ষ বল আর অন্যটা তড়িচ্চুম্বকীয় বল। দুনিয়ায়, মহাবিশ্বে যা কিছু ঘটছে তা এই দুটি বলে কারণে। এই দুই বলের আকর্ষণ সীমা বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত।
কিন্তু বিজ্ঞান এই দুইয়ে আটকে থাকল না। আবিষ্কার হল স্বল্প দৈর্ঘ্য-সীমার মধ্যে ক্রিয়াশীল আরো দুই প্রকার বল। সবল ও দুর্বল নিউক্লিয় বল। সবল নিউক্লিয় বল প্রোটন ও নিউট্রনদের নিউক্লিয়াসের মধ্যে শক্তিশালী বন্ধন তৈরি করে আটকে রাখে। আর দুর্বল নিউক্লিয় বল কাজ করে তেজস্ক্রিয় পরমাণুর নিউক্লিয়াসে। এই বল তেজস্ক্রিয় পরমাণুর নিউট্রনকে ভেঙে প্রোটনে পরিণত করে। আর সে কারণে তা থেকে বিটা-রশ্মি নির্গত হয়। বিটা রশ্মি মূলত ইলেকট্রনের স্রোত। এই দুই ধরনের বল নিউক্লিয়াসের ব্যাসের সমান বা তারচেয়ে ক্ষুদ্র দৈর্ঘ্য-সীমার মধ্যে কাজ করে। তাই এদেরকে যদি বুঝতে হয় তবে কোয়ন্টাম মেকানিক্সের ওপর ভরসা করা ছাড়া উপায় নেই।
দুর্বল নিউক্লিয় বলের রহস্য সমাধানের জন্যে কোয়ান্টামের জগতে হাত বাড়িয়েছিলেন বিখ্যাত ইটালিয়ান পদার্থবিদ এনরিকো ফার্মি। অনেক খেটেখুটে দাঁড় করিয়েছিনে গাণিতিক খসড়া। খসড়া মোটামুটি গ্রহণযোগ্য এবং সহজবোধ্য ছিল। কিন্তু ত্রুটিও ছিল তাতে। মুলকণিকাগুলো গতিশক্তি কম হলে ফার্মির তত্ত্বে কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু যেসব মুলকণিকাগুলো অনেক বেশি গতিশক্তি নিয়ে ছোটে, ফার্মি-তত্ত্বে গ-গোল লেগে যায় তখন।
পরের বিশ বছরে কোয়ান্টাম মেকানিক্সে এলো বৈপ্লবিক গতি। তড়িচ্চুম্বকীয় প্রক্রিয়ায় কোয়ান্টাম তত্ত্ব মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে গেল। আবার উচ্চগতিশক্তির কণাদের ক্ষেত্রেও কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সফল প্রয়োগ সম্ভব হলো। আর এর মধ্য দিয়েই জন্ম হলো ‘কোয়ান্টাম ইলেক্ট্রডাইনামিক্সের’। অর্থাৎ সবল নিউক্লিয় বলের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল কোয়ান্টাম মেকানিক্স।
বিজ্ঞানীদের নিরলস প্রচেষ্টার ফলে কোয়ান্টাম মেকানিক্স এই পর্যায়ে পৌঁছুতে পেরেছিল। তবে তিনজনের নাম আলাদাভাবে উল্ল্যেখ না করলেই নয়। রিচার্ড ফাইনম্যান, জুলিয়েন সুইংগার ও সিন-ইটিরো তোমোনাগা।
সবল নিউক্লিয় বলের জন্য কোয়ান্টাম তো প্রতিষ্ঠিত হলো, তাহলে দুর্বল নিউক্লিয় বলের জন্য কেন নয়? এই চিন্তা-ভাবনা যখন চলছে তখন আবিষ্কৃত হলো দুর্বল বলের এক আশ্চর্য ধর্ম। তা হল, দুর্বল প্রক্রিয়ায় মূল কণিকার স্পিনিং ধর্ম ডান-বাঁমের সাম্যবস্থায় থাকে না।
বিষয়টা আরেকটু খোলসা করে বলা যাক। আগেই বলা হয়েছে, দুর্বল নিউক্লিয় বলের প্রভাবে তেজস্ক্রিয় পদার্থ থেকে বেটা রশ্মির আদলে ইলেকট্রন বেরিয়ে আসে। একটা বিষয় জানা ছিল বিজ্ঞানীদের। ইলেক্ট্রন সবসময় নিজে নিজে লাটিমের মতো ঘোরে। যদিও কোয়ান্টাম মেকানিক্স ঠিক লাটিমের মতো ঘোরার ব্যাপারটা সমর্থন করে না। তবুও ব্যাপরটা যা দাঁড়ায় তা কিছুটা হলেও লাটিমের মতো ঘূর্ণন বলে ধরে ধরে নেয়া যায়। মোট কথা, ইলেকট্রনের একটা নিজস্ব ‘কৌণিক ভরবেগ’ থাকে, যার কারণ হচ্ছে ঘূর্ণন প্রক্রিয়া।
এই ঘূর্ণন দুদিকে হতে পারে। ডানহাতি ও বাঁহাতি স্ক্রু নিয়মে। ডানহাতি স্ক্রু নিয়ম হলো, ডান হাত সাহায্যে স্ক্রু-ড্রাইভার দিয়ে স্ক্রু আটতে গেলে হাতটাকে যে ভাবে ঘোরাতে হবে। আর বাঁহাতি স্ক্রু নিয়ম হলো, বাঁ হাতের সাহায্যে স্ক্রু-ড্রাইভার দিয়ে স্ক্রু আটতে গেলে হাতটাকে যে ভাবে ঘোরাতে হবে।
আবার ফিরে আসি আগের প্রসঙ্গে। বেটা রশ্মির অন্তর্ভুক্ত ইলেকট্রনগুলো পরীক্ষা করে আর্শ্চজনক ফল পেলেন বিজ্ঞানীরা। এই ইলেক্ট্রনগুলোর সবই বাঁহাতি স্ক্রু নিয়মে ঘোরে। সত্যি অদ্ভুত! এই আবিষ্কার ফার্মির তত্ত্বকে এগিয়ে দিল আরো একধাপ। তবে ফার্মির তত্ত্বে নতুন বিষয়টা যোগ করার দরকার হল- তত্ত্বটার মধ্যে একটা ডান-বামের অসাম্য থাকতে হবে।
এ-কাজে এগিয়ে এলেন চার-চারজন মার্কিন বিজ্ঞানী। জর্জ সুদর্শন, রবার্ট মার্শাক, মারে গেলমান ও রিচার্ড ফাইনম্যান। এঁদের প্রচেষ্টায় ফার্মির তত্ত্বে আরও সুন্দর কাঠামো পেল। কিন্তু ইলেক্ট্রডাইনামিক্সের মতো সর্বাঙ্গসুন্দর কোয়ান্টাম তত্ত্ব এখনও পাওয়া যায়নি।
কোন বিশেষ কারণে বিজ্ঞানীরা হন্যে হয়ে কোয়ান্টাম ইলেক্ট্রডাইনামিক্সের আদলে দুর্বল প্রক্রিয়ার তত্ত্বকে সাজাতে চাইছিলেন তা একটু বোঝার চেষ্টা করা যাক। ধরা যাক, দুটো ইলেকট্রন ছুটে পরস্পরের কাছাকাছি এলো। কিন্তু তাদের মধ্যে পাস্পারিক বিকর্ষণের ফলে আবার ছিটকে দুদিকে চলে গেল। এরকম ঘটনা কী হারে ঘটতে পারে? ইলেকট্রনগুলির কোনও বিশেষ দিকে ছিটকে যাওয়ার সম্ভাবনা কীরকম? অঙ্ক কষে এগুলোর উত্তর বের করতে গেলে ফল আসবে ‘অসীম’! এক-কে শূন্য দিয়ে ভাগ করলে যেমন কোনও অর্থবহ ভাগফল পাওয়া যায় না। ইলেকট্রন ছিটকে যাওয়ার হার কষতে গেলে সেরকমই হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
কোয়ান্টাম ইলেক্ট্রট্রডাইনামিক্স এই আশঙ্কা দূর করে। এর কতগুলো গাণিতিক বৈশিষ্ট্যও আছে, যার ফলে ওই জাতীয় উদ্ভট পরিণাম সব সময়েই এড়ানো যায়। তাই স্বাভাবিকভাবেই বিজ্ঞানীরা চাইলেন দুর্বল নিউক্লিয় বলকেও একই রকম গাণিতিক ছাঁচে ফেলতে।
আমেরিকান পদার্থবিদ শেলডন গ্ল্যাশো প্রথম এধরনের একটা গাণিতিক কাঠামো প্রস্তাব করালেন। ৬০-এর দশকে কিন্তু সেই কাঠামোকে সম্পূর্ণ চেহারা দিতে লেগে গেল বেশ কয়েক বছর। শেষ পর্যন্ত আবদুস সালাম ও স্টিফেন ওয়াইনবার্গ- এই দুজনের হাত দিয়ে সম্পূর্ণ চেহারাটা বেরিয়ে এল। সত্তর দশকের শুরুর দিকে দুই ডাচ বিজ্ঞানী জি টি হুফ ও এম ভেল্টম্যান নামের দুজন বিজ্ঞানী প্রমাণ করলেন যে, তত্ত্বটার গাণিতিক গঠন অভ্রান্ত।
গ্ল্যালাশোর প্রস্তাব, আর সালাম-ওয়াইনবার্গের দেওয়া পূর্ণাঙ্গ রূপ-এর মাঝে কটা বছর কেন অপেক্ষা করতে হল? এই প্রশ্নটাই বিজ্ঞানকে হিগস বোসন কণার হদিস পাইয়ে দেয়। গ্ল্যাশোর প্রস্তাবিত কাঠামো নিঃশর্তভাবে মেনে নিলে এবং তা তা দুর্বল প্রক্রিয়ার জন্যে ঠিকমতো কাজ করতে গেলে মহাবিশ্বের সমস্তÍ মুল কণিকাকে সম্পূর্ণ ভরহীন হওয়া লাগত। কিন্তু তা তো সম্ভব নয়। ইলেকট্রনের ভর আছে, ভর আছে অন্যসব মূল কণিকার। সুতরাং বিজ্ঞানীরা পড়ে গেলেন কঠিন এক ধাঁধার ফাঁদে।
শেষ পর্যন্ত সমাধান এলো। কারও একার কৃতিত্বে নয়। বেশ কয়েকজন পদার্থবিদের পরিশ্রমের ফলে। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত নাম স্কটল্যান্ডের এডিনবরার তৎকালীন অধ্যাপক পিটার হিগস। একই সময়ে আরো কয়েকজন বিজ্ঞানী একই প্রক্রিয়ায় বিষয়টা নিয়ে গবেষণা করেন। টম কিব্ল, ফিলিপ অ্যান্ডারসন, কার্ল হেগেন, ফ্রাঁসোয়া এংলার্ট, রবার্ট ব্রাউট এবং জেরাল্ড গুরালনিক। এদের সবার কাজের সম্মিলিত সম্মিলিত রূপই হিগস কণার অস্তিত্ব সম্মন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী। এঁদের মধ্যে একমাত্র রবার্ট ব্রাউট ছাড়া সবাই এখনো জীবিত। ২০১২ সালের ৪ জুলাই জেনেভায় এক বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে এলএইচসির পক্ষ থেকে জানানো হয়, হিগস কণার অস্তিত্ব প্রাথমিক ভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এই সম্মেলনে ওই বিজ্ঞানীদের অনেকই অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
ওই সম্মেলনে একথাও বলা হয়, হিগস বোসন প্রাপ্তি সম্পর্কে মোটমুটি নিশ্চিত হলেও শতভাগ গ্যারান্টি দিয়ে বলা যাচ্ছে না নতুন আবিষ্কৃত কণাটিই হিগস বোসন কণা। তবে এই সন্দেহের কফিনে এলএইচসি’র বিজ্ঞানীরা শেষ পেরেক ঠোকেন ২০১৩ সালের ১৪ মার্চ ইতালির এক সম্মেলেনে। তাঁরা এখন শতভাগ নিশ্চিত নতুন আবিষ্কৃত কণাটিই হিগস বোসন। হিগস বোসন আবিষ্কারে সাথে সাথে বিজ্ঞান জগতে খুলে গেল এক নতুন দিগন্ত। কারণ, এর অস্তিত্বের কথা ভাবা হয়েছিল, মূল কণিকাদের নিয়ে গ্ল্যাশোর প্রস্তাবিত গাণিতিক কাঠামোর কিছু সমস্যা এড়াতে গিয়ে। একটা গোলমেলে পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে গিয়ে যদি জলজ্যান্ত একটা কণার অস্তিত্ব ধরা পড়ে যায়, তাহলে সেটা শুধু আশ্চর্য বলা যায় না, এটা অত্যশ্চর্য ঘটনা!
আবার পেছনে ফেরা যাক। গ্ল্যাশো’র গাণিতিক ত্রুটির সমাধানটা হলো কীভাবে? ত্রুটি এড়াতে বিজ্ঞানীরা অন্যপথ ধরলেন। ধরে নেওয়া হল, প্রকৃতিতে এমন একটা অতিরিক্ত কণা আছে, যার নিজের ভর আছে এবং সে শূন্যের মধ্যে খানিকটা শক্তি ছড়িয়ে রাখে। শূন্যাবস্থায় শক্তি বিরাজ করা কোয়ান্টাম তত্ত্বে নতুন কথা নয়। হাইজেনবার্গ এর অনিশ্চয়তা তত্ত্বের মধ্যেই লুকিয়ে আছে এর মূল সুর। তবে এতোদিন শূন্যে লুকিয়ে থাকা শক্তি নিয়ে খুব বেশি হৈ চৈ হয়নি। হিগস বোসনের ধারণা যখন করা হলো তখনই বেশি করে প্রয়োজন হলো শূন্যস্থানের শক্তির ব্যাপারটা। তসে সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে ভর নিয়ে একটু ভাবা যাক। কোনও স্থির বস্তুকে বাহ্যিক কোনো বলের (force) সাহয্যে ঠেলা দিলে সে কত তাড়াতাড়ি গতি পাবে তা নিশ্চিত করে তার ভর। ভর যত বেশি হবে, সে গতি পাবে তত ধীরে।
ধরা যাক শুকনো স্বাভাবিক রাস্তায় একটা লোক হাঁটছেন। এক্ষেত্রে তাঁর হাঁটার গতি স্বাভাবিক। কিন্তু রাস্তায় যদি হাঁটু পরিমাণ পানি জমে থাকে, তবে তার হাঁটার গতি আর আগের মতো থাকবে না। বেশ কমে যাবে। আবার পানির বদলে রাস্তায় যদি মধু জমে থাকে তবে হাঁটার গতি আরো কমে যাবে।
যেহেতু আমরা হিগস বোসন কণা শূন্যের মধ্যে শক্তি ছড়িয়ে রাখে। ছড়িয়ে রাখা সেই শক্তি থাকে থাকে ক্ষেত্রের ভেতর. যেটার পোশাকি নাম হিগস ফিল্ড। আপাত ভরহীন অন্য কণাদের এগোতে হবে শূন্যের মধ্যে জমাট শক্তির ওই বাধা ঠেলে। আইনস্টাইনের E = mc^2 সমীকরণের ভেতরেই লুকিয়ে আছে- বস্তু ও শক্তি আসলে সমার্থক বিষয়। তাই জমে থাকা শক্তি, জমে থাকা বস্তুর মতো। সেই জমাট শক্তিকে ঠেলে সামনে এগুতে গেলে সব কণারই স্বাভাবিক গতি বাধাগ্রস্ত হয়। তখনই মনে হবে বস্তুটি ভারি। অর্থাৎ তাদের ভর আছে।
তাই ভর আছে দুর্বল নিউক্লিয় বলের সাথে সংশ্লিষ্ট দুটি কণা W এবং Z কণাদেরও ভর আছে। এই কণা দুটো আবিষ্কৃত হয়েছে প্রায় তিরিশ বছর আগে। এরা রীতিমতো ‘ভারী’ কণা। এদের কারণেই দুটি কণার মধ্যে দুর্বল নিউক্লিয় বলের সীমা খুব ছোট দূরত্বের মধ্যে আটকে থাকে।
এই প্রক্রিয়ার বাইরে কেবল আলোর কণা। কারণ, ফোটন শুধু তারই সঙ্গে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় অংশ নেয়, যার নিজস্ব বৈদ্যুতিক চার্জ আছে। হিগস বোসন চার্জহীন কণা। তাই তার শূন্যে ছড়ানো জমাট শক্তিও কোনও চার্জ বহন করে না, আর এ কারণেই আলোর কণা তার মধ্যে দিয়ে চলতে গেলে বাধা পায় না।
হিগস বোসনের কল্যাণে দুর্বল নিউক্লিয় তত্ত্বটির যে কাঠামো দাঁড়িয়েছিল এবং তা থেকে যেসব ঘটনার ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল- গত দুই দশকে তা বারবার প্রমাণিত হয়েছে। পাওয়া যায়নি স্ব¦য়ং কণাটিকেই। ২০০৯-এএলএইচসি চালু হয়। তার আগেই এই প্রজেক্টের মূল লক্ষ্য ছিল হিগস বোসন কণা খুঁজে বের করা।
এলএইচসি’র সাইক্লোট্রনে প্রবল গতি নিয়ে প্রোটন কণার স্রোত ছুটাছুটি করে পরস্পরকে ধাক্কা মারে। তা থেকে তৈরি হয় বহুরকমের কণা। কিছু ভারী কণাও তৈরি হয়। তবে তা অস্থায়ী। দ্রুতই সেই কণা কয়েকটা হালকা কণার জন্ম দিয়ে নিজে বিলুপ্ত হয়ে যায়। হিগ্স কণার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটার কথা। সাইক্লোট্রনে জন্ম নেয়া নানা ধরনের কণাকে পর্যবেক্ষণ করে, তাদের উৎস যে অন্য কণা নয়, হিগস কণা- এটা প্রতিষ্ঠা করাই ছিল পদার্থবিদদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
কেন একে ঈশ্বর কণা নামে ডাকা হয়। এর ফলে অনেকেই এলএইচসি’র গবেষণার সাথে ইশ্বরের যোগসূত্র খোঁজেন। ধারণা করেন, ইশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করাই এই গবেষণার আসল উদ্দেশ্য। আসল ব্যাপার কিন্তু তা নয়। যখন হিগস বোসন খুঁজে বের করার চ্যালেঞ্জ নিয়ে বিজ্ঞানীদের কপালে চিন্তার ভাঁজ, তখন নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী লিওন লেডারম্যান, তাঁর বিজ্ঞান নিয়ে লেখা একটি রসরচনামূলক বইয়ের শিরোনামে একে উল্ল্যেখ করলেন ‘দ্যা গডড্যাম পার্টিকেল’ বা ‘ইশ্বর নিকুচি’ বলে। উদ্দেশ্য ছিল একটু বাড়তি নাটকীয়তা সৃষ্টি করা। তৈরি হল স্থায়ী নাটক। প্রকাশনা সংস্থার সম্পাদকের কাছে নামটা শিষ্টাচার বহির্ভূত বলে মনে হল। তিনি কলম চালিয়ে ‘ড্যাম’ শব্দটা কেটে রেখে দিলেন ‘গড পার্টিকেল’। ব্যস, এ থেকেই জন্ম হল যত বিভ্রান্তির। এখন বিজ্ঞানীরা সবাইকে বুঝিয়ে কুল পাচ্ছেন না- তাদের কাজের সাথে, হিগস বোসন কণার সাথে ঈশ্বরানুসন্ধানের কোনই যোগাযোগ নেই।
[বইটির সূচীপত্র এবং সবগুলো খন্ডের লিংক একত্রে দেখুন এখানে]
বিজ্ঞান পত্রিকায় সম্পূর্ণ বইটি পড়া যাবে। তবে কেউ সংগ্রহে রাখতে চাইলে অনলাইনে কেনা যাবে ০১৫৫ ৭৭৭ ৯৩২৩ নম্বরে ফোন করে।
-আব্দুল গাফফার রনি
বিজ্ঞান লেখক
[লেখকের ফেসবুক প্রোফাইল]