মানুষের মস্তিষ্কের বাম গোলার্ধ যুক্তি-তর্ক/ হিসেব-নিকেশের কাজগুলো করে আর ডান গোলার্ধ সৃজনশীল কাজ, শিল্পকর্ম এসবের সাথে জড়িত এই ধারনাকে ভিত্তি হিসেবে ধরে নিয়ে প্রচুর মনোবৈজ্ঞানিক গবেষণা, আত্ম-উন্নয়নমূলক বই এবং দল-গঠনের চর্চা হয়ে গেছে, কিন্তু এই ধারনাটি নিজেই আগা-গোড়া ভিত্তিহীন।
ইউটাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক ৭ থেকে ২৯ বছর বয়সী ১০০০ মানুষের মস্তিষ্ক বিশ্লেষণ করে এই ধারনাকে ভুল প্রমাণ করেছেন। তাঁদের গবেষনায় দেখা গেছে যে কোনো কাজের জন্য সমগ্র মস্তিষ্কেরই অংশগ্রহণ রয়েছে। পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী প্রতিটি মানুষই সমগ্র পরীক্ষাকালীন সময়ে মস্তিষ্কের উভয় অংশই সমানভাবে ব্যবহার করেছেন এবং বিজ্ঞানীদের সংশয় দূর করেছেন।
তবে মস্তিষ্কের বিশেষ বিশেষ অঞ্চল বিশেষ বিশেষ কাজের জন্য অধিকতর হারে কাজ করে এতে বিজ্ঞানীদের কোনো সংশয় নেই। যেমন: অধিকাংশ ডান-হাতি মানুষের ক্ষেত্রে বাকশক্তি উৎপন্ন হয় মূলতঃ মস্তিষ্কের বাম অংশ হতে। তার অর্থ এই নয় যে বড় বড় লেখক বা বক্তা তাঁদের মস্তিষ্কের ডান অংশের চেয়ে বাম অংশ বেশি ব্যবহার করেন। কিংবা এক অংশে অপর অংশের চেয়ে নিউরন বেশি। এবং একই কারণে কেউ ডান-মস্তিষ্কধারী এবং অন্যরা বাম-মস্তিষ্কধারীও নন।
বিশ্লেষণধর্মী সকল কাজ-কর্ম মস্তিষ্কের একটি অংশেই হয় এবং সৃজনশীলতার সাথে জড়িত সবকিছু বাকী অংশে ঘটে এটি ভুল ধারনা। তাহলে এ ধরনের ধারনার উৎপত্তি হলো কিভাবে? বিশেষজ্ঞদের মতে ডান-বাম মস্তিষ্কের এই ধারনার উৎপত্তি ১৯ শতকে যখন বিজ্ঞানীরা পর্যবেক্ষণ করেছিলেন একটি দুর্ঘটনায় মস্তিষ্কের একপাশ ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ায় সুনির্দিষ্ট কিছু কর্মক্ষমতা লোপ পেয়েছে। এই মতবাদ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পেছনে ১৯৬০ এর দশকের নোবেল বিজয়ী একটি গবেষনার উল্লেখযোগ্য প্রভাব রয়েছে। নিউরোসাইকোলজিস্ট রবার্ট স্পেরি এবং মাইকেল গাজানিকা “খন্ডিত মস্তিষ্ক” নামক এই গবেষনার কাজটি করেছিলেন। গবেষনগণ মৃগী রোগের শেষ সমাধান হিসেবে অপারেশনের মাধ্যমে মস্তিষ্কের কর্পাস কোলোসাম কেটে ফেলে দিতে হয়েছে এমন রোগীদের নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। মস্তিষ্কের এই বিশেষ অংশটি দুই গোলার্ধের মধ্যে স্নায়ুতন্তুর মাধ্যমে সংযোগ সাধন করে।
গবেষকগণ দেখতে পেলেন যখন মস্তিষ্কের দুই গোলার্ধ পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগ করতে পারে না তখন সেগুলো উদ্দীপনার প্রতি ভিন্ন ভিন্ন সাড়া দেয়। যা থেকে মনে হয় মস্তিষ্কের ডান ও বাম গোলার্ধের কাজ পৃথক।
এই উভয় গবেষণা থেকে প্রাপ্ত ধারনা হতেই বাম-ডান মস্তিষ্কের পৃথক কর্মকান্ডের মতবাদ ছড়িয়ে যায় এবং অতিউৎসাহী মনোবিদগণের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।
ইউটাহ বিশ্বাবিদ্যালয়ের গবেষণাসহ অন্যান্য গবেষনায় এই ধারনা ভুল প্রমাণীত হওয়ার পরেও এই ডান-বাম মস্তিষ্কধারী ব্যক্তিত্বের ধারনা খুব সহসা বিলীন হয়ে যাবে এমনটি আশা করা যাচ্ছে না। কারণ সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে চেপে বসা বদ্ধমূল ধারনাগুলো মানুষের মন থেকে সহজে দূর হয়ে যায় না। কিন্তু এইধরনের ভুল ধারনার অনেক খারাপ দিক আছে্। একজন কিশোর বা কিশোরী অনলাইন বা এজাতীয় কোনো মাধ্যমে বাম/ডান মস্তিষ্কের কোনো পরীক্ষা দিয়ে যদি নিজেকে ডান-মস্তিষ্কধারী হিসেবে আবিষ্কার করে, তাহলে সে হয়তো গণিত ইত্যাদি বিশ্লেষণধর্মী বিষয়ে আর আগ্রহী হবে না, যেসব বাম-মস্তিষ্কের কর্মকান্ড হিসেবে দেখা হয়। একই ভাবে বাম-মস্তিষ্কধারী হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া কেউ হয়তো সৃজনশীল কাজ করতে নিরুৎসাহীত হবে। যার ফলে তৈরি হতে পারে হতাশা ও মানসিক বিপর্যয়।
-বিজ্ঞান পত্রিকা ডেস্ক