কৃষ্ণগহ্বর-১১ : প্রতি কণার জগতে

0
900

ধরুন গহিন একটা বনের মধ্যে হাঁটছেন। সাথে আপনার প্রিয় এক বন্ধু। হাঁটছেন দুজন হাত ধরাধরি করে। হয়তো পথ ভুলে গেছেন। হঠাৎ দেখলেন আপনাদের মতো আরো দুজন মানুষ সেই জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছেন হাত ধরাধরি করে। তাঁদের পেছনটা দেখতে পাচ্ছেন। সেটা দেখেই আপনাদের ভিরমি খাবার জোগাড়। কারণ সেই দুজনের উচ্চতা, দেহের গড়ন হুবহু আপনাদের মতো। ব্যাপারটা স্পষ্ট করে বোঝার জন্য আপনি তাঁদের উদ্দেশে হাঁক ছাড়লেন, ‘এই যে ভাইজানরা, একটু শুনবেন?’

তাঁরা ঘুরে দাঁড়াল। তাদের সামনের দিকটা দেখে চমকে উঠলেন আপনারা। চোখ কপালে উঠে গেল। দুর্বল চিত্তের হলে অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারেন। কারণ যে দুজনকে আপনরার দেখেছেন, সেই দুজন আর আর কেউই নয়, আপনারা দুজনই।

যদি আপনাদের নার্ভ আরেকটু শক্ত হয়, ভূতটুত যদি না না মানেন, তাহলে এগিয়ে যেতে পারেন। আপনাদের কার্বন কপি দুজনের পরিচয়-টরিচয় জানার চেষ্টা করতে পারেন। ধরুন, এই কাজটি করতে গেলেন আপনার সঙ্গের বন্ধুটি। তিনি ‘হাই আমি অমুক’ বলে তাঁর কার্বন কপিটির দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। তাঁর কপিটিও তাঁর দিকে হাত বাড়িয়ে দিল।

সেকেন্ডের ব্যবধানে তাদের একে অপরের হাত একত্রিত হলো। আর যাবে কোথায়! সাথে সাথে আপনার বন্ধু আর তার কার্বন কপি যেন মুহূর্তের জন্য আলোর ঝলকে পরিণত হলো এবং দুজনেই ভ্যানিস!

আপনি প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। তারপর যখন সম্বিত ফিরে পেলেন। তখন যদি আপনার বন্ধুর মতো ভ্যানিস না হতে চান, তবে কার্বন কপিটির সাথে আলাপ না করে ঝেড়ে বিপরীত দিকে দৌড় দিন। তাতে আপনার প্রাণ রক্ষা পাবে।

এই ঘটনা, বাস্তবে এমনটা ঘটার সম্ভাবনা নেই। তবে তাত্ত্বিকভাবে সম্ভব। সেটা সম্ভব প্রতি পদার্থের কারণে। প্রতি পদার্থ কী জিনস?

আমাদের বিদ্রোহী কবি দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন–

পৃথিবীতে যা কিছু মহান চির কল্যাণকর

অর্ধেক তার গড়িয়াছে নারী, অর্ধেক নর।
আপনার প্রতিকণা কপির সাথে হাত মেলাতে যাবেন না যেন

নর-নারীর মধ্যে ফারাকটা কী? উভয়েই তো রক্ত-মাংসের মানুষ! পার্থক্য শুধু লিঙ্গে। মানুষের এই দুটো শ্রেণিকে যদি আমরা দুটো কণার সাথে তুলনা করি। এক লিঙ্গের মানুষ বিপরীত লিঙ্গের মানুষকে আকর্ষণ করে।

কণা রাজ্যেও এমনটা ঘটে। তবে লিঙ্গের পরিবর্তে সেখানে আকর্ষণ করার জন্য রয়েছে বৈদ্যুতিক চার্জ। তাই ঋণাত্মক চার্জযুক্ত ইলেকট্রন ধনাত্মক চার্জযুক্ত প্রোটনকে আকর্ষণ করে। ইলেকট্রন আর প্রোটনকে যদি আলাদা করে চিহ্নিত করতে হয়, তাহলে এদের চার্জ একটা বিরাট চিহ্ন। সেই সাথে ভরটাও ফ্যাক্টর। কণা জগতে প্রোটন বিরাট ভারী একটা কণা। সেই তুলনায় ইলেকট্রন নিতান্তই হালকা-পলকা। ইলেকট্রনের চেয়ে হালকা শুধু নিউট্রিনো।

প্রোটন আর ইলেকট্রনের ভরের ফারাক যতই হোক একটা জায়গায় কিন্তু সমানে সমান। সেটা হলো বৈদ্যুতিক চার্জÑদুটোরই সমান। তবে প্রোটনের চার্জ ধনাত্মক আর ইলেকট্রনের চার্জ ঋণাত্মক। আর চার্জ সমান সমান বলে তারা পরস্পরের প্রতি প্রচণ্ড আকর্ষণ অনুভব করে।

ধরা যাক একটা কণা, যেটার ভর প্রোটনের সমান। কিন্তু চার্জ ইলেকট্রনের সমান, অর্থাৎ -১ হয়। তাহলে ব্যাপারটা কেমন হয়?

তখন সেই ধনাত্মক আর ঋণাত্মক প্রোটন যদি পরস্পরের কাছে আসে, সংঘর্ষ হয়, তাহলে তারা কিন্তু বিপরীত চার্জের কারণে পরস্পরের প্রতি আর শুধুই আকর্ষণ করবে না। সেই সংঘর্ষে দুটি কণাই স্রেফ গায়েব হয়ে যাবে। তৈরি হবে শক্তি। তেমনি ইলেকট্রনের ভরের সমান অথচ চার্জ ধণাত্মক কণা যদি ইলেকট্রনের সাথে মোলাকাত করতে আসে, একই ঘটনা ঘটবে। একই ভরের কিন্তু বিপরীত চার্জের কণাটি হলো মূল কণিকাটির প্রতিকণা।

আদৌ কি আছে?

থাকেই যদি, তবে তার স্থান মহাবিশ্বের কোথায়?

[এই লেখাটি কৃষ্ণগহ্বর ঃ এক মহাজাগতি রহস্যের ঊপাখ্যান বইয়ের অংশবিশেষ। বইটি ২০১৮ সালের অমর একুশে বইমেলায় প্রকাশ করবে অন্বেষা প্রকাশন]
প্রতি পদার্থের প্রবক্তা কোয়ান্টাম বলবিদ্যার অন্যতম রূপকার ব্রিটিশ পদার্থবিদ পল ডিরাক। বিজ্ঞানী পল ডিরাকের ভাবনা চিন্তা একটু অন্য রকম ছিল। গণিতের যে ঋণাত্মক মান, সেটার গুরুত্ব আমরা শুধু গণিতের খাতাতেই ফেলে রাখি। বাস্তব জগতে এর কোনো মূল্য আছে বলে মনে করি না। আমরা কি -৩টি বই কিংবা -৭টি কলমের কথা ভাবতে পারি?

কথিত আছে ডিরাক নাকি এভাবে ঋণাত্মক বস্তুর কথা ভাবতে পারতেন। সেটা আসলেই সত্যি নাকি গালগল্প, সে কথা কেউ বলতে পারে না। কিন্তু তার এ ধরনের চিন্তাধারায় পদার্থবিদ্যার জগতে এক নতুন দুয়ার উšে§াচিত হয়েছিল। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন একই ভরের ভিন্ন চার্জযুক্ত কণার অস্তিত্ব থাকতে পারে। তিনি ইলেকট্রনের জন্য কোয়ান্টাম মেকানিক্স ব্যবহার করার চেষ্টা করেছিলেন। তা করতে গিয়েই ডিরাক প্রতি পদার্থের ভবিষ্যদ্বাণী করেন।

সেটা ১৯৩১ সালের কথা। আপেক্ষিক তত্ত্ব থেকেই নাকি ডিরাক প্রতিকণার ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ইলেকট্রনের প্রতিকণা পজিট্রনের কথা। পরের বছরেই কার্ল অ্যান্ডারসন পজিট্রন আবিষ্কার করে দেখালেন। ডিরাকের অনুমান একশত ভাগ সত্যি হলো। কার্ল অ্যান্ডারসন একটা পরমাণুর কক্ষপথ থেকে ইলেকট্রন সরিয়ে ফেলে দেখলেন সেখানে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পজিট্রন তৈরি হয়েছে। তবে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় যেভাবে ইলেকট্রন সরানো হয়, ওভাবে সরালে হবে না। কণা ত্বরক যন্ত্র নামের শক্তিশালী এক যন্ত্রের সাহায্যে প্রতিকণা তৈরি সম্ভব।

পল ডিরাক

প্রতি পদার্থ অনেকটা নেগেটিভ সংখ্যার মতো, একটা পজিটিভ সংখ্যার সাথে একই নেগেটিভ সংখ্যা যোগ করলে যেমন কিছুই থাকে না, ঠিক সে রকম পদার্থের সাথে প্রতি-পদার্থ মিলিত হলে দুটোই অদৃশ্য হয়ে যায়! থাকে শুধু শক্তি। ব্ল্যাকহোল ও বিগব্যাং থিওরিকে প্রতিষ্ঠিত করতে প্রতি পদার্থের ভূমিকা ব্যাপক।

পরবর্তীকালে একই প্রক্রিয়ায় প্রোটনের প্রতিকণা অ্যান্টি-প্রোটন ও নিউট্রনেরও প্রতিকণা অ্যান্টি-নিউট্রন আবিষ্কার হয়। শুধু তা-ই নয় কোয়ার্কসহ প্রতিটি মৌলিক কণার প্রতি কণাও আবিষ্কার হয়। আমাদের চারপাশের জগৎ যেমন ইলেকট্রন ও প্রোটন দিয়ে তৈরি, অ্যান্টি-প্রোটন, অ্যান্টি-নিউট্রন ও পজিট্রনের সসন্বয়ে প্রতি পদার্থ এমনকি প্রতি পদার্থের জগত তৈরি হওয়া অসম্ভব নয়। বিজ্ঞানীরা পরীক্ষাগারে রীতিমতো প্রতি পদার্থ তৈরি করে এর সত্যতার প্রমাণ দিয়েছেন।

একই ধরনের পদার্থ এবং প্রতি পদার্থ একে অপরের সংস্পর্শে আসে সাথে সাথে একটা আরেকটাকে ধ্বংস করে শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে যায়। সেই শক্তির পরিমাণ আইনস্টাইনের বিখ্যাত ঊ=সপ২ ব্যবহার করে বের করা যায় খুব সহজেই।

কণা আর প্রতিকণাদের সংঘর্ষে উভয় কণা ধ্বংস হয়ে যায়

 

নজরুল বলেছিলেন, পৃথিবীর যা কিছু সন্দুর তার অর্ধেক তৈরি নারীর অর্ধেক নরের। কবিতার লাইন এখানে তোলার একটা উদ্দেশ্য আছে। বিজ্ঞানীরা এখন নিশ্চিত প্রতিটা মূল কণিকার একটি করে প্রতিকণা আছে। কিন্তু আমাদের চারপাশের জগৎ শুধুই প্রতিকণা দিয়ে তৈরি বিশেষ অবস্থা তৈরি না করলে প্রতিকণার দেখা মেলে না।

তার মানে, পৃথিবীতে মহাবিশ্বে শুধুই কণাদেরই জয়জয়কার। প্রতিকণাদের ঠাঁই মহাবিশ্বে নেই। কিন্তু আধুনিক সৃষ্টিতত্ত্ব বলছে ভিন্ন কথা। বিগব্যাং অর্থাৎ মহাবিস্ফোরণ তত্ত্ব এখন প্রমাণিত সত্য। সেই মহাবিস্ফোরণের বৈজ্ঞানিক ইতিহাস বের করতে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, মহাবিস্ফোরণের পর যখন যখন বস্তু কণাদের জš§, তখন যতগুলো কণা তৈরি হয়েছিল, ঠিক সেই পরিমাণ প্রতিকণাও তৈরি হয়েছিল। আবার কণা আর প্রতিকণাদের সংঘর্ষে শক্তি তৈরি হয়।

তাহলে হিসাবটা দাঁড়ায়, কণা আর প্রতিকণাদের সংঘর্ষে সব কণা ধ্বংস হয়ে যাবার কথা। তাতে উৎপন্ন শক্তিই শুধু পড়ে থাকার কথা মহাবিশ্বে, কোনো কণা নয়। কিন্তু দেখাই যাচ্ছে সেটা হয়নি। হলে এই বই লেখার জন্য যেমন আমি থাকতাম না, আবার পড়ার জন্য আপনাকেও পেতাম না। মোট কথার বস্তু কোনো অস্তিত্ব মহাবিশ্বজুড়ে। বিজ্ঞানীদের বলছেন, বিশেষ এক কারণে গোটা মহাবিশ্ব থেকে প্রতিকণারা ধ্বংস হয়ে গেছে তাদের মূল কণাদের সাথে নিয়ে।

আগের সব পর্ব :

কৃষ্ণগহ্বর-১০: কোয়ার্ক, নিউট্রিনো আর অন্যান্য কণিকা

কৃষ্ণগহ্বর-৯ : মূল কণিকাদের কথা

কৃষ্ণগহ্বর-৮ : পরমাণুর কথা

কৃষ্ণগহ্বর-৭ : মহাকর্ষের কথা শোনে আলোও
কৃষ্ণগহ্বর-৬ : আপেক্ষিকতা ও আধুনিক মহাকর্ষ

কৃষ্ণগহ্বর-৫ : আলোর কচড়া

কৃষ্ণগহ্বর-৪ : নিউটনের কামান আর পৃথিবীর মুক্তিবেগ

কৃষ্ণগহ্বর-৩ : নিউটনের মহাকর্ষে

কৃষ্ণগহ্বর-২ : মহাকর্ষের পটভূমি

কৃষ্ণগহ্বর-১ : ফিরে দেখা ইতিহাস

 

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.