[বইটির সূচীপত্র এবং সবগুলো খন্ডের লিংক একত্রে দেখুন এখানে]
অতি ক্ষুদ্র এক কণা। শক্তিশালী মাইক্রোস্কোপ দিয়েও দেখা যায় না। অথচ তার অস্তিত্ব আছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে কোনও বস্তুর ওপর তার কোনও প্রভাবও নেই। সামনে যত বাধাই আসুক তা ভেদ করে চলে যায়। পৃথিবীর মতো বিশাল একটা বস্তুও এর জন্য কোনও বাধাই নয়। তাহলে কণাটা আছে, এটা বুঝব কী করে? বিজ্ঞানীরাই বা মানবেন কেন? বিজ্ঞানীরা তো প্রথমে মানতেই চাননি। আবার না মেনে উপায়ও ছিল না। অথচ সেই কণা নাকি ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন তৈরি হচ্ছে প্রতি মুহূর্ত! কণাটার নাম নিউট্রনো। ২০১৫ সালে এরজন্য দুজন বিজ্ঞানী নোবেল পেয়েছেন।
অস্ট্রিয়ান বিজ্ঞানী উলফগ্যাং পাউলি। ‘পাউলির অপবর্জন নীতি’ নামে একটা বিখ্যাত সূত্র আছে পদার্থবিজ্ঞানে। সূত্রটা তাঁরই আবিষ্কার। এই পাউলিই সর্বপ্রথম নিউট্রন কণার ভবিষ্যদ্বাণী করেন। তবে এর পেছেনে আরেকজনের অবদান আছে। তিনি আরেক বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী নীলস বোর। ২৯২৯ সাল। বোর তখন বিখ্যাত বনে গেছেন তাঁর পরমাণু মডেলের কারণে। বোর একটা পরামর্শ চেয়ে চিঠি লিখলেন পাউলিকে। পাউলি বোরের চেয়ে ১৫ বছরের ছোট। তাছাড়া ততদিনে নোবেল প্রাইজ পেয়ে গেছেন বোর। তবুও ২৯ বছর বয়সী জুনিয়র বিজ্ঞানীর কাছে পরামর্শ কেন? কারণ পাউলি স্পষ্ট বক্তা হিসেবে বিখ্যাত। কোনও বিজ্ঞানীর তত্ত্ব ঠিক মনে না করলে, সসাসরি বলে ফেলতেন তাঁর বক্তব্য। তাঁর কটু মন্তব্যের ভয় পেতেন অনেক তরুণ বিজ্ঞানীও। এজন্য বোর তাঁর তত্ত্ব পরীক্ষা করতে পাঠিয়েছিলেন পাউলির কাছে। পাউলি বোরের ধারণার সাথে একমত হতে পারেননি। জবাবে লিখেছিলেন, ‘বিকিরণ বিষয়ে আপনার ধারণা মোটেও সন্তোষজনক নয়। আপততঃ আপনার ধারণা ঘুমিয়ে থাকুক আর নক্ষত্ররা আলো দিক শান্তিতে…!’ বোরের মুখের ওপর এমন জবাব দেওয়ার সাহস তখন অনেক ডাকসাইটে বিজ্ঞানীরও ছিল না।
কী এমন বলেছিলেন বোর?
দুই
নিউক্লিয়াসের ধণাত্মক চার্জের উৎস সন্ধান করতে গিয়ে রাদারফোর্ড ১৯১৯ সালে প্রোটন নামে এক ধরনের কণার অস্তিত্ব আবিষ্কার করেন। এই কণা ধণাত্মক চার্জের উৎস।
১৯৩২ সাল। রাদারফোর্ডের সহকর্মী জেমস চ্যাডউইক অদ্ভূত এক ধরনের কণার সন্ধান পেলেন নিউক্লিয়াসের ভেতরে। সেই কণার কোনও চার্জ নেই। অর্থাৎ চার্জ নিরপেক্ষ। তাই এর নাম দেওয়া হলো নিউট্রন। বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হলেন ইলেট্্রন, প্রোটান ও নিউট্রন- এই তিনটি মূলকণা দিয়েই পৃথিবীর সব মৌলিক পদার্থের সৃষ্টি। যৌগিক পদার্থগুলো আবার মৌলিক পদাথের্র পরমাণু দিয়ে তৈরি। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, পৃথিবীর সব বস্তু এই তিনটি মূল কণিকার সমন্বয়ে গঠিত। কিন্তু বিজ্ঞান এখানেই থেমে থাকলেন না। বিজ্ঞানী-সমাজে প্রশ্ন উঠল, নিউক্লিয়াসে প্রোটন ও নিউট্রন পরস্পরের সাথে দৃঢ়ভাবে যুক্ত থাকে কীভাবে? তাদের মধ্যে তো মহাকর্ষ বল ক্রিয়া করে না? তাছাড়া নিউট্রন চার্জ নিরেপেক্ষ কণা, অন্যদিকে প্রোটন পজেটিভ চার্জযুক্ত; তাই এদের মধ্যে কোনো বৈদ্যুতিক আকর্ষণ বল ক্রিয়া করার কথা নয়। আবার একই চার্জযুক্ত দুটি কণা পরস্পরকে বিকর্ষণ করে, তাই একাধিক প্রোটনযুক্ত নিউক্লিয়াসে বিকর্ষী বল ক্রিয়া করার কথা। এর ফলে প্রোটনগুলো নিউক্লিয়াসে আটকে না থেকে দূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ার কথা। তাহলে…?
এই সমস্যার সাথে তাঁরা লক্ষ করলেন আরেকটি অদ্ভুত ব্যাপার। একটা নিউক্লিয়াসের ভর এর ভেতরের প্রোটন ও নিউট্রনগুলোর আলাদা আলাদা ভরের যোগফলের সমান হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা হলো না। নিউক্লিয়াসের ভর প্রোটন ও নিউট্রনগুলোর আলাদা আলাদা ভরের যোগফলের সমান নয়। বেশ খানিকটা কম। তাহলে বাকি ভরটুকু গেলো কোথায়?
এই সমস্যদুটো সমাধানে এগিয়ে এলেন স্বয়ং আইনস্টাইন। নিউক্লিয়াসের ভেতর থেকে নিউক্লিয়নগুলো (প্রোটন ও নিউট্রনকে একত্রে নিউক্লিয়ন বলা হচ্ছে) আলাদা করতে হলে বিপুল পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন হয়। এই ব্যপারটাকে উল্টোদিক থেকে হিসাব করলে দাঁড়ায়, নিউক্লিয়নগুলো নিজেদের ভেতর যখন বন্ধন তৈরি করে তখন তারা ওই একই পরিমাণ শক্তি ছেড়ে দেয়। এই শক্তি নিউক্লিয়নগুলো কোথায় পায়? এই শক্তি উৎপাদন করার জন্য নিউক্লিয়নগুলো তাদের সামগ্রীক ভর কিছুটা কমিয়ে ফেলে। তাই নিউক্লিয়াসে ভর ঘাটতি দেখা দেয়। সেই ঘাটতি ভরটুকু আইনস্টাইনের বিখ্যাত সমীকরণ E = mc^2 অনুসারে বিপুল পরিমাণ শক্তিতে পরিণত হয়। আবার সুগঠিত নিউক্লিয়াসকে ভাঙতে গেলে সেই পরিমাণ শক্তি বাইরে থেকে প্রয়োগ করতে হয়। তখন নিউক্লিয়নগুলো সেই শক্তি গ্রহণ করে তাদের হারানো ভর ফিরে পায় এবং তাদের নিউক্লিয় বন্ধন ভেঙে যায়।
নিউক্লিয়াসের ভর ঘাটতির সমস্যা সমাধান হয়ে গেল, তাই বিজ্ঞানীরা ধরে নিলেন ইলেক্ট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন এই তিনটি মৌলিক কণা দিয়েই আমাদের দৃশ্যমান জগত গঠিত। কিন্তু তাঁদের সেই ধারণা ভুল প্রমাণিত করলেন মারে গেলম্যান নামের এক বিজ্ঞানী। ১৯৬৭ সালে গেলম্যান প্রমাণ করলেন ইলেক্ট্রন অবিভাজ্য কণা হলেও প্রোটন ও নিউট্রন তা নয়। কোয়ার্ক নামের আরো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিছু কণা দ্বারা মূলত প্রোটন-নিউট্রন তৈরি। কোয়ার্কের গল্প থাক। আমরা বরং আমাদের মূল বিষয়ে ফিরে যাই।
তিন
১৯০৫ সালে আলবার্ট আইনস্টাইন ভরশক্তির সমীকরণ E = mc^2 প্রকাশ করেন। এই সমীকরণ অনুসারে বস্তুর ভরকে শক্তিতে রূপান্তর করা যায়। ভর ও শক্তির মধ্যে সম্পর্ক তৈরি হলো। তখন বেরিয়ে এলো আরেকটি সূত্র। ভরশক্তির নিত্যতা সূত্র। আগে ভর ও শক্তির আলাদা আলাদা নিত্যতা সূত্র ছিল। নিত্যতা সূত্রে বলা হলো, মহাবিশ্বের ভর-শক্তির পরিমাণ সমসময় এক। নতুন করে ভর-শক্তির জন্ম দেওয়া যাবে না আবার মোট ভরশক্তির কমও হবে না। শুধু ভর-শক্তিকে এক অবস্থা থেকে আরেক অবস্থায় রূপান্তর করা যাবে।
কিন্তু নিত্যতা সূত্রগুলো লঙ্ঘিত মনে হলো কিছু তেজস্ক্রিয় পরামাণুতে। কিছু মৌলিক পদার্থ একধরনের রশ্মি বিকিরণ করে। ফলে এদের নিউক্লাসে ভাঙন ধরে। ভাঙনের পর সেই নিউক্লিয়াস অন্য পরমাণুর নিউক্লিয়াসে পরিণত হয়। যেমন ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াস তেজস্ক্রিয় রশ্মি বিকিরণ করে সিসাতে পরিণত হয়। তেজস্ক্রিয় ক্ষয়টা হয় একেবারে বাধাহীন প্রক্রিয়ায়। ইউরেনিয়াম যদি হাজার মাইল গভীর পাথরের নিচেও চাপা পড়ে থাকে, তবু সে রশ্মি বিকিরণ করে।
তিন ধরনের রশ্মি বিকিরণ করে তেজস্ক্রিয় পদার্থ। আলফা, বিটা ও গামা রশ্মি। রশ্মি বলছি ঠিক, তবে এগুলো ঠিক রশ্মি নয়, কণা। কণাগুলো বিকিরণের ফল হিসেবে রশ্মিগুলো দেখা যায়।
আলফা ও গামা রশ্মি ক্ষয়ে কোনও সমস্যা দেখা যায় না। ভর-শক্তির নিত্যতা বজায় থাকে। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল বিটা রশ্মি বিকিরণের সময়। যেসব পরমাণু বিটা রশ্মি বিকিরণ করে তাদের ক্ষেত্রে ভর-শক্তির নিত্যতা সূত্রের লঙ্ঘন দেখা গেল। যেমন ট্রিটিয়ামের কথাই ধরা যাক। ট্র্রিটিয়াম হলো দুটো প্রোটন ও একটা নিউট্রন যুক্ত হাইড্রোজেনের তেজস্ক্রিয় নিউক্লিয়াস। স্বাভাবিক হাউড্রোজেনে শুধুমাত্র একটি প্রোটন থাকে, কোনও নিউট্রন থাকে না। ট্রিটিয়াম নিউক্লিয়াসে থাকে দুটি নিউট্রন ও একটি প্রোটন। ট্রিটিয়াম বিটা রশ্মি নিঃসরণ করে হিলিয়াম নিউক্লিয়াসে পরিণত হয়। আর বিটা রশ্মি ইলেক্ট্রনের ভর ও বেগ নিয়ে ছিটকে চলে যায়। ফলে ট্রিটিয়ামের ভরশক্তি কিছুটা কমছে। অন্যদিকে কিছুটা ভরশক্তি নিয়েই পরমাণু থেকে ছিটকে বেরিয়ে যাচ্ছে ইলেক্ট্রন বা বিটা রশ্মি। ট্রিটিয়ামের হারানো ভরশক্তি ভরশক্তি নিউক্লিয়াস থেকে ছুটে বেরিয়ে যাওয়া ইলেকট্রনের ভরশক্তির সমান হওয়া উচিৎ। কিন্তু হিসাব কষে দেখা গেল বিটা রশ্মির ইলেক্ট্রনের ভরশক্তি কিছুটা কম।
তাহলে বাকি ভরশক্তি গেল কোথায়?
বিজ্ঞানীরা অনেক মাথা খাটিয়েও এর সমাধান বের করতে পারেনি। তখন বোর প্রস্তাব করলেন, পরামণুর অভ্যন্তরে চিরায়ত পদার্থ বিজ্ঞানের অনেক সূত্রই খাটে না। এ কারণেই জন্ম হয়েছিল কোয়ান্টাম মেকানিক্সের। অবশ্য কোয়ান্টাম মেকানিক্সের প্রথম প্রবক্তা ছিলেন বিখ্যাত জার্মান বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক। বোরের মতে, হারিয়ে যাওয়া ভর-শক্তির ব্যাখ্যা না পাওয়ার অর্থ ভরশক্তির নিত্যতা সূত্র কাজ করছে না এখানে। সূতরাং এক্ষেত্রে আমাদের নিত্যতা সুত্র পরিহার করতে হবে পারমাণবিক বস্তুগুলোর ক্ষেত্রে। আর এই প্রস্তাবটাই তিনি জানিয়েছিলেন পাউলিকে লেখা চিঠিতে।
পাউলি তখন এ বিষয়টা নিয়ে ভাবতে লাগলেন। তিনি ভর-শক্তির নিত্যতাকে বাদ দিতে চাইলেন না। কারণ আলফা ও গামা রশ্মি বিকিরণে ভরশক্তির নিত্যতা বজায় থাকে। বোরের কথা মানলে সেখান থেকেও ভরশক্তির নিত্যতা সুত্র বাদ দিতে হয়। আর সেটা করতে গেলে পারমণাবিক পদার্থবিজ্ঞানের অনেক বিষয়ই ওলট-পালট হয়ে যাবে। পাউলি একটু অন্যভাবে ভাবতে শুরু করলেন। ভাবলেন, হারানো ভরটুকু নিশ্চয়ই অন্য কোনও অদৃশ্য কণায় পরিণত হয়। কী সেই কণা? কণাটার অস্তিত্ববা ধরা পড়ে না কেন?
সেই কণাটার নাম নিউট্রনো। পাউলি বললেন সেই কণাটার চার্জ নেই। চার্জযুক্ত কণারা চার্জিত অন্য কণাদের দ্বারা আকৃষ্ট হয়। তাই বাতাসে বা অন্য বস্তুর মধ্যে তাদের মিথস্ক্রিয়া ঘটে। চার্জযুক্ত কণাকে তাই সহাজেই কণা-ডিটেক্টর যন্ত্র দিয়ে খুঁজে বের করা যায়। কিন্তু চার্জবিহীন কণা অন্য বস্তুর সাথে মিথষ্ক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার সম্ভবনা খুব কম। তাই চার্জহীন কণা খুঁজে পাওয়া মুস্কিল। চার্জযুক্ত ইলেকট্রন, প্রোটনের ততদিনে পাওয়া গেছে কিন্তু নিউট্রন তখনও আবিষ্কার হয়নি। তবে বিজ্ঞানীরা এটা নিশ্চিত ছিলেন বিট ক্ষয়টা হয় নিউক্লিয়ানের ভেতর থেকে এবং সেটার জন্য প্রোটন দায়ী নয়। অন্য কোনও উৎস থেকে সেটা আসছে। সেই উৎসটা যে নিউট্রন, তখনও পর্যন্ত তা অজানা। নিউট্রনের আবিষ্কারের গল্পও যথাসময়ে আসবে।
অদ্ভুত সেই কণা একে তো চার্জ নিরপেক্ষ তার ওপর এর ভেদন ক্ষমতা অত্যন্ত বেশি। অর্থাৎ কোনও কিছুর সাথে কণাটা বিক্রিয়া করে না, আবার কোনও ঘটনায় সে অংশ নেয় না। পাউলি কণাটার নামকরণ করলেণ ‘নিউট্রন’। অঙ্ক কষেও তাঁর তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করলেন। কিন্তু সামান্য যে ভর ঘাটতি দেখা যায়, সেই পরিমাণ ভরের কণা কল্পনা করাও কষ্ট। তাই পাউলি ধরে নিয়েছিলেন কণাটি ভরহীন। অনেকটা আলোর কণার মতো। ভর নেই কিন্তু শক্তি আছে। তবে কোনও জার্নালে সেই তত্ত্ব ছাপালেন না পাউলি। কারণ তাঁর মনে হয়েছিল, জার্নালের সম্পাদকরা এটাকে পাগলের প্রলাপ ভেবে বাতিল করে দেবেন।
১৯৩০ সালে জামার্নিতে বিশ্বের সব বাঘা বাঘা বিজ্ঞানী জড়ো হলেন এক সম্মেলনে যোগ দিতে। ওই সম্মেলনের মূল বিষয় ছিল বিটা রশ্মির সমাস্য নিয়ে আলোচনা করা। পাউলিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। কিন্তু তিনি জার্মানিতে গেলেন না।
আসলে তখন পাউলি ব্যক্তিগত জীবনের নানা টানাপোড়নে জর্জরিত। স্ত্রীর সাথে সংসার ভেঙে গেছে। স্ত্রী বিয়ে করেছেন আরেক রসায়ন বিজ্ঞানীর সাথে। মানসিকভাবে পুরোপুরি বিপর্যস্ত। গ্যালন গ্যালন মদ গিলেছেন। আবার মনোবিদের চিকিৎসা চলছে। অবসাদ ভুলতে নাচগান আর পার্টিতে সময় কাটাতেন। হৈ হুল্লোড় করে বেড়াতেন।
জার্মিনির ওই সম্মেলনে যোগ দেওয়া বিজ্ঞানীদের উদ্দেশ্যে একটা চিঠি লিখলেন পাউলি। সেই চিঠিতে ছিল তার কল্পিত কণাটির ব্যাপারে বিস্তারিত লিখলেন। আর লিখলেন, তিনি সম্মেলনে যোগদিতে পারলেন না তার কারণ, তার নৈশ পার্টিটা নাকি বিজ্ঞান সম্মেলনের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ!
১৯৩১ সালে ইতালিতে আরেকটি সম্মেলনের আয়োজোন করলেন বিখ্যাত বিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মি। পাউলি গেলেন সেখানে। তবে সম্মেলনে যোগ দিতে নয়, ফার্মির সাথে নতুন কণাটির বিষয়ে আলোচনা করতে। ফার্মি পাউলির কথার গুরুত্ব বুঝলেন। তবে নতুন কণাটির নাম একটু পাল্টে দিয়ে রাখলেন ‘নিউট্রনো’। এর অর্থ ‘ছোট নিউট্রন’।
ওই বছরই ব্রিটিশ পদার্থবিদ জেমস চ্যাডউইক পরামাণুর নিউক্লিয়াসের ভেতর নতুন একধরনের কণা আবিষ্কার করলেন। অনেকে ভাবলেন এই নতুন কণাটাই বোধহয় পাউলির ধারণা করা নিউট্রনো। কিন্তু পাউলির হিসাবের থেকে এই কণাটার ভর অনেক বেশি, প্রায় প্রোটনের সমান। কণাটি চার্জ নিরপেক্ষ। তাই চ্যাডউইক কণাটির নাম দিলেন নিউট্রন। আর পাউলির কণাটির নাম হয়ে গেল নিউট্রনো। তবে আরেকটা সমাধানও বেরুলো। সদ্য আবিষ্কৃত নিউট্রন থেকেই মূলত বিটা রশ্মির ক্ষয় হয়। তার ফলে জন্ম হয় একটা ইলেকট্রন ও নিউট্রনোর। সাথে একটা প্রোটনের জন্ম হয়। ওটা রয়ে যায় প্রোটনের ভেতরে। ফলে ট্রিটিয়ামে নিউক্লিয়াস পরিণত হয় হিলিয়াম নিউক্লিয়াস।
ফার্মি নিউট্রনো নিয়ে অনেক চিন্তা-ভাবনা করলেন। অনেক খেটেখুটে একটা বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ দাঁড় করালেন। ১৯৩৪ সালে সেটা পাঠালেন বিখ্যাত নেচার পত্রিকায়। কিন্তু নেচারের সম্পাদক সেটাকে ছাপার উপযুক্ত মনে করেননি। পরে জার্মানির একটা জার্নালে ছাপা হলো সেটা। সেই প্রবন্ধটাই আজ বিজ্ঞানের ইতিহাসে অন্যতম সেরা কাজ বলে বিবেচিত হয়। বিটা ক্ষয়ের সমস্যা সমাধানে ফার্মি এক নতুন ধরনের বলের প্রস্তাব করলেন। তখনও পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা দুই ধরনের বলের কথা জানতেন। মহাকর্ষ বল ও তড়িচ্চুম্বকীয় বল। ফার্মি প্রস্তাবিত সেই বল ‘দুর্বল নিউক্লিয়’ বল হিসেবে পদার্থবিজ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। এই বলের শক্তি তড়িচ্চুম্বকীয় বলের এক হাজার ভাগের একভাগ মাত্র।
ফার্মি বললেন, এই দুর্বল বলের কারণে পরমাণুর নিউক্লিয়াসে ভাঙন ধরছে। নিউক্লিয়াসের একটি নিউট্রন ভেঙে একটি প্রোটন ও একটি ইলেক্ট্রন তৈরি হচ্ছে। আর তৈরি হচ্ছে সেই রহস্যময় কণা নিউট্রনো। অবশ্য এক্ষেত্রে কণাটি নিউট্রনো নয়, প্রতি নিউট্রনো। আসলে সব কণারই একটি করে প্রতিকণা থকে। প্রতি-কণাগুলোর ভর বাস্তব কণাগুলোর সমান। কিন্তু ধর্ম সম্পূর্ণ বিপরীত। যেমন ইলেক্ট্রনের প্রতি কণা পজিট্রনের এর ভর ইলেক্ট্রনের সমান কিন্তু চার্জ ধনাত্মক। অর্থাৎ পাউলি যেটাকে নিউট্রনো মনে করতেন সেটা আসলে প্রতি-নিউট্রনো।
চার
প্রতি-কণার কথা যখন এসেই পড়ল তখন এদের সম্পর্কে সামান্য ধারণা রাখলে বুঝতে সুবিধা হয়। এবার আমি একটা উদ্ভট পশ্ন করব! ধরা যাক, এমন দুটি কণা আপনার সামনে পরীক্ষা করতে দেয়া হলো। এদের একটার ভর প্রোটনের সমান আরেকটার ভর ইলেকট্রনের সমান। কিন্তু প্রোটনের সমান ভরের কণাটির চার্জ নেগেটিভ এবং ইলেকট্রনের সমান ভারের চার্জ পজেটিভ। তাহলে ব্যাপারটা কেমন দাঁড়ায়? আমি জানি পদার্থ সম্পর্কে ধারণা কম এমন অনেক পাঠকই হয়তো বলবেন, দূর এ কখনো হয় নাকি? যারা যুক্তিবাদী তারা হয়তো বলবেন, আসলেই তো ভাবনার বিষয়! হ্যাঁ আসলেই ভাববার মতো বিষয় এটা।
ছোট্টবেলাই স্যারেরা আমাদের আই কিউ পরীক্ষার জন্য উদ্ভট সব প্রশ্ন করতেন। একটা মানুষের দুটি হাত আছে আবর একটা বানরেরও দুটি হাত আছে, তাহলে একটা গরুর কয়টি হাত আছে? তেমনি, একটা ডালে ছটি পাখি আছে, তুমি যদি একটা গুলি করে মেরে ফেলো তাহলে সেই ডালে আর কয়টি পাখি থাকে? কিংবা মনে করো, তোমাদের তিনটা মুরগি ছানা আছে, তার ভেতর থেকে শিয়াল বাবাজি পাঁচখানা মুরগি খেয়ে ফেলল, তবে তোমাদের আর কয়টি মুরগি থাকবে?
শেষ প্রশ্নটা নিয়ে আমরা মাথা ঘামাতে পারি। এই প্রশ্নের উত্তরে, আসাদের সবচেয়ে চটপটে বন্ধুটি বলেছিল, ‘দুটি থাকবে স্যার।’ তখন আমাদের সে কী হাসি! আমাদের সবচেয়ে চালাক বন্ধুটি চটপটে বন্ধুটিকে বলেছিল, ‘দূর বোকা, এটুকুও বুঝিসনে? তিনটা ছানাা থেকে শেয়াল পাঁচটা ছানা আবার খেতে পারে নাকি!’
পাঠক অধৈর্য হয়ো না। শেয়াল আর মুরগিছানার গল্প শোনাবার পেছনে আমার একটা উদ্দেশ্য আছে- প্রতি-পদার্থের বিষয়টা ভালোভাবে বোঝানো। এজন্য আমরা পল ডিরাকের কথা স্মরণ করতে পারি। তিনি নাকি সবকিছু ভাবতেন একটু ভিন্নভাবে। যেমন আমাদের এই শিয়ালের পাঁচটি মুরগি ছানা খাওয়ার গল্প শুনলে নির্ঘাৎ তিনি মুচকি একটা হাসি দিয়ে বলতেন, ‘কেন মাইনাস দুটো (-২) মুরগিছানা থাকে!’
সত্যি বলতে কি, মুরগিছানা আর শিয়ালের কোনো গল্প ডিরাকের শিক্ষকরা তাঁকে করেননি। তবে এ ধরনের কোনো প্রশ্ন করলে তিনি এমন ধরনের জবাবই দিতেন। তোর সোজা সাপ্টা যুক্তি- বীজগণিতের নিয়মে যদি এভাবে উত্তর বেরিয়ে আসে তাহলে তাঁর কী করার আছে! পল ডিরাকের উদ্ভট উত্তর আর উদ্ভট যুক্তি ক্লাসে যথেষ্ট কৌতুকপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করত। তবে তাঁর এ ধরনের চিন্তাধারায় পদার্থ বিদ্যার জগতে এক নতুন দুয়ার উন্মোচিত হয়েছিল। তিনি ভষ্যিদ্বাণী করেছিলেন একই ভরের ভিন্ন চার্জযুক্ত কণার অস্তিত্ব থাকতে পারে। ১৯৩১ সালে প্রথমবার ইলেকট্রনের প্রতি-পদার্থ পজিট্রনের ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন। পরের বছরেই কার্ল অ্যান্ডারসন পজিট্রন আবিষ্কার করে দেখালেন ডিরাকের অনুমান একশত ভাগ সত্যি। কার্ল অ্যান্ডারসন বিশেষ যন্ত্রে একটা পরমাণুর কক্ষপথ থেকে ইলেক্ট্রন সরিয়ে ফেলে দেখলেন সেখানে অটোমেটিক পজিট্রন তৈরি হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে এই পজিট্রন এলো কোথা থেকে?
এর উত্তরে পরে আসি, তার আগে জেনে নিই প্রতি-পদার্থের খুটিনাটি বিষয়গুলো। প্রতি-পদার্থ অনেকটা নেগেটিভ সংখ্যার মতো। একটা পজেটিভ সংখ্যার সাথে একটি নেগেটিভ সংখ্যা যোগ করলে যেমন কিছুই থাকে না, ঠিক সেরকম পদার্থের সাথে প্রতি-পদার্থ মিলিত হলে দুটোই অদৃশ্য হয়ে যায়! থাকে শুধু শক্তি। বিগ ব্যাং থিয়োরিকে প্রতিষ্ঠিত করতে প্রতি পদার্থের ভূমিকা ব্যাপক।
পরবর্তীকালে একই প্রক্রিয়ায় প্রোটনের প্রতি-কণা প্রতি-প্রোটন ও নিউট্রনেরও প্রতি-কণা প্রতি-নিউট্রন আবিষ্কার হয়। শুধু তাই নয় কোয়ার্কসহ প্রতিটি মৌলিক কণার প্রতি কণাও আবিষ্কার হয়। আমাদের চারপাশের জগত যেমন ইলেকট্রন ও প্রোটন দিয়ে তৈরি, প্রতি-প্রোটন, প্রতি-নিউট্রন ও পজিট্রনের সমন্বয়ে প্রতি-পদার্থ এমনকী প্রতি-পদার্থের জগত তৈরি হওয়া অসম্ভব নয়। বিজ্ঞানীরা পরীক্ষাগারে রীতিমতো প্রতি-পদার্থ তৈরি করে এর সত্যতার প্রমাণ দিয়েছেন।
একই ধরনের পদার্থ এবং প্রতি-পদার্থ একে অপরের সংস্পর্শে আসে সাথে সাথে একটা আরেকটাকে ধ্বংস করে শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে যায়। সেই শক্তির পরিমাণ আইনস্টাইনের বিখ্যাত ঊ=সপ২ ব্যবহার করে বের করা যায় খুব সহজেই।
প্রতি-পদার্থ সম্পর্কে দেশের জনপ্রিয় বিজ্ঞান লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল তাঁর ‘আরো একটুখানি বিজ্ঞান’ বইয়ে লিখেছেন, ‘সৃষ্টি জগৎ যেহেতু বারোটি মৌলিক কণা এবং তাদের প্রতি-কণা দিয়ে তৈরি হয়েছে কাজেই আমরা ধরে নিতে পারি এই জগতে আমরা যে রকম পদার্থ দেখতে পাব ঠিক সে রকম প্রতি-পদার্থও দেখতে পাব। কিন্তু এখানে একটি বড় রহস্য এখনো উন্মোচিত হয় নি। কোনো একটি অজ্ঞাত কারণে আমাদের দৃশ্যমান সৃষ্টি জগৎ পুরোটাই তৈরি হয়েছে পদার্থ দিয়ে, এখানে কোনো প্রতি-পদার্থ নেই। এটা গোপনে কোথাও রয়ে গেছে, আমরা দেখতে পাচ্ছি না, তার কোনো সম্ভাবনা নেই, কারণ পদার্থ প্রতি-পদার্থ একে অপরের সংস্পর্শে এলেই দুটোই ধ্বংস হয়ে শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে যাবে। কাজেই এটা কোনোভাবেই বিজ্ঞানীদের চোখকে ফাঁকি দিতে পারবে না।
এই সৃষ্টি জগৎ তৈরি হয়েছি বিগ ব্যাং (ইরম ইধহম) এর ভেতর দিয়ে, সেই বিগ ব্যাংয়ের পর সৃষ্টি জগতে কিন্তু সমান পরিমাণ পদার্থ এবং প্রতি-পদার্থ তৈরি হওয়ার কথা, সেই সমান পরিমাণ পদার্থ এবং প্রতি-পদার্থ একে-অপরের ধ্বংস করে সৃষ্টি জগতে শুধু শক্তি থাকার কথা। এই গ্রহ-নক্ষত্র, গ্যালাক্সি কিছুই থাকার কথা নয়, থাকার কথা শুধু শক্তিরÑ কিন্তু আমরা খুব ভালো করে জানি বিশ্বব্রহ্মান্ডতে পদার্থ রয়ে গেছে, গ্রহ-নক্ষত্র, গ্যালাক্সি রয়ে গেছে। কোনো একটি অজ্ঞাত কারণে প্রতি-পদার্থ পদার্থের কাছে হেরে গেছে এবং সৃষ্টি জগতের সকল প্রতি-পদার্থকে ধ্বংস করার পরও বাড়তি পদার্থ রয়ে গেছে যেটা দিয়ে আমাদের এই দৃশ্যমান জগৎ তৈরি হয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এখনো সঠিকভাবে জানেন না ঠিক কিভাবে ব্যাপারটা ঘটেছে।’
পাঁচ
ফিরে যাই ভূতুড়ে প্রতি-নিউট্রনোর গল্পে। এই কণা পাওয়া যাবে কীভাবে। কোনও বাধাই এর কাছে বাধা নয়। যে কণা সচ্ছন্দে সবকিছু ভেদ করে চলে যেতে পারে, সে আছে না নেই- তার প্রমাণই বা কীভাবে হবে? তখন রসিক পাউলি আবার তার রস ভান্ডার উন্মুক্ত করে বললেন, ‘আমি সাংঘাতিক এক কণার কথা কল্পনা করেছি যা সনাক্ত করা অসম্ভব!’ অনেকেই চেষ্টা করলেন পাউলি-ডিরাকের তত্ত্ব ধরে এগুতে। কেউই নিউট্রিনো কণার হদিস দিতে পারলেন না। সবাই যখন অসম্ভব মনে করছেন, তখন চীনা বিজ্ঞানী ক্যান-চ্যাঙ ওয়াং বাতলে দিলেন নতুন পথ। তিনি বললেন বিটা ক্ষয়ের পথ ধরে চললে নিউট্রনোর সন্ধান মিলবে না। ধরতে হবে উল্টো পথ। নিউট্রন থেকে বিটা ক্ষয়ের মাধ্যমে একটা প্রোটন, একটা ইলেক্ট্রন ও প্রতি-নিউট্রনোর জন্ম হয়। তাহলে বিটা ক্ষয়ের উল্টো পথে একটা প্রোটন ও প্রতি-নিউট্রনোর সংঘর্ষে নিশ্চয়ই একটি নিউট্রন ও পজিট্রন কণা জন্ম নেবে। অর্থাৎ কোথাও যদি নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ায় একসাথে নিউট্রন ও প্রোটনের জন্ম হয়, তাহলে নিশ্চিত হওয়া যাবে প্রোটন ও প্রতি-নিউট্রনোর সংঘর্ষ থেকেই এদের জন্ম হয়েছে।
দুই জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী হ্যানস বেথে ও রুডলফ পিয়ের্লেস হিসেব করে দেখান, প্রতি এক হাজার আলোকবর্ষ পুরু কোনও বস্তু ভেদ করার সময় একটি প্রতি-নিউট্রনোর সাথে প্রোটনের সাথে সংঘর্ষ ঘটতে পারে। আলোকবর্ষ হলো এক বছরে আলো যতটুকু যাই সেই পরিমাণ দূরত্ব! আলোর গতি সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার। তাহলে এক বছরে আলো কতটুকু দূরত্ব অতিক্রম করবে ভাবা যায়! বেথে আর পিয়ার্লেসের হিসাব শুনে পাউলি আবার চলে এলেন আলোচনায়। ঠাট্টা করে ধরে বসলেন বাজি। নিউট্রিনো কিংবা প্রতি-নিউট্রনো যিনি আবিষ্কার করবেন তাঁকে এক কেস শ্যাম্পেনের বোতল উপহার দেবেন পাউলি।
১৯৪০ সাল। মার্কিন পারমাণবিক গবেষণাগারে কাজ করেন ফ্রেডেরিক রেইনস। তাঁর মাথায় এলো নিউট্রনো ধরার আইডিয়া। একদিন তিনি আইডিয়ার কথা জানালেন বন্ধু ক্লাইড কাওয়ানকে। কাওয়ানেরও মনে ধরল সেই আইডিয়া। রেইনস হিসাব করে দেখেছিলেন, পারমাণবিক চুল্লিতে প্রতি মুহূর্তে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন প্রতি-নিউট্রনো ও পজিট্রন উৎপন্ন হয়। এদের দুয়েকটিকে প্রোটনের সাথে সংঘর্ষের করানো গেলে প্রতি-নিউট্রনোর অস্তিত্ব প্রমাণিত হবে। অতএব তাঁরা ফাঁদ পাতলেন। ফাঁদটা পাতা হলো নিউক্লিয় চুল্লির পাশে। আর তাঁদের এই কাজের নাম রাখলেন ‘প্রজেক্ট পোলটারগাইস্ট’। অর্থাৎ ‘ভূত ধরা প্রকল্প’!
ফাঁদটা হলো একটা পানির ট্যাঙ্ক। পানিতে মেশানো হলো ক্যাডমিয়াম ক্লোরাইড। চুল্লি থেকে নির্গত পজিট্রন পানির অণুর ইলেকট্রনের সাথে সংর্ঘষ ঘটাবে। ইলেকট্রন হলো বাস্তব কণা, তার প্রতি-কণা হলো পজিট্রন। কোনও বাস্তব কণা ও তার প্রতি-কণার মধ্যে সংর্ঘর্ষ ঘটলে উভয়ই ধংস হয়ে যায়। থাকে শুধু শক্তি। শক্তি হিসেবে নির্গত হয় আলোর কণা বা ফোটন। এখানকার এই পানির ট্যাঙ্কেও ইলেকট্রন আর পজিট্রনের সংঘর্ষে দুটি ফোটন কণা উৎপন্ন হবে। সেই ফোটন কণা অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য ডিটেক্টর বসানো হলো। অন্যদিকে পজিট্রনের সাথে যে নিউট্রনের জন্ম হবে সেটা ক্যাডমিয়ামের নিউক্লিয়াসের সাথে সংঘর্ষ লিপ্ত হয়ে আরেকটা ফোটনের জন্ম দেবে। আগের যে দুটো ফোটন জন্মেছিল, পরের ফোটনটা জন্মাবে তার এক সেকেন্ডের ২ লক্ষ ভাগের একভাগ সময়ে। ডিটেক্টরের সাহায্যে তিনটি ফোটনের ঝলক রেকর্ড করা হবে।
১৯৫৬ সালে রেইনস ও কাওয়ান ঘোষণা দিলেন তাঁরা প্রতি-নিউট্রনোর সন্ধান পেয়েছেন। পাউলি তখন আনন্দে আত্মহারা। ২৬ বছর পর তাঁর ভবিষ্যদ্বাণীর প্রমাণ মিলেছে! সে রাতেই বন্ধুদের নিয়ে এক কেস শ্যাম্পেন সাবাড় করলেন পাউলি। মজার কথা হলো এর ৩৯ বছর বছর পর ১৯৯৫ সালে মার্কিন পদার্থবিদ মার্টিন লুইস পার্লের সাথে ফ্রেডেরিক রাইনেসকে নোবেল প্রাইজ দেওয়া হয়। কিন্তু বঞ্চিত হলেন কাওয়ান। কারণ ১৯৭৫ সালেই তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। আরও মজার ব্যপার হলো রাইনসের আগেই নিউট্রনো গবেষণার জন্য তিন মার্কিন বিজ্ঞানী লিয়ন ম্যাক্স লেডারম্যান, মেলভিন শোয়ার্জ ও জ্যাক স্টাইনবার্গ ১৯৮৮ সালে নোভেল পেয়ে গেছেন। ১৯৬২ সালে তাঁরা আবিষ্কার করেন ‘মিউ নিউট্রনো’।
যাইহোক ১৯৫৬ সালে প্রতি-নিউট্রনো আবিষ্কারের পর বাস্তব নিউট্রনো আবিষ্কার তখন ছিল সময়ের ব্যাপার। পাউলি-রাইনস- কাওয়ানের নিউট্রনোর (অথবা প্রতি-নিউট্রনো) নাম ছিল ‘ইলেক্ট্রন নিউট্রনো’। লেডারম্যান, শোয়ার্জ আর স্টাইনবার্গের আবিষ্কার করেছিলেন ‘মিউ নিউট্রনো’। ২০০০ সালে আবিষ্কার হয় আরেক প্রকারের নিউট্রনো। সেটা হলো ‘টাউ নিউট্রনো’। পাউলির কল্পিত নিউট্রনোর সাথে একটা করে ইলেক্ট্র উৎপন্ন হয়, এজন্য এর নাম ইলেক্ট্রন নিউট্রনো। অন্যদিকে মিউ ও টাউ নিউট্রনোর সাথে উৎপন্ন হয় একটা করে মিউ ও টাউ কণা। তাই এদের এমন নাম।
২০০২ সালে আবারও নিউট্রনো গবেষণার জন্য নোবেল পান দুই বিজ্ঞানী। তাঁরা হলেন যুক্তরাষ্ট্রের রেমন্ড ডেভিস ও জাপানের মাসাতোশি কোশিবা। তাদের গবেষণাও অবশ্য সত্তরের দশকে। নিউট্রনো আবিষ্কারের পর একটা ধাঁধায় পড়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। সূর্যের ভেতর ট্রিটিয়াম নিউক্লিয়াস ভেঙে হিলিয়ায়ে পরিণত হয় প্রতিনিয়ত। সাথে সাথে প্রতি ভাঙনে তৈরি হয় একটা করে প্রতি-নিউট্রনো। কিন্তু যতগুলো প্রতি-নিউট্রনো উৎপন্ন হয় তার শতকরা ত্রিশ ভাগ মাত্র পৃথিবীতে আসে। বাকিরা তাহলে কোথায় যায়? ডেভিস ও কোশিবা বাকি সত্তরভাগ নিউট্রনোর হদিস দেন। তাঁরা বলেন, বাকি নিউট্রনো মাঝপথে রূপ বদলায়। এক নিউট্রনো রূপ বদলে অন্য নিউট্রনোতে পরিণত হয়। আসলে সূর্যের নিউট্রনো খুঁজে বের করে যেসব ডিটেক্টর সেগুলো শুধু ইলেক্ট্রন-নিউট্রোনো (আসলে প্রতি-নিউট্রনো) শনাক্ত করতে পারত। মিউ ও টাউ নিউট্রনো শনাক্ত করতে পারত না। তখন কেউ বুঝতেই পারেননি এক নিউট্রনো রূপ বদলে আরেক নিউট্রিনোতে পরিণত হয়। কিন্তু সমস্যা হলো কোনও কণা তখনই রূপ বদলাতে পারে যখন তার ভর থাকে। এতদিন বিজ্ঞাীরা ভাবতেন নিউট্রনোর ভর নেই। কোশিবা দেখালেন, খুব সামান্য হলেও নিউট্রনোর ভর আছে।
নিউট্রনোর ভর আছে সেটা প্রমাণ তো করতে হবে। এ বিষয়ে গবেষণা চালিয়ে যান জাপানের তাকআকি কাজিতা ও কানাডার আর্থার বি ম্যাকডোনাল্ড। অবশেষে তাঁরা নিউট্রনোর ভর নির্ণয় করতে সক্ষম হন। অবশ্য আলাদা আলাদাভাবে ইলেক্ট্রন, মিউ ও টাউ নিউট্রনোর ভর নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। তাঁরা নির্ণয় করেছেন তিন ধরনের নিউট্রনোর মিলিত ভর। মিলিত ভরও কিন্তু খুব সামান্য। একটা ইলেক্ট্রনের ভরের দশ লক্ষ ভাগের এক ভাগ মাত্র! এজন্যই কাজিতা ও ম্যাকডেনাল্ডকে ২০১৫ সালে নোবেল প্রাইজ দেওয়া হয়েছে।
[বইটির সূচীপত্র এবং সবগুলো খন্ডের লিংক একত্রে দেখুন এখানে]
বিজ্ঞান পত্রিকায় সম্পূর্ণ বইটি পড়া যাবে। তবে কেউ সংগ্রহে রাখতে চাইলে অনলাইনে কেনা যাবে ০১৫৫ ৭৭৭ ৯৩২৩ নম্বরে ফোন করে।
-আব্দুল গাফফার রনি
বিজ্ঞান লেখক
[লেখকের ফেসবুক প্রোফাইল]