ফিরে যেতে হবে একশ বছর আগে। পদার্থবিজ্ঞান তখন দুটি চিরায়ত তত্ত্বের ওপর দাঁড়িয়ে। একটা হলো নিউটনের গতি তত্ত্ব। আরেকটা ম্যাক্সওয়েলের তড়িচ্চুম্বকীয় তত্ত্ব। নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্বও প্রকৃতিবিজ্ঞানের অন্যতম ভিত্তি। তবে মহকর্ষ তত্ত্ব নিউটনের গতিতত্ত্বের বাইরে নয়।
আপেক্ষিকতা প্রকাশের আগে বিজ্ঞানীরা স্থান ও কালকে আলাদা করে দেখতেন। আইনস্টাইন বললেন, স্থান ও কাল আলাদা কোনও বিষয় নয়। স্থানকালে এক করে দেখতে হবে। আগে জড় বস্তুর তিনটে মাত্রা ছিল। দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা। এই তিনটিই স্থানের মাত্রা। স্থানকাল যেহেতু অভিন্ন সত্তা সুতরাং জড়বস্তুর মাত্রা একটা বেড়ে গেল। সেটা কালের বা সময়ের মাত্রা।’স্থানকাল’ শব্দটা বিশেষ মর্যাদা লাভ করল পদার্থবিজ্ঞানে।
আইনস্টাইন বললেন, গোটা মহাবিশ্বই দাঁড়িয়ে আছে এই স্থাকালের ওপর। ব্যাপারটা একটু খোলসা করা যাক। মহাবিশ্বের গ্রহ, নক্ষত্র, গ্যালাক্সিগুলো কোথায় দাঁড়িয়ে?
অনেকে বলেনর, মহাশূন্যে বা মহাবিশ্বে। এই মহাবিশ্ব বা মহাশূন্যটা কী?
আগে ওটাকেই বিজ্ঞানীরা বলতেন স্পেস বা স্থান। আইনস্টাইন বললেন, শুধু স্পেস বললে ভূল হবে। ওটা আসলে স্পেসটাইম বা স্থানকাল।
বিশেষ আপেক্ষিকতা থেকে আরেকটি বিখ্যাত সূত্র বেরিয়ে এসেছিল। সেটা হলো ভরশক্তির সমীকরণ। এই সমীকরণ থেকে বেরিয়ে এলো, ভর ও শক্তির অভিন্ন স্বত্ত্বা নয়। ভরকে শক্তিতে রূপন্তরিত করা যায়। তেমনি শক্তিকেও ভরে পরিণত করা সম্ভব।
বিশেষ আপেক্ষিকতা প্রকাশ করেই বসে থাকলেন না আইনস্টাইন। বুঝতে পারলেন এই তত্ত্বও পদার্থবিজ্ঞানকে সম্পূর্ণ করতে পারেনি। মহাকর্ষ বল নিয়ে কোনও কথাই বলা হয়নি এই তত্ত্বে। নিউটনের মহকর্ষের কথা আগেই বলা হয়েছে। নিউটনের তত্ত্ব দিয়ে গ্রহ-নক্ষত্রের গতিপথ, পৃথিবীর ঘূর্ণন, বলবিদ্যা ইত্যাদি ভালোভাবেই ব্যাখ্যা করা যাচ্ছিল। তবে কিছু ত্রুটি রয়ে গিয়েছিল মহাকর্ষ সূত্রে। এতে সময়ের কথা বলা হয়নি। একটা বস্তুর ওপর আরেকটা বস্তুর মহাকর্ষ বলের ক্রিয়া সংঘটিত হতে কত সময় লাগবে? মানে দুটোর কোনো একটা বস্তুর যদি ভরের পরিবর্তন হয় তাহলে তাদের মহাকর্ষ বলের পরিবর্তন হবে, সেই পরিবর্তনটা হতে কত সময় লাগবে?
পৃথিবী আর সূর্যের কথাই ধরা যাক। পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব মোটামুটি ১৫ কোটি কিলোমিটার। ধরা যাক, মহাকাশের আরেকটি বিরাট নক্ষত্র কক্ষচ্যুত হয়ে সূর্যের ওপর এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। তাল সামলাতে না পা পেরে সূর্য তার অবস্থান থেকে খানিকটা সরে গেল। ফলে পৃথিবীর সাথে তার দূরত্বের হেরফের হলো। ফলে মহাকর্ষ বলের মানেরও পরির্তন ঘটবে।
কিন্তু পৃথিবী ঠিক কখন টের পাবে মহাকর্ষ বলের পরিবর্তন হয়েছে? তা কি সূর্যের অবস্থানচ্যূত হওয়ার সাথে সাথে?
নাকি পরে?
কত পরে?
নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র বলছে দূরত্বের হেরফের হলে বস্তুদুটোর আকর্ষণ বলেরও হেরফের হবে। তাই সূর্যের অবস্থানচ্যূত হলে সাথেই সাথেই পৃথিবী তা টের পেয়ে যাওয়ার কথা।
তাহলে মহাকর্ষীয় আকর্ষণ কি দূরক্রিয়া?
মানে কালক্ষেপন না করেই কোনো বার্তা কোটি কোটি কিলোমিটার দূরে ছড়িয়ে দেয়া?
তা কি সম্ভব?
এখানেই আসলে মূল সমস্যা। কিন্তু নিউটনের সময়ে এই ক্রটির কথা কেউ ভাবেনি।
আরও কয়েকটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল আইনস্টাইনের মাথায়। মহাকর্ষ বলের উৎস কী? বস্তুর ভেতরের কোন ধর্মের কারণে মহাকর্ষ বল ক্রিয়া করে। বিদ্যুৎ ও চুম্বকেরও আকর্ষণ ধর্ম আছে। কিন্তু ওই দুই বলের বিকর্ষণী ক্ষমতাও আছে। অথচ মহাকর্ষ বল শুধু আকর্ষণই করে। এর কোনো বিকর্ষণী ক্ষমতা নেই।
কিন্তু কেন?
১৯০৭ সাল। আইনস্টাইন তখন সুইজারল্যান্ডের বার্ন শহরে বাস করেন। সেখানকার পেটেন্ট অফিসের সামান্য কেরানি। একদিন অফিসে বসেই তার মাথায় এলো একটা চিন্তা । যেটাকে তিনি বলেছেন, তার জীবনের সবচেয়ে সুখের চিন্তা।
ধরা যাক, একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে লিফটের ভেতরে। লিফটটা আছে মাটি থেকে কয়েকশো ফুট থেকে বেশ ওপরে। হঠাৎ যদি লিফটের দড়ি ছিঁড়ে যায়। তাহলে লিফট আর ভেতরের লোকটা মুক্তভাবে নিচে পড়তে থাকবে। উয়েরই ত্বরণ হবে মহাকর্ষ ত্বরণের সমান। লোকটা তখন ওজন অনুভব করবে না। ওপর থেকে মুক্তভাবে পড়া যেকোন বস্তুই আসলে মাটি ছোঁয়ার আগ পর্যন্ত নিজেকে ওজনহীন মনে করে।
একই উচ্চতা থেকে ভিন্ন দুটি বস্তু মুক্ত যখন নিচে পড়ে তখন তাদের ত্বরণ সমান হয়। তারা একইসাথে মাটি স্পর্শ করে।
পড়ন্ত বস্তুর এই সূত্রগুলো আবিষ্কার করেছিলেন গ্যালিলিও। এগুলো গাণিতিকভাবে প্রমাণ করে দেখান নিউটন। অর্থাৎ পড়ন্ত বস্তুর গতি কিংবা ত্বরণের ওপর ভরের কোনও সম্পর্ক নেই। অথচ পড়ন্ত বস্তুর পতনের জন্য দায়ী পৃথিবীর মহাকর্ষ বল। মহাকর্ষ সূত্রেই আবার দাবি করা হয়েছে, মহাকর্ষ বল ভরের ওপর নির্ভরশীল।
আইনস্টাইন পড়ন্ত বস্তুর ওপর পৃথবীর আকর্ষণ আর মহাকর্ষ বলকে এক সূতোই বাঁধার চেষ্টা করলেন। নিউটন দেখিয়েছিলেন পড়ন্ত বস্তুর ত্বরণের জন্য পৃথিবীর মহাকর্ষ ক্ষেত্র দায়ী। আইনস্টাইন একটু উল্টোভাবে চিন্তা করলেন। মহাকর্ষ বলের কারণে বস্তু ত্বরিত হয়।
যেখানে মহাকর্ষ বল অনুপস্থিত, সেখানে যদি কোনও বস্তু ত্বরিত কর হয় তাহলে কি মহাকর্ষ বলের সৃষ্টি হবে। আইনস্টাইন হিসেব করে দেখলেন, মহাকর্ষ বল যেখানে নেই সেখানে কোনও লিফটকে যদি যান্ত্রিক উপায়ে ত্বরিত করা যায় তাহলে সেই লিফটের ভেতর কৃত্রিম মকাকর্ষ ক্ষেত্র তৈরি হয়।
এরপর আইনস্টাইন লেগে পড়লেন মহাকর্ষ বলের সবরকম রহস্য অনুসন্ধানে। ১৯১৫ সালে তিনি আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব প্রকাশ করলেন। তাতে বলা হল, মহাকর্ষ বলের জন্য বস্তুর ভর দায়ি নয়। মহাকর্ষ বল স্থানকাল জ্যামিতির খেলা মাত্র। তিনি হিসাব করে দেখিয়েছিলেন ভারি কোনো উপস্থিতি স্থানকালকে বাঁকিয়ে দেয়।
ধরা যাক, একটা চাদর। সেটা চারটে খুঁটির মাথায় টানটান করে বাঁধা। সেক্ষেত্রে চাদরটাও সমতল পৃষ্টের মতো টানটান হয়ে থাকবে। তারওপর একটা লোহার বল রাখা হলো। তাহলে চাদরটার মাঝখানের জায়গাটা নিচের দিকে ঝুলে যাবে ওই বলটার কারণে। এখন একটা কাচের গুলি চাদরের একপাশে গড়িয়ে দেওয়া হোক। সেটা ধীরে ধীরে চাদরের মাঝখানের দিকে এগিয়ে যাবে। যেখানে লোহার গোলকটা আছে সেদিকে। তারপর গোলটার কাছাকাছি গিয়ে কয়েকপাক ঘুরবে। ঘুরতে ঘুরতে একসময় লোহার গোলকের সাথে ধাক্কা খাবে।
এটা কেন হচ্ছে?
কারণ লোহার গোলক চাদরের মাঝখানটা বাকিয়ে দিয়েছে। তাই গুলিটা চাদরের ওপর গড়িয়ে দিলে সেটা চলার জন্য আর সমতল পথ পাচ্ছে না। তার চলার পথ বেঁকে গেছে। তেই সে বাঁকা পথেই চলে গেছে গোলকটার দিকে।
স্থানকালকেও এমন চাদরের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। পৃথিবী, সূর্য, নক্ষত্র, ব্ল্যাকহোল ইত্যাদি ভারী বস্তুর উপস্থিতি স্থানকালকে বাঁকিয়ে দেয়। তখন ভারী বস্তুর কাছে আরেকটা হালকা বস্তু এলে মনে হবে ভারী বস্তুটা হালকা বস্তুকে আকর্ষণ করছে। ঠিক চাদরের ওপর যেভাবে লোহার গোলক কাচের গুলিকে আকর্ষণ করেছিল। তবে চাদরের সাথে স্থানকালের পার্থক্য আছে। স্থানকাল চারমাত্রিক। আর চাদরে তর হলো দ্বিমাত্রিক। তাই স্থানকালকে ভারি বস্তু চারমাত্রায় বাঁকিয়ে দেবে।
স্থানকালের এই বক্রতাই হলো মহাকর্ষ বলের উৎস। কিন্তু আমাদের সাধারণ ইউক্লিডিও জ্যামিতি দিয়ে এটা ব্যাখ্যা করা যাচ্ছিল না। আইনস্টাইন তখন তাঁর গণিতবিদ বন্ধু মার্সেল গ্রসম্যানের শরণাপন্ন হন। গ্রসম্যন তাকে কার্ল গাউস ও তার ছাত্র র্বানাড রীম্যানের প্রতিষ্ঠিত করা বক্র জ্যামিতির সন্ধান দেন।
সেই জামিতির সাহায্যে আইনস্টাইন সাধারণ আপেক্ষিত তত্ত্বের সমাধান করেন। সেইসাথে মহাকর্ষীয় বলেরও সমাধান হয়। ১৯১৯ সালে জ্যোতির্বিদ আর্থার এডিংটনের একদল গবেষক সর্বপ্রথম সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বের প্রমাণ দেন।
আগের পর্ব : কৃষ্ণগহ্বর-৫ : আলোর কচড়া কৃষ্ণগহ্বর-৪ : নিউটনের কামান আর পৃথিবীর মুক্তিবেগ কৃষ্ণগহ্বর-৩ : নিউটনের মহাকর্ষে কৃষ্ণগহ্বর-২ : মহাকর্ষের পটভূমি কৃষ্ণগহ্বর-১ : ফিরে দেখা ইতিহাস
-আব্দুল গাফফার রনি সহসম্পাদক, মাসিক বিজ্ঞানচিন্তা [লেখকের ফেসবুক প্রোফাইল]