মহাকর্ষ তরঙ্গের পরোক্ষ প্রমাণ

0
944
আইনস্টাইনের জেনারেল থিয়োরি অব রিলেটিভিটি প্রকাশ হয় ১৯১৫ সালে। তার সব প্রমাণই একে একে জমা হতে লাগল। সেটা বছর চারেকের মধ্যেই। মহাকর্ষ তরঙ্গের কারণেই যে মহাবিশ্বের দোমড়ানো-মোচড়ানো অবস্থা– তাও প্রমাণিত হলো। কিন্তু সন্ধান মিলছিল না মহাকর্ষ তরঙ্গের। মহাকর্ষ তরঙ্গের অস্তিত্ব প্রথমবারের মতো নির্ণয় করতে অপেক্ষা করতে হলো আরো পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময়।
১৯৬৭ সাল। জোসলিন বেল এবং অ্যান্টনি হিউয়িশ নামে দুই জ্যোতির্বিদ মহাকাশে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের এক নক্ষত্র আবিষ্কার করলেন। সূর্যের মতো সাধারণ নক্ষত্রে সাধারণত ইলেক্ট্রন এবং প্রোটন এবং তার সঙ্গে কিছু নিউট্রন মৌলিক উপাদান হিসেবে থাকে। নতুন এই নক্ষত্রে তা নেই। ইলেক্ট্রন আর প্রোটনশূন্য এই নক্ষত্রের প্রায় পুরোটাই নিউট্রনে ভরা। তাই এর নাম দেয়া হলো নিউট্রন তারা বা নিউট্রন স্টার।
বিজ্ঞানীরা অবশ্য আগে থেকেই জানতেন, এ ধরনের তারার অস্তিত্ব মহাকাশে আছে। সত্যি বলতে কি, এই তারাও একসময় সাধারণ তারাই ছিল। কিন্তু আয়ুষ্কালের শেষ পর্যায়ে গেলে তারা জরাগ্রস্ত দশায় চলে যায়। এ অবস্থায় তারা থেকে দৃশ্যমান আলো বের হয় না বললেই হয়। বের হয় আরো লম্বা তরঙ্গদৈর্ঘের আলোকতরঙ্গ। রেডিও তরঙ্গ। রেডিও তরঙ্গের সঙ্কেতের সূত্র ধরেই নিউট্রন তারা প্রথম সনাক্ত করলেন বেল আর হিউয়িশ। এর জন্য হিউয়িশ নোবেল পুরষ্কার পেলেন ১৯৭৪ সালে। কিন্তু জোসলিন বেল পেলেন না। কেন পেলেন না, তা আমার জানা নেই।
সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো আসে নিরবচ্ছিন্নভাবে। কিন্তু নিউট্রন তারা থেকে রেডিও তরঙ্গ নিরবচ্ছিন্নভাবে আসে না। আসে ঘুরে ঘুরে। বিমানবন্দরে সার্চলাইট কিংবা ঘুরন্ত টর্চের মতো। ঘুরতে ঘুরতে যখন আলো আমাদের গায়ে এসে পড়বে তখন আমরা দেখতে পাব, নইলে নয়। অর্থাৎ নিউট্রন তারার রেডিও সংকেত পাবো ঝলকে ঝলকে। ঝলকের ইংরেজি হলো ‘পালস’। তাই নিউট্রন তারার নাম দেয়া হলো পালসার।
১৯৭৪ সাল। এই বছরই হিউয়িশ নোবেল পেয়েছেন। জ্যোতির্বিদ জোসেফ টেলর তখন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। রাসেল হাল্স্ নামে এক ছাত্র তখন টেলরের অধীনে পিএইচডি করছেন। টেলরের তত্ত্বাবধানে হালস্ গবেষণা করছিলেন পালসারদের নিয়ে। মোট ৫০ টা পালসার খুঁজে বের করলেন তাঁরা। এগুলোর মধ্যে দশটা বাদে সবকটাই নতুন। এই ৫০টিকে নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করলেন তাঁরা। অবাক হয়ে দেখলেন, এদের মধ্যে একটির চরিত্র খুব অদ্ভুত। সেই তারাটির নাম চঝজ ১৯১৩+১৬।

জোসলিন বেল ও অ্যান্টোনি হিউয়িশ
সাধারণ পালসার থেকে যে ঝলক আসে, তা একেবারে ঘড়ির কাঁটা মেপে নির্দিষ্ট সময় পর পর। ১৯১৩+১৬ এর ক্ষেত্রে এ ধারা ব্যতিক্রম হচ্ছে। এর পরপর দুটি ঝলকের মধ্যে গড় ব্যবধান ৫৯ মিলি সেকেন্ড। অর্থাৎ প্রতি সেকেন্ডে গড়ে ১৬.৯৪টি ঝলক আসার কথা। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ঝলকগুলো ঠিক ৫৯ মিলি সেকেন্ড অন্তর আসছে না। কখনও দেরি হচ্ছে, কখনও আসছে খুব তাড়াতাড়ি। পরপর দুটি ঝলকের মধ্যে সময়ের ব্যবধান কত হচ্ছে তার হিসেব কষতে বসলেন হাল্স্ ও টেলর। হিসাব থেকে বেরোল, এই ব্যবধান ০.০৮ মিলি সেকেন্ড পর্যন্ত কমছে-বাড়ছে। খুব সামান্য মনে হয়, কিন্তু অন্য কোনো পালসারে যে এই সামান্য ব্যাপারটাও ঘটে না!

হাস্যোজ্জ্বল হালস ও টেলর
হাল্স্-টেলর আরো সূক্ষ্মভাবে পরীক্ষা করে দেখলেন, এই ঝলকের আসার মধ্যে যে সময়ের ব্যবধান ঘটছে তা মোটেও এলোমেলো নয়। বরং একটা নির্দিষ্ট সময় পর পর সময়ের ব্যবধান ঘটছে। ঠিক এই মুহূর্তে যদি পরপর দুটো ঝলকের মধ্যে সময়ের ব্যবধান সবচেয়ে কম হয়, তাহলে আবার পৌনে আট ঘণ্টা পরে একই অবস্থা হবে।
এ থেকে হাল্স্ আর টেলর সিদ্ধান্তে এলেন, এ তারাটি মহাকাশে ঠিক একা নয়। আরেকটা সঙ্গীর সাথে সে ঘুরপাক খাচ্ছে। চলতে চলতে যখন পৃথিবীর দিকে এগিয়ে আসছে তারাটা, তখন একটি ঝলকের পরে দ্বিতীয় ঝলকটি বেরোতে বেরোতে পৃথিবীর একটু কাছে চলে আসছে। তাই পরের ঝলকটিকে পৃথিবীতে পৌঁছাতে কম কম দূরত্ব অতিক্রম করতে হচ্ছে। একারণেই আগেরটার তুলনায় পরের ঝলকটার পৃথিবীতে আসতে সময় কম লাগছে। ফলে দুটো ঝলকের মধ্যে সময় ব্যবধান ঘটছে। যখন দূরের দিকে যাচ্ছে, তখন পরপর দুটো ঝলকের মধ্যে দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছে। তাই আগেরটার তুলনায় পরেরটা পৃথিবীতে আসতে বেশি সময় নিচ্ছে।
দুটি ঝলকের মধ্যে সময়ের পার্থক্য থেকে নক্ষত্রটার গতিবেগ বের করা সম্ভব হলো। সেকেন্ডে ৪০০ কিলোমিটার। যেহেতু আট ঘণ্টা পর পর একই সময় ব্যবধানের দু’টো ঝলক দেখা যায়, তাই ধরে নেয়া যায় এই পালসার আট ঘণ্টায় তার কক্ষপথ একবার অতিক্রম করছে। সুতরাং এর গতিবেগ থেকে হিসাব করলেই বেরিয়ে আসে এর কক্ষপথের দৈর্ঘ্য। তা প্রায় ১ কোটি কিলোমিটার।
পৃথিবীর সাথে এই পালসার দুটোর চলার পথের তুলনা করা যাক। এদের চলার পথ যদি বৃত্তাকার হত, তবে দুই সঙ্গীর মধ্যে দূরত্ব হত ১৮ লক্ষ কিলোমিটার। কিন্তু এর চলার পথ বৃত্তাকার নয়। উপবৃত্তাকারও নয়। বরং বেশ লম্বাটে। সূর্যকে ঘিরে পৃথিবীর যে কক্ষপথ তার সাথে এই পালসার দুটোর চলার পথের সবচেয়ে বড় পার্থক্য। বড় আরেকটা পার্থক্য আছে। পৃথিবীর ভর সূর্যের হাজার ভাগের এক ভাগও নয়। বরং পিএসআর ১৯১৩+১৬-এর ঝলক তারাটার বৈশিষ্ট্য প্রমাণ করে, এর সঙ্গীটাও প্রায় সমান ভারী। দুটোরই ভর সূর্যের ভরের মোটামুটি দেড়গুণ। তবে সঙ্গীটিকে অমাবস্যার চাঁদই বলা যায়। ধারণা করা হলো, সেটাও একটা নিউট্রন তারা। তবে তার ঝলক নেই।

শিল্পীর কল্পনায় পিএসআর ১৯১৩+১৬
এখন কথা হচ্ছে এই দুই নক্ষত্রের কে কাকে প্রদক্ষিণ করছে?
যেহেতু দুটোরই ভর সমান, তাই কে কাকে কেন্দ্র করে ঘুরছে– এ প্রশ্ন অবান্তর। বরং বলা যায় উভয়ই উভয়কে কেন্দ্র করে ঘুরছে। সুতরাং এরা যুগ্ম তারা।
আগেই বলেছি, বুধ গ্রহের ওপর সূর্যের আকর্ষণ বল অন্য গ্রহের তুলনায় বেশি। তাই বুধ-সূর্যের মহাকর্ষ বলের পরিমাপ করতে গেলে নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র থেকে হিসাব করা যায় না। করতে হয় আইনস্টাইনের মহাকর্ষ তত্ত্ব থেকে।
সূর্য থেকে বুধের দূরত্ব ৬ কোটি কিলোমিটার। পিএসআর ১৯১৩+১৬ পালসারের যুগ্ম তারার ভেতর দূরত্ব এর অনেক কম। প্রায় ৩০ ভাগের এক ভাগ। সুতরাং কাছাকাছি থাকায় তাদের ভেতর মহাকর্ষ টানের পরিমাণও অনেক অনেক বেশি। তাছাড়া বুধের চেয়ে এই তারাগুলো অনেক অনেক ভারী। সে জন্য মহাকর্ষ টানও অনেক বেশি জোরাল হবে। সুতরাং এখানেও নিউটনের সূত্র অচল। আইনস্টাইনেই তাই ভরসা রাখতে হচ্ছে। শুধু তাই নয়, আইনস্টাইনের থিয়োরি ব্যাবহার করে এখানে মহাকর্ষ তরঙ্গের সন্ধান মিলতে পারে।
কথা হচ্ছে, মহাকর্ষ তরঙ্গের প্রভাব বোঝা যাবে কী করে?
আবার ফিরে যাই বিদ্যুচ্চুম্বকীয় তরঙ্গে। ম্যাক্সওয়েল যখন বিদ্যুৎ আর চুম্বকের সমন্বয় ঘটালেন, তখন দেখা গেল, কোনো চার্জ যদি চলতে চলতে গতি বদলায়, তা হলে তা থেকে বেরিয়ে আসে তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ। তেমনি, আইনস্টাইনের মহাকর্ষ তত্ত্বেও বলা হয়েছে, পরস্পরকে আকর্ষণ করা ভারী বস্তু দুটোর একটা যদি গতি বদলায়, তা থেকে মহাকর্ষ তরঙ্গ বেরিয়ে আসবে।

সূর্যকে কেন্দ্র করে বুধ গ্রহের উপবৃত্তাকার কক্ষপথ
গতি বদল মানে কিন্তু শুধু গতির হেরফের হওয়া নয়। গতির দিক পরিবর্তন হলেও মহাকর্ষ তরঙ্গ ছড়াবে। সূর্যের চারপাশে ঘোরার সময় পৃথিবীর গতিবেগও বদলাচ্ছে, সেখান থেকেও বেরোচ্ছে ঢেউ। কিন্তু পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্বের কারণে সেটা আমরা ধরতে পারছি না। পিএসআর ১৯১৩+১৬ পালসারের যুগ্ম তারার ক্ষেত্রে মহাকর্ষের টান অনেক শক্তিশালী বলে নির্গত মহাকর্ষ তরঙ্গও অনেক শক্তিশালী হবে। তাদের প্রভাব হবে অনেক বেশি স্পষ্ট। ঠিক এই রকম এক চিন্তা থেকেই টেলর ও হাল্স্ হাত দিলেন এক দীর্ঘস্থায়ী প্রকল্পে।
তরঙ্গ বেরিয়ে গেলে তার সাথে বেরিয়ে যায় কিছু শক্তি। শক্তি বেরিয়ে যাবার ফল কী হবে?
ধরুন, আঙুলে সুতো বেঁধে তার মাথায় একটা ছোট্ট পাথর জুড়ে সুতোটা ঘোরাচ্ছেন। এক সময় আপনি ঘোরানো বন্ধ করে দিলেন। তারপরও কয়েক পাক ঘুরবে পাথরটা। বাতাসের সংঘর্ষে ধীরে ধীরে পাথরের ঘুর্ণন-শক্তি কমতে থাকবে। সাথে সাথে নেতিয়ে পড়তে শুরু করবে পাথরটা। ক্রমেই আঙুলের কাছাকাছি চলে আসবে সেটা। যুগ্ম তারা থেকে মহাকর্ষ তরঙ্গ বের হওয়ার সময় অনেকটা সে রকম ঘটনা ঘটে। দুই সঙ্গীর দূরত্ব ক্রমশ কমবে, কাছাকাছি আসার ফলে পরস্পরকে এক চক্কর ঘুরতে সময় লাগবে আগের চেয়ে কম।

এই প্রবন্ধটি অন্বেষা থেকে প্রকাশিত “মহাকর্ষ তরঙ্গ : শতবছরে সমাধান” বইটির অংশবিশেষ
ছয় বছর ধরে, সহকর্মীকে সাথে নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করলেন টেলর। দেখলেন, সত্যিই তাই হচ্ছে। ঝলক তারাটির আবর্তনকাল ক্রমেই কমে চলেছে।
তবে এই আবর্তনকাল কমার পরিমাণ কিন্তু খুব সামান্য। বছরে ০.৭৬ মিলি সেকেন্ড। কিন্তু এটুকুরই গুরুত্ব বিশাল। কারণ আইনস্টাইনের থিয়োরি থেকে হিসেব করে ১৯১৩+১৬ পালসারে যুগ্ম তারাদের আবর্তনকাল কমার হিসাব কষে পাওয়া গেল একই সংখ্যা। অর্থাৎ প্রমাণ হলো মহাকর্ষের তরঙ্গের অস্তিত্ব।
হাল্স্ আর টেলরের প্রমাণকেই বলা হয় মহাকর্ষ তরঙ্গের পক্ষে পরোক্ষ প্রমাণ। এ প্রমাণের জন্য ১৯৯৩ সালে হাল্স্-টেলর পেলেন নোবেল পুরস্কার।
-আব্দুল গাফফার রনি
বিজ্ঞান লেখক
[লেখকের ফেসবুক প্রোফাইল]

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.