গ্রহাণুদেরকে একসময় মহাকাশের ভিলেন হিসেবে দেখা হতো। জ্যোতির্বিদরা দূর নক্ষত্র বা গ্যালাক্সির কোনো ছবি তুলতে গেলে সেখানে প্রায় সময় ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কোনো এক গ্রহাণু। এদের যন্ত্রণায় নির্ভুল ছবি পাওয়া যায় না। অন্যদিকে গ্রহাণুরা পৃথিবীতে আছড়ে পড়ে পৃথিবীর প্রাণিজগতের জন্য বিশাল হুমকি হতে পারে। পৃথিবীতে প্রতাপের সাথে দাপিয়ে বেড়ানো ডায়নোসরদের সমস্ত প্রজাতি তো বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে পৃথিবীতে গ্রহাণুর আছড়ে পড়ার কারণেই।
কিন্তু সময় এখন পাল্টেছে। গ্রহাণু হতে পারে মহাকাশ গবেষণার চমকপ্রদ এক বিষয়। আমাদের সৌরজগতের উৎপত্তি বিকাশ ও বিবর্তনের অনেক তথ্য সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে গ্রহাণু নিয়ে গবেষণা-বিশ্লেষণ করলে। ভবিষ্যতের মহাকাশ বাণিজ্যের এক উল্লেখযোগ্য উপাদান হবার সম্ভাবনা আছে এই গ্রহাণুর।
জাপানের হায়াবুসা মহাকাশযান ২০১০ সালে একটি গ্রহাণু থেকে কিছু পরিমাণ ধূলিকণা নিয়ে ফিরে এসেছিল। নাসা এর চেয়েও বড় এক প্ল্যান করেছিল। একটি মহাকাশযানের মাধ্যমে গ্রহাণু থেকে বড় আকারের নুড়ি নিয়ে আসা ছিল এই প্ল্যানের অংশ। কিন্তু পরবর্তীতে এই প্রজেক্টে নাসার পর্যাপ্ত পরিমাণ বাজেট হয়নি, যার কারণে এটি এখনো আলোর মুখ দেখেনি। কিন্তু তারপরেও গ্রহাণুকে ধরা, এতে অনুসন্ধান ও গবেষণা করার যথেষ্ট ভালো কারণ আছে। নাসা এর পেছনে সময় ও লোকবল দিয়ে খাটছেও।
কীভাবে করা হবে এই কাজ
প্রথমে নাসা কর্তৃপক্ষ রাসায়নিক জ্বালানী সম্বলিত একটি রকেটের সাহায্যে একটি রোবটিক মহাকাশযান প্রেরণ করবে। পাশাপাশি থাকবে খুবই কার্যকর একটি ইলেকট্রিক প্রপালশন সিস্টেম। এই সিস্টেম প্রয়োজনের সময় মহাকাশযানকে উপযুক্ত স্থানে বয়ে নিতে পারবে। সূক্ষ্মভাবে মহাকাশযানকে গ্রহাণুর পৃষ্ঠে অবতরণ করিয়ে সেখান থেকে উপযুক্ত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কয়েক টন ওজনের একটি নুড়ি তুলে আনবে। এই নুড়ি তুলে আনতে রোবটিক হাত ব্যবহার করা হবে। ভরের দিক থেকে স্বল্প হবার কারণে গ্রহাণুর অভিকর্ষীয় টান কম। অভিকর্ষীয় টান কম বলে গ্রহাণুর পৃষ্ঠে এই কাজটা করতে কষ্টকর হবে। তবে আশার কথা যে গ্রহাণুর অভিকর্ষ বল কম হলেও একদমই শূন্য নয়। চ্যালেঞ্জ নিয়ে এই কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব।
এরপর নুড়িটিকে সযত্নে চাঁদের কক্ষপথে স্থাপন করা হবে। সম্ভব হলে পৃথিবীতে নিয়ে আসবে। একবার সফলভাবে চাঁদের কক্ষপথে স্থাপন করা গেলে পরবর্তীতে বিজ্ঞানীরা সহজেই ছোটখাটো মিশন নিয়ে এটি নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা গবেষণা করতে পারবে।
কেন প্রয়োজন
আজকের যুগে পর্যটকরা যেমন বার্লিন, প্যারিস, কক্সবাজার, সুন্দরবন ঘুরে বেড়ায় তেমনই এমন এক সময় আসবে যখন এক গ্রহ থেকে আরেক গ্রহে যাওয়াও কক্সবাজার-সুন্দরবনের মতোই মামুলি ব্যাপার হয়ে যাবে। এমন ধরনের অল্প দূরত্বের বা অধিক দূরত্বের মহাকাশ ভ্রমণে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান হচ্ছে পানি। পৃথিবীতে প্রচুর পানি থাকলেও সৌরজগতের অভ্যন্তরে কিংবা নাক্ষত্রিক ভ্রমণে যথেষ্ট পরিমাণ পানি উড্ডয়নের সময় মহাকাশযানের সাথে করে নিয়ে যাওয়া যায় না। প্রকৌশলগত কিছু সমস্যা আছে তাতে। বেশি পানি নিলে ওজন বেড়ে যাবে, যা মহাকাশযানকে স্বল্প সময়ে উড়িয়ে নিয়ে যেতে বাধার সৃষ্টি করবে।
জ্বালানীর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। বেশি জ্বালানী নিলে বেশি পথ ভ্রমণ করা যাবে, আবার খুব বেশি নিলে ভর বেড়ে যাবে যা প্রাথমিক মুক্তিবেগ কাটিয়ে উড্ডয়নে সমস্যা করবে কিংবা উড়িয়ে নিতে সমস্যা করবে।
এই সমস্যার মোটামুটি একটা সমাধান দিতে পারে গ্রহাণু। গ্রহাণুগুলোতে প্রচুর পানি বরফায়িত অবস্থায় থাকে। গ্রহাণুর জ্ঞাতি ভাই ধূমকেতু তো সবটাই বরফ। বর্তমানে মহাকাশে প্রতি কেজি পানি বহনে খরচ পড়ে ১০ হাজার ডলার। গ্রহাণু থেকে পানি ব্যবহার করলে খরচের পরিমাণ কমে যাবে দশ গুণ। প্রতি কেজি পানি বহন করতে লাগবে ১ হাজার ডলার।
এখানে উল্লেখ্য যে চাঁদের পৃষ্ঠেও বরফ আছে। কিন্তু চাঁদে বরফ থাকলেও তা থেকে বরফ মুক্ত করে কক্ষপথে নিয়ে আসা যথেষ্ট জটিল কাজ। চাঁদের চেয়ে তুলনামূলকভাবে সহজে করা যাবে গ্রহাণু থেকে পানি সংগ্রহের কাজ। একটি গবেষণায় দুই জন বিজ্ঞানী দেখিয়েছেন সৌরজগতে অনেক অনেক গ্রহাণু আছে যারা পানি বহন করে এবং দীর্ঘদিন ব্যবহারের জন্য এগুলো যথেষ্ট। এদের মাঝে অনেক গ্রহাণুই আছে যাদের কাছে সহজে পৌঁছা সম্ভব। এসব গ্রহাণু থেকে বরফ সংগ্রহ করে প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে উপযুক্ত স্থানে নিয়ে আসা এবং সৌরশক্তি বা যান্ত্রিক শক্তি ব্যবহার করে তাদের গলিয়ে পানিতে রূপান্তর করা প্রকৌশলগত দিক থেকে অসম্ভব কিছু না।
যথেষ্ট পরিমাণ প্রযুক্তিগত উন্নতি লাভ করলে গ্রহাণু থেকে মহাকাশযানের জ্বালানীও সংগ্রহ করা যেতে পারে। উপড়ে দেখেছিলাম ওজন বহনের সীমাবদ্ধতার কারণে মহাকাশযানগুলো বেশি জ্বালানী নিতে পারে না। এই সমস্যার সমাধান হতে পারে গ্রহাণু। গ্রহাণুর বরফকে বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যাবে অক্সিজেন আর হাইড্রোজেন। অক্সিজেন জ্বলতে সাহায্য করে আর হাইড্রোজেন ব্যবহার করা যেতে পারে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ক হিসেবে। যা জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। যদিও হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া মানুষের নিয়ন্ত্রণে আনার প্রক্রিয়াটা অনেক চ্যালেঞ্জিং। উল্লেখ্য সূর্যের সমস্ত শক্তি তৈরি হচ্ছে হাইড্রোজেনের নিউক্লীয় বিক্রিয়ার মাধ্যমেই। অন্যদিকে মানুষের জন্য অক্সিজেন কতটা মূল্যবান তা না বললেও চলে। পৃথিবীতে অক্সিজেন অহরহ ও সহজলভ্য হলেও মহাকাশযানে তা সহজলভ্য নয়। পৃথিবীতে যেমন না চাইলেও অক্সিজেনের সাগরে ভেসে থাকা যায় মহাকাশযানে এমন সুবিধা নেই। তাই এখানে মানবিক প্রয়োজনেও গ্রহাণু তথা অক্সিজেন খুব কাজে আসতে পারে।
গ্রহাণুকে বন্দী করা নিয়ে নাসার তৈরি একটি এনিমেটেড ভিডিও দেখুন এখানে–
আরো বেশি কাল্পনিক বাস্তবতার কথা বিবেচনা করলে চলে আসে মহাকাশে কলোনি তৈরির কথা। হাইটেক সায়েন্স ফিকশন। পৃথিবী দূষিত হয়ে গেছে তাই পৃথিবী থেকে বাইরে থাকতে হচ্ছে- এমন পরিস্থিতিতে মানুষের পক্ষে কলোনি তৈরি করা লাগতে পারে। আর কলোনি তৈরি করতে হলে অবশ্যই মাল মশলা লাগবে। এসব ইট পাথর কাঁচামালের যোগান দিতে পারে গ্রহাণুরা। হাজার হাজার বছর আগে থেকেই তৈরি হয়ে আছে ভবিষ্যতে আমাদেরকে সেবা দেবার জন্য।
তবে এখানে সমস্যা কিছু সমস্যা আছে। এই ধরনের মিশন প্রচুর ঝুঁকিপূর্ণ। ছোটখাটো একসিডেন্টে বড় ধরণের মূল্য দিতে হবে। তার উপর গ্রহাণু শিকারে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হলে প্রকৌশল ও প্রযুক্তির দিক থেকে আরো উন্নত হতে হবে পৃথিবীকে। পৃথিবীবাসী হিসেবে এমন একটা দিনের আশা করছি যেখানে মানুষ বিজ্ঞান-প্রযুক্তি-প্রকৌশলে এমন উন্নতি লাভ করবে যে গ্রহাণু শিকার করা একটা মামুলী ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। [IFLScience University of Gloasgow এবং NASA এর তথ্য অনুযায়ী]
-সিরাজাম মুনির শ্রাবণ