যত ধরনের মানচিত্র প্রচলিত আছে তাদের প্রায় সবকয়টিই সত্যিকার পৃথিবীর শতভাগ সঠিক আকৃতি দিতে ব্যর্থ। মানচিত্রের মাঝে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ‘মার্কেটর প্রজেকশন ম্যাপ’। এই মানচিত্রে এক দেশের সাথে আরেক দেশের আকারের খুব বাজে রকমের হেরফের হয়। হাতের কাছের কোনো একটি সমতল মানচিত্র খুলে ধরে অস্ট্রেলিয়া ও গ্রিনল্যান্ডের দিকে খেয়াল করলে দেখা যাবে গ্রিনল্যান্ডের ক্ষেত্রফল অস্ট্রেলিয়ার ক্ষেত্রফলের দ্বিগুণের চেয়েও বেশি। কিন্তু গ্রিনল্যান্ডের সত্যিকার ক্ষেত্রফল হচ্ছে ২∙২ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার আর অস্ট্রেলিয়ার ক্ষেত্রফল ৭∙৭ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার। বাস্তবতার সাথে সমতল মানচিত্রের যেনো আকাশ পাতাল পার্থক্য।
আবার আফ্রিকার দিকে একটু চোখ বুলিয়ে নিলে দেখা যাবে এটি মোটামুটি বড় জায়গা দখল করেই বিরাজ করছে। কিন্তু আফ্রিকার সত্যিকার আকৃতি, আমরা যেমনটা ভাবি তার থেকেও অনেক বড়। আফ্রিকাকে বাস্তবিক ক্ষেত্রে গ্রিনল্যান্ডের তুলনায় ১৪ গুণ বড়। এই আফ্রিকার ভেতরে পুরো আমেরিকা, চীন, ভারত, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য সহ আরও বেশ কয়েকটি দেশ এঁটে যাবে। আমেরিকার ক্ষেত্রফল যেখানে ৯.৫ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার সেখানে আফ্রিকার ক্ষেত্রফল ৩০.৪ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার।
মার্কেটর প্রজেকশন মানচিত্রে বিভিন্ন দেশের আকৃতির নাটকীয় পার্থক্যের নমুনা দেখুন এই ভিডিওটিতে।
মানচিত্র অঙ্কনবিদ্যায় আরেকটি পদ্ধতি আছে ‘গুড হোমোলোসাইন প্রজেকশন’। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে মহাদেশগুলোর তুলনামূলক আকৃতির মোটামুটি সঠিক ধারণাটা পাওয়া যায়। কিন্তু তাদের পরস্পরের দূরত্ব নিয়ে নতুন করে ঝামেলা বাঁধে। এছাড়া মহাসাগরগুলোর প্রতি অবহেলা করার ব্যাপারটা তো চোখে পড়েই।
বিভিন্ন ধরনের সুবিধা বা অসুবিধা সম্বলিত এমন অনেক মানচিত্রই তৈরি হয়েছে। কোনো একটি মানচিত্র এক দিক থেকে সুবিধা বাড়িয়ে দেয় আবার অন্য দিক থেকে সুবিধা কমিয়ে দেয়। মানচিত্র অঙ্কন বিদ্যায় এই সুবিধার দেয়া-নেয়ার ব্যাপারটি একটি স্থায়ী সমস্যা। এতসব সমস্যার জন্ম হয়েছে পৃথিবীর আকৃতির জন্য। পৃথিবী গোলাকার হওয়ায় সমতল কাগজে কোনোভাবেই গোলাকার মানচিত্রের সব খুঁটিনাটি তুলে আনা যায় না। ব্যাপারটি অনুধাবন করতে আমরা পৃথিবীকে কমলার সাথে তুলনা করতে পারি। কমলার খোসাকে মানচিত্রের কাগজের প্রতিনিধিত্বকারী বলে বিবেচনা করতে পারি। কমলার খোসা ছাড়িয়ে নিয়ে সমতলে বিছিয়ে দেবার চেষ্টা করলে দেখা যাবে কোনোভাবেই সমতল মানচিত্রের মতো হচ্ছে না। মাঝখান দিয়ে কাটতে হচ্ছে। ফলে তল অসম্পূর্ণ রয়ে যাচ্ছে, এবং এমনকি এরপরেও পুরোপুরি সমতল হচ্ছে না।
মার্কেটর প্রজেকশন মানচিত্রে গোলক আকৃতির পৃথিবীকে সমতল দেখানো হয়। মূলত পুরো গোলকটিকে একটি সিলিন্ডারে উন্নীত করা হয়, এতে করে আনুপাতিক হারে দেশের আকার পাল্টে যায়। সিলিন্ডারটির বক্রতলকে সমতলে বসিয়ে নিলে সবার জন্য বুঝতে সহজ মনচিত্রটি পাওয়া যায়।
এমন অবস্থায় যে মানচিত্রটি সবচেয়ে ভালো সুবিধা দেবে সেটি ব্যবহার করাই উত্তম। নির্ভুলতার কথা চিন্তা করলে অবশ্যই গ্লোব বা গোলাকার মানচিত্রের উপরে কিছু নেই। কিন্তু মানচিত্র জিনিসটি যাদের বেশি কাজে লাগে তাদের বেলায় বড় আকারের গোলক বহন করা বেশ সমস্যা সাপেক্ষ ব্যাপার। আবার তুলনামূলক মাপজোখ করতে এটি অসুবিধাজনক। গোলাকার মানচিত্র অধিকতর নির্ভুল হলেও উপযোগের দিক থেকে বিবেচনা করলে পিছিয়ে পড়বে। এই দিক থেকে মার্কেটর মানচিত্র সবচেয়ে কার্যকর। অনেক কাজের বলেই স্থান ও ব্যক্তি নির্বিশেষে সকলের কাছে এটি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। নাবিকদের জন্য এটি একটি আদর্শ মানচিত্র। তার উপর নাবিকদের কাছে মূল মানচিত্রের পাশাপাশি প্রতিটি স্থানের আলাদা আলাদা মানচিত্র রয়েছে, যখন প্রয়োজন হয় তখন তা ব্যবহার করেন তাঁরা। ছোট স্কেলে গোলাকার ও সমতলে পরিমাপের খুব বেশি পার্থক্য হয় না।
গোলক ও সরলরেখা নিয়ে এখানে আরেকটা সমস্যার কথা বলি। পৃথিবীর সমতল মানচিত্রে আঁকা সোজা রেখা আসলে সর্বনিম্ন পথ রচনা করে না। পৃথিবীর এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যে পথে গেলে সর্বনিম্ন পথ রচিত হবে তা দেখতে বক্ররেখার মতো। যেমন নিচের চিত্রে ইয়োকোহামা থেকে পানামা খাল পর্যন্ত যাবার দুটি পথ আঁকা রয়েছে। একটি বক্র, আরেকটি সোজা। এখানে বক্ররেখাটিই সবচেয়ে কম পরিমাণ দূরের।
এমনটা হবার কারণ এই লাইনগুলো সমতলে চিত্রিত বলে। গোলাকার পৃথিবীর আকৃতিকে সমতলে রূপান্তরিত করে ফেললে তা বিকৃত হয়ে যায়। এই বক্ররেখাটিই যদি গ্লোব মানচিত্রে আঁকা হয় তাহলে স্পষ্ট দেখা যাবে এতক্ষণ যে রেখাটিকে বক্র, ও দূরের পথ রচনাকারী বলে মনে হয়েছিলো, সেটি এখন সর্বনিম্ন পথ রচনা করছে।
তবে সমতলে বাঁকা রেখাতে পথ সর্বনিম্ন হলেও অনেক সময় নাবিকেরা সেটা জেনেও সর্বনিম্ন পথে ভ্রমণ করেন না। কারণ মাঝে মাঝে সর্বনিম্ন পথের রেখা এমন কিছু এলাকার উপর দিয়ে যায় যে দিক দিয়ে জাহাজ চালানো দুরূহ। যেমন বরফ। এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাবার এমন অনেক সংক্ষিপ্ত পথ আছে যেগুলো এন্টার্কটিকার বরফের উপর দিয়ে গিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে গোলকের আকৃতির প্রেক্ষাপটের সর্বনিম্ন পথ পরিহার করে সমতলের আপাত দৃশ্যমান সোজা পথ অনুসরণ করাই উত্তম। পৃথিবীর গোলাকৃতি যেমন অনেক ধরনের সুবিধা দেয় তেমনই অল্প-বিস্তর অসুবিধার সৃষ্টিও করে।
– সিরাজাম মুনির শ্রাবণ
বিজ্ঞান পত্রিকা প্রকাশিত ভিডিওগুলো দেখতে পাবেন ইউটিউবে। লিংক:
১. টেলিভিশনঃ তখন ও এখন
২. স্পেস এক্সের মঙ্গলে মানব বসতি স্থাপনের পরিকল্পনা