মহিমান্বিত নকশা (The Grand Design): পর্ব-৭

0
602

[বইটির সূচিপত্র তখা সব পর্বের লিংক দেখুন এখানে]

সপ্তম অধ্যায়: প্রতীয়মান অলৌকিকতা (Apparent Miracle)

চৈনিকদের মাঝে প্রচলিত গল্প মতে সাঁই ডায়নাস্টি (খ্রিষ্টপূর্ব ২২০৫-১৭৮২) স্থিতিকালের একসময় আমাদের মহাজাগতিক পরিবেশ হঠাৎ করে পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিলো। আকাশে দশটি সূর্য আবির্ভূত হয়েছিলো। পৃথিবীর মানুষজন ভীষণ তাপের কারণে ভুগতে লাগলো, তাই সম্রাট এক বিখ্যাত তীরন্দাজকে হুকুম দিয়েছিলেন বাড়তি সূর্যগুলোকে কতল করার জন্য। তীরন্দাজকে এমন একটি ঔষধের বড়ি দিয়ে পুরষ্কৃত করা হয়েছিলো যেটি খেলে সে অমরত্ব লাভ করবে, কিন্তু তার স্ত্রী বড়িটি চুরি করে। সেই অপরাধে স্ত্রীকে চাঁদে নির্বাসিত করা হয়েছিলো।

চৈনিকেরা বুঝেছিলো যে দশটি সূর্যের সৌরব্যবস্থা মানবজীবনের জন্য বন্ধুবৎসল কিছু নয়। বর্তমানে আমরা জানি, হয়তো সূর্যস্নানের জন্য সুবিধাজনক হলেও একাধিক সূর্যের সৌরব্যবস্থা কখনোই প্রাণের বিকাশের জন্য সহায়ক নয়। কারণগুলো চৈনিক কিংবদন্তিতে কল্পিত লৌহতপ্ত তাপের মতো সরল নয়। প্রকৃতপক্ষে, একটি গ্রহ মনোরম তাপমাত্রা অনুভব করবে যদি একাধিক নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণ করে, অন্তত কিছু কালের জন্য। কিন্তু জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় দীর্ঘ সময় ধরে পরিমিত তাপ নাও পেতে পারে। কেনো নয় সেটি বোঝার জন্য চলুন একাধিক-নক্ষত্র ব্যবস্থায় কী ঘটে সেটি খতিয়ে দেখি। দুটো সূর্য নিয়ে গঠিত সৌরব্যবস্থাকে বলা হয় যুগলব্যবস্থা (binary system)। মহাকাশের সব নক্ষত্রগুলোর প্রায় অর্ধেক এমন যুগলব্যবস্থার সদস্য। কিন্তু এমনকি সরলতম যুগলব্যবস্থা-ও কেবল নির্দিষ্ট ধরণের কক্ষপথ অক্ষুণ্ন রাখতে পারে, নিচের চিত্রে দেখুন। এই কক্ষপথগুলোর প্রতিটির কোনো এক সময়ে এমন অবস্থা হয় যে গ্রহটি জীবনধারণের জন্য হয় খুব বেশি গরম অথবা খুব শীতল অনুভব করে। পরিস্থিতি আরো খারাপ হয় যদি অধিক সংখ্যক নক্ষত্র থাকে।

আমাদের সৌরব্যবস্থার আরো একটি “সৌভাগ্যজনক” বৈশিষ্ট্য রয়েছে যেটি ছাড়া জটিল জীবন-রূপ কখনোই বিকশিত হতো না। উদাহরণস্বরূপ, নিউটনের সূত্রাবলি হয় বৃত্ত অথবা উপবৃত্ত (উপবৃত্ত হচ্ছে পিষ্ট হওয়া বৃত্ত, এক অক্ষ বরাবর প্রশস্ত এবং অন্য অক্ষ বরাবর চিকন) গ্রাহিক কক্ষপথের অনুমোদন করে। কোন ডিগ্রিতে একটি উপবৃত্ত পিষ্ট হয়েছে তা বর্ণনা করা হয় উৎকেন্দ্রিকতা অনুসারে, শূন্য থেকে এক পর্যন্ত মানের একটি সংখ্যা। শূন্যের কাছাকাছি উৎকেন্দ্রিকতা মানে জ্যামিতিক চিত্রটি একটি বৃত্তের সদৃশ, অন্যদিকে একের কাছাকাছি উৎকেন্দ্রিকতা মানে এটি খুবই চেপ্টা। গ্রহগুলো যে বৃত্তাকার পথে প্রদক্ষিণ করে না এই ধারণা কেপলারকে বিচলিত করেছিলো, কিন্তু পৃথিবীর প্রায় ২ শতাংশের মতন উৎকেন্দ্রিকতা আছে অর্থাৎ এটি প্রায় বৃত্তাকার। দেখা গেলো যে এটি সৌভাগ্যের চিহ্ন।

পৃথিবীতে মৌসুমি আবহাওয়া চক্র প্রধানত নির্ধারিত হয় সূর্যের চারপাশে পৃথিবীর কক্ষপথের তলের সাপেক্ষে পৃথিবীর ঘূর্ণন অক্ষের কাত হওয়ার মাধ্যমে। উদাহরণস্বরূপ, উত্তর গোলার্ধে শীতকালের সময় উত্তর মেরু সূর্যের দিক থেকে দূরে কাত হয়ে থাকে। ওই সময় পৃথিবী সূর্যের সবচেয়ে নিকটবর্তী থাকে- কেবল ৯১.৫ মিলিয়ন মাইল দূরে, এবং জুলাইয়ের প্রথমদিকে প্রায় ৯৪.৫ মাইল দূরে থাকার সময় কাত হওয়ায় সৃষ্ট প্রভাবের সাথে তুলনামূলকভাবে খুবই নগণ্য প্রভাব সৃষ্টি করে। কিন্তু যেসব গ্রহের উৎকেন্দ্রিকতা বড়, সূর্য থেকে দূরত্বের তারতম্যে বড় ধরণের প্রভাব সৃষ্টি হয়। যেমন, বুধগ্রহের প্রায় ২০ শতাংশ উৎকেন্দ্রিকতা রয়েছে, ফলে গ্রহটি যখন সূর্য থেকে সবচেয়ে দূরে থাকে সেই সময়ের চেয়ে যখন সবচেয়ে বেশি নিকটবর্তী থাকে তখনকার তাপমাত্রা ২০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট বেশি উষ্ণতর। প্রকৃতপক্ষে, আমাদের পৃথিবীর কক্ষপথের উৎকেন্দ্রিকতা যদি একের কাছাকাছি হতো তবে আমরা যখন সূর্যের সবচেয়ে কাছাকাছি হতাম তখন আমাদের মহাসমুদ্রগুলো ফুটতে শুরু করতো, এবং যখন সূর্য থেকে সবচেয়ে দূরে থাকতাম তখন বরফ হয়ে যতো, ফলে গ্রীষ্মকালীন অথবা শীতকালীন অবকাশ হতো দুর্বিষহ। কক্ষপথের বড় উৎকেন্দ্রিকতা জীবনের জন্য সহায়ক নয়, সুতারাং আমরা ভাগ্যবান যে আমাদের গ্রহের কক্ষপথের উৎকেন্দ্রিকতা প্রায় শূন্যের কাছাকাছি।

সূর্যের ভর ও সূর্য থেকে আমাদের দূরত্বের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও আমরা ভাগ্যবান। কারণ একটি নক্ষত্রের ভর নির্ধারণ করে সেটি কী পরিমাণ শক্তি নির্গত করবে। বিশাল নক্ষত্রগুলো আমাদের সূর্যের চেয়ে প্রায় একশ গুণ বেশি ভরের অধিকারী, অন্যদিক প্রায় একশ গুণ কম ভরের ছোট নক্ষত্র-ও আছে। পৃথিবী-সূর্যের যে দূরত্ব বিদ্যমান সেই একই দূরত্ব অনুমান করে, যদি আমাদের সূর্যের ভর ২০ শতাংশ কম অথবা বেশি হতো, তবে পৃথিবী বর্তমান মঙ্গলগ্রহের তুলনায় অনেক ঠাণ্ডা হতো অথবা বর্তমান শুক্রগ্রহের চেয়ে অধিক উষ্ণ হতো।

প্রথাগতভাবে, যে কোনো নক্ষত্রের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানিরা নক্ষত্রটির চারপাশে একটি অপ্রশস্ত অঞ্চলকে বসবাসযোগ্য অঞ্চল হিসেবে সীমা নির্ধারণ করেন, যেখানটায় তাপমাত্রা এমন হবে যে তরল পানির অস্তিত্ব সম্ভব। বসবাসযোগ্য অঞ্চলকে অনেকসময় “গোল্ডিলকস অঞ্চল” (Goldilocks zone) বলে, কারণ পানির অস্তিত্ব থাকার আবশ্যিক শর্ত বোঝাচ্ছে যে বুদ্ধিমান জীবনের জন্য গ্রহের তাপমাত্রা “যথাযথ সঠিক” হওয়া প্রয়োজন। আমাদের সৌরব্যবস্থার বসবাসযোগ্য অঞ্চল ছোট। আমাদের মতো বুদ্ধিমান জীবন-রূপের জন্য সৌভাগ্য যে পৃথিবীর অবস্থান ঠিক ওখানেই!

নিউটন বিশ্বাস করতেন যে আমাদের এই অদ্ভুত বসবাসযোগ্য সৌরব্যবস্থা “নিছক প্রাকৃতিক নিয়মাবলি দ্বারা বিশৃঙ্খলা হতে উদ্ভুত” হয় নি। বরং, তিনি অটল থাকলেন যে মহাবিশ্বের শৃঙ্খলা “সৃষ্টি হয়েছিলো ঈশ্বর কর্তৃক এবং তার মাধ্যমে বর্তমান সময় পর্যন্ত একই অবস্থায় ও পরিস্থিতিতে সংরক্ষিত হয়েছিলো।” সহজেই বোঝা যায় কেউ একজন কেনো এরকমভাবে ভাববে। আমাদের অস্তিত্ব সংঘটনে সাহায্য করা অনেক অভাবনীয় ঘটনা এবং আমাদের জগতের মানব-বন্ধুবৎসল রূপরেখা যে কাউকেই ধাঁধায় ফেলবে যে আমাদেরটিই কি মহাবিশ্বের একমাত্র বিশেষ সৌরব্যবস্থা! কিন্তু ১৯৯২ সালে আমাদের সূর্যের মতো অন্য একটি নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণ করা গ্রহকে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিলো। আমরা এখন ওই রকম শত শত গ্রহের ব্যাপারে জানি, এবং অনেকে সন্দেহ করেন যে আমাদের মহাবিশ্বের অনেক বিলিয়ন নক্ষত্রের মাঝে এই রকম অগণিত গ্রহের অস্তিত্ব আছে। ফলে এটি আমাদের গ্রাহিক পরিস্থিতি অর্থাৎ কেবল একটি সূর্য, পৃথিবী-সূর্যের দূরত্ব ও সূর্যের ভরের সৌভাগ্যজনক সাম্য ইত্যাদি মিলিয়ে শুধু মানবজাতির চাহিদার জন্য আমাদের পৃথিবীকে সতর্কতার সাথে গঠন করা হয়েছিলো এমন ধারণার প্রমাণ খুবই কম, এবং যেগুলো বিদ্যমান সেগুলো কম জোতদারি। বিভিন্ন ধরণের গ্রহের অস্তিত্ব আছে। কিছু গ্রহ অথবা অন্তত একটি গ্রহ জীবনকে ধারণ করে। অবশ্যই, ওই গ্রহটির জীবন-সত্তা যখন তাদের জগতের আশপাশ পর্যবেক্ষণ করে তখন তারা নিশ্চিতভাবে খুঁজে পায় যে তাদের পরিবেশ বেঁচে থাকার জন্য আবশ্যিক শর্তগুলোকে সন্তুষ্ট করছে।

উপরের শেষ বিবৃতিটিকে একটি বৈজ্ঞানিক নীতিতে রূপান্তর করা সম্ভব: আমাদের গূঢ় অস্তিত্ব একটি নিয়ম আরোপ করে যে কোথা থেকে এবং কোন সময়ে আমাদের পক্ষে মহাবিশ্বকে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব। অর্থাৎ, আমাদের অস্তিত্ব যে ধরণের পরিবেশে আমরা বসবাস করি তার বৈশিষ্ট্যাবলিকে সীমাবদ্ধ করে। এই তত্ত্বকে বলা হয় দুর্বল মানবীয় তত্ত্ব (weak anthropic principle)। (আমরা শীঘ্রই দেখবো কেনো “দুর্বল” বিশেষণটি যোগ করা হয়েছে।) “মানবীয় তত্ত্ব” শব্দগুলোর চেয়ে আরো ভালো পরিভাষা হবে “নির্বাচন তত্ত্ব,” কারণ তত্ত্বটি নির্দেশ করে কীভাবে আমাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে আমাদের নিজস্ব জ্ঞান সম্ভাব্য সকল পরিবেশ থেকে শুধুমাত্র যেসব পরিবেশ জীবনধারণের উপযোগী সেগুলোকে নির্বাচন করার জন্য কিছু নিয়মাবলি আরোপ করে।

যদিও শুনতে দর্শনশাস্ত্রের মতো মনে হয়, তারপরও দুর্বল মানবীয় তত্ত্বটিকে বৈজ্ঞানিক ভবিষ্যদ্বাণী করার জন্য ব্যবহার করা যাবে। উদাহরণস্বরূপ, আমাদের মহাবিশ্বের বয়স কতো? আমরা শীঘ্রই দেখবো যে আমাদের অস্তিত্বের জন্য মহাবিশ্বে অবশ্যই কার্বন থাকতে হবে, যেটি কিনা নক্ষত্রের ভেতরে হালকা পরমাণুসমূহ থেকে তৈরি হয়। তারপরে অতিকায় নবনক্ষত্র বিস্ফোরণে সেই কার্বনকে মহাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে হবে, এবং অবশেষে একটি নতুন-প্রজন্মের সৌরব্যবস্থায় একটি গ্রহের অংশ হিসেবে ঘনীভূত হতে হবে। ১৯৬১ সালে পদার্থবিজ্ঞানি রবার্ট ডিক যুক্তি দিলেন যে এই প্রক্রিয়া প্রায় দশ বিলিয়ন বছর সময় নেয়, সুতারাং আমাদের অস্তিত্ব নির্দেশ করছে যে মহাবিশ্বকে কম করেও এই বয়েসী হতে হবে। অন্যদিকে, মহাবিশ্বের বয়স ১০ বিলিয়ন বছরের চেয়ে খুব বেশি হওয়া উচিত নয়, সেক্ষেত্রে নক্ষত্রগুলোর সকল জ্বালানি ব্যবহৃত হয়ে যাওয়ার কথা, অথচ আমাদের অস্তিত্বের জন্য তপ্ত নক্ষত্র আবশ্যক। সুতারাং, মহাবিশ্ব অবশ্যই প্রায় ১০ বিলিয়ন বছর বয়েসী হতে হবে। এটি খুব সূক্ষ্ম গণনা নয়, কিন্তু সত্য বটে- বর্তমান তথ্যউপাত্ত মতে মহাবিস্ফোরণ হয়েছিলো প্রায় ১৩.৭ বিলিয়ন বছর আগে।

মহাবিশ্বের বয়েসের মতো, মানবীয় তত্ত্ব যেকোনো ভৌত ধ্রুবকের জন্য নির্ভুল কোনো মান নির্দেশ না করে মানের ব্যাপ্তি বা বিস্তার অনুমান করে। কারণ আমাদের অস্তিত্বের জন্য অনেক ভৌত ধ্রুবকের সুনির্দিষ্ট মান আবশ্যক নয়, অনেক সময়ই আমাদের প্রাপ্ত মানের কাছাকাছি একটি মান হলেই চলে। অধিকন্তু আমরা আশা করি যে আমাদের মহাবিশ্বের প্রকৃত অবস্থা মানবীয় তত্ত্বের অনুমোদিত ব্যাপ্তির মধ্যে পড়বে বা তত্ত্বের অনুমানের সাথে মানানসই হবে। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো গ্রহের উৎকেন্দ্রিকতা শূন্য থেকে ০.৫ হলে জীবনের বিকাশ সম্ভব হয়, তবে কোনো উৎকেন্দ্রিকতার মান ০.১ আমাদের বিস্মিত না করার কথা কারণ মহাবিশ্বের সকল গ্রহাবলির মাঝে অনেক গ্রহেরই এতো ছোট উৎকেন্দ্রিকতা থাকা সম্ভব। কিন্তু যদি দেখা যেতো যে পৃথিবী প্রায় বৃত্তিক পথে প্রদক্ষিণ করে অর্থাৎ এর উৎকেন্দ্রিকতা ধরুন ০.০০০০০০০০০০১ হতো, তবে পৃথিবীকে একটি বিশেষ গ্রহ হিসেবে গণ্য করতে হতো বটে, এবং ব্যাপারটি কেনো আমরা এই রকম একটি ব্যতিক্রমী গ্রহে বসবাস করছি তা ব্যাখ্যা করতে আমাদের উদ্বুদ্ধ করতো। এই ধারণাকে অনেক সময় সাধারণত্বের নীতি (principle of mediocrity) বলা হয়।

সৌভাগ্যজনক মিলগুলো যেমন গ্রহের কক্ষপথের আকার-আকৃতি, সূর্যের ভর ইত্যাদিকে বলা হয় পরিবেশগত, কারণ সেগুলো আমাদের চারপাশ থেকে দৈবক্রমে উদ্ভূত এবং প্রকৃতির মৌলিক নিয়মাবলি থেকে আকস্মিক সৌভাগ্য হিসেবে আবির্ভূত নয়। মহাবিশ্বের বয়েস-ও একটি পরিবেশগত ব্যাপার, যেহেতু মহাবিশ্বের ইতিহাসের পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী কোনো এক সময়ে আমাদেরকে অবশ্যই এই সময়ব্যাপ্তিতে বসবাস করতে হবে কারণ এটিই একমাত্র জীবনের জন্য সহায়ক সময়ব্যাপ্তি। পরিবেশগত মিলগুলো বোঝা খুবই সহজ কারণ মহাবিশ্বের অগণিত গ্রহ-নক্ষত্রের মাঝে আমাদেরটিই একমাত্র মহাজাগতিক আবাসভূমি, এবং আমাদেরকে অবশ্যই জীবনধারণযোগ্য এমন একটি আবাসভূমিতে অস্তিত্বমান থাকতে হবে।

দুর্বল মানবীয় তত্ত্ব খুব বেশি বির্তকিত নয়। কিন্তু এটির আরো একটি সুদৃঢ় রূপ রয়েছে যেটি আমরা আলোচনা করবো, যদিও অনেক পদার্থবিজ্ঞানি এটিকে তাচ্ছিল্যজ্ঞান করেন। সবল মানবীয় তত্ত্ব মতে, আমাদের অস্তিত্ব কেবল আমাদের পরিবেশের উপরই চাপ সৃষ্টি করে না, বরং প্রকৃতির নিয়মাবলির সম্ভাব্য রূপ এবং উপাদান বা অংশের উপর-ও চাপ বা সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি করে। এই ধারণা উদ্ভূত হওয়ার কারণ হচ্ছে যে আমাদের সৌরব্যবস্থার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যাবলিই কেবল মাত্র মানব জীবন বিকাশের জন্য অদ্ভুতভাবে সহায়ক নয়, বরং পুরো মহাবিশ্বের বৈশিষ্ট্যাবলিই আমাদের আনুকূল্যে, এবং ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করা আরো কঠিন।

হাইড্রোজেন, হিলিয়াম এবং কিছু পরিমাণ লিথিয়ামের আদিম মহাবিশ্ব- যেটি আমাদের মতো বুদ্ধিভিত্তিক প্রাণের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে সেটির কথা কয়েক অধ্যায়ে লিখলেও শেষ হবে না এমনই বিশাল। আমরা পূর্বে যেমন উল্লেখ করেছিলিম, প্রকৃতির বলগুলো এমন হওয়ার দরকার ছিলো যে ভারী উপাদানগুলো (যেমন- কার্বন) আরো হালকা আদিম উপাদানগুলো থেকে গঠিত হতে পারে এবং কয়েক বিলিয়ন বছর ধরে স্থায়ী হয়। সেই ভারী উপাদানগুলো নক্ষত্রের অগ্নিকুণ্ড বা চুল্লিতে গঠিত হয়েছিলো, সুতারাং, প্রাকৃতিক বলসমূহ প্রথমে নক্ষত্র এবং ছায়াপথ গঠন করেছিলো। তারা উদ্ভুত হয়েছিলো আদি মহাবিশ্বের প্রায় সম্পূর্ণ সমরূপের সমঘনত্ব থেকে, কিন্তু ভাগ্য ভালো যে ১০০০০০ তে ১ ভাগে ঘনত্বের তারতম্য ছিলো। তা সত্ত্বেও, নক্ষত্রসমূহের অস্তিত্ব, এবং আমরা যেসব উপাদান দিয়ে গঠিত সেগুলো নক্ষত্রসমূহের ভেতরে যথেষ্ট ছিলো না। নক্ষত্রসমূহের সক্রিয় শক্তি বা গতি এমন হওয়ার দরকার ছিলো যে এক সময় সেগুলোর কোনো কোনোটি বিস্ফোরিত হবে এবং বিস্ফোরণ এমনতর হওয়ার প্রয়োজন ছিলো যে ভারী উপাদানগুলো মহাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। তাছাড়া, প্রকৃতির নিয়মাবলি এমনভাবে কর্তৃত্ব প্রয়োগ করার প্রয়োজন ছিলো যে বিস্ফোরণের অবশিষ্টাংশ পুনর্ঘনীভূত হয়ে ভারী উপাদান সমৃদ্ধ গ্রহ পরিবেষ্টিত নতুন প্রজন্মের তারার জন্ম দিবে। ঠিক যেমনটি আদি পৃথিবীতে অনেক ঘটনা এমন ধারায় সংঘটিত হওয়ার দরকার ছিলো যেসব আমাদের বিকাশের জন্য সহায়ক, ফলে প্রতিটি ব্যাপারই আমাদের অস্তিত্বের জন্য দরকারি ছিলো। তবে যেসব ঘটনার পরিণতি মহাবিশ্বের বিবর্তনকে প্রভাবিত করেছিলো সেগুলো কিন্তু প্রকৃতির মৌলিক বলসমূহের মধ্যকার ভারসাম্যের মধ্য দিয়ে পরিচালিত হয়েছিলো এবং আমাদের অস্তিত্বের জন্য সেগুলোর মিথস্ক্রিয়া সঠিকভাবে হওয়ার প্রয়োজন ছিলো।

দৈবক্রমে যে সৌভাগ্যজনক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিলো এই ধারণা ১৯৫০ সালের দিকে সর্বপ্রথম প্রস্তাব করেন ফ্রেড হয়েল। হয়েল বিশ্বাস করতেন যে সকল রাসায়নিক উপাদানই সর্বপ্রথম হাইড্রোজেন থেকে গঠিত হয়েছিলো, এবং হাইড্রোজেনই সত্যিকারের আদিম উপাদান। হাইড্রোজেনের সবচেয়ে সরলতম পারমাণবিক কেন্দ্র বা নিউক্লিয়াস রয়েছে- একটি প্রোটন সমৃদ্ধ, এক বা দুটো নিউট্রন সংযুক্ত অথবা কোনো নিউট্রন ছাড়াই। (হাইড্রোজেন বা যে কোনো নিউক্লিয়াসের বিভিন্ন রূপ অর্থাৎ একই সংখ্যক প্রোটন কিন্তু ভিন্ন সংখ্যক নিউট্রন নিয়ে গঠিত হওয়াকে আইসোটোপ বলা হয়।) এখন আমরা জানি যে হিলিয়াম এবং লিথিয়াম, যেগুলোর পরমাণু যথাক্রমে দুটো এবং তিনটি প্রোটন দিয়ে গঠিত, আদিমকালে অর্থাৎ যখন মহাবিশ্ব কেবল ২০০ সেকেন্ড বয়েসী ছিলো সেই সময়ে সংশ্লেষিত হয়েছিলো। অন্যদিকে, জীবন আরো জটিল উপাদানসমূহের উপর নির্ভর করে। কার্বন হলো সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সকল জৈবরাসায়নের ভিত্তি।

যদিও আপনি কল্পনা করতে পারেন যে “জীবন্ত” সত্তা যেমন বুদ্ধিমান কম্পিউটার বানানো হয় সিলিকনের মতো অন্যান্য ভারী উপাদান থেকে, কার্বনের অনুপস্থিতিতে জীবন স্বতঃস্ফূর্তভাবে উদ্ভুত বা বিবর্তিত হবে এমন ধারণার ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ আছে। কারণগুলো বেশ কৌশলসংক্রান্ত, অন্যান্য উপাদানের সাথে কার্বনের বন্ধন তৈরি করার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য আছে। উদাহরণস্বরূপ, কার্বন ডাইঅক্সাইড কক্ষ তাপমাত্রায় গ্যাসীয়, এবং জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু সিলিকন পর্যায় সারণীতে কার্বনের ঠিক নিচেরই একটি উপাদান, এটির প্রায় একই রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য আছে। তবুও, সিলিকন ডাইঅক্সাইড বা সিলিকা কোনো জীবন্ত সত্তার ফুসফুসের চেয়ে পাথরের স্তুপের জন্য অনেক দরকারি। তবে সিলিকন ভক্ষণ করে এবং নিয়মিতভাবে তাদের লেজকে তরল অ্যামোনিয়ার ডোবাতে কচলায় এমন জীবন-রূপের বা উদ্ভব বা বিবর্তন-ও হয়তো সম্ভব। কেবল দুটো সুস্থিত যৌগ গঠন করতে পারা আদিম উপাদানগুলো (হাইড্রোজেন ও লিথিয়াম) থেকে এই ধরণের প্রাণের বিচিত্র বিকাশ সম্ভব নয়; কারণ লিথিয়াম হাইড্রাইড হচ্ছে বর্ণহীন স্ফটিকধর্মী কঠিন পদার্থ, এবং হাইড্রোজেন একটি গ্যাস- দুটোর কোনোটিই বংশবৃদ্ধির অথবা প্রেমে পড়ার জন্য সহায়ক নয়। তাছাড়া আমরা হলাম কার্বনভিত্তিক জীবন-রূপ, এবং ফলে প্রশ্ন জাগে যে নিউক্লিয়াসে ছয়টি প্রোটন বিশিষ্ট কার্বন পরমাণু অথবা আমাদের শরীরের আরো ভারী পরমাণু বা উপাদান কীভাবে সৃষ্টি হয়েছিলো।

এইক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপ ছিলো যখন বয়েসী নক্ষত্রগুলো হিলিয়াম পুঞ্জীভূত করতে শুরু করে, তখন দুটো হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস সংঘর্ষে গলে জোড়া লেগে যায়। এই ফিউশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নক্ষত্রসমূহ শক্তি সৃষ্টি করে যা আমাদের উষ্ণতা যোগায়। দুটো হিলিয়াম অণু এরপর সংঘর্ষে চারটি প্রোটন সমৃদ্ধ বেরিলিয়াম নিউক্লিয়াস গঠন করে। তাত্ত্বিকভাবে, যখন বেরিলিয়াম তৈরি হয় তখন এটি তৃতীয় একটি হিলিয়ামের সাথে সংঘর্ষে কার্বন তৈরি করার কথা। কিন্তু এমনটি হয় না, কারণ বেরিলিয়ামের আইসোটোপ সৃষ্টির হওয়ার সাথে সাথে ক্ষয়ে হিলিয়াম নিউক্লিয়াসে পরিণত হয়।

পরিস্থিতি পাল্টালো যখন একটি নক্ষত্রের হাইড্রোজেনের মজুত শেষ হতে শুরু করে। তখন নক্ষত্রটির কেন্দ্র ভেঙে পড়তে শুরু করে যতক্ষণ পর্যন্ত না কেন্দ্রীয় তাপমাত্রা প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডিগ্রী কেলভিনে উন্নীত হয়। ওই পারিপার্শ্বিক অবস্থার চাপে, নিউক্লিয়াসগুলো পরস্পরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় এবং কিছু বেরিলিয়াম নিউক্লিয়াস ক্ষয়ে যাওয়ার আগেই হিলিয়াম নিউক্লিয়াসের সাথে সংর্ঘষ করতে পারে। এরপর বেরিলিয়াম হিলিয়ামের সাথে গলে জোড়া লেগে কার্বনের একটি সুস্থিত আইসোটোপ সৃষ্টি করে। কিন্তু মানুষের মতো রাসায়নিক যৌগের সমষ্টি গঠনের ক্ষেত্রে এই কার্বনের এখনো অনেক দূরের পথ পাড়ি দেয়া বাকি, যেটি এক গেলাস বর্দু (ফ্রান্সের বর্দু শহরে বানানো ওয়াইন) উপভোগ করতে পারে কিংবা মহাবিশ্ব সম্পর্কে প্রশ্ন করতে পারে। মানুষের মতন সত্তাসমূহের অস্তিত্বের জন্য এই কার্বনকে নক্ষত্রের কেন্দ্র থেকে অন্য কোনো “বন্ধুবৎসল” প্রতিবেশে অবশ্যই সরার দরকার পড়েছিলো। সেটি, আমরা আগে যেমন বলেছিলাম, সুসম্পন্ন হয়েছিলো যখন নক্ষত্র তার জীবনচক্রের শেষ অবস্থায় অতিকায় নবনক্ষত্র আকারে বিস্ফোরিত হয়ে কার্বন এবং অন্যান্য ভারী উপাদানগুলো নির্গত করেছিলো এবং পরবর্তীতে ঘনীভূত হয়ে গ্রহে রূপান্তরিত হয়েছিলো।

কার্বন সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে বলা হয় ত্রি-আলফা পদ্ধতি কারণ আলফা কণা হলো প্রক্রিয়াটিতে সংশ্লিষ্ট হিলিয়ামের আইসোটোপের নিউক্লিয়াসের আরেকটি নাম, এবং প্রক্রিয়াটিতে অবশেষে তিনটি আলফা কণা গলে জোড়া লাগে। প্রচলিত পদার্থবিজ্ঞান অনুমান করে যে ত্রি-আলফা পদ্ধতিতে কার্বন উৎপন্ন হওয়ার হার খুব ছোট হওয়া উচিত। এই কথাটি মনে রেখে, ১৯৫২ সালে হয়েল ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে একটি বেরিলিয়াম নিউক্লিয়াস এবং একটি হিলিয়াম নিউক্লিয়াসের সম্মিলিত শক্তির পরিমাণ পুরোপুরিভাবে কার্বনের আইসোটোপ সৃষ্টির একটি নির্দিষ্ট কোয়ান্টাম অবস্থার শক্তির পরিমাণের সমান হবে, অবস্থাটিকে বলা হয় অনুরণন (resonance), যা নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার হার বা গতিকে অনেক বাড়িয়ে দেয়। হয়েলের সময়ে এই রকম কোনো শক্তিস্তর সম্পর্কে জানা ছিলো না, কিন্তু হয়েলের সুপারিশের উপর নির্ভর করে ক্যালটেকের উইলিয়াম ফাওলার সেটির অন্বেষণ করে খুঁজে পেয়েছিলেন, যা ছিলো কীভাবে জটিল নিউক্লিয়াসসমূহ সৃষ্টি হয়েছিলো সেই সম্পর্কিত হয়েলের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সমর্থন।

হয়েল লিখেছিলেন, “আমি বিশ্বাস করি না যে প্রমাণগুলো পরীক্ষা করেছেন এমন কোনো বিজ্ঞানি সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হবেন যে নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মগুলোকে নক্ষত্রের ভেতরে নিয়মগুলো কী প্রভাব সৃষ্টি করবে সেই ধারণা মাথায় রেখে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে।” সেই সময়ে কেউ দৈবযোগে সৃষ্ট এই যথাযথ ভৌত নিয়মাবলি বুঝতে পারার জন্য নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞান সম্পর্কিত যথেষ্ট ভালো জ্ঞান রাখতো না। কিন্তু সবল মানবীয় তত্ত্বের সত্যতা নিরূপণের জন্য সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পদার্থবিজ্ঞানিরা নিজেদের প্রশ্ন করা শুরু করলেন যে প্রকৃতির এই নিয়মগুলো ভিন্ন রকমের হলে মহাবিশ্বের রূপ কেমন হতো? বর্তমানে আমরা কম্পিউটার মডেল তৈরি করে গণনা করে বলতে পারি ত্রি-আলফা প্রক্রিয়ার হার কীভাবে প্রকৃতির মৌলিক বলসমূহের শক্তির উপর নির্ভর করে। সেই ধরণের গণনা মতে সবল কেন্দ্রকীয় বলের শক্তির ০.৫ শতাংশের অথবা তড়িৎ বলের ৪ শতাংশের মতো ক্ষুদ্র পরিবর্তন প্রতিটি নক্ষত্রের হয় প্রায় সকল কার্বন অথবা সকল অক্সিজেনকে ধ্বংস করে ফেলবে এবং সেই সাথে জীবনের সম্ভাবনা-ও নষ্ট হয়ে যাবে। আমাদের মহাবিশ্বের নীতিগুলো সামান্য পরিমাণে পরিবর্তন করলে আমাদের অস্তিত্বের জন্য প্রয়োজনীয় পরিস্থিতির অন্তর্ধান ঘটবে!

আমাদের উদ্ভব ঘটানো মহাবিশ্বের কম্পিউটার মডেলে পদার্থবিজ্ঞান তত্ত্বগুলো বিভিন্নভাবে পরিবর্তন করে যে কেউ একজন পদ্ধতিগতভাবে পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট প্রভাব যাচাই করতে পারেন। দেখা যায় যে শুধুমাত্র সবল কেন্দ্রকীয় বল এবং তড়িচ্চুম্বকীয় বলের শক্তিমত্তাই আমাদের অস্তিত্বের জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী তৈরি হয় নি, বরং আমাদের তত্ত্বগুলোতে দৃষ্টিগোচর হওয়া অধিকাংশ মৌলিক ধ্রুবকের মান হালকা এদিকসেদিক পরিবর্তন করা হলে মহাবিশ্বের রূপ অনেক ভিন্নতর হবে, এবং অনেক ক্ষেত্রেই জীবন বিকাশের জন্য উপযোগী হবে না। যেমন, যদি দুর্বল কেন্দ্রকীয় বল যদি আরেকটু দুর্বল হতো, আদি মহাবিশ্বে সহজেই হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম গঠিত হতো, ফলে স্বাভাবিক কোনো নক্ষত্র তৈরি হতো না; আবার যদি বলটি আরেকটু সবল হতো, তবে অতিকায় নবনক্ষত্রের বিস্ফোরণের সময় অতিকায় নবনক্ষত্রটি এর বাইরের স্তরটিকে স্থানচ্যুত হতে দিতো না, ফলে জীবনের জন্য আবশ্যকীয় ভারী উপাদানগুলো বহির্জগতে নির্গত হতো না। যদি প্রোটন আরো ০.২ শতাংশ ভারী হতো, তবে সেগুলো ক্ষয়ে নিউট্রনে রূপান্তরিত হতো, এবং পরমাণুর কাঠামো ভেঙে পড়তো। যদি প্রোটনের গাঠনিক উপাদান কোয়ার্কগুলোর ভরের যোগফল ১০ শতাংশের মতো ক্ষুদ্র পরিমাণে পরিবর্তন করা হয় তবে আমাদের গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় সুস্থিত পরমাণু নিউক্লিয়াসের সংখ্যা কম হবে; প্রকৃতপক্ষে, কোয়ার্কের ভরের যোগফল দেখে মনে হয় যেনো এটিকে বেশি সংখ্যক সুস্থিত নিউক্লিয়াসের অস্তিত্বের জন্য অনুকূলকরণ করা হয়েছে।

কেউ যদি ধরে নেন যে কয়েক শত মিলিয়ন বছরের সুস্থিত কক্ষপথ গ্রাহিক জীবন বিকাশের জন্য আবশ্যক, তবে স্থানিক মাত্রার সংখ্যা-ও আমাদের অস্তিত্বের জন্য উপযুক্ত। কারণ, মহাকর্ষের সূত্র মতে কেবলমাত্র তিন মাত্রায় সুস্থিত উপবৃত্তাকার কক্ষপথ সম্ভব। বৃত্তাকার কক্ষপথ অন্যান্য মাত্রায় সম্ভব, কিন্তু সেগুলো নিউটন যেমন আশঙ্কা করেছিলেন সেরকম ভারসাম্যহীন হবে। অন্য মাত্রায় অথবা তিনটি মাত্রার ক্ষেত্রে সামান্যতম গোলযোগ যদি হতো, যেমন ধরুন অন্যান্য গ্রহগুলোর প্রবল আকর্ষণ টান থাকতো, তবে পৃথিবী নিজের বৃত্তাকার কক্ষপথ থেকে চ্যুত হতো, ফলে সেটি সূর্যের দিকে অথবা সূর্য থেকে দূরের দিকে সর্পিল আকারে সরে যেতো, এবং আমরা হয় গরমে পুড়ে অথবা ঠাণ্ডায় জমে যেতাম। তাছাড়া, তিনটি মাত্রার অধিক মাত্রা ব্যবস্থায় দুটো বস্তুর মধ্যকার মহাকর্ষীয় বল দ্রুতভাবে হ্রাস পেতো। ত্রিমাত্রিকে দুটো বস্তুর মধ্যকার মহাকর্ষীয় বল ১/৪ ভাগ কমে যায় যদি মধ্যবর্তী দূরত্ব দ্বিগুণ হয়, অন্যদিকে চারটি মাত্রার ব্যবস্থায় এটি ১/৮ ভাগে হ্রাস পায়, এবং পাঁচটি মাত্রার ব্যবস্থায় এটি ১/১৬ ভাগে হ্রাস পেতে থাকে এবং প্রভৃতি। ফলে ত্রিমাত্রিকের বেশি মাত্রায় সূর্য নিজের অভ্যন্তরীণ চাপ ও মহাকর্ষ বলের মধ্যকার ভারসাম্য করে সুস্থিত অবস্থায় অস্তিত্বমান থাকতো না। এটি হয় ভেঙে পড়তো অথবা কৃষ্ণগহ্বর তৈরি করার জন্য পতিত হতো, যে কোনো একটি ঘটলেই আপনার জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠতো বটে। অন্যদিকে পারমাণবিক মাপদণ্ডে, তড়িৎ বল মহাকর্ষীয় বলের মতো আচরণ করতো। অর্থাৎ পরমাণুর ইলেকট্রন হয় নিউক্লিয়াস থেকে ছুটে যেতো অথবা এতে পতিত হতো। যে কোনো ক্ষেত্রে আমাদের জ্ঞাত পরমাণুর অস্তিত্ব সম্ভবপর হতো না।

বুদ্ধিমান সত্তার অস্তিত্ব ধারণ করতে সক্ষম এমন জটিল ব্যবস্থার উদ্ভাবনকে খুব ভঙ্গুর মনে হয়। প্রকৃতির নিয়মাবলি খুবই সূক্ষ্ম-সমন্বিত ব্যবস্থা গড়ে তুলে, এবং আমাদের জ্ঞাত জীবন বিকাশের সম্ভাবনাকে ধ্বংসের মুখে না ঠেলে ভৌত সূত্রে খুব সামান্যই পরিবর্তন করা যায়। মনে হয় যেনো ভৌত সূত্রের যথাযথ খুঁটিনাটিতে চমকপ্রদ অনেকগুলো আকস্মিক যোগাযোগ না হলে মানুষ এবং এই ধরণের জীবন-রূপ অস্তিত্বের আবির্ভাব কখনোই ঘটতো না।

সবচেয়ে বেশি চিত্তাকর্ষক সূক্ষ্ম-সমন্বিত আকস্মিক যোগাযোগের দেখা মেলে আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতার সমীকরণের তথাকথিত মহাজাগতিক ধ্রুবকের ক্ষেত্রে। আমরা যেমন বলেছিলাম, ১৯১৫ সালে তিনি যখন তত্ত্বটি সূত্রবদ্ধ করেন, আইনস্টাইন তখন বিশ্বাস করতেন যে মহাবিশ্ব স্থির অর্থাৎ এটি প্রসারিত হচ্ছে না অথবা সংকুচিত-ও হচ্ছে না। যেহেতু সব পদার্থই অন্য পদার্থকে আকর্ষণ করে, মহাবিশ্বের নিজের ভেতরের নিজে ভেঙে পতিত হওয়ার প্রবণতাকে দূর করতে তিনি তার তত্ত্বটিতে প্রতিমহাকর্ষ নামের একটি বলের প্রস্তাব করেন। বলটি অন্যান্য বলের মতো কোনো সুনির্দিষ্ট উৎস থেকে আসে না বরং স্থান-কালের খুব সূক্ষ্ম কাঠামোয় সন্নিবিষ্ট থাকে। মহাজাগতিক ধ্রুবক এই বলটির শক্তি বর্ণনা করে।

যখন আবিস্কৃত হয়েছিলো যে মহাবিশ্ব স্থির নয়, প্রসারিত হচ্ছে, তখন আইনস্টাইন তার তত্ত্বটি থেকে মহাজাগতিক ধ্রুবকটি বাদ দিয়ে দেন এবং বলেন যে এটিকে অন্তর্ভুক্ত করাটা ছিলো তার জীবনের সবচেয়ে গুরুতর ভুল। কিন্তু ১৯৯৮ সালে সুদূর অতিকায় নবনক্ষত্র পর্যবেক্ষণ থেকে জানা যায় যে মহাবিশ্ব একটি ত্বরান্বিত হারে (accelerating rate) প্রসারিত হচ্ছে, মহাবিশ্বের সর্বত্র একটি বিকর্ষক বলের অনুপস্থিতি ছাড়া যেটি সম্ভব হতো না। মহাজাগতিক ধ্রুবকের ব্যবহার নতুন করে আবার শুরু করা হলো। যেহেতু আমরা জানি যে এটির মান শূন্য নয়, প্রশ্ন জাগে, কেনো এটির মান ঠিক যে মানটাই আছে সেটিই? পদার্থবিজ্ঞানিরা ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করার জন্য যুক্তি দিয়েছেন যে এটি হয়তো কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞানের প্রভাবে সৃষ্ট, কিন্তু তারা যে মানটি গণনা করে বের করেছেন সেটি অতিকায় নবনক্ষত্রের পর্যবেক্ষণ থেকে পাওয়া আসল মানের চেয়ে প্রায় ১০১২০ গুণ (১ এর পরে ১২০ শূন্য) শক্তিশালী। সুতারাং হয় তাদের গণনা ও যুক্তিতে কোনো ভুল ছিলো অথবা হয়তো অন্য কোনো প্রভাব আছে যেটি অলৌকিকভাবে সংখ্যাটির অকল্পনীয় ক্ষুদ্র অংশ বাদে বাকি সমস্ত কাটাকাটি করে দেয়। আমরা একটি বিষয়ে নিশ্চিত যে মহাজাগতিক ধ্রুবকের মান যদি আরো বড় হতো, আমাদের মহাবিশ্ব ছায়াপথগুলো সৃষ্টি হওয়ার আগেই নিজে নিজে নিঃশেষিত হয়ে যেতো এবং আমাদের জানা জীবন বিকাশ অসম্ভব হতো।

এইসব আকস্মিক যোগাযোগের আলামত থেকে আমরা কী সিদ্ধান্ত নিতে পারি? প্রকৃতির মৌলিক বল এবং বিভিন্ন বিন্যাস বা নির্মিতিতে ভাগ্য সুপ্রসন্ন হওয়া কিন্তু পরিবেশগত ব্যাপারে সুপ্রসন্ন হওয়া থেকে ভিন্ন ধরণের। এটিকে খুব সহজে ব্যাখ্যা করা যায় না, এবং অনেক গভীর ভৌত ও দার্শনিক নিহিতার্থ রয়েছে। আমাদের মহাবিশ্ব এবং এর নিয়মাবলি দেখে মনে হয় যে আমাদের অস্তিত্বের জন্য একে নকশা করে তৈরি করা হয়েছে, এবং যদি আমাদের অস্তিত্ব বহাল থাকতে হয় তবে মহাবিশ্বের বিভিন্ন ঘটনা বা পরিস্থিতির ক্ষেত্রে খুব অল্প পরিবর্তন করার সুযোগ থাকে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উত্থাপিত হয়, কেনো সবকিছু ঠিক এইরকম খাপে খাপ হয়েছে?

অনেক লোকই এইসব আকস্মিক যোগাযোগ বা দৈবযোগকে ঈশ্বরের কর্মের প্রমাণস্বরূপ প্রস্তাব করতে পছন্দ করবে। হাজার হাজার বছর আগ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ এবং পৌরাণিক সৃষ্টিকথায় এই ধারণার দেখা মেলে যে মানবজাতির সুবিধার জন্য মহাবিশ্বকে এভাবে নকশা করা হয়েছে। মায়ান পোপোল ভুহ্‌ (Popol Vuh) পুরাণ-ঐতিহাসিক অ্যাখ্যানে দেবতারা ঘোষণা করেন যে, “যতক্ষণ পর্যন্ত মানবজাতি অস্তিত্বমান না হয় এবং সচেতনতার অধিকারী না হয়ে ওঠে, আমরা আমাদের সৃষ্টি করা সমস্ত কিছু থেকে কোনো গৌরব অথবা সম্মান গ্রহণ করবো না।” খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ সালের একটি মিসরীয় ধর্মগ্রন্থের মূল বিষয়বস্তু মতে, “ঈশ্বরের পশু- মানুষকে সব কিছু সরবরাহ করা হয়েছে। তিনি [সূর্যদেবতা] আকাশ এবং পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন মানুষের মঙ্গলের জন্য।” চীনে ডাওবাদী (Taoist) দার্শনিক লীহ ঈ ক’ঔ (Lieh Yii-K’ou) (আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০) প্রায় একই ধরণের ধারণা প্রকাশ করেছেন একটি গল্পে চরিত্রের সংলাপে, “স্বর্গলোক আমাদের মঙ্গলের জন্য পাঁচ প্রকারের খাদ্যশস্য উৎপন্ন ও পাখনাঅলা পালকবিশিষ্ট প্রাণী তৈরি করে।”

পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে তাওরাত ধর্মগ্রন্থে ঈশ্বর কর্তৃক সৃষ্টিজগতের দূরদর্শী নকশার কথা বলা হয়েছে, কিন্তু প্রচলিত খ্রিস্টীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনেকাংশে অ্যারিস্টটলের ধারণার মাধ্যমে প্রভাবিত হয়েছিলো, অ্যারিস্টটল বিশ্বাস করতেন “একটি বুদ্ধিভিত্তিক প্রাকৃতিক জগতে- যেটি সুচিন্তিত নকশা অনুসারে কাজ করে।” মধ্যযুগে খ্রিস্টান ধর্মতাত্ত্বিক থমাস অ্যাকুইনাস প্রকৃতির বিন্যাস সম্পর্কিত অ্যারিস্টটলের ধারণাকে ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে যুক্তি হিসেবে ব্যবহার করার জন্য কাজে লাগিয়েছিলেন। আঠার শতকে আরেকজন খ্রিস্টান ধর্মতাত্ত্বিক এমন-ও বলেছিলেন যে খরগোশের সাদা লেজ থাকার কারণ এতে সেগুলোকে শিকার করা আমাদের পক্ষে সুবিধে হবে! খ্রিস্টীয় আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির দেখা মেলে কয়েক বছর আগে যখন ভিয়েনার আর্চবিশপ কার্ডিনাল ক্রিসটোফ স্কাচনবর্ন লিখেছিলেন, “এখন একবিংশ শতাব্দির শুরুতে, আধুনিক বিজ্ঞানে প্রকৃতির নকশা ও উদ্দেশ্যের অভিভূত প্রমাণের উদ্ভাবনকে দাবিয়ে রাখতে যেসব বৈজ্ঞানিক দাবি যেমন নব্য-ডারউইনবাদ এবং মহাবিশ্বতত্ত্বে অগণন মহাবিশ্বের প্রস্তাব করা হয় সেইসবের মুখোমুখি হয়েও ক্যাথলিক গির্জা আবারো মানুষের প্রকৃতি সম্পর্কে পূর্বের সেই পক্ষাবলম্বন করবে যে প্রকৃতিতে অন্তর্নিহিত সর্বব্যাপী নকশা বিদ্যমান।” মহাবিশ্বতত্ত্বে প্রকৃতির নকশা ও উদ্দেশ্যের যে অভিভূত প্রমাণের কথা কার্ডিনাল বলছেন সেটি আমাদের উপরে আলোচনা করা ভৌত নিয়মাবলির সূক্ষ্ম-সমন্বয়।

মানব-কেন্দ্রিক মহাবিশ্বের ধারণাকে বৈজ্ঞানিকভাবে বাতিল করার সন্ধিকাল ছিলো কোপারনিকাসের সৌরব্যবস্থা মডেলটি, যেটিতে পৃথিবী জগতের কেন্দ্রে অবস্থিত নয়। বিপরীতভাবে, কোপারনিকাসের নিজের জগতদৃষ্টিভঙ্গি-ও ছিলো মানবীয়-তাত্ত্বিক, আমাদের সান্তনা দিতে তিনি তার সূর্যকেন্দ্রিক মডেলে নির্দেশ করেছিলেন যে পৃথিবী মহাবিশ্বের প্রায় কেন্দ্রে অবস্থিত: “যদিও এটি [পৃথিবী] জগতের কেন্দ্রে নয়, তারপরও অন্যান্য সুস্থিত নক্ষত্রের সাথে তুলনা করলে [কেন্দ্র থেকে] এই দূরত্ব খুব বেশি কিছু নয়।” টেলিস্কোপের আবিষ্কারের ফলে, সতের শতাব্দির পর্যবেক্ষণ থেকে ধারণা মেলে যে আমাদের গ্রহই একটি চাঁদ দ্বারা প্রদক্ষিণ করা একমাত্র গ্রহ নয়, আমরা মহাবিশ্বে বিশেষাধিকার-প্রাপ্ত কোনো অবস্থান আঁকড়ে নেই। পরবর্তী শতাব্দিগুলোতে মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমরা আরো যতো আবিষ্কার করলাম, ততোই মনে হতো লাগলো যে আমাদের গ্রহটি গ্রহ-বাগানে নিছক একটি বৈচিত্র্যময় গ্রহ। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকৃতির নিয়মাবলিতে আবিষ্কৃত অনেক চরম সূক্ষ্ম-সমন্বয় আমাদের কাউকে কাউকে অন্ততপক্ষে সেই পুরানো ধারণার দিকে ধাবিত করে যে এই মহিমান্বিত নকশা কোনো এক মহিমান্বিত কারিগরের সৃষ্টি। যুক্তরাষ্ট্রে, যেহেতু ইস্কুলে ধর্মশিক্ষা সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ, এই ধরণের ধারণাকে বলা হয় বুদ্ধিদীপ্ত নকশা (intelligent design), অব্যক্ত কিন্তু বুঝতে ইঙ্গিত করছে যে মহিমান্বিত কারিগরটি হলেন ঈশ্বরই।

কিন্তু এটি আধুনিক বিজ্ঞানের উত্তর নয়। আমরা পঞ্চম অধ্যায়ে দেখেছি যে আমাদের মহাবিশ্ব ভিন্ন ভিন্ন নিয়মাবলি সমৃদ্ধ অনেকগুলো মহাবিশ্বের একটি। ওই অগণন মহাবিশ্বের ধারণাটি সূক্ষ্ম-সমন্বয়ের অলৌকিকতা ব্যাখ্যা করার জন্য প্রস্তাব করা হয় নি। অগণন মহাবিশ্বের ধারণা সীমারেখাহীন শর্ত এবং আধুনিক মহাবিশ্বতত্ত্বে অন্তর্গত অন্যান্য তত্ত্বের ফলাফল। কিন্তু যদি এটি সত্য হয়, তবে সবল মানবীয় তত্ত্বটিকে দুর্বল মানবীয় তত্ত্বের মতো একই নগণ্য বিবেচনা করা যায়, অর্থাৎ পরিবেশগত ব্যাপারগুলোর মতো ভৌত নিয়মাবলির সূক্ষ্ম-সমন্বয়কে একই পায়ের তলায় রাখা চলে, অর্থাৎ আমাদের বাসযোগ্য মহাবিশ্ব বা পর্যবেক্ষণযোগ্য সমগ্র মহাবিশ্ব এইরকম অনেকগুলোর একটি- ঠিক যেমনটি আমাদের সৌরব্যবস্থাটি অনেকগুলোর একটি। এটি বোঝাচ্ছে, যেভাবে আমাদের সৌরব্যবস্থার পরিবেশগত দৈবযোগকে বিলিয়ন সংখ্যক এই ধরণের সৌরব্যবস্থার ধারণার মাধ্যমে যৌক্তিকভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছিলো, তেমনি প্রকৃতির নিয়মাবলির সূক্ষ্ম-সমন্বয় ব্যাপারটিকে অগণন মহাবিশ্বের ধারণার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যায়। কালক্রমে অনেক মানুষই প্রকৃতির সৌন্দর্য এবং জটিলতাকে ঈশ্বরের অবদান হিসেবে ভেবেছেন কারণ তাদের সময়ে এইসবের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ছিলো না। কিন্তু ডারউইন এবং ওয়ালেস যেভাবে জীবন্ত-রূপ বা সত্তাগুলোর আপাত অলৌকিক নকশাকে কোনো শক্তিমান ঈশ্বরের ধারণা ছাড়াই ব্যাখ্যা করেছেন, ঠিক তেমনি অগণন মহাবিশ্বের ধারণা ব্যবহার করে কোনো দয়ালু ঈশ্বরের (যিনি আমাদের মঙ্গলের জন্য মহাবিশ্বকে সৃষ্টি করেছিলেন) প্রয়োজন ছাড়াই ভৌত নিয়মাবলির সূক্ষ্ম-সমন্বয়কে ব্যাখ্যা করা যাবে।

আইনস্টাইন একবার তার সহকারী আর্নস্ট স্ট্রাসকে প্রশ্ন করেছিলেন, “মহাবিশ্বের সৃষ্টির সময় ঈশ্বরের হাতে কি অন্য কোনো বিকল্প ছিলো?” ষোল শতাব্দির শেষ দিকে কেপলার দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে ঈশ্বর কিছু উৎকৃষ্ট গাণিতিক সূত্র অনুযায়ী মহাবিশ্বকে সৃষ্টি করেছিলেন। নিউটন দেখিয়েছিলেন যে মহাবিশ্বে যেসব সূত্রগুলো কাজ করে সেই একই সূত্রগুলো পৃথিবীর জন্য-ও প্রযোজ্য এবং সূত্রগুলোর গাণিতিক সমীকরণ প্রকাশ করেছিলেন, সূত্রগুলো এতোই এলিগেন্ট ছিলো যে আঠার শতাব্দির অনেক ধর্ম-সচেতন বিজ্ঞানিই এগুলোকে ব্যবহার করেছিলেন ঈশ্বর একজন উত্তম গণিতবিদ একথা প্রমাণ করতে!

নিউটনের পর থেকে, বিশেষ করে আইনস্টাইনের পর থেকে পদার্থবিদ্যার লক্ষ্য হয়ে ওঠে কেপলারের অনুমিত সেই সরল গাণিতিক সূত্রাবলি খুঁজে বের করা এবং এমন একটি সার্বিক তত্ত্বের প্রণয়ন যেটি প্রকৃতিতে যেসব বলসমূহ এবং পদার্থ আমরা দেখি তার সবকিছুকে খুঁটিনাটি পর্যন্ত ব্যাখ্যা করতে পারবে। উনিশ শতকের শেষের দিকে এবং বিংশ শতাব্দির সূচনাকালে ম্যাক্সওয়েল এবং আইনস্টাইন তড়িৎ, চুম্বকত্ব এবং আলোর তত্ত্বসমূহকে একীভূত করেছিলেন। ১৯৭০ সালের দিকে দুর্বল এবং সবল কেন্দ্রকীয় বলসূহ এবং তড়িচ্চুম্বকীয় বলের একীভূত তত্ত্ব প্রমিত তত্ত্ব প্রস্তাব করা হয়েছিলো। স্ট্রিং তত্ত্ব এবং এম-তত্ত্ব অবশিষ্ট বল মহাকর্ষকে একীভূত করার জন্য পরবর্তীতে আসে। লক্ষ্য ছিলো যে একটি একক তত্ত্ব খুঁজে বের করার যেটি সকল বলকে এবং সকল মৌলিক ধ্রুবক বা সংখ্যা যেমন বলসমূহের শক্তি, মৌলিক কণিকাগুলোর ভর এবং আধানের মান ইত্যাদিকে ব্যাখ্যা করতে পারবে। প্রত্যাশাটি ছিলো আইনস্টাইন যেমন বলেছিলেন, “প্রকৃতি এতোটাই সুগঠিত যে এমন নিরূপিত সূত্রাবলি খুঁজে পাওয়া যৌক্তিকভাবে সম্ভব যে এগুলোর ভেতরে কেবল পুরোপুরি যৌক্তিকভাবে নিরূপিত ধ্রুবক পাওয়া যায় (ধ্রুবক নয়, বরং নিরূপিত ধ্রুবক- যেটির সাংখ্যিক মান পরিবর্তন করা যাবে পুরো তত্ত্বটিকে বাতিল না করে)।” যদি আমরা সাম্প্রতিক সময়ের অগ্রগতির আলোকে একটি একক তত্ত্বের ব্যাপারে আইনস্টাইনের স্বপ্নকে রূপদান করি যেটি কিনা ভিন্ন ভিন্ন নিয়মাবলির এই মহাবিশ্ব এবং অন্যান্য মহাবিশ্বকে ব্যাখ্যা করতে পারে তবে সেই তত্ত্বটি হবে এম-তত্ত্ব। কিন্তু এম-তত্ত্ব কি আসলেই একক কোনো তত্ত্ব, না কি এর জন্য অন্য কোনো সরল যৌক্তিক তত্ত্বের প্রয়োজন পড়ে? আমরা কি এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি: কেনো এম-তত্ত্বই?

[বইটির সূচিপত্র তখা সব পর্বের লিংক দেখুন এখানে]

মূল: স্টিফেন হকিং ও লিওনার্দো ম্লোডিনো

অনুবাদ: -আশরাফ মাহমুদ
গবেষক, কবি ও লেখক
[লেখকের ফেসবুক প্রোফাইল]

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.