আমাদের চারপাশে এক বার তাকালেই অবাক হয়ে দেখতে হয়, নানান রকম প্লাস্টিক পণ্যে আমরা ডুবে আছি। এই যে এত এত প্লাস্টিকের ব্যবহার, কিন্তু তার মাত্র ১০ ভাগ পুনঃপ্রক্রিয়া করা হয়। বাকি প্লাস্টিকের কিছু অংশ মাটিতে দূষণ শুরু করে আর প্রায় সবটুকুর ভবিষ্যত হয় খাল, নদী, সাগর হয়ে মহাসাগরে। প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে অর্ধেক ইউরোপের সমপরিমাণ আয়তনের গ্রেট প্যাসিফিক গারবেজ প্যাচ নামে এক বিশাল প্লাস্টিকের জগত সৃষ্টি হয়েছে, তা আমাদের অনেকেরই অজানা। একটু বর্ষায় রাস্তায় জলাবদ্ধতার সমস্যা থেকে শুরু করে আমাদের খাদ্যচক্রে মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণের ভয়াবহতা আমাদেরকে এক নতুন প্রশ্নের মুখে দাড় করিয়ে দিয়েছে।
সাধারণত প্লাস্টিক বলতে এমন কিছু বোঝায় যা নমনীয় এবং যাকে সহজে আকৃতি দেয়া যায়। প্লাস্টিক হল পলিমার জাতীয় পদার্থ যাতে অনেকগুলো ছোট অণু নিজেদের মধ্যে আন্তঃসংযোগের মাধ্যমে একটি বড় অণু তৈরি করে। সাধারণত কার্বন, অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন এর পরমাণু দিয়ে পলিমারটি তৈরি করা হয়। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিকের মধ্যে পলিইথিলিন, পলিভিনাইল ক্লোরাইড (পিভিসি), টেফলন, পলিস্টার, পলিস্টাইরিন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। প্রাকৃতিক উপাদান যেমন প্রাকৃতিক রাবার, নাইট্রোসেলুলোজ, কোলাজেন ইত্যাদি দিয়ে তৈরি প্লাস্টিকের মাধ্যমে এর ব্যবহার শুরু হয়। আঠারো শতকে শিল্পবিপ্লবের পর প্লাস্টিকজাত দ্রব্য ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। সর্বপ্রথম ১৮৬২ সালে মানবসৃষ্ট প্লাস্টিক আবিষ্কার করেন আলেক্সান্ডারপার্ক্স এবং সেই আবিষ্কার “গ্রেট ইন্টারন্যাশনাল এক্সিবিশন’’ লন্ডনে প্রদর্শিত হয়। পার্ক্সেটাইন নামে এ প্লাস্টিকটি সেলুলোজ থেকে উদ্ভুত একধরনের জৈবপদার্থ দিয়ে তৈরি যাকে উত্তপ্ত অবস্থায় বিভিন্ন আকারে পরিবর্তন করা যেত। পার্ক্সেটাইন আবিষ্কারের কারণে আলেক্সান্ডার পার্ক্সকে ব্রোঞ্জপদকেও ভূষিত করা হয়। ১৮৬৯ সালে জন উইসলে হেয়ট প্রথম সিনথেটিক পলিমার সেলুলয়েড তৈরি করেন যা প্লাস্টিক উদ্ভাবনের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ঊনিশ শতকের শুরুতে ফেনল ওফমালডিহাইড ব্যবহার করে সর্বপ্রথম সম্পূর্ণ সিনথেটিক প্লাস্টিক উদ্ভাবন করেন লিও ব্যাকেল্যান্ড যার নাম রাখা হয় ব্যাকেলাইট। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে, রসায়ন ক্ষেত্রে প্রযুক্তির বিপ্লব ঘটে এবং এর মাধ্যমে প্লাস্টিক ব্যবহারের বিস্ফোরণ ঘটে। ১৯৪০ থেকে ১৯৫০ এ ব্যপক ভাবে প্লাস্টিক উৎপাদন শুরু হয়। ১৯২০ সালে পলিভিনাইল (পিভিসি), ১৯৩০ সালে পলি স্টাইরিন, ১৯৩৩ সালে পলিইথিলিন এর উৎপাদন প্লাস্টিক ব্যবহারে নতুন দিগন্ত স্থাপন করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অপ্রতুল প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর চাপ কমাতে বিকল্প হিসেবে সিনথেটিক প্লাস্টিক উৎপাদনের ব্যপকতা বৃদ্ধি পায়। যুদ্ধে ব্যবহৃত দড়ি, প্যারাসুট, হেলমেট লাইনার ইত্যাদিতে ব্যবহার করা হয় নাইলন, এয়ার ক্রাফট উইন্ডোতে গ্লাসের পরিবর্তে ব্যবহার করা হয় প্লেক্সিগ্লাস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রে প্লাস্টিক উৎপাদন বৃদ্ধি পায় প্রায় ৩০০ শতাংশ। যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও এর ব্যবহার থেমে থাকে না। বরং নতুন মাত্রা যুক্ত হয় আমাদের দৈনন্দিন তৈজসপত্র থেকে উড়োজাহাজের ককপিট সবখানে ছড়িয়ে পড়ে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে প্লাস্টিক উৎপাদন ও ব্যবহারে যে বিস্ফোরণ ঘটেছিল তা মানুষের প্রয়োজনীয়তায় আরো ব্যাপ্তি লাভ করে। বর্তমান যুগে মানুষের জীবন যাপনে প্লাস্টিক একটি অপরিহার্য নাম। প্লাস্টিকের বেশ কিছু গুণাবলী আছে যার কারণে এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি অত্যাবশ্যকীয় অংশ। প্লাস্টিককে খুব সহজে যেমন ইচ্ছা আকৃতিতে পরিবর্তন করা যায়, এটি ওজনে হালকা, এটিতে মরিচা ধরে না, কিছু কিছু প্লাস্টিক খুব মজবুত। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি খুব সস্তা। আমাদের খাবার টেবিলের পানির বোতল থেকে শুরু করে একটি দিন ও প্লাস্টিক ছাড়া কল্পনা করা যায় না। বাসা, অফিস এবং শিল্পকারখানায় প্লাস্টিকের ব্যবহার অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। এমন জিনিস খুব অল্পই আছে যেখানে একেবারেই প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়নি। আপনার বাসার টেলিভিশন, সাউন্ড সিস্টেম, রেফ্রিজারেটর, কিছু ক্ষেত্রে আসবাবপত্র এমনকি আপনার মোবাইল ফোনটিতেও ব্যবহার করা হয়েছে প্লাস্টিক। রান্নাঘরের দিকে উঁকি দিলেই দেখবেন বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিক সামগ্রী, ননস্টিক ফ্রাইপ্যান থেকে শুরু করে পানির কল, কোথায় নেই প্লাস্টিক? এবার আসুন দেখি আমাদের খাদ্যসামগ্রীতে, প্লাস্টিকের প্যাকেট থেকে শুরু করে প্লাস্টিক বোতল, ব্যাগ, টিউব কোন কিছুই প্লাস্টিক ছাড়া চিন্তা করা যায় না। ট্রেন, প্লেন, মোটর কার, এমনকি জাহাজেও ব্যাপক হারে প্লাস্টিক ব্যবহার করা হচ্ছে। বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিকের যোগান দিতে ব্যপকহারে গড়ে উঠছে প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রি। বাংলাদেশে গত দুই দশক ধরে প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রি উল্লেখযোগ্যহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। সর্বপ্রথম ১৯৬০ সালে ছোট পরিসরে এই ইন্ডাস্ট্রির সূচনা হয়েছিল, যার সংখ্যা বর্তমানে প্রায় ৩০০০। সারাদেশের আনাচে কানাচে ছেয়ে গেছে প্যাকেটজাত ও বোতলজাত পন্য।
প্লাস্টিক দূষণ বর্তমান বিশ্বে এখন সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। ঠিক যে কারণে প্লাস্টিক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, ঠিক সেই কারণেই প্লাস্টিক এখন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে, সেটি হল এর অপচনশীলতা। বিপুল ব্যবহৃত এই প্লাস্টিক ব্যবহারের পর ফেলে দেয়া হচ্ছে প্রকৃতিতে। কিন্তু হাজার বছর ধরে জমতে থাকা প্লাস্টিক থেকেই যাচ্ছে পরিবেশে, যার ফলে প্রতিনিয়ত বর্জ্য হিসেবে বাড়ছে প্লাস্টিকের পরিমাণ যার কিছু অংশ রিসাইকেল করা হলেও বেশির ভাগই জমা হচ্ছে আমাদের মাটিতে, সমুদ্রে। সাধারণত প্লাস্টিকের প্রকৃতিতে মিশে যেতে ১০০ থেকে ১০০০ বছর পর্যন্ত লাগে। এক বার ব্যবহারের পানির বোতল বা পিইটি বোতলের লাগে ৪৫০ বছর। আর এ থেকেই এর ভয়াবহতা সম্পর্কে আঁচ করা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের একটি পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ৩৩.৬ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য হিসেবে তৈরি হচ্ছে যার মাত্র ৬.৫ শতাংশ রিসাইকেল করা হয় এবং ৭.৮ শতাংশ পুড়িয়ে এনার্জি সেক্টরে কাজে লাগানো হয়। বাকি ৮৭.৫ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্য আবর্জনার স্তূপে জমা হচ্ছে এবং যা পচতে প্রায় হাজার বছর সময় লাগছে।
প্লাস্টিক বোতলসহ পণ্য মোড়কীকরণে ব্যবহৃত এসব প্লাস্টিক যত্রতত্র ফেলে দেয়ার জমি চাষ ব্যহত হচ্ছে, বিষাক্ত প্লাস্টিক থেকে নির্গত হচ্ছে বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য যা পরবর্তীতে মাটির মধ্য দিয়ে পৌঁছে যাচ্ছে আমার ভূগর্ভস্থ পানির উৎসে। এছাড়া পলিথিন ব্যাগ, বিভিন্ন দ্রব্যের মোড়ক যেমন চিপসের প্যাকেট, মিনিপ্যাক, প্লাস্টিক বোতল ইত্যাদি বর্জ্য যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে ছড়িয়ে পড়ছে নদী-নালা, খাল-বিলে। ভরাট হয়ে যাচ্ছে শহরের ড্রেন, যার ফলে সৃষ্টি হচ্ছে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে ঢাকা শহর, চট্টগ্রাম শহর ও অন্যান্য বড় বড় শহরগুলো জলাবদ্ধতার স্বীকার হচ্ছে যার অন্যতম প্রধান কারণ পলিথিন ব্যাগ ও প্লাস্টিকের মোড়ক। আমাদের পরিবেশ নিয়ে অসচেতনতা আর সুষ্ঠ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাবে প্রতি বর্ষায় জনজীবন হচ্ছে বিপর্যস্ত।
পৃথিবীতে বিভিন্ন প্রান্তে পুঞ্জীভূত প্লাস্টিকের একটা বড় অংশ দিনশেষে জমা হচ্ছে সমুদ্রে। প্রতি বছর ৮ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক সমুদ্রে পতিত হচ্ছে এবং ধারণা করা হয় যে ২০৫০ সালের মধ্যে সমুদ্রে মাছের চেয়ে প্লাস্টিকের পরিমাণ বেশি থাকবে। অপচনশীল প্লাস্টিক বছরের পর বছর সমুদ্রে ভাসতে থাকে। অণুজীব এদের ভেঙে সরল উপাদানে পরিণত করতে না পারায়, বিশ্বজুড়ে প্লাস্টিক উৎপাদন বাড়ার সাথে সাথে সমুদ্রে এদের পরিমাণ বেড়ে চলছে। তবে তাপ, চাপ সহ অন্যান্য পরিবেশগত কারণে বড় আকারের প্লাস্টিক ক্রমান্বয়ে পরিণত হচ্ছে ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণিকায়, বৈজ্ঞানিক পরিমণ্ডলে যাদের নাম দেওয়া হয়েছে ‘মাইক্রোপ্লাস্টিক’। যেসকল প্লাস্টিক বর্জ্যের আকার ২ মাইক্রোমিটার থেকে ৫ মিলিমিটার এর মধ্যে, সেসকল প্লাস্টিক বর্জ্যকে মাইক্রোবর্জ্য বলা হয়। ২০০৪ সালে যুক্তরাজ্যের প্লাইমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রিচার্ড থম্পসন গবেষণার মাধ্যমে ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, এন্টার্কটিকা অঞ্চলের সাগরের পানিতে প্রচুর পরিমাণে মাইক্রোবর্জ্য খুঁজে পান। থম্পসন ও তার সহযোগীরা ঐ অঞ্চলের পানিতে গৃহস্থালি ও বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের ভাঙ্গা অংশ খুঁজে পান, যার কিছু মানুষের চুলের থেকেও ক্ষুদ্র। সাধারণ প্লাস্টিকের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি ক্ষতিকর এই মাইক্রোপ্লাস্টিক কণিকা। খাদ্য হিসেবে এই প্লাস্টিক কণা সামুদ্রিক প্রাণীর শরীরে প্রবেশ করছে যাতে এই প্রাণিদের বেঁচে থাকা হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। এই বিষাক্ত প্লাস্টিক পরিপাক ও প্রজননের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। ফলে প্রাণীটি ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় বিলুপ্তির দিকে। তবে শুধু গভীর সমুদ্রে বসবাসরত প্রাণীই নয় কাছিম, সিল কিংবা সামুদ্রিক পাখির মতো প্রাণীরাও আছে মারাত্মক ঝুঁকিতে। সামুদ্রিক কাছিমদের বেশিরভাগই প্লাস্টিক ব্যাগ এবং জেলিফিশের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না বলে গবেষকেরা প্রমাণ পেয়েছেন। ফলে প্লাস্টিককে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করার ফলে অবধারিতভাবেই সামুদ্রিক কাছিমের একটি বড় অংশ সরাসরিভাবে পলিথিন দূষণের শিকার। মাইক্রোপ্লাস্টিকের প্রায় ৮০ শতাংশ সমুদ্রে আসে মানুষের ব্যবহৃত প্লাস্টিক বোতল আর পলিথিন ব্যাগ থেকে। এছাড়া প্লাস্টিকের মাছ ধরার সামগ্রী যেমন জাল, ছিপ ইত্যাদি তিমি, ডলফিন, কাছিম, সীল ও অন্যান্য প্রাণীর মৃত্যুর কারণ। প্রতিবছর ৬,৪০,০০০ টন পরিত্যক্ত মাছ ধরার সামগ্রী সামদ্রিক প্রাণির বিলুপ্তির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
শুধু প্রাণীকুলই না, সামুদ্রিক পাখিও প্লাস্টিক বর্জ্যের কারণে ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। সমুদ্রে ভাসমান প্লাস্টিক ও মাছের মধ্যে তুলনা না করতে পারায় পাখিরা খাদ্য হিসেবে প্লাস্টিক গ্রহণ করে। ২০০৪ সালে এক গবেষণার মাধ্যমে গবেষকরা জানান “সামুদ্রিক গিল” এর পেটে ৩০ খন্ডের সম পরিমাণ প্লাস্টিক পাওয়া যায়। পাখিরা যখন প্লাস্টিক পদার্থ গ্রহণ করে তখন তাদের পেটে বিষাক্ত রাসায়নিক পলিক্লোরিনেটেড বায়োফেনল নির্গত হয় ৷ এর জন্য তাদের দেহের টিস্যু ধ্বংস হয়, তাদের দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। ধীরে ধীরে পাখির মৃত্যু হয়।
১৯৮৮-তে আমেরিকার ন্যাশনাল ওশানিক এন্ড এটমোস্ফিয়ারিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (NOAA) এর তথ্য অনুযায়ী উত্তর প্রশান্ত মহাসাগর এর ৭,০০,০০০ বর্গ কিমি এলাকা জুড়ে তৈরি হয়েছে প্লাস্টিকের পাহাড়। যাকে বলা হয় গ্রেট প্যাসিফিক গারবেজ প্যাচ। সায়েন্টিফিক রিপোর্টস জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা তথ্য মতে, মহাসাগরে ভেসে থাকা প্লাস্টিকের স্তূপটি ফ্রান্স, জার্মানি ও স্পেনের একত্রিত আকারের চেয়েও বড়। প্রতিবেদনে বলা হয়, আবর্জনাকুন্ডটি কমপক্ষে ৭৯,০০০ টন প্লাস্টিক নিয়ে সমুদ্রে ভেসে বেড়াচ্ছে। এসব আবর্জনার মোট ওজন ৫০০টি জাম্বো জেটের সমান হবে। বর্তমানে প্লাস্টিক ভাসমান স্তূপটি মহাসাগরের ১৬ লাখ বর্গকিলোমিটার জায়গাজুড়ে ছড়িয়ে আছে এবং তা অব্যাহতভাবে বেড়ে চলেছে।
শুধুমাত্র পরিবেশ আর প্রানীকুলই নয়, মানুষের ওপর ও প্লাস্টিকের ভয়াবহ প্রভাব রয়েছে। প্লাস্টিক থেকে নির্গত হয় এমন কিছু রাসায়নিক দ্রব্য যা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। এর মধ্যে আছে বিসফেনল-এ (বিপিএ), থ্যালেট ইত্যাদি। পানির বোতল বা খাবারের পাত্রে এ ধরনের প্লাস্টিক ব্যবহারের ফলে তা মিশে যাচ্ছে খাদ্যে এবং প্রবেশ করছে মানুষের শরীরে। এছাড়া মাত্রাতিরিক্ত প্লাস্টিক দূষণের কারণে মাছ ও অন্যান্য প্রাণীর খাবারে প্রবেশ করছে বিষাক্ত প্লাস্টিক কণা, যা পরবর্তীতে খাদ্য শৃংখলের মাধ্যমে মানুষের দেহে প্রবেশ করছে। বিপিএ শুক্রাণু ও ডিম্বানু উৎপাদেনে প্রবল বাধার সৃষ্টি করে যাতে করে গর্ভধারণে সমস্যার সৃষ্টি হয়। একইসঙ্গে দেহে বিভিন্ন হরমনের ক্ষরণ অনিয়মিত করে দেয়।এছাড়া ব্রেস্ট ক্যান্সার, হার্টের অসুখ ও জন্মগত শারীরিক ত্রুটির ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রয়েছে এর। এছাড়া বারবার ব্যবহারে প্লাস্টিক বোতলে ব্যাকটেরিয়া জমতে পারে যা অনেক ধরনের ক্ষতিকর রোগ সৃষ্টির কারণ।
ফুড গ্রেড প্লাস্টিকের নাম আমরা শুনেছি। ফুড গ্রেড প্লাস্টিক মূলত এইচডিপিই (উচ্চ ঘনত্বের পলি ইথিলিন) যা দীর্ঘ সময়ব্যাপী ১১০ ডিগ্রী তাপমাত্রা পর্যন্ত রাসায়নিক বিক্রিয়া প্রতিরোধ করতে সক্ষম। আরেক ধরণের ফুড গ্রেড প্লাস্টিক আছে যার নামের সাথে আমরা অধিক পরিচিত, তা হল পেট (পিইটি), পলি ইথিলিন টেরিফেলেট, সাধারন পানীয় যে বোতলে থাকে। এই পেট প্লাস্টিক হল বহুল ব্যবহৃত প্লাস্টিক যা খাদ্য সংরক্ষন এবং পরিবেশনে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।উন্নত বিশ্বে ফুড গ্রেড প্লাস্টিকের জন্য নির্দিষ্ট নিয়মনীতি রয়েছে। কোন ধরণের খাদ্যপণ্য কোন ধরণের প্লাস্টিক পাত্রে বাজারজাত করা যাবে তার একটি নির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে। আমাদের দেশে এই ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট আইনের সল্পতা প্রকটভাবে লক্ষণীয়।
রিসাইকেলের মাধ্যমে প্লাস্টিকের ভয়াবহতা রোধ করা সম্ভব, কিন্তু তার জন্য নির্দিষ্ট নীতিমালা অনুসরণ করা উচিত। হাসপাতালে ব্যবহৃত প্লাস্টিক থেকে শুরু করে অপরিশোধিত প্লাস্টিক রিসাক্লিং করা হচ্ছে যা পরবর্তীতে স্বাস্থ্যঝুকি আরো বাড়াচ্ছে। তাই পানির বোতল বা খাবারের পাত্র হিসেবে প্লাস্টিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে ফুড গ্রেড কিনা যাচাই করে নিতে হবে। সবচেয়ে সহজ উপায় হল পণ্যের রিসাইক্লিং নাম্বার দেখা। এই নাম্বার ১ থেকে ৭ পর্যন্ত হয়ে থাকে। সবচেয়ে ভালো প্লাস্টিক পাত্র যা খাদ্যের জন্য উপযুক্ত তা হল এইচ ডি পি ই, যার রিসাইক্লিং নাম্বার হল ২। এছাড়া রয়েছে পি ই টি ই, এল ডি পি ই এবং পি পি এদের রিসাইক্লিং নাম্বার যথাক্রমে ১, ৪ এবং ৫।রিসাইক্লিং নাম্বার ১ হল একবার ব্যবহারের জন্য তৈরি প্লাস্টিক পণ্য। রিসাইক্লিং নাম্বার ২, ৪, ৫ হল ফুড গ্রেড নাম্বার। আর ৩, ৬, ৭ মোটেও খাদ্যের জন্য উপযুক্ত প্লাস্টিক নয়।
প্লাস্টিকের ভয়াবহ ক্ষতিকরদিক সমূহ থেকে বাঁচতে প্লাস্টিকের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে।২০০২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে রাজধানীতে এবং পরে ১ মার্চ থেকে সারাদেশে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন, বিক্রি ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। এ জন্য পরিবেশ আইন ১৯৯৫ সংসদে সংশোধনও করা হয়। কিন্তু প্লাস্টিক বা পলিথিনের কোন বিকল্প বাজারে না আসায় এটি অকার্যকর হয়ে যায়। বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরেই চেষ্টা করে আসছেন, কীভাবে পরিবেশে প্লাস্টিকের ক্ষতিকর প্রভাবকে কমিয়ে আনা যায়। আর প্লাস্টিকের বিকল্প নিয়েও গবেষণাগারে দীর্ঘদিন ধরেই কাজ চলছে। আবিষ্কৃত হয়েছে পরিবেশে পচনশীল বায়োপ্লাস্টিকও। কিন্তু সেই প্লাস্টিক উৎপাদনের খরচ অনেক বেশি হওয়ায় বাণিজ্যিকভাবে এই প্লাস্টিক ব্যবহার করা হচ্ছে না। তবে আশার বিষয় হচ্ছে, অতি সম্প্রতি পাটের পলিমারকে কাজে লাগিয়ে পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পচনশীল ব্যাগ প্রস্তুত করা হচ্ছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশ এটমিক এনার্জি কমিশনের ডিজি এবং প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোবারক আহমদ খানের তত্ত্বাবধায়নে পাইলট পর্যায়ে এ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। প্রথমে পাট থেকে সেলুলোজ আহরণ করা হচ্ছে। ওই সেলুলোজকে প্রক্রিয়াজাত করে অন্যান্য পরিবেশবান্ধব দ্রব্যাদির সাথে কম্পোজিট করে এ ব্যাগ তৈরি করা হয়। উৎপাদিত ব্যাগে ৭০ শতাংশের বেশি পাটের সেলুলোজ বিদ্যমান।এছাড়া এতে অন্য কোন প্রকার অপচনশীল দ্রব্য ব্যবহার হয় না বিধায় এটি তিন থেকে চার মাসের মধ্যেই সম্পূর্ণরূপে মাটির সাথে মিশে যায়। এই ব্যাগের নাম দেয়া হয়েছে সোনালী ব্যাগ, এটি পলিথিন ব্যাগের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হলে কিছুটা হলেও প্লাস্টিক সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।
এছাড়া জলাবদ্ধতা, মাটির উর্বরতা রোধ, নদী-দূষণ ও মানুষের স্বাস্থ্যঝুকি রোধ করতে সকল স্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে এবং প্লাস্টিকের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে বিকল্প পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে। প্লাস্টিকের পরিবর্তে কাঁসা, এলুমিনিয়াম ইত্যাদির তৈরি সামগ্রীকে রান্নাঘরে বেশি প্রাধান্য দেয়া উচিত। বাজারে যাওয়ার সময় কাপড়ের ব্যাগ নিয়ে যাওয়া এবং একবার ব্যবহারের পর ফেলে দেয়া যায় এমন জিনিসের পরিবর্তে বারবার ব্যবহার করা উচিত। যত্রতত্র পানির বোতল, চিপসের প্যাকেট, চকলেটের খোসা, পলিথিন ব্যাগ না ফেলে সঠিক স্থানে ফেলতে হবে। সর্বোপরি, একজন মানুষ তার ব্যাক্তিগত জীবনে প্লাস্টিক বা পলিথিন ব্যবহারের পরিমাণ কমিয়ে আনতে পারলে এ ভয়াবহ সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। পরিবেশের প্রতি সচেতনতা আর আন্তরিকতাই পারে আমাদের একমাত্র বাসস্থান পৃথিবীকে বাঁচাতে ।
-ফৌজিয়া আহমেদ
প্রভাষক, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস