এলিয়েন হ্যান্ড সিনড্রোম: অধিভৌতিক এক মানসিক রোগ

0
551

ধরুন, আপনার ফোনে বেশ অনেক্ষণ ধরে রিং বাজছে। আপনার বাম হাত সেই ফোনটা হাতে তুলে নিয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেটা সে কিছুতেই কানে দিতে চাইছে না। আবার ডানহাতকেও সে কিছুতেই ফোনটা ধরতে দিচ্ছে না! কী করবেন আপনি?
কিংবা ধরুন, অফিসে যাওয়ার জন্য ডান হাতে যে শার্টটা আলনা থেকে বেছে নিয়েছেন, আপনার বাম হাত বারবার সেটা আলনায় রেখে দিচ্ছে! ডান হাত বাধা দিতে চাইলে এমনকি মারামারি বাঁধিয়ে দিতে চাইছে সেটার সাথে!
কিংবা ধরুন, বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছেন, এমন সময় দেখলেন আপনার বাম হাত নিজে থেকেই আপনার ঘাড় মটকে দিতে চাইছে!

কী মনে হবে আপনার? জ্বীন-ভুতের আছর হয়েছে?
আসুন, বিজ্ঞানের চোখে পুরো ব্যাপারটা একটু ঘেঁটে দেখা যাক।

এই যে অদ্ভুত কাজকর্ম, একে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় এলিয়েন হ্যান্ড সিনড্রম (Alien Hand Syndrome, সংক্ষেপে ASH)। কোন ভাবে মাথায় আঘাত পেয়ে মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল লোব, প্যারাইটাল লোব এবং অক্সিপিটাল লোব ক্ষতিগ্রস্থ হলে কিংবা ব্রেইন সার্জারি, স্ট্রোক, মস্তিষ্কে ইনফেকশন, টিউমার ইত্যাদির কারণে এমনটা হতে পারে। আবার যেসব নিউরোলজিক্যাল রোগে মস্তিষ্কের কোষ মরে যায়, যেমন এলজাইমার, এসব রোগের জন্যেও এলিয়েন হ্যান্ড সিনড্রোম দেখা দিতে পারে। তবে এই রোগ সবচেয়ে বেশী দেখা যায় কর্পাস ক্যালোসাম(Corpus Callosum) ক্ষতিগ্রস্থ হলে।
আমাদের মস্তিষ্ককে আসলে দুটো প্রধান অংশে ভাগ করা যায়। ডান পাশের অংশটাকে বলা হয় ডান সেরিব্রাল হেমিস্ফেয়ার (Right Cerebral Hemisphere) আর বাম পাশের অংশটাকে বলা হয় বাম সেরিব্রাল হেমিস্ফেয়ার (Left Cerebral Hemisphere)। এই দুটো অংশ আবার একটা সেতু দিয়ে জোড়া দেয়া থাকে, যাতে প্রয়োজনে মস্তিষ্কের একপাশের যে কোন তথ্য অন্যপাশে গিয়ে প্রয়োজনীয় কাজে অংশ নিতে পারে। এই সেতুটার নাম কর্পাস ক্যালোসাম। এটা মূলত এক বান্ডেল স্নায়ু দিয়ে তৈরি।

কর্পাস ক্যালোসাম অনেকভাবেই ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। মস্তিষ্কে মৃগী রোগের সংক্রমণ রোধ করার জন্য সার্জারি করে কর্পাস ক্যালোসাম কেটে ফেলে দিতে হতে পারে(এছাড়া মৃগী রোগের সংক্রমণ ঠেকানোর কোন উপায় বিজ্ঞানীরা আজো জানেন না)। এছাড়া যুদ্ধক্ষেত্রে আঘাত পেলে কিংবা পড়ে গিয়ে মাথার মাঝখানের অংশে আঘাত পেলে কর্পাস ক্যালোসাম ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে।

অনেক রোগী এলিয়েন হ্যান্ড সিনড্রোমের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, ‘আমার এই হাতটার আলাদা চিন্তা-ভাবনা আছে।’ কেউ আবার বলেছেন, ‘এটা আসলে ঠিক আমার নিয়ন্ত্রণে নেই। মনে হয় এটা যেন অন্য কারো হাত।’ কেউ কেউ আবার এক কাঠি আগে বেড়ে এলিয়েন হাতের আলাদা নামকরণও করে ফেলেছিলেন!

যেমন, এক রোগী তার এলিয়েন হাতের নাম দিলেন ‘ভালো হাত!’
আসলে, উনি ডান হাতে একটা সিগারেট জ্বালিয়ে মুখে দেয়ার চেষ্টা করছিলেন। যতবারই তিনি সিগারেট মুখে দিচ্ছিলেন, এলিয়েন হাত ততবারই তার মুখ থেকে সিগারেট ফেলে দিচ্ছিল। কাজেই, তার মনে হলো, হাতটা তার ভাল চায় বলেই তাকে সিগারেট খেতে দিচ্ছে না।

আরেক রোগী তার এলিয়েন হাতের নাম দিয়েছিলেন ‘বেবি জোসেফ’!
বেচারীর বাম হাত স্পর্ষকাতর সব জায়গায় একটু পরপর সুড়সুড়ি দিচ্ছিল। মানুষ সাধারণত নিজেকে সুড়সুড়ি দিলে সেটা সুড়সুড়ি মনে হয় না। কিন্তু এলিয়েন হাতের সুড়সুড়ির জ্বালায় হাসতে হাসতে বেচারীর একেবারে দম বন্ধ অবস্থা! যতই বলেন ‘তোর শয়তানি বন্ধ কর’- হাত কিছুতেই সুড়সুড়ি দেয়া বন্ধ করে না!

তবে সবসময় যে ব্যাপারটা মজার, এমন নয়। দেখা গেল বাসে ওঠার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন, এসময় আপনার সামনে দাঁড়ানো মানুষটা হঠাৎ পিছনে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি আমার পিঠে বাড়ি মারছেন কেন?’ আপনি অবাক হয়ে আবিষ্কার করলেন, নিজের হাতে আপনি লোকটার মুখের উপর থাপ্পড় মেরে বসেছেন! আর অফিসের বসের সাথে কথা বলতে গিয়ে দুর্ভাগ্যবশত এমন কিছু হলে তো হয়েছেই!

এই যে এলিয়েন হাতের এসব অদ্ভুত কাজকারবার, এর পিছনের কারণ খুঁজতে গিয়ে সাইকোলজিস্টরা তিনটা থিওরি নিয়ে কাজ করেছেন।

১. বিচ্ছিন্নতা (Disconnection)
মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ নড়াচড়ার কাজ করে। যে স্নায়ুগুলো শরীর নড়াচড়ার কাজ করে থাকে, এদেরকে বলে ‘মোটর স্নায়ু’। এসব স্নায়ুদের নিজেদের মধ্যে যদি কোন কারণে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তখন এটা হতে পারে। এসময় মস্তিষ্ক একটা অঙ্গ নাড়ানোর জন্য সচেতনভাবে পুরো একটা সিগনাল তৈরি করতে ব্যর্থ হয়।  একে বিজ্ঞানের ভাষায় বলে ‘সেন্স অফ এজেন্সি’ হারিয়ে ফেলা। এজন্য হাতের উপর মানুষের নিজের যে নিয়ন্ত্রণ, সেটা আর কাজ করে না।

২. নিজস্ব দায়বদ্ধতার চেতনা হারিয়ে ফেলা (Loss of inhibitions):
চাইলেই যে যা খুশি তাই করা যায় না, নিজের কাজকর্মের উপর নিজের যে একটা দায়বদ্ধতা আছে- মস্তিষ্ক আঘাত পাওয়ার ফলে এই বোধটুকু কোনভাবে মস্তিষ্ক থেকে হারিয়ে গেলে বা ক্ষতিগ্রস্থ হলে এমনটা হতে পারে।
সাম্প্রতিক এক রিসার্চ পেপার বলছে, মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল লোবের ক্ষতি হলে এমনটা হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়।

৩. কোন আঘাতের ফলে হেমিস্ফেয়ারগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে (Disconnection of hemispheres due to injury): কর্পাস ক্যালোসাম ক্ষতিগ্রস্থ হলে অথবা সার্জারি করে কেটে বাদ দিলে এটা হতে পারে (যেটা এরই মধ্যে উপরের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে ব্যাখ্যা করা হয়েছে)।

প্রশ্ন হলো, এই উদ্ভট রোগের প্রতিকার কী?
এলিয়েন হ্যান্ড সিনড্রোমের আসলে কোন প্রতিকার নেই। তবে কিছু পদ্ধতি অনুসরণ করে এটাকে মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।
যেমন, এলিয়েন হাতকে নির্দিষ্ট জিনিসপত্র ধরে রাখার ট্রেনিং দেয়া। হাঁটার সময় একটা কোকের ক্যান বা কফি মগ সারাক্ষণ ধরে রাখার ট্রেনিং দেয়া হলে, সেটা দরকার হোক বা না হোক, এলিয়েন হাতের উদ্ভট কাজকর্ম অনেকটাই কমে আসে।
সরল কথায়, এলিয়েন হাতকে নিয়মিত ব্যস্ত রাখা হলে এবং একটু একটু করে নির্দিষ্ট কাজকর্মে অভ্যস্ত করে তোলার চেষ্টা করে হলে অবাধ্য এলিয়েন হাত কিছুটা বাধ্য হয়ে আসতে পারে।

কাজেই, মস্তিষ্কে যে কোনভাবে ব্যাথা পেলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিৎ। নাহয়, রাত-দুপুরে ঘুম ভেঙ্গে গেলে বাম হাতে বেডসাইট টেবিল থেকে পানির গ্লাসটা তুলে নিয়ে মাথায় পানি ঢেলে দিলেই বুঝবেন, সেরেছে!

পাদটীকা-১: রোগের নাম এলিয়েন হ্যান্ড সিনড্রোম হলেও এই রোগ পাতেও হতে পারে। তবে এমনটা একেবারে দুর্লভ।
পাদটীকা-২: এই রোগ সাধারণত বাম হাতে হলেও ক্ষেত্র বিশেষে ডান হাতেও হতে পারে। বামহাতি মানুষের ক্ষেত্রে এমনটা হতে দেখা গেলেও সংখ্যাটা খুবই কম।

ট্যাগ: মানবদেহ, মনস্তত্ত্ব

তথ্যসুত্র
১. উইকিপিডিয়া
২. The Happiness Hypothesis by Jonathan Haidt

-উচ্ছ্বাস তৌসিফ
শিক্ষার্থী, কম্পিউটার সাইয়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।
[ফেইসবুক প্রোফাইল]

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.